সম্প্রতি ট্রিস গ্রীনহল ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি অপেক্ষাকৃত সহজপাঠ্য ও নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে অপর এক বৈজ্ঞানিকের (কার্ল হেনেগান) লেখা একটি রিভিউ এর সমালোচনা করতে গিয়ে ১০ টি প্রামাণ্য নিদর্শণ দিয়েছেন যে কারণে মনে করা যেতে পারে যে কোভিডের জীবাণু অতি ক্ষুদ্র কণায় ভাসমান থাকে, ও বায়ুবাহিত হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। আমরা এই লেখাটিতে একটু দেখে নিই কি কি বৈজ্ঞানিক কারণ তিনি দেখিয়েছেন, এবং এতে করে আমাদের নিজেদের কি করণীয়।
ব্যাপারটি সবিশেষ প্রণিধাণযোগ্য দুটি কারণে: এক, প্রথম থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ("বিস্বাস") এবং অন্যান্য বহু স্বাস্থ্য আমাদের সাধারণ মানুষকে বলে এসেছেন কোভিড মূলত বড় ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়, এবং তাই হাঁচি কাশি ইত্যাদির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ছ ফুট (দুই মিটা দূরত্ব ) অবলম্বন করাই বিধেয়। তার থেকে দূরে কি সে ছড়ায় না? এ নিয়ে তাঁরা মোটামুটি নীরব থেকেছেন। এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, এই যে কোভিড বায়ুবাহিত বলে স্থির হল,এতে করে মাসক পরিধান, মেলা সমাবেশ, বাস-ট্রাম-ট্রেনে করে যাতায়াত, মায় হাসপাতাল কি হোটেলের ঘর, ইত্যাদিতে যে কোভিড ছড়াবে এইটা জানার পর মানুষের কি করণীয় তাই নিয়ে সাবধান হবার ব্যাপার আছে। ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়, অনেকেই অনেক দিন ধরে বলে আসছেন, তবুও ব্যাপারটি জনসমাজে প্রচলিত হওয়াতে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করতে হয়।
এরোসল, ড্রপলেট কি এই নিয়ে খুব ছোট করে লিখে নেওয়া যাক | ধরুণ কেউ কাশলেন, জোরে চেঁচিয়ে কথা বললেন, থুতু ছেটালেন, এই জাতীয় কাজকর্মের ফলে শ্বাসনালী থেকে হাওযায় ভাসমাণ জলকণা ছড়িয়ে পড়ল। এ সবই এরোসল (কারণ তারা হাওয়ায় যে সামান্য জলকণা থাকে সেখানে দ্রবীভূত অবস্থায় রয়েছে),এবার এদের সাইজ অনুযায়ী কেউ ড্রপলেট,কেউ ছোট পারটিকুলেট। এই সাইজের ব্যাপারটি, আমি যতদূর পড়েছি, ভারি গোলমেলে - কেউ বলেন ২ মাইক্রোমিটার,কেউ পাঁচ, কেউ ১০০ | ধরা যাক ৫ মাইক্রোমিটার সাইজের বা তার থেকে বড় সাইজের কণাকে আমরা ড্রপলেট বলে ধরা যাক (এইটা বিস্বাসের অনুমান, দেখুন: https://www.who.int/news-room/commentaries/detail/modes-of-transmission-of-virus-causing-covid-19-implications-for-ipc-precaution-recommendations)। এতে করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে মনে করা হচ্ছিল যে এ ভাইরাস কেবলই যারা আক্রান্ত মানুষের কাছাকাছি থাকেন তাঁদেরই ছড়ায় যেহেতু এর সংক্রমণ ক্ষমতা হাম বা অন্যান্য সমগোত্রীয় জীবাণুর তুলনায় কম তাই, মোটামুটি মুখ থেকে ফুট ছয়েক দূর যাবার পর এই ড্রপলেট মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে মাটিতে পড়ে যায়। কাজেই ফুট ছয়েক দূরত্বের কথা বলা হয়েছে। ড্রপলেট নিয়ে পরে বিশদে আরো লেখা যাবে, আপাতত এই লেখাটির অবতারণায় আরো একটি কথা বলে নিই। ড্রপলেট কিন্তু স্থায়ী নয়, সে বাড়ে কমে, বিশেষ করে গরমকালে জলীয় কণা যেহেতু দ্রুত উবে যায়, তার আকারও কমে যায, তখন সে শুধুই পারটিকুলেট এবং হাওয়ায় ভাসতে থাকে। সেখানেও ভাইরাস থাকে, এবং ঘন্টা তিনেক ভাইরাস সেই বায়ুবাহিত অবস্থায় ভেসে থাকে। কাজেই শুধু বড় কণিকা বা ড্রপলেট নয়, খুব ছোট কণিকা দিয়েও করোনা সংক্রমণ সম্ভব। এবং এই নিয়ে বহুদিন ধরে বৈজ্ঞানিকরা সাবধান করে আসছিলেন।
কি বলেছেন ট্রিশ রা? এনাদের বক্তব্য যে এমন যদি মনে করা হয় যে বড় ভাসমাণ কণার মাধ্যমেই মূলত যদি করোণা ছড়ায় তাহলে এই যে সাবধানতা যেমন ঘর বাড়ি পরিষ্কার রাখা, সরাসরি সংযোগ এড়ানো সামাজিক দূরত্ব, হাঁচি কাশি সম্বন্ধে সাবধানতা, মুখে মাস্ক পরা, এই ব্যাপারগুলো ঘরের ভেতরে বাইরে একই রকম থাকবে, এবং এইটুকু হলেই চলবে। কিন্তু ধরুণ যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় করোনাভাইরাস রয়েছে তাতে ইনফেকশন হবে, তখন কিন্তু আরো অনেক কিছু ভাবতে হবে | তার মধ্যে ঘরের ভেন্টিলেশন, হাওয়ার ফিলটার, কতটা সময় ঘরের ভেতরে কাটাচ্ছেন, মেলা বা জনসমাগম, তারপর ধরুন যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের অন্যরকমের সুরক্ষা, এই ব্যাপারগুলো আসবে কিন্তু | আমরা যতদূর দেখেছি, বা করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে প্যাটারণগুলো দেখা গেছে তা থেকে একটা ব্যাপার এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে এ ভাইরাস শুধুই বা "মূলত" বড় কণা থেকে ছড়ায় না, বাতাসে ভাসমান ছোট কণা থেকেও কিন্তু ছড়ায় |
তার প্রথম প্রমাণ, বার বার দেখা যাচ্ছে মেলা, জনসমাগম, ইলেকশনের লোক সমাগম, এইসব জায়গা বা ঘটনা থেকে করোনা ছড়ায় - এগুলো কিন্তু সুপারস্প্রেড ঘটনা। শুধু বড় কণিকা বাহিত হলে এমনটা হত না। দু নম্বর, বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেমন নিউজিল্যাণ্ডে কোযারানটািইন হোটেলে দেখা গেছে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। নিউ জিল্যাণ্ডে যেমন জনসমাজে সেভাবে কোভিড নেই বলা চলে, কিন্তু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে কোভিডের সংক্রমণ হয়েছে (ধরুণ আপনি ক নম্বর ঘরে আছেন, আপনার পাশের ঘর "খ" ঘর,"ক" ঘরে কোভিডের সংক্রমণ হয়েছে, কয়েক দিন পরে আপনার ঘরেও আপনার সংক্রমণ হল, যদি আপনার সঙ্গে "ক" নম্বর ঘরের বাসিন্দার কোন যোগাযোগ হয়নি |
তিন, দেখবেন প্রায় ৬০% সংক্রমণ এমন কিছু মানুষের সূত্রে হচ্ছে, যাঁদের কিন্তু প্রিসিমপটোমাটিক বা এসিমপটোমাটিক বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এঁরা যে কাশছেন হাঁচচেন তা কিন্তু নয়, সাধারন ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছেন, অর্থাৎ এঁদের সুত্রে বড় মাপের কণিকা বেরোনর কথা নয়। কথা বললেও কণিকা বেরোবে অবশ্যই, তবে মনে রাখতে হবে সে কণিকার মাপ বিশেষ বড় সাইজের হবার কথা নয়। অথচ বাস্তবিক পক্ষে দেখলে দেখা যাবে, এই মানুষদের সূত্রে সবচেয়ে বেশী অসুখ ছড়াচ্ছে।
চার, দেখুন ঘরের ভেতরে সবচেয়ে বেশী অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা। তার থেকেও বড় কথা, ঘরের ভেনটিলেশন যদি ভাল হয়, তাহলে কিন্তু অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায়। কাজেই, ঘরের ভেনটিলেশনের একটা ভূমিকা আছে,সেক্ষেত্রে শুধুই বড় ড্রপলেট মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই |
পাঁচ, যে সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী এমন মাসক বা পিপিই ব্যবহার করেন যাতে শুধু বড় ড্রপলেট আটকানো যাবে, কিন্তু ছোট এরোসল আটকানো যাবে না, তাঁদের মধ্যে সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশী | এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এমনিতেই সংক্রমণের হার অনেকটা বেশী হবার কথা, (এ নিয়ে সেথ জাডসনের একটি লেখা আছে,উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6832307/) ,তাহলেও এই তারতম্যের একটা বড় কারণ ছোট ছোট বায়ুবাহিত ভাসমাণ ভাইরাসকণা।
ছয়, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মোটামুটি ঘন্টাখানেক ও প্রায় তিন ঘন্টা পর্যন্ত বাতাসে করোনাভাইরাসকে মাপযোক করে পাওয়া যেতে পারে। সব সময় সবাই সব স্টাডিতে যে পেয়েছেন তা নয়,তবে ভাইরাস ওভাবে ধরাও সব সময় সম্ভব হয় না। তাহলেও, ব্যাপারটি উপেক্ষার নয়।
সাত, হাসপাতালের বায়ু সঞ্চালন টিউবে, এয়ার ফিলটারে কিন্তু করোনার উপস্থিতি দেখা গেছে।
আট, বিশেষ করে দেখা গেছে যে উপরে নীচে খাঁচা রাখা আছে তাতে প্রাণী রাখা, এবং নীচের খাঁচায় পরীক্ষামূলক ভাবে একটি প্রাণীকে সংক্রমিত করা হল, দেখা যাবে কিছুকাল পরে ওপরের খাঁচায় অবস্থিত প্রাণীটিরও কিন্তু সংক্রমণ হচ্ছে। কাজেই, বড় ড্রপলেট,সে শুধুই নীচের দিকে ভরবাহিত হয়ে পড়ে গেলে এমনটি হত না। নিশ্চয়, বাতাসে ভাসমান অবস্থায় সে প্রাণিটিকে সংক্রমণ করেছে।
এই রকম আরো দু-একটি প্রামাণ্য বিষযের উপস্থিতি থেকে মনে করা হচ্ছে যে বড় ড্রপলেট তো বটেই, করোনাভাইরাস সতত বাতাসে ভাসমান। অতএব কয়েকটি বিষয় বিশেষ করে মনে রাখতে হবে:
(১) মেলা,জনসমাগম, যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভাল (কেন, এ নিয়ে পররর্তী লেখাটিতে বিশদে লিখব)
(২) অন্তত দু লেয়ারের মাসক পরুন, যাতে যতটা সম্ভব নিজের তরফ থেকে কম সংক্রমণ করতে পারেন
(৩) পারলে ঘরের জানলা খুলে রাখুন, বা একান্ত ভাবে সম্ভব না হলে এয়ার কনডিশনারের ডাকট যেন যথাসম্ভব পরিষ্কার থাকে
জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও জনসমাগম যথাসম্ভব কম করার কথা বা তাই নিয়ে প্রচার করার আশু প্রয়োজন |
এসেছেন অরিন। সুস্বাগতম।
এই সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় লেখা। পরের কিস্তির অপেক্ষায়।
দরকারি লেখা অরিনয়া, তাড়াতাড়ি পরের কিস্তির অপেক্ষায়।
"অন্তত দু লেয়ারের মাসক পরুন"
দু লেয়ার মানে কী? দুটো আলাদা মাস্ক? N95 পরলেও দুটো মাস্ক পরতে হবে?
এইটা থাকল।
আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিল। এ যে বায়বাহিত হতে পারে তা গত জুলাইয়েই কিছু গবেষণা বলেছিল। এখানে বিস্তারিত আছে। তো, এতদিন সেই নিয়ে কিছু টনক নড়েনি কেন? আর এই স্টাডিগুলো কি রেফারড এই নতুন পেপারে, আমি খুঁটিয়ে দেখিনি।
অরিন লিখেছেন বলে খুব খুশি হলাম। আর এঈ লেখা টা তো আশা করছিলাম ই।
অরিন দা, থ্যাঙ্ক ইউ।
যা বুঝলুম, সংক্রমণ কিছুতেই আটকানো যাবেনা। নিজস্ব O2 Apparatus বা air scrubbing system ছাড়া। ইমিউনিটি বাড়ানোর দিকে মন দেয়াই ভাল।
অরিনকে ধন্যবাদ সহজ ভাষায় বিষয়টা উপস্থাপনার জন্য। অভ্যুর মতো আমারও জিজ্ঞাসা যে দুই লেয়ারের মাস্ক বলতে কী বোঝায়। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
সহজবোধ্য, সুন্দর লেখা। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে। গতবছর আগস্ট মাসে গুরুচণ্ডালীর পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল "বাতাসে করোনা - The answer my friend is blowing in the wind"।
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17871&srchtxt=জয়ন্ত%20ভট্টাচার্য
এ দুটি লেখা হয়তো পরিপূরক।
অনেকদিন পর। খবর সব ভালো তো ।
উল্লিখিত দশটি প্রামাণ্য নিদর্শনের বাকি দুটি জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছে। গবেষণাপত্রে গেলে এতো সহজে তো বোঝা যাবে না।
অরিনের লেখা বেশ কিছুদিন পর পাওয়া গেছে। সহজবোধ্য লেখা! অনেক ধন্যবাদ!!
Amar ekta kotha mone holo, ei virus protiniyoto natun mutant hobe , r ekta time ontor ei natun kore wave ashbe abar setar sathe manush immune kore gele abar kichudin kombe abar natun mutant er opekha , eivabei cholbe
Ei vabna ta koto ta thik?