কাল বলছিলাম কুলতলীর কথা। ভাসা গুরগুড়িয়া ভুবনেশ্বরী দেবীপুর একসাথে বলা হয় বলছিলাম। এই কারণেই। এই বিস্তৃত অঞ্চলে এমন অনেক পাড়া আছে যেগুলোর নাম বিধবা পাড়া। জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছে ওই পাড়াগুলোর অনেকে। বর্তমানের জেলা করেস্পনডেন্স রত্নাকরদা আর জয়ন্তদার সাথে এর আগে এরকম গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নদীর ওপাড়ে বাঘ বসে থাকতে দেখা যায় মাঝে মাঝে, জাল একটু উঁচু করা আছে নাকি। এপারে আসেনা। শীতের সময় মাঝে সাঝে আসে বটে। তার থাকার জায়গা, মানুষ তাকে ভাগিয়ে জঙ্গল কেটে বসত বানিয়েছে, আর সে চলে এলে আমরা বলি লোকালয়ে বাঘ ঢুকে পড়েছে। মাইরি!
জাতিতে জেলে কৈবর্ত। নদীর পারগুলোতে বাস। আর ভাবনা বারোমাস। কারো বোট আছে আর কারো তেলো ডিঙা। মানে একটা তালগাছের গুঁড়িকে কেটেকুটে ছোট মতো ভেসে থাকার একটা জিনিস। সেটাকে নৌকা না বলাই ভালো। নদীর বাঁধে জাল শুকোতে দেওয়া থাকে। বাড়িতে তুলসী মঞ্চ আর মনসার ছবি পাশাপাশি। আশপাশে গাছের গায়ে লাল কাপড়ের টুকরো বাঁধা। বনবিবি কিংবা দক্ষিনরায়ের থানেরও দেখা মেলে।
বাঘে খাওয়া মানুষ যেমন ঘরে, ঘরে তেমনি বাঘের আঁচড় খেয়ে ফেরা কিংবা বাঘের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নিয়ে ফেরা মানুসেরও দেখা মেলে।
এমনই তিন চার জন বাঘ বাহাদুরের সাথে দেখা কাল। সাত আট জনকে ফিরিয়ে এনেছে এমন এক বুড়ো। নৌকায় কোয়ারেন্টাইনে আছে। কাল ফিরেছে অন্ধ্র থেকে। 1400 কিলোমিটারের মধ্যে 670 কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গাঁয়ে ফিরে আপাতত নিজের নৌকায় বন্দি। ঘরে নাতি নাতনিরা আছে না!
বাঘের গল্প বলতে বললে শিশুর মত অনাবিল হাসছে, আর গল্প বলছে। মাঝে মাঝে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। জঙ্গলে সামনাসামনি বাঘের কি রূপ! চোখ নাচায়, ভুরু নাচায়। দুমাস আগেই নাকি এগ্রামের একটা দল বাঘের খপ্পরে পড়েছিল। বুড়োর ছেলেও ছিল তাতে। ৬ জনের টিম। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বাঘের সাথে লড়ে নিজেরা ফিরেছে। টানা ৭-৮ ঘন্টা ধাওয়া করেছে বাঘটা। আম্ফানের মতই ৭-৮ ঘন্টা। হ্যাঁকাতে আছে বাঘটা। বুড়ো বলল আমার ছেলেটা তো একটু হ্যাঁকাতে। ৪টের পর বাঘ তাড়ালেও তখন ভাটা, নৌকা কাদায় আটকে। গভীর রাতে জোয়ার। ততক্ষণ নৌকাতেই বসে থেকেছিল। যেকোনো সময়েই বাঘ আসতে পারতো। বাঘের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নিয়ে ফিরেছে। যদিও যাকে ধরেছিল সে বাঁচেনি। প্রবল রক্তক্ষরণে সে নৌকাতেই মারা গেছে। কাঁথা জামাকাপড় সব রক্তে ভেসে গিয়েছিল। তাও ফেরাতে পেরেছে -সেটুকুই তাদের গর্ব।
মোটা লাঠি দিয়ে পাঁচ ছ জন ক্রমাগত পেটাচ্ছে। আর ফুটবলে পেটানোর মতো ঢপ ঢপ করে আওয়াজ হচ্ছে। বাঘের পিঠে হাত রেখেছিল বুড়োর ছেলে। নিজের চামড়ার ভেতরের মাংস পেশিতে বাঘ এমন টান দিয়েছে মনে হলো যেন মাংস দলা পাকিয়ে সামনের দিকে চলে গেল আর তার টানে বুড়োর ছেলের হাত একেবারে বাঘের ঘাড়ের কাছে।
বাঘের সাথে মানুষ পারে? এ হল জঙ্গলের বাঘ। বাঘের সামনে হতভম্ব হলে হবে?
বাঘকে ওরা বাবা বলে, কেউ বলে বাবু। বাঘ বলে না।
কোথায় কাঁকড়া ধরতে যায় ওরা বলবে না। পাস নেই যাওয়ার। মৃতদেহ নিয়ে ফেরা সে আর এক বিপত্তি। বেআইনীভাবে গেছে বলে পুলিশের হ্যারাসমেন্ট আছে না। নদীর ওপারে বডি নিয়ে বসে থাকা আরো একদিন। এপারের লোকেদের পার্টি পঞ্চায়েত আর পুলিশের সাথে নেগোসিয়েসন করতে হয়। তারপর মাকরি পেরিয়ে ঘরে ফেরা। পোস্টমর্টেম হয় মৃতদেহের। 2 মাস আগে যে মারা গেছে তার ছ্যাতা বালুশ কাদায় পড়ে আছে, দেখালো বুড়োর ছেলে।
তাও ওরা জঙ্গলে যায়, যেতে বাধ্য হয়, পেটের টানে। কারণ পঞ্চায়েত ওদের প্রাপ্য ঘর দেয়না, চাল মেরে দেয়, বিকল্প কর্মসংস্থান দূর কি বাত। বুড়োর ছেলে আগেও বাঘ দেখেছে, কিন্তু লড়ল এই প্রথম। অসম সাহসী, কিন্তু চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ এখনো কাটেনি। জঙ্গলে আর যাবে না বলছে। বাইরে অন্য কাজ করতে যাবে, হয়তো বাবার মত। পাড়ার লোকে বলল ওরকম সকলেই বলে ফিরে এসে। তারপর আবার যেতে হয়। কি করবে না গিয়ে? এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় তাদের পেট চলবে?
"ওরকম সকলেই বলে ফিরে এসে। তারপর আবার যেতে হয়। কি করবে না গিয়ে? এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় তাদের পেট চলবে?" - পড়লে কিরকম দমবন্ধ লাগে।