"কি বলছেন স্যার! জঙ্গল নেই? মানে!" মোবাইলে কথাটা একটু উত্তেজিত ভাবেই ভেসে আসে। পুলিশ সুপার সিরিয়াস মানুষ। ডিউটির সময় এই সব খোশগল্প করতে পছন্দ করেন না।
কিন্তু সিরিয়াস অলক মজুমদারও। তারও কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অতবড় একটা জঙ্গল উবে গেল! এমনিতেই তার এই সব ঝামেলা পোহানোর কথা না। কিন্তু উপাধ্যায় স্যার রেজিগনেশন দিয়ে ছুটি নিয়ে দেশে চলে গেছেন। ফলে বাঁশ এসে পড়েছে তার ঘাড়ে। যখন প্রথম প্রথম এখানে পোস্টিং নিয়ে এসেছিল, কি যে ভাল লাগত। সমুদ্রের জলের রঙের খেলা, খোলা আকাশ, সবুজের হাজার শেড সব মিলিয়ে নেশা ধরে যেত। কিন্তু এই প্রজেক্টের চক্করে সব মাথায় উঠেছে।
প্রথম থেকেই এই প্রজেক্টটা নিয়ে ঝামেলা চলছে। একেই তো বন কেটে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটানো। এ বন ওঙ্গি জনজাতির নিজস্ব বাসভূমি। এ জঙ্গল কাটার কথা শুনলে যে কোন সুস্থ মানুষের অস্বস্তি হবে। তার উপর আবার এখানে জায়েন্ট লেদার ব্যাক টার্টলের ডিম পাড়তে আসে। তাদের কথা ভেবেও এই জায়গাটাতে হাত না দিলেই ভাল হত। কিন্তু হুকুম হয়েছে, এখানেই করতে হবে। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। তাও তো উপাধ্যায় স্যার অনেক হুকুম নড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। প্রজেক্টটা হলে অনেকের অনেকরকম সুবিধা।সব সুবিধা কি আর চোখেও দেখা যায়! শেষকালে রেগেমেগে উনি তো রেজিগনেশনই দিলেন। বললেন, জঙ্গলই না থাকলে আর ফরেস্ট অফিসার কোন কাজে লাগবে! ধুর! আর ব্যস, সব ঝক্কি এসে পড়ল অলকের ঘাড়ে!
অলকের বাড়িতে বৌ, ছোট বাচ্চা আছে। উপাধ্যায় সাহেবের মত ঝাড়া হাত-পা নয়। কাজেই মনের ক্ষোভ মনে চেপে রেখেই কাজ করে যেতে হয়েছে। টেন্ডার ডাকা, ঠিকাদার নির্বাচন সব কাজই হয়ে গেছে। পুরো কাজটা এতটাই বড় যে অনেকগুলো ব্লকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্লকের কাজ এখন শুরু হবে। ঠিকাদার খবর পাঠিয়েছে তার অনুগত বাহিনীকে। তারা আবার খবর পাঠিয়েছে পেটোয়া লোকদের। শুধু তো এই দ্বীপেই নয়, আশেপাশের দ্বীপেও। এলাকার ছেলে ছোকরারা অবশ্য প্রজেক্টের খবরে ভারি খুশি। এমনকি ওঙ্গি উপজাতির অনেকেই বেশ খুশি। বন্দর হবে, দেশ বিদেশ থেকে লোকে বেড়াতে আসবে, হাসপাতাল হবে, এই দ্বীপেই কাজের সুযোগ মিলবে ... তা এতকিছুর জন্য যদি কিছুটা জঙ্গল সাফ করতে হয় তো কি আর করা যাবে। আরও তো কত জঙ্গল থাকবে। এ দ্বীপের তো এখন গোটাটাই জঙ্গল। তার কিছুটা গেলেই বা কি!
গ্রামের তিনমাথা বুড়োরা একটু গাঁইগুঁই করছিল বটে , জঙ্গল হল দেবতা, তার গায়ে ঘা দিবি? ছেলেপুলের সংসার, যদি অকল্যাণ হয়? জোয়ানরা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। কোন অমঙ্গল হবে না, উল্টে মঙ্গল হবে। বাচ্চা হতে গিয়ে কেউ মরবে না, সাপের কামড় খেয়েও না। বুড়ো বয়সে দুটো ওষুধ পাবে, আমরা হাতে দুটো পয়সা পাব, বাচ্চা বুড়োদের ভাল মন্দ খেতে দিতে পারব। অগত্যা বুড়োরাও মেনে নিয়েছে।
খালি যাদের মতামত নেওয়ার কথা কেউ ভাবেও নি, তারা হল ওই জঙ্গলের গাছগুলো। তারা যে কী ভাবছিল তা অজানাই রয়ে গেল।
কিন্তু একী তাজ্জব ব্যাপার! সকাল থেকে ধারালো কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে লোক জড়ো হয়েছে গ্রামের শেষে। ঠিকাদারের লরি এসে জমা হয়েছে। তার সঙ্গে এসেছে ইলেকট্রিক করাত আরও কত যন্ত্রপাতি! একটা বড় মাঠ , তার ওপারে ঘন জঙ্গল। মানে কাল রাতেও ছিল। আজ সে জঙ্গল কোথায়? পুরো সাফ জমি, একটা ঘাসও নেই। গাছ পালা লতা পাতা পাখি পাখালি কাঠবিড়ালি তো দূরের কথা! ন্যাড়া জমি! একটুকরো সবুজ নেই কোথাও। শুধু মাঝে মাঝেই গভীর বিশাল আকারের অতল-ছোঁয়া গর্ত। কি যে ব্যাপার কারোরই মাথায় কিছু ঢুকছে না। ওরাই বনদপ্তরে খবর দিয়েছে। শুনে অলক দলবল নিয়ে ছুটে এসেছে। সব দেখে তো হতভম্ব। গ্রামের লোকজনকে প্রশ্ন করলেন। কেউ কিছু দেখে নি, শোনেও নি। এক বুড়ো শুধু বলছিল, রাতের দিকে জমি জ্যান হালকা দুলতাছিল, আর গরর গরর পারা একখান শব্দও আসতাছিল, জ্যান মেঘ ডাকে। আর কেউ দুলুনিও টের পায় নি, শব্দও শোনে নি। আর সত্যিই, কোন মানুষের পক্ষে রাতারাতি কী এমন চেঁছেপুছে এত বড় জঙ্গল সাফ করা সম্ভব? অলক পুলিশকে খবর দিলেন। প্রথম দফার অবিশ্বাস কাটার পরে সুপার জায়গাটাতে এখনি আসছেন বলে জানিয়েছেন । অলক অপেক্ষা করছে। এমন সময় মিতার ফোনটা এল।
দুপুরবেলা প্লেস্কুল ছুটির পরে বুবাইকে নিয়ে সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছিল মিতা। জামা ছাড়ানোর যুদ্ধ চলছিল। বাড়িতে এখন মানুষ বলতে সাকুল্যে দুজন। এমন সময় গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠল। ছোট বড় কয়েকটা ভূমিকম্প আগে দেখেছিল মিতা, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোন মিলই নেই। ঠিক যেন নাগরাজ বাসুকি প্রবল উত্তেজনায় বার বার মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। আর অসহায় বাড়িটা কোনক্রমে সেই দুলতে থাকা মাথার উপর এই পড়ে-গেলাম পড়ে-গেলাম বলে কাঁদো কাঁদো মুখে আঁকড়ে বসে থাকতে চেষ্টা করছে। বুবাইকে টানতে টানতে কোনক্রমে মোবাইল আর বাইরে বেরনোর ব্যাগটা নিয়েই বাড়ির বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে এল মিতা।
ততক্ষণে আশেপাশের আরও অনেকেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। চোখের সামনে চরচরিয়ে পিচ বাঁধানো রাস্তা দুফাঁক হয়ে গেল। মাটির দুলুনি এড়াতে তাড়াতাড়ি বুবাইকে কোলে নিয়ে একটু দূরের খেলার মাঠের দিকে ছুটল মিতা। সেখানেই সেই আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল মিতার। মাঠ কোথায় গেল? মখমলি মাঠ এখন টুটিফাঁটা। দুদিকের বাড়ির পাঁচিল যা ছিল, তার ইঁট খসে খসে পড়েছে। ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে গাছের ডাল। আর মাঠ জুড়ে গজিয়ে উঠেছে বনস্পতিদের ঘন জটলা। মাটি ঢেকে আছে ঝোপে, লতায়। খোলা দুপুরের রোদে জ্বলা মাঠ এখন ঘন ছায়ায় ঢাকা। জংলী গন্ধ, ছোট ছোট বুনো ফুল, এ কোন জায়গা? চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল। মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। বুবাই পর্যন্ত ভয় পেয়ে হতভম্ব মায়ের কোলে সিঁটকে রয়েছে।
মাটির দুলুনি একটু থামতে বাড়ির রাস্তা ধরেছিল মিতা। চেনা রাস্তা তবু যেন কেমন অচেনা! রাস্তার মাঝে মাঝে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মহীরূহ। গাছ তেমন চেনে না মিতা, তবে চওড়া গুঁড়ি, ছড়ানো ডালপালা দেখে বোঝা যাচ্ছিল কচি গাছ তো নয়, আদিম অরণ্যের বৃদ্ধ সন্তান। রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর পাঁচিল ফুঁড়ে উদ্ধতভাবে বেরিয়ে আছে মোটা সপত্র ডাল। সেসব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কোন ক্রমে বুবাইকে কোলের মধ্যে সাপটে নিয়ে নিজের বাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছিল মিতা। কিন্তু এ যে না দেখতে হলেই ভাল ছিল। যেন একটা দৈত্য বাড়িটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলেছে। বাড়ির ছাদ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে এক বিশালদেহী গাছ। লিভিংরুমের দেওয়াল ফাটিয়ে বেড়িয়ে এসেছে তার অসংখ্য ডালপালা। কাছে এসে দেখে দরজার সামনে তার শখের টবের বাগান তছনছ। টব উলটে মাটিতে পড়ে, ভেঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে। লিভিংরুমের সোফাসেট উলটে পড়ে আছে এক কোনে, তার সাধের কাশ্মিরী কার্পেটের উপর মাটি পাতার আলপনা। ক্রিস্টালের ডিসপ্লে র্যারক ঘরের কোণ থেকে ঝটকা লেগে এসে পড়েছে শালগাছের গায়ে। আর সেই কোণ ফাটিয়ে উঁকি মারছে এক ফুলেল আকন্দ গাছ। বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবির কাঁচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। আর ছবিটা মুখ থুবড়ে এসে পড়েছে একটা কাদা ভরা ফাটলের মধ্যে। আর সহ্য করতে পারে না মিতা। এক ছুটে বাড়ির বাইরে চলে যায় আবার। দরজার বাইরের ভাঙ্গা সিঁড়িতে বসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে। তার সাজানো সংসার! তারপর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে অলককে ফোন করে।
***
মিতার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না অলক। কিসব ভূমিকম্প, গাছ কি সব বলছে। কেটে দিয়ে হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও কল করে ব্যাপারটা বোঝার জন্য। মিতা আর মুখে বোঝানোর চেষ্টা না করে বাড়ির দিকে ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে পুলিশসুপার এসে গেছেন। অলক তাকে ইশারায় ফোনের স্ক্রীন দেখতে বলে। হতভম্ব দুজন সরকারি কর্তা হাঁ করে ভিডিওকলে কলকাতার বাড়ি ফাটিয়ে আচমকা গজিয়ে ওঠা সতেজ বৃক্ষরাজি দেখতে থাকেন। দেশের আরও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশ্চর্য রকম জঙ্গল আচমকা গজিয়ে ওঠার খবর তখন ডিস্ট্রিবিউশন কিউতে ঠেলাঠেলি করছে। তাদের পাত্তাও না দিয়ে একটাই খবর বারে বারে দিকে দিকে প্রচারিত হচ্ছে। আজকের ব্রেকিং নিউজ। আজ সকালবেলা নিউ দিল্লি এলাকায় আচমকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। কোন প্রাণহানির খবর না পাওয়া গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেছে পার্লামেন্টভবন সহ সকল সরকারি ভবনের মেঝে ফাটিয়ে, ছাদ ফুঁড়ে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল মহীরূহ। দেওয়াল ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের ডালপালা। বিষয়টির তদন্ত করে দেখার জন্য ইতিমধ্যেই সরকার উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। যে সব গাছ দেখা যাচ্ছে সেগুলির কোনটাই দিল্লি অঞ্চলের স্থানীয় গাছ না। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে সেগুলো সবই বৃষ্টিবহুল এলাকার গাছ। ....
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।