আমরা গত এক বছরে জেনেছি যে কোভিড শুধু থুতু শ্লেষ্মা কফ ইত্যাদির বড় বড় কণা থেকেই ছড়ায় না, সে অতি সূক্ষ্ম কণাবাহিত হয়েও বাতাসে, বিশেষ করে বদ্ধ ঘরে, প্রায় কিছু না হলেও ঘন্টাতিনেক কাটিয়ে দেয়। ওই সময়ের মধ্যে সে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, এবং সেই ব্যক্তি যদি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বা পুরনো ইনফেকশনের প্রভাবে ইমিউন থাকেন তাহলে এক কথা, না হলে মানুষটি কোভিড পজিটিভ হবেন। অতএব বদ্ধ ঘর, ভিড় ঠাসা ঘর, যেখানে ঠিকমতন ভেন্টিলেশনের অভাব, জানলা দরজা বন্ধ, সেই রকম একটি জায়গায় কোভিড আক্রান্ত কোন মানুষ মাস্ক না পরে যদি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলেন, ঝেড়ে কাশেন, হাঁচেন, তাহলে তাঁর চারপাশের অনেকেই আক্রান্ত হবেন, ও শুধু তাঁরাই নন, কোভিড যেহেতু ঘরে দীর্ঘক্ষণ ক্ষুদ্র কণাবাহিত হয়ে অবস্থান করতে পারে, সেই জন্য অন্যেরাও, যাঁরা তার সমীপবর্তী নন, ঘরের অন্য কোণায় রয়েছেন, তাঁরাও আক্রান্ত হবেন, এমনকি যাঁরা ওই ঘরে পরে প্রবেশ করবেন, তাঁদের মধ্যেও অসুখ ছড়াতে পারে। তার মানে, একজনের সূত্রে অনেকে আক্রান্ত হলেন। যাঁরা আক্রান্ত হলেন, তাঁরা নিজেরা হয়ত বড়জোর আরো একজন কি দুজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম হলেন, কিন্তু যেহেতু এই একজন বা এনার মত আরো অনেকে হয়ত রয়েছেন, দেখা যাবে কোভিডের সংক্রমণ জনসমাজে বেড়েই চলেছে। বছর খানেক আগেও এই ব্যাপারটিকে ব্যতিক্রম মনে করা হত, যার জন্য কোভিডের নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরণের মডেল বৈজ্ঞানিকরা ব্যবহার করে দিক নির্দেশ করতেন, সেই মডেল কিছুটা সরলতর ছিল। আমরা এই সুযোগে একটু দেখে নিই ওভারডিসপারশন আর হাইপারস্প্রেডার বলতে কি বোঝাতে চাইছি, আর কেনই বা বদ্ধ ঘর, বহু লোক সমাবেশ জমায়েত, বার, রেসটুরেনট, ক্লাসরুক, বড়/ছোট বাস, এরোপ্লেন এতে করে সমস্যা হতে পারে, ও কি করলে ব্যক্তিগত ভাবে এবং সরকারের তরফে এর সুরাহা সম্ভব।
কোভিড ছড়ানোর গল্প
কোভিড যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ করে দেখবেন, খুব অল্প সংখ্যক মানুষ একযোগে একেবারে অনেককে রোগ ছড়ান, ধরুন প্রায় ২০% মানুষ ৮০% অসুখ ছড়ানোয় সক্ষম। এর মানে, একযোগে সবাই আক্রান্ত হন না,আবার এরকমও নয় যে একজন লোক কেবল আরো একজনকেই সংক্রমিত করতে পারেন | কোভিড ছড়ানোর এই প্যাটার্ণটিকে আমরা ইংরেজীতে বলব overdispersion, এর উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই, বাংলায় বললে বলা যেতে পারে অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া। একটা সহজ গল্পের মাধ্যমে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।
মনে করুন 'ক' বাবু একজন ভারি চেহারার লোক, বাজখাঁই কণ্ঠের অধিকারী, পাড়ায় একা থাকেন | তাঁর প্রিসিমপটোম্যাটিক কোভিড, তিনি এই অবস্থায় পাড়ার ক্লাবে সন্ধ্যাবেলা আড্ডা মারতে এলেন। তখন সন্ধ্যা সাতটা, ক্লাবে তাঁর আরো পাঁচজন বন্ধু ছিলেন (ধরুণ তাঁদের নাম অ, আ, ই, ঈ, উ) | ক্লাবঘরের দরজা বন্ধ, জানলাও খোলা রাখা নেই, শীতের সন্ধ্যা | তবে ঘরটা বেশ বড়, প্রায় কিছু না হলে বিশফুট মতন। ক বাবু বেশ খানিকক্ষণ কাটিয়ে গেলেন, হা হা করে উচ্চস্বরে হাসলেন, কথা বললেন, দু একবার ঝেড়ে কাশলেনও | ক-বাবু বিশেষ মাস্ক পরেন না, কারণ তাঁর ধারণা আজকাল যেহেতু কোভিডের সংক্রমণ কমে আসছে (এ ধরুণ ২০২১ এর জানুয়ারী মাসের কথা বলছি) | ক্লাবের আড্ডা ধরুণ ঘন্টাখানেক পর ভেঙে গেল (একটু সরল করার জন্য লিখছি), বাকিরা যার যার বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু এর মধ্যে হল কি, ক বাবুর বন্ধু বান্ধবদের প্রত্যেকে ক বাবুর সূত্রে আক্রান্ত হয়ে গেলেন।
এর দু-দিন পর, ক বাবুর জ্বর এল, তিনি কোভিডের পরীক্ষা করিয়ে দেখলেন, যে তাঁর কোভিড পজিটিভ বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর যে সমস্ত বন্ধুবান্ধব ("অ" থেকে "উ"), তাঁরাও তাঁদের নিজ নিজ বাড়িতে একজন করে অজান্তে ইনফেকট করে ফেলেছেন। ক-বাবুর কোভিড পজিটিভ বেরোনর পরে তাঁরা নিজেরাও পরীক্ষা করিয়ে দেখলেন, তাঁদেরও কোভিড পজিটিভ, এবং তাঁদের বাড়ির একজন করে সব পজিটিভ বেরোল। তার মানে ক-বাবু ৫ জনকে কোভিড দিলেন, পাঁচজনের একেক জন একজন করে আক্রান্ত করলেন, সব মিলিয়ে ১১ জন কোভিড আক্রান্ত হলেন, কিন্তু এঁদের মধ্যে ক বাবু একাই ৫ জনের আক্রমণের জন্য দায়ী (চিত্র ১ দেখুন):
চিত্র ১: ইনফেকশনের প্যাটার্ণ, ১, ২, ৩, ইত্যাদি = ক বাবু, অ বাবু , থেকে উ বাবু; কত শতাংশ আক্রান্ত অন্য একসিসে দেখা যাচ্ছে
এই ছবিটি একটি মাত্র ছ'জনের একটা ছোট গ্রুপের, এ থেকে কয়েকটি ব্যাপার দেখুন:
১) ক-বাবুর সূত্রে ৫০% ইনফেকশনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে
২) অথচ, মাথা গুনলে দেখবেন ৬ জন মানুষের সূত্রে ১১ জন আক্রান্ত, কাজেই, সাবেক সংক্রমণের পরিমাপ (R0) মাপ করলে মনে হবে গড়ে ১ জন মানুষ দু-জনকে আক্রান্ত করেছেন, কাজেই R0 = 2
৩) ক বাবু থেকে উ বাবুদের পরিবার মিলিয়ে একটি বৃত্ত তৈরী হয়েছে , মারী বিজ্ঞানের পরিভাষায় ক্লাসটার | প্রথম দিকে বৃত্তটিতে শুধু ক বাবু এবং অ থেকে উ বাবু পর্যন্ত ছ জন ছিলেন, পরে সেখানে আরো পাঁচ জন যুক্ত হলেন। একই সময়, বৃত্তটি বাড়বার কালে সংক্রমণও ছড়িয়ে পড়ল।
৪) আরো একটি ব্যাপার, এটিকে যদি নেটওয়ারক রূপে দেখেন, দেখবেন
চিত্র ২: নেটওয়ার্ক চিত্র, দেখুন নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে ক বাবু, এখানে "X" বলে চিহ্নিত করা হয়েছে
ধরুণ আমরা যদি ক বাবুদের কোভিড নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে ক-বাবুর সঙ্গে তাঁর আড্ডার বন্ধুদের প্রথম যোগাযোগটিকে সুপারস্প্রেডার ঘটনা রূপে বিবেচনা করা চাই। অর্থাৎ, মাথা গুনে ক'জন আক্রান্ত, তার হিসেব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দ্রুত সম্প্রসারণ রোধ করতে গেলে যেটি আশু কর্তব্য, সেটি এই ধরণের সুপারস্প্রেডার ঘটনাগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের যতটা সম্ভব রোধ করার বন্দোবস্ত করা চাই | মেলা, সমাবেশ, বিশেষ করে যেখানে একত্রে বহু মানুষ জমায়েত হবেন, এবং তারপর তাঁরা দূরান্তে ছড়িয়ে পড়বেন, সেখানে সুপারস্প্রেডিং ঘটনা (নাকি অঘটন), তার হদিশ পাওয়া দুরূহ শুধু নয়, অমন ঘটনার আয়োজন করার অর্থ কোভিডকে ডেকে আনা!
মেলা, সমাবেশ ইত্যাদি কেন সাংঘাতিক?
এই ধরণের যে কোভিডের ছড়িয়ে পড়া, সেখানে কোভিড নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শুধুই হাত ভ্যাকসিন, মাস্ক ব্যবহার, ওষুধ, পারস্পরিক দূরত্ব, ইত্যাদির সঙ্গে ভিড় এড়ানোর এবং চাপা ছোট জায়গায় সমাবেশ না করা, বা আদৌ মেলা সমাবেশ এড়ানোর একটি ভূমিকা রয়েছে, এবার সেই আলোচনায় আসা যাক।
খুব ভালো অনালজি, ধন্যবাদ।
"ওই সময়ের মধ্যে সে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, এবং সেই ব্যক্তি যদি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বা পুরনো ইনফেকশনের প্রভাবে ইমিউন থাকেন তাহলে এক কথা, না হলে মানুষটি কোভিড পজিটিভ হবেন"
"কিন্তু এর মধ্যে হল কি, ক বাবুর বন্ধু বান্ধবদের প্রত্যেকে ক বাবুর সূত্রে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। "
শরীরে অ্যান্টিবডি না থাকলে কোভিড ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে প্রত্যেকেই সংক্রমিত হবেন, এই ধারণাটা কি বাস্তব? এক একজনের সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা একেক রকম না? আমি আর শোভন দুজন একই মেসে খাওয়া দাওয়া করলাম, এমন কী চা-ও এক দোকান থেকে খেলাম, শোভনের কলেরা হল আমার কিচ্ছু হল না, এরকম তো আমরা দেখেই থাকি।
@Somnath Roy, আপনি ঠিক | সংক্রমণের ব্যাপারটি সত্যি অত সরল নয়। তবে এটা সহজ করে লেখার জন্য লিখেছিলাম। ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন প্লিজ।
আমার ভিন্নতর প্রশ্ন পাচ্ছে, সুপার স্প্রেডারের মতন সুপার রেসিস্ট্যান্ট একটা গোষ্ঠী থাকতে পারে তাহলে। সেই গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পারলে একটা সুরাহা মেলে।
সুপার রেসিসটান্ট বলতে ঠিক কাদের কথা বলছেন? অল্প বয়েসিদের?
সেটা জানিনা, দশজনের মধ্যে একজন যেমন (ক বাবু, ভারি চেহারা বাজখাঁই গলা) সুপারস্প্রেডার, তেমনি একজন সুপার রেজিস্ট্যান্টও থাকা উচিৎ। ক-বাবুর সামনে ছেরে দিলেও যার করোনা হবে না। তার বৈশিষ্ট্য কী হবে, সেগুলো জেনে নিলে তাকে চিহ্নিত করার সুবিধা।
সেটা জানিনা, দশজনের মধ্যে একজন যেমন (ক বাবু, ভারি চেহারা বাজখাঁই গলা) সুপারস্প্রেডার, তেমনি একজন সুপার রেজিস্ট্যান্টও থাকা উচিৎ। ক-বাবুর সামনে ছেরে দিলেও যার করোনা হবে না। তার বৈশিষ্ট্য কী হবে, সেগুলো জেনে নিলে তাকে চিহ্নিত করার সুবিধা।
সুপার রেজিস্ট্যান্ট তো জানাই আছে। কুম্ভস্নানের সাধু, বিজেপি সমাবেশের ভক্ত, সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইয়ে...এমনকি করোনাগ্রস্ত গোমাতার কথাও কি জানা গেছে এখনও?
এই সিরিজটা খুবই ভালো লাগছে। সহজ করে বুঝিয়ে লেখার জন্য অরিনকে অনেক ধন্যবাদ। চলতে থাকুক। মন দিয়ে পড়ছি।