প্রোফেসর ভাজ্জি সকালে দেখা হতেই বললেন,“চাও, চাও। হাউ আর ইউ ইন্দ্রাণী? হাউ ইজ ইয়োর ওয়ার্ক গোয়িং?” জানালাম কাজ ভাল চলছে, “প্রেটি গুড”।
এসেছি ইতালির পাভিয়া ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে চারমাসের জন্য। পাভিয়া বহু পুরনো ইউনিভার্সিটি। ১৩৬১ সালে এখানে পড়ানো শুরু হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্তত একটি নাম সম্ভবত সকলের জানা– বিজ্ঞানী আলেসানড্রো ভোল্টা, যাঁর নাম থেকে ‘ভোল্ট’ কথাটি এসেছে। তিনি এখানে চল্লিশ বছর অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন। খুব মন দিয়ে কাজ করি সারাদিন। পড়াশোনা আর পেপারের কাজ নিয়ে সারাদিন কেটে যায়।
বাইরে গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত আটটা বাজার ঘণ্টা পড়ল।কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে পড়লাম বাসায় ফেরার জন্য। এখন জানুয়ারী মাস। মাঝে মাঝেই তুষারপাত হয়। সমস্ত গাছপালা, বাড়ি-ঘর, গাড়ি সব বরফের চাদরে ঢেকে যায়। ভারী সুন্দর সেই দৃশ্য। গেস্ট হাউসের ছাদের একপাশে কাঁচের জানলা আছে একটা। মাঝে মাঝে সকালে উঠে দেখি সেই কাঁচের জানলাটা একেবারে সাদা বরফের মোটা আস্তরণে মোড়া। অপূর্ব লাগে সেই দৃশ্য।
ঘরের ভিতর রুম হিটারটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে বসি ফোন করতে আমার মঁসিয়ে আর মেয়েকে কলকাতায়। মেয়ের ক্লাস সিক্স। পাভিয়ায় এসে প্রথমে একটু মন কেমন করলেও কিছুদিন বেশ ভালই লাগছিল। নতুন পরিবেশে কাজ। মানুষজন ভাল।তিনমাস কেটে যাওয়ার পর শেষটা যেন আর কাটতে চায় না। মনে হয় কবে ফিরব। বাড়ির কথা মনে পড়তে থাকল সারাক্ষণ।কতদিন দেখিনি ওদের। মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে আমাকে ছাড়া। ভাবি ওর হোমওয়ার্ক ঠিকমতো হচ্ছে কি না।ওরা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছে তো?
ফোন শেষ করে আবার কাজ করতে বসি। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে ঘুমোতে যাই। মনে মনে প্ল্যান করেনিই কাল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কী কী কাজ শেষ করব। একটা পেপার শেষ করে ফেলতে হবে আর সাতদিনের মধ্যে। তারপর মেয়ে আর মেয়ের বাবা এসে পড়বে আমার কাছে।সবাই মিলে ঘুরতে যাব ইউরোপ ট্যুরে ১৫ দিন।
ছুটির দিনে মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াই এলোমেলো রাস্তায়। চমৎকার সব বাড়িঘর পুরনো ধাঁচের, কংক্রিট বাঁধানো রাস্তা, বড় বড় স্ট্যাচু– কোনটা দেবী মিনার্ভার, কোনটা বা যুদ্ধের শহীদদের। আর আছে রোমান স্টাইলের পুরনো সব বড় বড় গির্জা। ভারী সুন্দর লাগে এই ছোট্ট শহর পাভিয়াকে।
কিছু বন্ধু তৈরি হয়ে গেছে এখানে। সবাই মিলে মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁতে খেতে যাই। ইতালিয়ান পিৎজা আর পাস্তা তো অতুলনীয়। কিন্তু কফি খেতে গিয়ে একটু হোঁচট খাই। একটা খুব ছোট কাপে,ছোটবেলার পুতুল খেলার মত দেখতে যার মাপ, তাতে খুব কড়া কালো কফি দেয় এখানে। আর সেটা এক ঢোঁকে খেয়ে ফেলতে হয়। মনে হয় যেন নিমপাতার রস খেলাম! উফ বাবা কী অখাদ্য! ইতালিয়ান বন্ধুরা হাসতে থাকে আমার অবস্থা দেখে। বলে ওটাই এখানকার কফির মজা। ওরা হাসতে হাসতে বলে,“দুধ-চিনি দিয়ে কফি খায় তো বাচ্চারা”।
অবাক হওয়ার আরও বাকি আছে সুপার মার্কেটে গিয়ে। বাপ রে! কত অজস্র রকমের চীজ! কত বিচিত্র তাদের নাম-মোজারেলা, রিকোট্টা, পারমেসান, গোরগঞ্জলা! জন্মে নাম শুনিনি এদের। এইসব চীজ কোনটা খুব নরম, কোনটা শক্ত, কোনটা খুব পুরনো সময়ে তৈরি, আরও কতরকমের বৈশিষ্ট্য তাদের। ওখানে থাকতে থাকতে বুঝলাম ইতালিয়ানরা খুব চীজভক্ত। সব খাবারের সঙ্গে কোড়ানো চীজ খায় তারা। চীজ না হলে ওখানে খাওয়া অসম্পূর্ণ।
সপ্তাহান্তে দেখতাম মানুষজন বেরিয়ে পড়ে সকাল থেকেই হৈ হৈ করতে করতে সপরিবারে। আর দেখতাম ইতালিয়ানরা সব সময় খুব আনন্দে থাকে আর হৈ চৈ করতে ভালবাসে। সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে ভিলেজ মার্কেট বসে, যেখানে নানারকম খাবার পাওয়া যায় বাড়িতে বানানো। বাড়ির বাগানের ফল, সব্জি, চীজ, অলিভ, সসেজ আরও কত কি পাওয়া যায় সেখানে। ঘুরে ঘুরে দেখি দোকানপাট। কখনো সখনো একটু কেনাকাটাও করি।
এখানে লাঞ্চ খাই ক্যান্টিনে। সেখানে বেশির ভাগ দিন পাওয়া যায় একরকমের আঠালো ভাত,স্যালাড, চিকেন, ফল এই সব। খাবার টেবিলে চীজ রাখা থাকে, যেমন ইচ্ছে কুড়ে নেওয়ার জন্য। প্রথম দিকে একদিন খুব ঘাবড়ে গেলাম লাঞ্চ খেতে গিয়ে। কী ওগুলো ভাতের মধ্যে? ওরে বাবা এ যে দেখি অক্টোপাসের বাচ্চা! ইশ, এ আমি খেতে পারব না কিছুতেই। দেখেই মনে পড়ল ছবিতে দেখা বিরাট অক্টোপাসের কথা। সেদিন শুধু ব্রেড খেলাম।
আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার শুনলাম ইতালিতে এসে। ওরা নাকি ব্রেকফাস্ট খায় না সেরকম। হয়তো একটা ক্রোস্যাঁ আর একটু জুস খেয়ে নিল। লাঞ্চ ওদেরপ্রধান খাবার। আমেরিকানদের থেকে ইতালিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস খুব আলাদা বুঝলাম। আরও একটা ব্যাপার নজরে পড়ল এখানে এসে। সব ইংরেজি বই এখানে ইতালিয়ানে অনুবাদ করে পড়ানো হয় ক্লাসে। ইংরেজি অনেক মানুষই বলতে পারে না। অ্যাকাডেমিক পেপারও প্রোফেসররা লেখেন ইতালিয়ানে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব খুব এদের। বিশ্বে যত মানুষ ইতালিয়ান বলে তার থেকে বাংলা বলে ঢের বেশি মানুষ। অথচ আমাদের লেখালিখি এখনও ইংরেজির হাত ধরে। আঞ্চলিক ভাষা পাত্তা পায় না সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক কাজে।
সোমবার থেকে আবার শুরু হয়ে যায় জোরকদমে কাজ। মনে মনে দিন গুনি মেয়ের আর মেয়ের বাবার পাভিয়া আসার। হিসেব করে দেখি আর দশদিন বাকি ওদের আসতে। এলে কী কী করব ভাবতে থাকি। মেয়েকে পাশের বড় বইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে ‘অ্যাডভেনচারস অফ পিনোক্কিয়ো’ বইটা কিনে দেব। পিনোক্কিয়োএখানে খুব জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র। ওর ওই লম্বা ছুঁচলো নাক আর সরু সরু হাত-পা-ওলা টুপি পরা ছবিটা সর্বত্র দেখতে পাই এখানে। এছাড়া ইতালিয়ান পিৎজা, পাস্তা তো খাওয়াবই রেস্তোরাঁতে নিয়ে গিয়ে।
কয়েকদিনের মধ্যেই পেপারটা শেষ করে গাইডের কাছে জমা দিয়ে দিলাম। আর তিনদিন পরে ওরা আসছে। প্যাকিং করতে শুরু করি জিনিসপত্র যা ইউরোপ ট্যুরে সঙ্গে যাবে। সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, টুপি- সব গুছিয়ে নিলাম একে একে। ঠাণ্ডা এখন খুব বেশি – জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ।
অবশেষে সেই দিনটা এসে গেল। ওরা এসে পৌঁছল। ফ্যামিলি রিইউনিয়নে খুব আনন্দে কাটল দিনটা সবার। পরের দিন সকালে যাব ফ্লোরেন্স। তারপর রোম ও ভেনিস। এরপর যাব প্যারিস, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, লুসার্ন, জুরিখ। তারপর আবার ফিরব পাভিয়া। এই ভ্রমণটা করলাম ইউরেল ট্রেনে চেপে। দোতলা ট্রেন, ভিড় নেই। প্যারিস থেকে জেনেভা ট্রেন যাত্রার পথ খুব সুন্দর। ট্রেন থেকে পুরো আল্পস পর্বতমালা দেখা যায়, যার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত।
প্রত্যেকটা জায়গা, যেখানে আমরা গেলাম,অসাধারন সুন্দর। ইউরোপের প্রত্যেকটা জায়গার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে যা একবার দেখলে ভোলা যায় না। যেমন প্যারিসে ফুটপাথে অজস্র ছোট ছোট কাফে– যেখানে বসে সবাই কফি খাচ্ছে, গল্প করছে, কোনও ব্যস্ততা নেই কারোর। প্যারিসে প্রচুর ফ্যাশন বুটিক, যেখানে ক্রেতার সংখ্যা হাতে গোনা। মনে মনে ভাবি দোকানগুলো চলে কীভাবে? বুঝতে পারি, এগুলো আমাদের গড়িয়াহাটের দিন আনি দিন খাই দোকানের মত নয়। হয়ত দোকানের মালিকের এটা শখের ব্যবসা, বিক্রিবাটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, অঢেল অর্থের মালিক সে। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের কথা না বললে প্যারিসের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই মিউজিয়ামের সংগ্রহ এতই বিশাল যে একদিনে তা দেখে শেষ করতে পারলাম না। দু দিন শুধু গেল ল্যুভর দেখতেই। আর বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার তো আছেই।
আবার দেখি ভেনিসে চারদিকে শুধু জলের নালা, তারি মধ্যে সব বাড়িঘর। ছোট ছোট বোটে বা গণ্ডোলাতে সবাই যাতায়াত করছে অলিগলি দিয়ে। পুরো শহরে বয়স্ক মানুষজন, ট্রলিব্যাগ টেনে টেনে বাজার করে ফিরছে। বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলো দেখলাম, যার মধ্যে আছে উফিজি গ্যালারি, পালাজো ভেচ্চিও, গ্যালেরিয়া ডেল অ্যাকাডেমিয়া। এই শেষ মিউজিয়ামে আছে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর বিখ্যাত ভাস্কর্যডেভিড। ফ্লোরেন্স হচ্ছে শিল্পপ্রেমীদের শহর। সারা শহরে ছড়ানো অপূর্ব সব মিউজিয়াম। সুইজারল্যান্ডের লুসার্নে দেখলাম মাউন্ট তিতলিস, যেটা সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বত ও গ্লেসিয়ারের জন্য বিখ্যাত। ওখানকার কেব্ল কারে ঘোরাটাও একটা অভিজ্ঞতা। আর কি আশ্চর্য! এখানেও বিরাজ করছে শাহরুখ খান আর কাজলের বিরাট কাট আউট! ধন্য বলিউড!
১৫ দিন ইউরোপ ঘুরে পাভিয়া ফিরে এলাম। মন ভরে আছে বেড়ানোর নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দে। এরপর তিন দিন বাদে পাভিয়া থেকে ফেরার দিন। আবার ব্যাগ গোছানো, আবার প্লেনে চড়ে দীর্ঘ যাত্রা। বন্ধুদের আর কলিগদের বিদায় জানিয়ে আর একবার শেষবারের মত পাভিয়ার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিই। এই চারমাসে শহরটাকে যেন কত আপন করে নিয়েছিলাম মনে হয়। ফেরার সময়একটু মন খারাপ লাগে। অস্ফুটে বলি–“অ্যারিভেডোসি পাভিয়া, সি ভেডিয়ামো”। কানে লেগে থাকে গির্জার সেই ঘণ্টাধ্বনিযা আজও স্বপ্নে শুনতে পাই যেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।