সুরাট থেকে উত্তরপ্রদেশের বাস্তি জেলার দূরত্ব ১৪৫০ কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে এতটা পথ আসা অসম্ভব। এটা ওরা বুঝেছিল। অপেক্ষা করছিল কবে সব ঠিকঠাক হবে৷ কিন্তু এই লকডাউনের সীমা বেড়েই চলেছিল বারবার। জমানো টাকাও প্রায় সব শেষ। খাবার কোথা থেকে আসবে? কোম্পানি বন্ধ। অগত্যা ভরসা বাড়ি। বাড়ির লোক দুজনকেই চারহাজার টাকা করে পাঠিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে সুরাট থেকে উত্তরপ্রদেশগামী একটা ট্রাকের দুটো সিট ওরা বুক করেছিল। ইয়াকুব মহম্মদ আর অমৃত রামচরণ। ইয়াকুব কাজ করত সুতোর কারখানায় আর রাম কাজ করত পাওয়ারলুমে। দুজনের বাড়িই বাস্তি জেলায়। একসাথে কাজ করতে এসেছিল বাড়ি ছেড়ে। তিন বছর ধরে একই ঘরে দুজনে থাকছিল। থাকা,খাওয়া, ঘুমানো সবই একসাথে। দিনপ্রতি রোজগার ছিল ৩০০-৪০০ টাকা। লকডাউনের আভাস পেয়ে ২২শে মার্চের টিকিটও কেটে রেখেছিল দুজনে। কিন্ত মাত্র তিন ঘন্টার নোটিশে গোটা দেশজুড়ে সমস্ত কিছু বন্ধ। ওরা বুঝতেই পারেনি যে ওদের কথা কেউ ভাববে না। টিকিট ক্যান্সেল হল। ওদের ফেরা হল না। শুক্রবার বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে যে ট্রাকে ওরা সিট বুক করেছিল তাতে চেপে বসল। উঠে দেখল বসার জায়গাটুকুও নেই। ওদের সঙ্গী আরও ৫০ জনের বেশি। ওদের মতই সবাই। বাড়ি ফেরার তাড়নায় জড়ো হয়েছে নিজেদের শেষ পুঁজিটুকু দিয়ে। ২৫ ঘন্টার পথ। বাইরে তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি। ট্রাকের ভিতর দম ফেলার যায়গাটুকুও নেই। রামের শরীর গেল খারাপ হয়ে। গায়ে হাত দেওয়া যায়না এত গরম। রাম চোখ মেলতে পারে না। ইশারায় মহম্মদকে শুধু কিসব বলে। মহম্মদ বলতে থাকে গাড়ি ঘুরিয়ে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক তাদের। কিন্তু বাকি সবাই অমত জানায়। সন্দেহ করতে শুরু করে রাম বোধহয় করোনায় আক্রান্ত। ট্রাক রামকে নিয়ে যেতে অস্বীকার করে। ঠিক হয় তাকে নামিয়ে দেওয়া হবে রাস্তায়। পুলিশের গাড়িই তাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। মহম্মদ ঠিক করে সেও নেমে যাবে রামের সাথে। বন্ধুকে এই অবস্থায় সে একা ফেলে যাবে না। মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী অঞ্চলে হাইওয়ের ওপর নামিয়ে দেওয়া হয় রাম ও মহম্মদকে। রামের গায়ে তখন ১০৫ জ্বর। বন্ধুর মাথাকে নিজের কোলে রেখে রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে থাকে মহম্মদ। আগত গাড়িদের থামতে অনুরোধ করে। সবাই পাশ কাটিয়ে করে চলে যায়। অনেক পরে পুলিশ আসে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রামকে। ডাক্তাররা ভেন্টিলেটরে রেখেও শেষমেশ বাঁচাতে পারে না রামকে। ডাক্তারি ভাষায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয় হিট স্ট্রোক ও ডিহাইড্রেশন। রামের নিস্তেজ শরীর জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পরে মহম্মদ। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে এই লকডাউন হয়ত উঠবে না, ওদের বাড়ি ফেরা হবে না। ঠিক করেছিল আর ফিরবে না। গ্রামের খেতেই কাজ করবে এবার৷ কিন্তু রামের ফেরা হলনা।
আমরা এখনো যারা ধর্মের মালা জপতে জপতে, জানোয়ার কমিউনাল রাজনৈতিক নেতাদের প্ররোচনায় পা দিয়ে ওপাড়ায় গিয়ে ওদের ঘরে আগুন লাগিয় দিচ্ছি, বারবার কথায় কথায় ধর্মের কথা তুলে এনে ওদের গায়ে ভিনধর্মের ট্যাগ চাপিয়ে দিচ্ছি, ধর্মের দোহাই দিয়ে অশিক্ষিতের মত বলে চলেছি যে ওদের জন্যই আরও বেশি করে এই অতিমারি ছড়িয়ে পড়ছে তারা আসলে নিজেদের ধ্বজাধরা উগ্র জাতীয়তাবাদী মতকে প্রশয় দিয়ে ধর্মের মালা জপছি। আর মহম্মদরা রামেদের জন্য নিজেদের জীবনকেও বাজি রেখে দিচ্ছে। আর সুপ্রিম কোর্ট বলছে কারা রাস্তায় হাঁটবে সেটা তাদের দেখার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী কুম্ভিরাশ্রু ঝড়িয়ে বলছে তার ভুল হয়ে গেছে তিনি আগে শ্রমিকদের কথা ভাবেননি। এদিকে এখনও হাজার হাজার শ্রমিক হেঁটে বা ট্রাকের মাচায় ভেড়ার পালের মত ঘরে ফিরছে। কিন্তু এই হাজারও মহম্মদরা আছে বলে রামেরা এখনও ভরসা পাচ্ছে। বিশ্বাস করছে সরকার না করলেও এরা ঠিক পিপাসার সময় জল এগিয়ে দেবে। আর এই লড়াই লড়তে গিয়ে যে কটা প্রাণ যাবে সেগুলো শুধু কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে ধরা হবে সরকারি খাতায়। আর এই রামেরা, মহম্মদেরা আছে বলেই এই দেশটা এখনও ধর্মীয় কোন স্টেট হয়ে যায়নি। প্রতি মুহুর্তে এরাই তো মনে করিয়ে দিচ্ছে এই দেশটা যতটা সাভারকার- দাভোলকারের তার চেয়েও বেশি আসফাকুল্লা খান ও রামপ্রসাদ বিসমিলের। ইয়াকুব মহম্মদদের সন্ধ্যের আজানের সুর শুনে এখনও এদেশে তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালায় অমৃত রামচরণদের মা।
"প্রধানমন্ত্রী কুম্ভীরাশ্রু ঝড়িয়ে বলছে তার ভুল হয়ে গেছে" !
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী অশ্রু বা কুম্ভীরাশ্রু কোনোটাই ঝরাননি ।
এবং একবারও কোনো ভুল স্বীকার করেননি ।
ভুল স্বীকার করাটা ওঁর স্বভাবেই নেই । ২০০২-তেও যেমন করেননি । নোটবাতিল-(অথবা অনর্থকরণ)-এর পরেও যেমন করেননি ।