চোখের সামনে একটা দেশ, একটা শহরের অসংখ্য মানুষ শেষ হয়ে যাচ্ছে। জীবন চলে যাচ্ছে নিরীহ মানুষের, গরিব মানুষের। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাজ চলে গেছে রাতারাতি। পরিবারগুলো অর্ধাহারে আছে, অবসাদে, হতাশায় ভুগছে।
কিন্তু যাদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, তাদের কথা মিডিয়া বলেনা। কিন্তু বরিস জনসন, প্রিন্স চার্লস, টম হ্যাঙ্কস, কণিকা কাপুর আর এসব বড় বড় লোক দুদিনের জন্যে অসুস্থ হলে সে খবর হেডলাইনে চলে আসে। আজকে এইসব বড় বড় কিছু মানুষ -- সেলিব্রিটি -- যদি করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হতো, সে আমাদের দেশেই হোক বা আমেরিকা কি ইংল্যাণ্ডে -- যেটুকু লকডাউন, আইসোলেশন, কড়াকড়ি হয়েছে, সেটাও হতো কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তারপর আছে মিডিয়া সেলিব্রিটি এলেন ডিজেনারেস জাতীয় ব্যক্তিদের অমানবিক উক্তি -- যিনি বলেছেন এই লকডাউন তাঁর কাছে জেলে থাকার মতো। তিনি জেল কখনো দেখেছেন কিনা, বা সেখানে কত লোক পচে, এবং কীভাবে পচে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তাঁর বা তাঁর মতো বিলিওনেয়ার স্টারদের আছে কিনা, জানতে ইচ্ছে করে।
তিনি কি জানেন, সারা পৃথিবীর জেলবন্দীর ২৫%ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে? এবং তারা মনুষ্যেতর জীবনযাপন করে?
এই হলো বৈষম্য -- ভারতে, আমেরিকায়। শুধু আর্থিক বৈষম্য নয়, জীবন সম্পর্কে ধারণার নিষ্ঠুর বৈষম্য। এখানকার ওই এলেন, আর আমাদের দেশের হেলেন। একই ব্যাপার। এখানে হলিউড স্টার, ওখানে বলিউড। এখানে কোটিপতি বেসবল প্লেয়ার, দেশে ক্রিকেট।
আমেরিকার এই শোচনীয় অবস্থা -- আজ যা সারা পৃথিবীর কাছে নগ্ন হয়ে গেছে -- সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি এই শাসকশ্রেণীর সম্পূর্ণ উদাসীনতা, অবজ্ঞা, এবং নিষ্ঠুর মনোভাব আজ এই মৃত্যুর মিছিলের জন্যে দায়ী। এই কদর্য চেহারাটা মিডিয়া আগেও কখনো দেখায়নি, এবং এখনো যা দেখানো হচ্ছে, তাতে খবর বিক্রি করার, মুনাফা ও রেটিং বাড়ানোর উদ্দেশ্য যতটা, মানুষের কাছে কারণগুলো পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ সে তুলনায় নেই বললেই চলে।
আজকের দিনেও এই মানবতাবিরোধী, লাগামছাড়া, ভোগবাদী, ব্যাক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে মিডিয়াতে কোনো কথা নেই। কোনো আলোচনা নেই লাগামছাড়া পরিবেশ ধ্বংস ও অবিশ্বাস্য উষ্ণায়ন সম্পর্কে। কারণগুলোকে মানুষের চোখের থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছে আজকের এই মহাসংকটের দিনেও।
মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও আমেরিকার মিডিয়াতে মৃতদের ছবি দেখানো হয়না, তাদের পরিবারগুলোর, শিশুদের কান্না দেখানো হয়না।
তার ফলে যা হচ্ছে, এবং যা হবে এই মার্কিনি বিশ্বায়িত মডেলের কল্যাণে, তা হলো এই।
(১) এই মহামারী যখন কিছুটা প্রশমিত হবে, তখন সাধারণ মানুষের কথা না ভেবেই ওয়াল স্ট্রিট, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিজনেস ওয়ার্ল্ড খুলে দেওয়া হবে (ঠিক যেমন হয়েছিল ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর) -- যা ট্রাম্প এখনই করতে চাইছে মানুষের ভবিষ্যৎ বিপদের কথা না ভেবে।
(২) মানুষকে এই লকডাউন ও আইসোলেশনের নিয়মের বেড়াজালে পাকাপাকিভাবে বেঁধে ফেলা হবে, এবং মিটিং, মিছিল, সমাবেশ, রাজনৈতিক বিরোধিতা, এবং সাধারণ অর্থে সমাজ বলতে আমরা যে যৌথ জীবনযাত্রা বুঝি, তা বন্ধ হবে।
(৩) অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ওই ১%-মালিকানার বহুজাতিক ও বিশাল কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যাবে, এবং কারণ হিসেবে দেখানো হবে এই যে ছোট ছোট ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, ওষুধের দোকান, দৈনিক খুচরো বাজার, এবং যাবতীয় গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা যা আছে, তা আর চলছে না। যাকে বলে আমাজন অর্থনীতি (অথবা ভার্চুয়াল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থনীতি) তাই ক্রমে হয়ে যাবে "সাধারণ" বা নরমাল অর্থনীতি।
(৪) ডি-মানিটাইজেশন জাতীয় আইন আবার নতুন করে ফিরে আসবে, এবং তার সঙ্গে "দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির স্বার্থে" যেসব নতুন আইন পাশ হবে, তাতে আপনার আমার সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে, পেনশন থেকে, বীমা থেকে, পোস্ট অফিস থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। সুদের হার এখনই কমাচ্ছে ওরা, এবার আরো অনেক কমে যাবে।
(৫) তার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হবে একনায়কতন্ত্র, কারণ আমেরিকাতেই বলুন, বা ভারতে অথবা বাংলাদেশে -- একজন ছাড়া দুজন দেশনেতা বা নেত্রীকে আর চোখে দেখা যাচ্ছেনা এই সংকটের সময়ে -- আমরাও সেটাই মেনে নিয়েছি। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ, স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি সবকিছুই বাধ্যতামূলকভাবে মেনে নিতে হবে, এবং না মানলে জেল জরিমানা গুপ্তহত্যা ইত্যাদি রোজকার খুচরো জিনিসে পরিণত হবে।
মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র নামক প্রাণীটির এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ।
আমাদের সেই পুরোনো কলকাতায় হালখাতার ছোট ছোট দোকানগুলো। চুল কাটার সেলুন। রেশন থেকে তুলে আনা গম ভাঙানোর ঘুম ঘুম দোকানগুলো। মুড়ি তেলেভাজার দোকান। পাঁউরুটি বিস্কুট মেম খায় কুটকুট সাহেব বলে ভেরি গুডের দোকান। আমাদের রাস্তাছোঁয়া মেজেনাইন ফ্ল্যাটের ঠিক নিচে তারাপদবাবু স্যাকরার দোকান। বাড়ির সামনেই ছোট্ট লেদ মেশিনের কারখানা, যেখানে বারো কি পনেরো জন মিস্তিরি কাজ করে, আর কী যেন সব তৈরী করে মেশিনে। আমাদের নিতাইদার সাইকেল সারানোর দোকান, যেখান থেকে সাইকেল ভাড়া করে চালাতে শিখেছিলাম।
ওদিকে মাণিকতলা বাজার -- তার ভেতরে আর বাইরে নানারকম দোকান। ছোটবেলার ফুটবল ক্রিকেট খেলার বন্ধু কার্তিক পাল সেখানে ওদের চিঁড়ে বেসন মুড়কি ছোলাভাজার দোকানে এখন বসে ওর বাবা মারা যাবার পর। স্কটিশ ইস্কুলের আর এক বন্ধু যার সঙ্গে বুট পরে স্কুলের লীগে খেলতাম, সেই স্বপন সাহাদের কাঠচেরাইয়ের কল। ক্রিকেট খেলার রাইভ্যাল অসিত দাশ সরোজ দাশদের মিষ্টির দোকান যুগীপাড়ায়। এই প্রত্যেকটা দোকানে পয়লা বৈশাখ নববর্ষ হালখাতার কলাগাছ দেবদারু পাতা আর শোলার কদম ফুল দিয়ে সাজানো গণেশ পুজো এখনো পরিষ্কার মনে আছে।
যেন এই সেদিনের কথা।
কর্পোরেট আমেরিকার নিষ্ঠুর, মানবতা-ধ্বংসকারী অর্থনীতি ভারতবর্ষ প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করার পর এসব দোকানের অনেকগুলোই আস্তে আস্তে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। এবারে বাকিগুলোও যাবে। আমাদের কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোও চলে যাবে। বিশাল হাউসগুলো যাবেনা। বড় বড় সোনার গয়নার দোকান, সুপারমার্কেট, মল উঠে যাবেনা।
ছোট ছোট রাস্তার দোকানগুলো শেষ হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে বৈঠকখানা বাজারের বই বাঁধানোর দোকানগুলো। যাবে হ্যারিসন রোডের ট্রামলাইনের ধারের বিয়ে আর অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ কার্ডের দোকানগুলো। চলে যাবে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের মুখে বসা পরোটা, রুটি আর আলুর দমের সরু কাঠের বেঞ্চি পাতা দোকানগুলো।
শেষ হয়ে যাবে মঙ্গলবার বসা হাওড়ার মংলা হাট, রবীন্দ্র সেতুর ঠিক নিচে বসা ফুলের বাজার, বালিগঞ্জে রেল ব্রিজের তলায় চট পেতে বসা সন্ধের আবছা আলোয় গ্রামের দিদিদের লাউ, কুমড়ো, মোচা, জামরুল, থানকুনি পাতা বিক্রির পসরা। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি নিয়ে কলকাতার বাজারে আর আসবেনা। বংশীবদন না খেতে পেয়ে মরবে। ভাগ্নে মদন হারিয়ে যাবে কোথায়।
আরো কত দোকান, আরো কত ব্যবসা। আমার বন্ধুরাই অনেকে সেসব ব্যবসা গড়ে তুলেছে নিজের হাতে। যতটা পেরেছে সৎভাবে ব্যবসা করেছে এই দুর্নীতির যুগেও। চেষ্টা করেছে, কীভাবে গরিব কর্মচারীদের বিপদে আপদে তাদের পাশে থাকা যায়। এই নববর্ষের পরে আর তারা পারবে বলে মনে হয়না।
তাই বলছি "হয়তো এই শেষ নববর্ষ।" আমার জীবন সামনের পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত থাকবে কিনা, সেটা বড় কথা নয়। আমার দেশটা, আমার বাংলা দেশটা, আমার চেনা দুঃখ চেনা সুখ চেনা চেনা হাসিমুখের কলকাতা শহরটা থাকবে কিনা, সেটা অনেক বড় প্রশ্ন এই ১৪২৭ বাংলা সনের পয়লা বৈশাখে।
আজকের করোনাভাইরাস সঙ্কট হয়তো এক মাস, দু মাস, কিংবা তিন মাস পরে একটু কমবে। মানুষ হয়তো আবার একটু একটু করে রাস্তায় বেরোবে। বাচ্চারা স্কুলে যাবে। প্রেমিক প্রেমিকারা লেকের ধারে, কলেজ ক্যাম্পাসে, কিংবা রবীন্দ্রসংগীতের আসরে আবার একবার যাবে। হাত ধরবে। কিংবা ...
এমনও হতে পারে, এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার "অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তা" -- আর্জেন্ট নেসেসিটি দেখিয়ে শাসকশ্রেণী রবীন্দ্রজয়ন্তী, সভা সমাবেশ, মিটিং মিছিল, নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র সপ্তাহ, পৌষ মেলা, বারোয়ারি দোল দুর্গোৎসব, ঈদের মেলামেশা -- সবকিছুই একটু একটু করে নিষিদ্ধ করে দেবে। শাসকযন্ত্রের মিডিয়া হিন্দিতে চব্বিশ ঘন্টা প্রচার করবে, বাঙালিরা কেন রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল মেলা, বাউল গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেনা।
সেখানে একটাই মুখ প্রতিদিন দেখা যাবে -- সেই জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের বিগ ব্রাদারের মতো।
এবং আমরা সকলেই শাসকশ্রেণী এবং তাদের মিডিয়া প্রোপাগাণ্ডা নিঃশর্তে মেনে নেবো। যে মানবে না, তার জন্যে নানা ব্যবস্থা থাকবে।
"এই হয়তো শেষ নববর্ষ" আমাদের, বাঙালি জাতির। বাংলাদেশে একরকম। পশ্চিমবঙ্গে আর এক রকম।
আমেরিকার সঙ্কট, মৃত্যুমিছিলের কথা আমেরিকায় বসে লিখে যাচ্ছি একটানা। ভিডিওতে কথা বলছি ইংরিজিতে ও বাংলায়। এদেশের এই নির্মম শাসনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সিস্টেম, যেখানে সাধারণ মানুষকে কেবলমাত্র কর্পোরেট দানবের দানবীয় যন্ত্রের দানবীয় ক্ষুধার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার কথা লিখে যাচ্ছি এই মহাসংকটের মাঝখানে বসে।
যতদিন সুস্থ থাকবো, শরীর ও মন কাজ করবে, ততদিন লিখে যাবো, কথা বলে যাবো। ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু আছে কিনা জানিনা, কিন্তু যদি থাকে, আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এসব কথা পড়বে, শুনবে। সুদূর অতীতে আমেরিকার শাসকশ্রেণী মানুষকে কীভাবে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছিল, এবং তারপরে শেষ করে ফেলেছিলো, তার ইতিহাস জানতে পারবে।
সেই সিস্টেম কীভাবে আমাদের দেশ বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছিল, সে কথাও জানতে পারবে তারা।
--------------------------------
আমি অনেক কিছু লিখি। আমি যে সব বিষয়ে মহাবিশারদ, তা মোটেই নয়। কিন্তু বহু বিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট আছে। কলকাতায় বড় হয়েছিলাম, আর একটা অদ্ভুত ইস্কুলে পড়েছিলাম। আর একটা অদ্ভুত শহরে, সমাজে জীবন কেটেছিলো। সেখানে আকাশে, বাতাসে সূর্যের আলোর মতো জ্ঞানের, জ্ঞানপিপাসার আলো ছড়ানো ছিল। সেখানকার বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রতি মুহূর্তে বাঙালির চেতনার সবচেয়ে মহামূল্যবান রত্ন -- মনের উদারতা -- জানালা দরজা দিয়ে আসা রোদের মতো, বৃষ্টির ছাঁটের মতো হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে প্রবেশ করতো।
এতো ন্যাচারাল ছিল সেই শিক্ষা, যে মনেই হতোনা, শিখছি। তাই, ফুটবল, ক্রিকেট, রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ, নজরুল, সুনীল সমরেশ পরশুরাম লীলা, সত্যজিৎ মৃণাল ঋত্বিক, বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর, আবার প্রীতিলতা সূর্য সেন ক্ষুদিরাম বিবাদী বাগ থেকে চারু মজুমদার জ্যোতি বসু দেবব্রত বিশ্বাস সুচিত্রা মিত্র নির্মলেন্দু চৌধুরী থেকে শুকতারা কিশোর ভারতী সন্দেশ আর দেব সাহিত্য কুটির। আর একটু বড় হলে জগদীশ বসু সত্যেন বসু মেঘনাদ সাহা খোরানা জেনেটিক কোড। সায়েন্স কলেজে জীববিদ্যা থেকে ভাইরাস।
এই হলো আমাদের বাঙালি চেতনা, যা সেই রামমোহন রায় ডিরোজিও আর হিন্দু কালেজ আর উইলিয়াম কেরি আর শ্রীরামপুরের প্রেস থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের একটা অদ্ভুত জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছে। সেই গ্যালাক্সির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহ হলাম আমি। ওদের সূর্যের, নক্ষত্রের আলোতে আমি আলোকিত।
সেই আলোতে জীবন কাটাই। সেই আলোতে পথ দেখি। সেই আলোতে করোনাভাইরাস ও আউট অফ কন্ট্রোল অমানবিক ওয়াল স্ট্রিট অর্থনীতির বিশ্লেষণ করি। যে অর্থনীতিতে মানুষ মারার জন্যে ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ থাকে। আর মানুষ বাঁচানোর জন্যে খুদকুঁড়ো।
--------------------------------
"দাদা, আমেরিকার কথা জেনে আমাদের কী হবে?" -- এ প্রশ্ন খুব বেশি শুনতে হয় আজকাল। এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক, কারণ প্রথম হলো, ওখানে মানুষ শেষ হয়ে যাচ্ছে ভয়েতে, নানা আশঙ্কায়, বিজ্ঞান না জানার কারণে নানা কনফিউশনে। মিডিয়া ক্রমাগত মৃতের সংখ্যা বলে যাচ্ছে -- যেখানে এক মিডিয়া থেকে আর এক মিডিয়াতে মানুষ যাচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার না কি আসলে সাড়ে ছ হাজার তা ভেরিফাই করবার জন্যে।
দেশে মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের লকডাউন ভেঙে রাস্তায় নেমে আসার ছবি। মার খাওয়ার ছবি। কুকুর আর মানুষ রাস্তায় গড়িয়ে যাওয়া দুধ চেটে চেটে খাচ্ছে, তার ছবি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সঙ্গে একটা ইন্টেলেকচুয়াল তুলনা মকাইবাড়ি চায়ের সঙ্গে, কিংবা আরো এলিট মহলে জ্যাক ড্যানিয়েলস গ্লাসের সঙ্গে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের তুলনাও আসছে মাঝে মাঝে।
যেন একটা নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজনা। ফেটিশ। স্যাডিজম।
যেটা নেই সেটা হলো অর্থনীতি, রাজনীতির বিশ্লেষণ। কেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী দেশে হাসপাতালে নার্সরা গার্বেজ ব্যাগ পরে কাজ করছে কারণ মেডিকেল গাউন আর নেই -- সে কারণ অনুসন্ধানটা, ফেস টু ফেস চ্যালেঞ্জটা এই মকাইবাড়ি জ্যাক ড্যানিয়েলস এলিট আলোচনায় নেই। কেন নিউ ইয়র্ক শহরে মাস ফিউনারেল চলছে, তার বিশ্লেষণ নেই।
কেন মোদীর মুখ সর্বক্ষণ টিভিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তিনি কোনো সমাধানের রাস্তা একেবারেই দেখাতে পারছেননা, সে চ্যালেঞ্জ নেই।
গ্রামের মানুষ, কৃষকরা না খেতে পেয়ে আছে, কারখানা বন্ধ, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষ ফেলে যাওয়া দুধ চেটে খাচ্ছে -- এসব নিয়ে কোনো আলোচনা, বিশ্লেষণ নেই। কেন একটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মডেল নিউ ইয়র্ক বা মুম্বাইয়ের মতো শহরে কয়েক শো গজের মধ্যে ট্রাম্প কিংবা আম্বানির সামনেই হতদরিদ্র মানুষ ঝুপড়িতে থাকবে, আর মরে যাবে -- তার আলোচনা নেই।
আমাকে অনেকে বলেন, কী করা যাবে? এটাই তো নরমাল। আমি বোধহয় নেহাৎই মূর্খ, তাই নরমালকে চূড়ান্ত অ্যাবনর্মাল মনে করি।
কেন ট্রাম্প, মোদী আর ব্রেজিলের বলসেনারো একটানা বিজ্ঞানবিরোধী, প্রাগৈতিহাসিক কুসংস্কারের নিদান এই সেদিন পর্যন্ত আমাদের দিয়ে এসেছেন, সেই স্মৃতি শিক্ষিত মানুষের মন থেকে লুপ্ত। স্মৃতিকে শেখানো যায় কনভেনিয়েন্ট স্মৃতি রেখে দিয়ে অপ্রিয়, কষ্টদায়ক, বিবেক-পীড়ণকারী স্মৃতিগুলোকে, তথ্যগুলোকে বাদ দিয়ে দিতে। আজকের শিক্ষিত ও এলিট মার্কিন সমাজ, এবং আজকের শিক্ষিত বাঙালি ও ভারতীয় সমাজ আর কিছু না হোক, এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিজের জীবনে আক্ষরিক অর্থে কাজে লাগিয়েছেন।
সুতরাং, সিলেক্টিভ রিটেনশন অফ মেমরি যেখানে এতো চমৎকার কাজ করে মকাইবাড়ি বা জ্যাক ড্যানিয়েলস মানুষের কাছে, সেখানে আমেরিকার বডি ব্যাগ বা গার্বেজ ব্যাগের আলোচনা সেখানে আর কেন?
ওগুলো নির্বাচন করে ফেলে দেওয়া স্মৃতির মতোই। গার্বেজ ব্যাগে ভরো, আর ধাপার মাঠে গিয়ে ফেলে দাও।
সেই মাঠে শীতকালে ভালো কপি চাষ হবে।
"এটাই কি নরমাল নয়?"
একবার মানুষকে যদি মিডিয়া বা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে মগজধোলাই করানো যায় যে চারদিকে যা দেখছি, তা আপাতদৃষ্টিতে চূড়ান্ত অ্যাবনরমাল এবং ঐতিহাসিক মহাসঙ্কট বলে আমার মনে হলেও তাকে একরকম নরমাল বলেই বিশ্বাস করতে হবে, তাহলে শাসকশ্রেণীর অর্থাৎ যে কোনো দেশে যাদের হাতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা আছে, তাদের সম্পূর্ণ একচ্ছত্র ক্ষমতা কায়েম করতে আরো সুবিধে হয়ে যায়। এই করোনাভাইরাস রোগের বিশ্বজোড়া মহামারী এবং তার কারণ অনুসন্ধানের ও বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ অভাব আমাদের চোখে এই বিষয়টা আরো পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেয়।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে এই বিশ্লেষণটা একে একে করা যেতে পারে।
(১) সামাজিক "নরমাল" -- সমাজের শীর্ষে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে আমাদের দেশে এবং এদেশে এই আমেরিকাতেও খুব বড় ভূমিকা আছে পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের কর্তার। এবং ধর্মীয় নেতাদের। অর্থাৎ, গির্জা, মসজিদ, মন্দির, সিনাগগ। আজকে এই মৃত্যুর মহামিছিলের মধ্যেও আমেরিকার অতি-রক্ষণশীল দক্ষিণের চার্চগুলোতে জমায়েত, প্রার্থনা সবই চলছে। উত্তর-পূর্বের নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ম্যাসাচুসেটস, ভারমন্ট, নিউ হ্যাম্পশায়ার বা পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফোর্ণিয়া, ওয়াশিংটন রাজ্য বা ওরেগনের মতো "অধার্মিক" লিবারাল জায়গাগুলো বাদ দিলে ধার্মিক আমেরিকা বিশেষ কোথাও রবিবারের চার্চ প্রার্থনা বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনিনি।
অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও বড় বড় শহরে -- যেমন শিকাগো, ডেনভার, সেন্ট লুইস, ক্লিভল্যাণ্ড, ফিনিক্স জাতীয় জায়গায় চার্চের বা ইহুদি সিনাগগের জমায়েত হয়তো সাময়িকভাবে স্থগিত আছে। বাকিরা ঠিক ওই আমাদের বাংলাদেশ বা ভারতের মসজিদ বা মন্দিরের ধর্মান্ধ জনতার মতোই। হয়তো আমাদের দেশের মতো রাস্তায় নেমে পাথর ছুঁড়বেনা, কারুর বাড়ি বা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবেনা। কিন্তু মানসিকতা একেবারেই একরকম। ভুলে যাবেননা, দুশো বছর ধরে এরাই বাইবেল দেখিয়ে কালো মানুষদের ক্রীতদাস করে রেখেছে, আর চাবুক মেরে গাছে টাঙিয়ে দিয়েছে।
বর্ণবিদ্বেষের ঘাঁটি টেক্সাস, মিসিসিপি, অ্যালাবামা, কেন্টাকি, জর্জিয়া এসব জায়গায় প্রায় সর্বত্র খৃষ্টান চার্চ সানডে ওয়ারশিপ চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো বিজ্ঞান, কোনো সামাজিক মহাসঙ্কটই এদেরকে কোনো কিছু বোঝাতে পারবেনা। এই নিউ ইয়র্ক শহরে আমাদের ব্রুকলিন এলাকার সিনাগগ আর গোঁড়া ইহুদি কমিউনিটি দুদিন আগেও বড় বড় সমাবেশ করেছে, সরকারি কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে।
আমাদের দেশের মতোই এদের কাছে এখনো যা হচ্ছে, তা "নরমাল।" ঠিক আমাদের দেশের মতোই এদের কাছে এই মহাসঙ্কট ঈশ্বরের (আল্লাহ, গড, জিহোভা বা ভগবান) নতুন পরীক্ষা। না, ঈশ্বরকে পরীক্ষা করা নয়, বা তিনি কোথায় আছেন এই মড়কের সময়ে, সে সম্পর্কে কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। বলা হচ্ছে, ঈশ্বর এই মহামারী পাঠিয়েছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যে। যারা এই পরীক্ষায় উৎরে যাবে, তারা বিশ্বাসী বলে প্রমাণিত হবে। যারা টেঁসে যাবে, তারা অবিশ্বাসী। মুশকিল হলো, গরীবগুলোই সব অবিশ্বাসী প্রমাণিত হচ্ছে এই স্বর্গীয় এক্সপেরিমেন্টে। অথচ, তারাই চার্চে, মসজিদে আর মন্দিরে বেশি ভিড় জমায়। বিল গেটস, জেফ বেজোস, ব্লুমবার্গ বা আমাদের দেশের আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লাকে নিয়মিত ধর্মস্থানে হাজিরা দিতে কখনো দেখা যায়নি।
(২) অর্থনৈতিক ও এবং (৩) রাজনৈতিক "নরমাল" -- এই আমেরিকায় দু কোটিরও বেশি পুরুষ ও নারী কর্মচুত্য বেকার রাতারাতি। এই নিউ ইয়র্কে সমস্ত ছোট ও মাঝারি রেস্টুরেন্ট, পারিবারিক দোকান, ব্যবসা, চুল কাটার সেলুন, জামাকাপড়ের দোকান, মেয়েদের প্রসাধনের সালোন, বা এই ধরণের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিয়নের আওতায় থাকা নানা পেশার শ্রমিক কিছু মেডিকেল ইনস্যুরেন্স এবং আমাদের মতো বৈধ ইমিগ্রেন্ট শ্রমজীবীরা, শিক্ষক শিক্ষিকা, নার্স ইত্যাদিরা সরকারি বেকার ভাতা পাচ্ছি বটে, কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী, এবং আসল বেতনের চার কি পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অথচ, ভারত বা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশেও এই মহামারীর কারণে সরকারি চাকরি কারুর যায়নি। আমাদের দেশের কথা ছেড়ে দিন, কারণ সেখানে বলা হয় চাকরি পাওয়া ভারী শক্ত, কিন্তু চাকরি যাওয়া আরো শক্ত। কিন্তু আমেরিকার সমান্তরাল ধনী দেশ প্রতিবেশী ক্যানাডা, আর ওদিকে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের নানা দেশ -- কোথাও আমেরিকার মতো কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই রাতারাতি কোটি কোটি মানুষকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে, এমন শোনা যায়নি।
অথচ, আমেরিকায় এই হলো নরমাল। মানুষ এই সিস্টেমেই অভ্যস্ত। চাকরি গেছে। আবার চাকরি পাবে -- এই "চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুখানি চ সুখানি চ" -- এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে গত তিরিশ কি চল্লিশ বছরে। কেউ জানেই না, অন্য পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এভাবে চাকরি যায়না। কেউ ভাবতেই পারেনা। কিউবা অথবা ভিয়েতনাম অথবা ভেনেজুয়েলা হবার দরকার নেই। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম -- কোথাও আমেরিকার মতো এতো নিষ্ঠুর পুঁজিবাদ রয়েছে বলে আমার জানা নেই।
বিশ্বায়িত অর্থনীতির সবচেয়ে বড় লাভের গুড় তুলেছে বহুজাতিক মার্কিনি কর্পোরেশনগুলো। জেনারেল ইলেকট্রিক থেকে ডিজনি, অ্যাপল থেকে মাইক্রোসফট, আইবিএম থেকে আমাজন। ইএসপিএন থেকে ফক্স। গ্যাপ থেকে ওয়াল মার্ট। কোক পেপসি থেকে ম্যাকডোনাল্ড আর কে এফ সি। যুদ্ধ কর্পোরেশনগুলো। অথচ, মার্কিনি জনতা জানেইনা, সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পুঁজিবাদের চেহারা কেমন, মানবতা যে এখনো সেসব জায়গায় একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, আর এই মহাসঙ্কটে সাধারণ মানুষকে যে একেবারে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়নি -- সে খবর মার্কিন মিডিয়া ও সিকির দুই পিঠের মতো দুটো দলের নেতা নেত্রীরা মানুষকে জানতেই দেয়নি।
আজকের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরেও এই আলোচনা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যারা সে আলোচনা তুলেছিল, তাদের শেষ করে দিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন এবং ট্রাম্পের ফক্স।
পুঁজিবাদ মানেই প্রাইভেট। পুঁজিবাদ মানে শ্রমিকরা মালিকের দয়াভিক্ষাকারী। পুঁজিবাদ মানে ইউনিয়ন অনুপস্থিত। পুঁজিবাদ মানে চাকরি চলে গেলে মেডিকেল ইনস্যুরেন্সও চলে যাওয়া। পুঁজিবাদ মানে ধার করা। পুঁজিবাদ মানে টাকা না থাকলে ছেলেমেয়েকে কলেজে পড়াতে না পারার অক্ষমতা।
আর অন্য কোনোরকম কথা মানেই তুমি কমিউনিস্ট এবং আমেরিকা-বিরোধী। তোমার কথা আমরা শুনবোনা।
এই মডেল এখন ভারতে, বাংলাদেশে। ভারতে করোনাভাইরাসের এই মহাসঙ্কটের কালে বলি হচ্ছে প্রান্তিক শ্রমিকরা, ক্ষুদ্র চাষিরা, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার মজুররা, আর প্রাইভেট ফার্মে কাজ করা নতুন প্রজন্মের হোয়াইট কলার ক্রীতদাসরা। এই এখন মোদী-শাহ-মোহন ভাগবত আরএসএস গোমূত্র ভারতের নতুন নরমাল। এখানে প্রশ্ন, চ্যালেঞ্জ, বিতর্ক, বিশ্লেষণ বন্ধ। এখানে ইতিহাসের পর্যালোচনা বন্ধ। এখানে মুখে বেঁধেছি মাস্ক, আর করে চলেছি মালিক-নির্ধারিত টাস্ক।
রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ, অচলায়তন এখন আবার তার আদিম দশায়। জ্যানুস করজাক এই ডাকঘরের কথা কল্পনাও করতে পারেননি। ট্রেবলিঙ্কা হলোকস্ট ক্যাম্পও আজকের দিনে নতুন নরমাল বলেই পরিচিত হতো।
এখানে সে সময়কার এসএস এখন আর এক নতুন রূপে আবির্ভূত। নতুন নামে পুরোনো মদ নতুন বোতলে।
#দেবজিৎ_দত্ত
(সহকারী অধ্যাপক,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)
লিখেছেন
আমাদের দেশের করোনার মোকাবেলাকে অনেকটা লোকালয়ে বাঘ বের হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। বাঘ শিকারের অতীত অভিজ্ঞতা কারোর নেই, সেই ক্ষেত্রে কার কি ভূমিকা হতে পারে:
#কেন্দ্রীয়সরকার: সবাইকে ঠিক সময়ে জানিয়েছে জঙ্গল থেকে হিংস্র বাঘ রেড়িয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছে, তাই সরকার সিদ্ধ্যান্ত নিয়েছে যতদিন পর্যন্ত বাঘ কাউকে সামনে না পেয়ে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মারা না যাবে, ততোদিন কারো বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ।
#রাজ্যসরকার: কোনো বাঘ বের হয়নি, ওটা বাঘ নয় বন বিড়াল, ভয় নেই গরমেন্ট আপনাদের পাশে আছে, কিন্তু তাও সাবধানের মার নেই ঘরে থাকুন। আপানাদের জন্য কন্টেনমেন্ট কেজ করে দেওয়া হয়েছে বাঘ যতদিন না ধরা পড়ে আপনারা নিজেরাই ওতে বন্দী থাকুন।
#জনগন: ঘরে থেকে বাঘ নিয়ে পড়াশোনা করছে। বাঘ কি রকম, বাঘের পূর্বপুরুষ কারা, বাঘ কি ধরনের মানুষ খেতে পছন্দ করে, কি ভাবে কেউ কেউ বাঘের মুখে পড়েও বেচে গিয়েছিল, কোথায় কোথায় বাঘের উপদ্রব বেশী হচ্ছে, কেন বাঘ মারার বন্দুক আবিষ্কার করা যাচ্ছে না ইত্যাদি। কিছুদিন পরে যখন তাদের এলাকাকে বাঘের উপদ্রবের ভিত্তিতে নানা ভাবে ভাগ করা হল তখন:
#গ্রীনজোন: এদের বাড়ির চারপাশে বাশের পুরানো বেড়া দেওয়া আছে, তাই এরা ভাবছে বাঘ এদের বাড়িতে ঢুকতে পারবে না, তাই এদের খুব মজা।
#অরেঞ্জজোন: এরা এক ঝলক বাঘ দেখেছে কিন্তু তারপরই বাঘ কোথায় যেন পালিয়ে গেছে, তাই এরা কি করবে বুঝতে পারছে না।
#রেডজোন: এরা বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ টের পাচ্ছে, বুঝছে বাঘ আশেপাশেই আছে কিন্তু বাঘ ঠিক কোথায় তা জানে না ফলে চরম আতংকে।
#মিডিয়া: সারাদিন দেখাচ্ছে বাঘ এই যায়গা থেকে ওই যায়গায় চলে গেল। কাকে কাকে খেল আর সন্ধা বেলা কিছু শিকারী এবং কিছু সর্বজ্ঞ গল্প দাদুদের নিয়ে আলোচনায় বসছে যে কি কি করতে হবে, কেন বাঘ ধরা পড়ছে না ইত্যাদি।
#রাজনৈতিকনেতা: কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক নেতারা বলছে বাঘ ঠিক কোথায় দেখা গিয়েছিল সেই তথ্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে দিচ্ছে না, ফলে উপযুক্ত যায়গায় টোপ বসানো যাচ্ছে না, শিকারী টোপ বসাতে গেলেও ওদের গাইড করছে না, বাঘের টোপ হিসাবে যে হাস-মুরগি পাঠানো হয়েছিল তা রাজ্য সরকার বেচে দিয়েছে।
রাজ্য সরকারের সমর্থক নেতারা বলছে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর সংখ্যায় টোপের বন্দোবস্ত করছে না কেন? যে হাস-মুরগি গুলো টোপ হিসাবে পাঠানো হয়েছে তারা দুর্বল, ফলে বাঘ ওগুলো খাচ্ছে না, বাঘ মারতে উপযুক্ত বন্দুক পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
#প্রধানমন্ত্রী: শিকারীর বন্দোবস্ত না করেই বাঘ মারার জন্য মাঝে মাঝে প্লেন থেকে মাংসের টুকরো ফেলছেন ফলে বাঘ ওই মাংস খেয়ে আরো নাদুসনুদুস হচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছেন বাঘ তাড়ানোর জন্য বাড়িতে লাইট সারা রাত আলো জ্বালিয়ে রাখতে, বোম-পটকা মজুত করতে।
#মুখ্যমন্ত্রী: বাঘ নিয়ে খুব চিন্তিত, অনেক সময় খালি হাতেই বাঘ মারতে বেড়িয়ে পড়ছেন, পরে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
#রাজ্যপাল: দিনরাত শুধু বাঘ নিয়ে উপন্যাস লিখে চলেছেন এবং বলছেন উনি চান বাঘ মারা পড়ুক এবং বাঘ মারার ক্ষেত্রে তিনি সাহায্য করতে চাইলেও কেউ তাকে ব্যবহার করছেন না।
#মুখ্যসচীব: প্রতিদিনই বিকালে বলছেন বাঘ অমুকের পা খেয়ে নিয়েছে, তমুকের হাত খেয়ে নিয়েছে কিন্তু একটা পা, একটা হাত বাদেও আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুশী, সুস্থ আছেন এবং বলছেন এই আধখাওয়া মডেলই নাকি দেশের সেরা।
#আইসিএমআর: রোজ শুধু গ্রাফ বানাচ্ছে আজ কত জনকে বাঘে খেল, কতটা খাওয়ার পর আর বাঘের খবার ইচ্ছে চলে যাবে, রোজ বাঘের যাত্রা পথের নকশা করে চললেও বাঘকে কি করে মারা হবে সে নিয়ে কোনো দিশা দিতে পারছে না।
এই কাল্পনিক সংলাপ দেখে নিশ্চই আমাদের প্রশাসন, নেতা, মন্ত্রী এবং বাকিদের বাঘ মারার প্রস্তুতি নিয়ে একটু ধারনা হল এবং আশা করি করোনা নিয়েও এনাদের এযাবৎ করা উদ্যোগের চিত্র খানিকটা পরিষ্কার হল, তাই বাঘ মারার মতো যখন করোনা নিয়েও কারো কোনো সঠিক প্রস্তুতি নেই, অভিজ্ঞাতা নেই তখন কি করলে আপনি বাঘের পেটে, মানে করোনার কবলে পড়বেন না তা নিজেই ঠিক করুন।
কিছু পশ্ন পাপী মনে কিন্তু আসছে বস
১ আম্রিকা পুঁজিবাদী জেনেও চাকরি করতে দেশি লোক যায় কেন আর গিয়ে সবুজ পাত্তি ম্যানেজ করে পুঁজিবাদ এর পিন্ডি চটকায় কেন ?
২ ডেমোক্রাট রা এইসব লেখার জন্য ঠিক কিরকম ডিল দেয় ?