হায়!
না, না, হতাশার অভিব্যক্তি নয়, এ হল নতুন যুগের অভ্যর্থনা! আমরা যারা হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে এসেছি, দু-দুটো শতাব্দী জুড়ে বাঁচছি, অন্য ধ্যানধারণায় বড় হয়েছি, তাদের কাছে হয়তো এসব একটু আজব ঠেকে! তবে জানবেন, আসলে সেটা ওই সর্ব যুগে কাঁঠালি কলা জেনারেশন গ্যাপ। তাই হায় হায় দিয়ে অভ্যর্থনা করে বাই বাই করে চলে যেতে দেখলে নির্বিকার থাকা ছাড়া গতি নেই। নতুন যৌবনের দূত বলে কথা! ওদের ভাষা তো নতুনতর হবেই। সকালবেলা উঠে ওরা বিদেশি ভাষায় গুড মর্নিং বলে আর রাতে গুড নাইট পাঠিয়ে জানান দেয় যে মাতৃভাষাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে ওরা শুতে যাচ্ছে। আরও আছে। কেউ কিছু উপহার দিল? ভূয়সী প্রশংসা করল? আপনার অর্ডারমাফিক জিনিসটি দোকানি প্যাক করে দিল? কেউ আপনার পরম উপকার করল? প্রতিটি ক্ষেত্রে একমেবাদ্বিতীয়ম অভিব্যক্তি - থ্যাঙ্ক ইউ। আবার চলতে চলতে ধাক্কা? রং নম্বরে কল? দোকানি ভুল মাল দিলো? কারও প্রিয়জন গত হলেন? সেসব ক্ষেত্রেও একটাই অমোঘ উচ্চারণ - সরি! এই জেনারেশন আমাদের প্রজন্মের চেয়ে অক্লান্ত অনেক বেশি কথা বলে যায় ঠিকই কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের তুলনায় অনেক মিতবাকও বটে।
এভাবে বিদেশি শব্দ ধার করায় বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে না উচ্ছন্নে যাচ্ছে সেই বিতর্কে যাবার আগে একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখা যাক এইরকম পরিস্থিতিতে আগের যুগের মানুষেরা কি করত। কিভাবে অভ্যর্থনা জানাত, বিদায় জানাত, কিভাবেই বা অনুতাপ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত? দেখতে পাই, দেখা হলে প্রণাম করাটা ছিল সেদিনের সৌজন্যের ভাষা। ছোটরা প্রণাম, বড়রা মাথায় হাত রেখে, চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদ। বিনা কথায় দেওয়াও হলো, নেওয়াও হলো। বিদায় পর্বেও তাই। হাই-বাই বলার দরকার পড়ত না, একটা প্রণামের মধ্য দিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে অনেক কিছু বলা হয়ে যেত। এবার, কিছু পেলে সেযুগে কোনও ভাব বিনিময় হতো কি? তা-ও হতো। বড়রা কিছু দিলে প্রণাম বা নমস্কার, ছোটদের ভাগ্যে জুটত আদর, আর সমবয়সী হলে কোলাকুলি, গলাগলি বা নিজেদের মতো করে কিছু বলে মনের আনন্দ প্রকাশ। এ যুগের ছেলেপুলেরা ভাবপ্রকাশের বিভিন্নতা বা মাত্রাভেদে বিশ্বাস করে না। তাই এরা নির্বিচারে বড়ছোটরামরহিমচেনাঅচেনা সবার জন্য বরাদ্দ রাখে একটা থ্যাঙ্ক ইউ । সামনে থেকে, দূর থেকে, ফোন, এসএমএস, ইমেল – সর্বত্র থ্যাঙ্ক ইউ-র হরির লুঠ! মজার কথা, দোকানি মাল দিলে লোকে বলে 'থ্যাঙ্ক ইউ', আবার কঠিন রোগ সারিয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনলে ডাক্তারকেও বলে 'থ্যাঙ্ক ইউ'। একজন তাক থেকে টুথপেস্ট এনে দিল, অন্য জন জীবন ফিরিয়ে দিল। একটা সৌজন্য, অন্যটা বুক জোড়া ভক্তি আর কৃতজ্ঞতা। এমন দুটি ভিন্ন স্তরের কৃতজ্ঞতার অনুভূতিকে কি করে একই শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব? একি সেই নাটকের মহড়া যেখানে একটা লাইন বিভিন্ন আবেগ ও স্বরক্ষেপণে উচ্চারণ করে অভিনয়ের কৃতিত্ব দেখানো হয়? এটা অভিনয় না হৃদয় উৎসারিত বিভাব? কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো যন্ত্রচালিত থ্যাঙ্ক ইউর চলন হবে। ফ্যাসফেসে বুড়ো গলার বাপ পাঠাবে রেকর্ড করা রিনরিনে সুললিত থ্যাঙ্ক ইউ, শুনে ছেলে বলবে, বাঃ! এই থ্যাঙ্ক ইউটা ভারী এসথেটিক! বাবার টেস্ট আছে!
রিয়্যালিটি শোগুলিতে থ্যাঙ্ক ইউ-র আরেক নমুনা। গুরুস্থানীয় কেউ প্রশংসা করলেন, শিষ্য সবিনয়ে মাথা নিচু করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ! পুরনো দিনে এ দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়! গুরুর প্রশংসা মাথা নিচু করে নাও, ব্যস! উত্তরে কিছু বলা মানে ধৃষ্টতা, আর ওভাবে বিনয় প্রকাশ তো কপটতার নামান্তর! গুরুকে ধন্যবাদ দেবার তুমি কে হে পাঁচু? একবার ভাবুন তো আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবকে রবিশঙ্কর মাথা নিচু করে বলছেন, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ!!
এযুগের আরেকটা চলতি শব্দ – সরি। ধাক্কা এখনকার মত তখনও লাগত। কিন্তু না, সরি না, লোকে তখন কাছে এসে অপ্রস্তুত মুখে বলত, আহা, লেগেছে? ছি ছি একদম দেখতে পাইনি। ওঃ ম্যান!! এ্যাত্তগুলো কথা! হাতে অঢেল সময় ছিল কিনা! আমাদের মতো ব্যস্ত জীবনে একটা সরি-ই যথেষ্ট। না, যথেষ্ট নয়। অনুতাপ প্রকাশ করতে গেলে বাড়তি সময় দিতে হবে। অনুতাপ শুধু একটা শব্দ ছুঁড়ে দিয়ে নয়, শব্দ-কণ্ঠস্বর-অনুভব মিলিয়ে আপাদমস্তক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সহকারে প্রকাশ করতে হবে। ব্যক্তিগত ছোঁওয়া থাকলে তবে সেটা আন্তরিক আর খাঁটি হয়, দায়সারা শুকনো লৌকিকতার থেকে আলাদা হয়। তাছাড়া পরিস্থিতিভেদে দুঃখপ্রকাশের ভাষা ভিন্ন হয়, যত্রতত্র যন্ত্রবৎ ওই একটা সরি ঢেকুরের মত উগড়ে দেওয়া যুগপৎ অসমীচীন ও কৃত্রিম। ভুল নম্বরে কল করে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে স্রেফ সরি? আয়, আমার পা টিপে দে, জল খাওয়া, ফের চোখ লাগা পর্যন্ত সব কাজ ফেলে হাত জোড় করে বসে থাক, তবে না বুঝব সরি! আর তুই ব্যাটা দোকানি, ভুল মাল দিয়ে আমার সময় নষ্ট করলি, দরকারি কাজ ফেলে উল্টো পথে ফিরে আসতে আমাকে বাধ্য করলি, তার জন্য শুধু সরি? সবচেয়ে অবাক লাগে শ্রাদ্ধবাড়িতে গিয়ে সরি বলার রেওয়াজ। সরি তো অনুতাপের ভাষা! কিন্তু প্রয়াত মানুষটির মৃত্যুতে কোনোভাবে দায়ী না হয়েও কেন বলব, আই অ্যাম সরি?কি বললেন?এই সরির মানে অন্য, আসলে বোঝাতে চাইছে - আমি তোমার দুঃখে দুঃখী? ও তাই বুঝি? তাহলে অন্তত বুঝিয়ে দিন, ফোন লাইন ব্যস্ত থাকলে অপারেটার যে সরি বলে তার সঙ্গে এই সরির তফাত কোথায়। আর সত্যি বলতে কি, গভীর দুঃখের মুহূর্তে ‘আমি তোমার দুঃখে দুঃখী’ কথাটা মেকি শোনায় না?
আমাদের প্রাচীণ সংস্কৃতির ভঙ্গিমাভাষা সার্বজনীন ও সর্বকালিক, এর ব্যঞ্জনা সর্বজনবোধ্য এবং এগুলি সর্বজনের হিতকারী। দোকানদার আর ডাক্তারের প্রতি উচ্চারিত কৃতজ্ঞতার ভাষা সেখানে তালগোল পাকিয়ে এক নয়, বরং সঙ্গত কারণে স্পষ্টভাবে ভিন্ন। কারণ একজনের প্রাপ্য সুস্মিত সৌজন্য আর অন্যজনের সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা। শব্দদূষণহীন, যুক্তিনিষ্ঠ, সহজ সুন্দর ব্যাঞ্জনাময় এই ভাষা কবে, কেন, কি যুক্তিতে পরিত্যক্ত হলো জিজ্ঞেস করতে যাব না কারণ পরিবর্তনের নামই জীবন। যেমন যেমন সমাজ বদলায় তেমন তেমন ভাষাও। তবে যে যুগে হে ভগবান বোঝাতে ওঃ শিট্! বলা হয়, সেখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আদৌ যে একটা শব্দ রাখা হয়েছে, তাতেই উৎফুল্ল বোধ করা উচিত!
আমিও পাঁচ দশক পেরিয়েছি। সত্যি বলছি , কেবল বয়সে বড়ো হলেই সবাইকে প্রণাম কোনদিন মন থেকে খুশী হয়ে করিনি। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন তো, প্রণম্য কি শুধু বয়সের গুণে হয়? জবরদস্তির ফল এই যে বাঙ্গালীরা অনেক সময়ই সম্ভাষণ হিসাবে কিছুই করে না , কেবল একটা হেঁহেঁ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলার বাইরে থেকে সানন্দে গ্রহণ করেছি দু হাত জোড় করে নমস্তে। কলকাতায় নমস্কার বলে দেখি অনেকেই প্রত্যুত্তরে নির্বাক নিশ্চুপ।
বলি কি, নতুন সময়ের সবই মন্দ নয়। আমাদের চোখ আর মন একটু বদলাতে হবে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি টিঁকিয়ে রাখার প্রশ্নটা অন্যভাবে সমাধান করতে হবে। সরি থ্যাঙ্ক্যু হাই বাই থাকলে কোন ক্ষতি নেই। কিছু না বলার চেয়ে এ অনেক ভাল।
শিষ্য মানে পাঁচু আর ধন্যবাদ বলা মানেই কপটতা!!
এহে এ যে অতি সরলীকরণ। প্রণাম বস্তুটা অত সহজ ছিল নাকি? বাউনের ছেলে তো তাই খুব ভালো করে জানি কারা প্রণম্য ছিলেন। বিজয়া দশমীর পরে পাড়ার কাকিমা-জেঠিমাদের প্রণাম করতে গিয়ে দেখেছি তাঁরা সসঙ্কোচে পা সরিয়ে নিচ্ছেন। মানে যথেষ্ট তারতম্য ছিল (ও আছে)।
দোকানদারকে কেউ কৃতজ্ঞতা দেখাতেন! রীতিমতো হ্যাটা করে মুদি, নাপিত, মুচি, কামার বলা হত (ও হয়)। রিকশাওয়ালাদের তুইতোকারি তো অতি প্রচলিত লব্জ।
আত্মার চিরশান্তি কামনা করাও ততটাই হাস্যকর ও কৃত্রিম। যেমন কৃত্রিম সাহেবচাটা ধন্যবাদ, শুভ সকাল, শুভরাত্রি।
হায় সেই ডাক্তার কবেই বিলীন হয়ে গেছেন যাঁর জন্য 'সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা' বজায় থাকবে।
কিন্তু গোটা লেখাটায় নমঃশূদ্র ও মুসলমানরা অনুপস্থিত কেন? আমিও তো হাফ সেঞ্চুরি পার করেছি কবেই, কিন্তু তাঁদের প্রতি আচরণ তো আর নজর এড়ায়নি (ও এড়ায় না) !
এটা কি সিরিয়াস লেখা নাকি বিতর্ক/কমেন্ট এই সব হবে এমন উদ্দেশ্য নিয়ে এই পোষ্ট!
এতো এক্কেরে সেই টিপিকাল "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" মার্কা হ্যাজ নামানো হলো। :) :)
আচ্ছা এই 'বকলমে'মানে তো আসল লেখক অন্য কোথাও লিখেছেন আর অন্য কারো পছন্দ হওয়ায় এনে তুলে রেখেছেন। পছন্দের প্রশংসা করতে পারলাম না।
পাঁচ দশক পেরিয়েছি কবেই। কিন্তু দুমদাম পায়ে হাত দিতে কোনওকালে ভাল লাগে নি। ছোটবেলায় সবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাত বাড়ির লোকজন। খানিক বড় হতে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি নিজেও কারো প্রণাম নিই না। কারো মানে একেবারেই কারো, আত্মীয়দেরও না। এটাকে প্রশংসাযোগ্য কিছু ভাবতেও পারলাম না। আর বয়সে বড় বলে বাড়ির বয়স্ক কাজের মাসি বা দিদিকে প্রণাম করে লেখিকা সম্ভবত বিপদে পড়েন নি কোনওকালে।
থ্যাঙ্কুই সরিতে সমস্যাও বুঝলাম না। ধন্যবাদ দেওয়া একটা ভাল অভ্যেস। সামান্য সাহায্য বা কাজ্জের জন্যও ধন্যবাদ দেবার প্রথা যে সব জায়গায় সেসব দেখে শেখাই উচিৎ। সকলের সাথেই সকলের দারুণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে না, কিন্তু 'শুকনো' ভদ্রতা শুন্য ভদ্রতার চেয়ে ভাল মনে করি।