১
আজকেও শুতে দেরি হল।
বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সাতটা-আটটা নাগাদ বেশ জোর হয়েছিল। এখন কিছুটা কম - ঝিরঝিরে। রাস্তায় স্ট্রিটলাইট আর গাড়ির হেডলাইট-টেইলল্যাম্পের আলোর ছায়া পড়ছে। আলোর অবশ্য ছায়া পড়ে না, ওটা প্রতিফলন হবে।
অন্ধকার হওয়ার আগে একবার দেখেছিলাম, গির্জাটা বৃষ্টির জলে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটু কি বেশি কালো লাগছে?
গির্জাটার পেছনে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে আলেকজান্ডারপ্লাত্জ-এর টিভি টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছিল। টাওয়ারটা অদ্ভুত - মোটা থেকে সরু হয়ে উঠেছে, গলার কাছটায় একটা গোল বলের মতন। খ্যাংড়া কাঠির মাথায় আলুর দম।
মায়ের কাছে শুনেছি - মায়ের স্কুললাইফে, ছুটির পর স্কুলের গেটের বাইরে খ্যাংড়া কাঠির মাথায় আলুর দম পাওয়া যেত। আমি ও জিনিস কখনো দেখিনি।
আমার অবশ্য ঠিকঠাক উপমা দেওয়ার দায় নেই। লেখকরা যা ইচ্ছে লিখতে পারে।
এ বাড়ির ব্যালকনিটা যেন রাস্তার ওপর ঝুলে আছে। লোহার ব্যালকনি, হাঁটলে কেঁপে-কেঁপে ওঠে। খুব জোরে হাওয়া দিচ্ছে, নিঃশব্দে। ফুটপাথের গাছগুলো হেডব্যাং করছিল। ওগুলো বোধহয় কদম গাছ। অন্ধকারে ফুলগুলো দেখে তাই মনে হচ্ছে। এখানে কি কদম গাছ হয়?
মুখ খুলতেই সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। কড়া সিগারেট, পুরোটা খেতে চাপ হয়।
ভাবলাম, একবার শ্রেয়াকে একটা টেক্সট করেই দেখি। যদি না ঘুমিয়ে থাকে, ভাল হবে।
তারপর ভাবলাম, থাক।
মাঝখানে, বেশ কিছুদিন, বেশ কথা হচ্ছিল। ও কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে, পিএইচডি করছে। অনলাইন আলাপ, নিজেই নম্বর দিয়েছিল। ধানবাদে বাড়ি। ভাল ছবি আঁকে - আমাকে কয়েকটা পাঠিয়েও ছিল।
একদিন বলল - বরফ পড়া বন্ধ হলে, ঠান্ডাটা কমলে, একদিন পিকক্ আইল্যান্ডে হাঁটতে যেতে।
- ওখানে কি ময়ূর আছে?
ও জানেনা। ময়ূর দেখতে পায়নি।
আমি আগেও অনেক ময়ূর দেখেছি। হায়দ্রাবাদের ল্যাবের চারপাশের জঙ্গলে একগাদা ময়ূর ছিল। আমার মোটেই এদ্দুর এসে আলাদা করে ময়ূর দেখতে যাওয়ার শখ হয়নি।
আমার ইচ্ছে ছিল ওকে জিজ্ঞেস করার - ও কি আমার সঙ্গে পিকক্ আইল্যান্ডে হাঁটতে যাবে?
সেকথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তারপর আর কথাও হয়নি সেভাবে।
গতকাল দেখি, প্রোফাইলে ও একটা নতুন ছবি দিয়েছে। আগেরটায় গলায় আকাশি নীল স্কার্ফ ছিল। এটায় মেরুন। আগেরটায় চুল বাঁধা ছিল, এটায় খোলা।
একটা এম-ফর্টি ওয়ান, রাস্তায় আলোর ছায়া ফেলে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ওটাকে দেখা গেল, আমি ততক্ষণ ওটার টেইলল্যাম্পের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
২
বেরোতে বেরোতে বেলা হল বেশ। দেরি করে শুলে উঠতে দেরি হয়। দেরি করে উঠলে বেরোতে দেরি হবেই। বিরক্ত লাগছিল।
টেবিলের ওপর রাখা হলুদ ফুলগুলো একেবারে শুকিয়ে গেছে। সপ্তাহখানেক আগে আনা, মাঝে একদিনই জল দিয়েছি। ইচ্ছে ছিল গুগল্ করে নামটা দেখব, আর হয়নি।
গির্জাটার কোনাকুনি একটা বিশাল গ্রেভইয়ার্ড। আঠেরোশো সালের কিছু কবর আছে বলে শুনেছি। মানুষের শরীর অবশ্য বছর তিরিশের মধ্যে পুরোপুরি মাটিতে মিশে যায়।
গেটের পাশে একটা ফুলের দোকান। সেদিন ওদিকে গেছিলাম একটা প্রিন্ট-আউট নিতে। অনেকরকম ফুল সাজানো ছিল দোকানের বাইরে, ছোট কাঠের গ্যালারিতে।
হলুদগুলো নিলাম। বয়স্ক দোকানি চুরুট ঠোঁটে চেপে রেখে কাঁপা-কাঁপা হাতে দাম নিলেন। এক ইউরো, কিছু সেন্ট। শীতে ফাটা হাতের অনামিকায় একটা খুব পুরোনো তামার আংটি - সবুজ রং লেগেছে।
আজ দু'টো জায়গায় যেতে হবে। প্রথমে যাব কার্ল-মার্ক্স স্ট্রাসে। কয়েকটা তোয়ালে আর তিনটে পাপোষ কিনতে হবে। তারপর একটা ইন্ডিয়ান দোকানে যাওয়ার কথা। কিছু মশলা, সবজি কিনব ভাবছি।
এম-ফর্টি ওয়ানের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। ফুটপাথে দু'জন কনস্ট্রাকশনের কাজ করছেন। পথের কবলস্টোনগুলো তুলে পাশে রাখা। একপাশে বিয়ারের বোতল আর একটা ব্লু-টুথ স্পিকার। রেড হট চিলি পেপারস্ চলছে -
সামটাইমস্ আই ফিল লাইক আই ডোন্ট হ্যাভ আ পার্টনার
সামটাইমস্ আই ফিল লাইক মাই অনলি ফ্রেন্ড
ইজ দ্য সিটি আই লিভ ইন, দ্য সিটি অফ এঞ্জেলস্...
কার্ল-মার্ক্স স্ট্রাসের মেট্রো স্টেশনের বাইরে একটা দোকান, নাম - কার্ল-মার্ক্স শপ্। অদ্ভুত!
খানিকদূরে একটা কাবাবের দোকান। এরা বলে - কেবাপ্। তুর্কিদের দোকান নিশ্চয়ই। এই এলাকাটা বার্লিনের অন্যতম বড় তুর্কি-পাড়া।
রাস্তাটায় হালকা চড়াই মতন, মনে হয় যেন পাহাড়ে উঠছি। একটা পুরোনো বাড়ির বড় কাঠের দরজার সামনের ফুটপাথে পাশাপাশি তিনটে ছোট-ছোট পেতলের কবলস্টোন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এক যুবক আর একজন বোরখা-পড়া মধ্যবয়সী মহিলা সিগারেট খাচ্ছেন।
আমি আগে কখনো কোনো বোরখা-পড়া মহিলাকে সিগারেট খেতে দেখিনি। চোখাচুখি হতেই আমার অবাক চাহনি দেখে মহিলা একটু অস্বস্তি বোধ করে চোখ সরিয়ে নিলেন।
এখানে কাজ হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি-ই। এবার ইন্ডিয়ান দোকানটা হয়ে বাড়ি। গত সন্ধ্যের বৃষ্টিটা এখনো শহরটাকে ভুলতে পারেনি। ঝিরঝির করে আবার নেমেছে।
ফ্ল্যাটের কাছে হলেও, এই দোকানটায় আমি আগে কখনো আসিনি। দোকানের নাম - এশিয়া সুপার শপ্।
দোকানের ভেতর ঢুকতেই মনে হল যেন দেশে ফিরে এসেছি।
সর্ষের তেল, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, হাজার রকমের মশলা আর অম্রুতাঞ্জনের গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা নাকে আসছিল, সেটা হল দোকানির পেছনে রাখা ঠাকুরঘরের সস্তা ধুপকাঠির কড়া গন্ধ। দোকানিটি যে দক্ষিণ ভারতীয়, তা দেখেই বুঝেছি। শ্যামলা গায়ের রং, কপালে টিকা। আমায় ঢুকতে দেখে খুব মিষ্টি করে হাসলেন।
আমি ফ্রিজে রাখা একটা বড় সাইজের লাউ শুঁকে দেখছিলাম যে সেটাতেও ওই ধুপকাঠির গন্ধ আছে কিনা। পেছন থেকে এসে ভদ্রলোক নিজেই আলাপ করলেন।
আশ্চর্য! ভদ্রলোক শ্রীলঙ্কান! তামিলভাষী। চুরাশি থেকে এখানেই আছেন। ফ্লুয়েন্টলি জার্মান বলেন।
এই প্রথম কোনো শ্রীলঙ্কার লোকের সঙ্গে আলাপ হল। সত্যি বলতে, শ্রীলঙ্কা দেশটাকে নিয়ে কখনো সিরিয়াসলি ভেবেই দেখিনি। বেশ ভাল লাগছিল।
- আপনি হিন্দু?
একটু অবাক হলাম। মাথা নেড়ে বললাম - হ্যাঁ।
ভদ্রলোক কাউন্টারের ড্রয়ার থেকে দু'টো লিফলেট বের করে আমার হাতে দিলেন। দেখলাম, দু'টো মন্দিরের লিফলেট - একটা গনেশ, আরেকটা ময়ূরাপথি মুরুগান। তবে গনেশটা এখন বন্ধ রয়েছে, করোনার জন্যে।
একটা কাগজের বাক্সে একটু প্রসাদও দিলেন। বললেন - বাই, আবার আসবেন।
বৃষ্টিটা বাড়ছে। দু'শো আটচল্লিশে ভিড় আছে। সকলের জ্যাকেট থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ে বাসের মেঝেতে একটু কাদা হয়েছে।
হ্যালেসেস্ টরের কাছে অনেকে নেমে গেলেন। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি কি কিছু মিস্ করছি?
ভেজা হাতে গুগল্ করলাম - ব্রাস্ কবলস্টোন বার্লিন...
বাসটার পেছনের দিকে, একটা জানলার ধারের সিটে একটা মেয়ে বসে। পাশের সিটটা ফাঁকা।
মেয়েটা নিঃসন্দেহে ভারতীয় উপমহাদেশের। মাথায় কালো টুপি, মুখে কালো মাস্ক। গলার স্কার্ফটাও কালো। আকাশি নীলও নয়, মেরুনও নয়।
শ্রেয়া না?
মেয়েটা আমাকে লক্ষ্য করেনি। দেখলেও চিনতে পারার কথা নয়। আমার মুখেও মাস্ক।
বাসের জানলা দিয়ে গির্জাটার লাল দেয়াল দেখা যাচ্ছিল। পিএ সিস্টেমে আমার স্টপের নাম অ্যানাউন্স হয়ে গেছে।
আমি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
৩
শিল্পী গুন্টার ডেমনিগের নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। শোনার কথাও নয়। আমি এসবের খোঁজখবর বিশেষ রাখি না।
গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে আছে ডেমনিগের শিল্পকর্ম। আজ অজান্তেই, আমিও দেখে ফেলেছি ডেমনিগের কাজ। কার্ল-মার্ক্স স্ট্রাসের পুরোনো বাড়িটার বিশাল কাঠের দরজার সামনের ফুটপাথে, মাটিতে পোঁতা তিনটে পেতলের কবলস্টোন।
প্রতিটা কবলস্টোনে একজনের নাম লেখা। লেখা তাঁর মৃত্যুর সাল-তারিখ, এবং কোন নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, সেটার নাম। এঁরা কেউ ইহুদি, কেউ জিপসি, কেউ সমকামী। কেউ আবার নিতান্তই এমন একজন মানুষ - যাঁকে বেঁচে থাকতে দিয়ে লাভ নেই বলে মনে করেছে নাৎসিরা।
কবলস্টোনগুলো বসানো এঁদের শেষ স্বাধীন বাসস্থানের সামনে।
কবলস্টোনগুলোর পোশাকি নাম একটা আছে - স্টোলপারস্টাইন। বাংলায় - হোঁচট-পাথর।
আমি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম।
গির্জার গম্বুজটা একটা অফিসকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মেইনটেনেন্সের খরচ তোলার জন্যে নিশ্চয়ই। ওই গম্বুজ-অফিসে কাজ করতেন, এমন একজনকে আমি চিনতাম। তিনি একবার গল্প করেছিলেন - অফিসের কর্মচারীদের কোকেন স্নর্ট করে নীচে গির্জার ভেতরে শিশুদের ব্যাপটিজম্ দেখে ট্রিপ খাওয়ার।
আজ এত রাতেও অফিসে কাজ হচ্ছে। কয়েকটা হলুদ আলো জ্বলছিল।
কাল একবার ফুলের দোকানটায় যাব। দোকানির কাছে হলুদ ফুলটার নামটা জেনে নিতে হবে। দু'টো বোকে নেব - ওই ফুলেরই। একটা গিয়ে কার্ল-মার্ক্স স্ট্রাসের স্টোলপারস্টাইনটার ওপর রেখে আসব। আরেকটা শ্রেয়ার জন্যে।
বড় শহরগুলোর আর সমুদ্রের অনেক মিল আছে। দু'টোই বোধহয় আস্তে-আস্তে গ্রাস করছে আমাদের।
সমুদ্র অবশ্য নেয় না কিছুই, সবকিছু ফিরিয়ে দেয়। বড় শহরগুলোর ক্ষেত্রে সবসময় একথাটা ঠিক খাটে না।
আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শহরটার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একসময় গির্জার গম্বুজের শেষ আলোটা নিভে গেল।
ভালো লেগেছে।
ভালো লাগলো লেখাটা। মনের ভেতর সহজেই ছবি তৈরী হলো। ভাবনা আর বর্ণনা অনায়াসে মিলেমিশে গেছে।
পড়তে পড়তে মনে হলো যেন মেঘলা দিনে জার্মানির রাস্তায় একটু পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। মনটা উদাস মতো হয়ে গেল।
সবাইকে ধন্যবাদ! খুব ভাল লাগল সব্বার ভাল লেগেছে শুনে।