ওপরের শিরোনামটি ধার করা। একটা বিখ্যাত ডকুমেন্টারি আছে এই নামে। কিন্তু কাহিনীটা অরিজিন্যাল। কারণ লৌন্ডা নাচে বিহারে বা উত্তরপ্রদেশে সাধারণত অল্পবয়েসী ছেলেরা মেয়ে সেজে কনের বাড়িতে গমনেচ্ছু বারাতিদের সামনে নেচে নেচে আনন্দ বর্ধন করে। কিন্তু প্রত্যেক বছর মূলত উত্তরবঙ্গ থেকে দেহে পুরুষ, কিন্তু মনে নারী যে বিপুলসংখ্যক অর্ধনারীশ্বররা লৌন্ডা নাচতে যায় তাদের কথা বড় কেউ জানে না। তাদের একজনই বসে আছে এ গল্পের কেন্দ্রে। মনেপ্রাণে নারী সেই হিয়া দাসের কথা এবারের নারীদিবসে।
মালদায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িতে বড় হলেও নিজের রোখে কলেজের পড়া শেষ করেছিল সে। সহপাঠি এবং অন্যান্যদের ঠাট্টাবিদ্রুপের শিকার হয়েও। কিন্তু চাকরির কোনো ব্যবস্থা তো সমাজ এবং রাষ্ট্র করে রাখেনি, রাখেও না। বাধ্য হয়ে দুটো অপশন থাকে সামনে - হয় হাতে তালি দিয়ে রাস্তায় নামা অথবা আদিম পেশার হাতছানি।
কোনটাই করবে না জেদি হিয়া, তাই সে একদিন ট্রেনে চাপলো বিহারে যাবে বলে।
তখন বিয়ের সিজন। কপাল ভালো থাকলে দিনে দু তিন হাজার টাকা, কী আরো বেশি রেট যাবে লৌন্ডা নাচের। কোনো প্রথাগত তালিমের দরকার নেই। শুধু আদিম ভঙ্গীতে শরীরে অশ্লীল মোচড় যতো ভালো দিতে পারবে নাচিয়ে, ততোই হাততালি, ততোই উত্তেজনা। সবাই একটু ছোঁবার জন্য ধাক্কাধাক্কি করবে, টাকার মালা ছিটকে পড়বে গলায়, আর চারপাশে শুধু মুগ্ধ লোলুপ পুরুষদৃষ্টি। এমনকি যার বিয়ে সেই বরও চুপি চুপি এসে লৌন্ডা নাচিয়ের শরীর চায়। বরের ভাই, জেঠা, বন্ধু, সবাই, সবাই ! এ এক আদিম পৃথিবী, যেখানে, কাম ছাড়া আর কোন আবেগ নেই ! কোনো পুরুষ যদি বিবাহিত স্ত্রী ছাড়াও লৌন্ডা নাচনীকে রক্ষিতা হিসেবে রাখতে পারে, পৌরুষের সঙ্গে স্টাটাস সিম্বল মিলেজুলে সে হয়ে উঠবে এক বিরাট পুরুষ।
কেন রূপান্তরকামীদেরই রক্ষিতা হিসেবে চায় এরা ? এর পেছনে রয়েছে সহজ হিসেব। রক্ষিতা পুরোপুরি নারী হলে সন্তান, সন্তানের পেছনে সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি নানান ল্যাঠা। সামাজিক বিধিনিষেধ অব্দি গড়ায় ব্যাপারটা। উল্টোদিকে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে কোনো রূপান্তরকামীকে জড়িয়ে রাখা গেলে টাকাপয়সার ব্যাপারটাও অনেকটা হিল্লে হয়। সেইই তখন 'নাচানিয়া'-র পেশা থেকে আনা রূপাইয়ার ভাগ দেবে তার বাবুকে। সেক্স তো সেক্স, পয়সা, প্রেস্টিজ সব উশুল।
পিতৃতন্ত্রের হিসেবের কড়ি বাঘেও খায় না !
একজন নাচানিয়াকে 'বড়া লগনে' ( গ্রীষ্মকালের তুলনায় বড় দিনগুলোতে যে বিয়ের লগ্ন) শীতকালের 'ছোটা লগনে'র থেকে নাচতে হয় অনেক বেশি সময়, তার উপার্জনও হয় অনেক বেশি। কিন্তু প্রাণ বেরিয়ে গেলেও সে নাচের সময় কোন বিশ্রাম নিতে পারবে না। ক্ষিধে পেলে খাওয়া তো দূরের কথা, দশ বার ঘন্টা প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিয়েও থাকতে হতে পারে তাকে। বেশ কয়েক কিলোমিটার তাকে নাচতে নাচতে যেতে হয় যতোক্ষণ না গন্তব্য আসে। এই রাস্তাটুকু, হিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, নরকে যাবার রাস্তার মতোই। তুমুল বাজনার ভ্যাপ্পরভ্যাঁপোতে নাচানিয়ার কোনো প্রতিবাদ, কোনো আর্তনাদ শোনা যাবে না এই বিবেচনায় বরযাত্রীরা তাকে ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকে। লোভী হাত ঘুরে বেড়ায় সারা শরীরে, কেউ এসে কোলেই তুলে নিল হয়ত বা, নখের আঘাতে ফালা ফালা হয়ে যেতে পারে গলা, বুকের দৃশ্যমান অংশটুকু।
সেটুকু হলেও কথা ছিল। হিয়া বলতে বলতে সলজ্জ হাসে। তবু সে সব কথা খুলেই বলে। বরাত পৌঁছে গেলে একজায়গায় বরের ভাই এসে তার চোখ, ঠোঁটের বেজায় প্রশংসা করতে থাকে। ব্যাপার বেগতিক দেখে হিয়া তাকে শুরুতেই নিরস্ত করার চেষ্টা শুরু করে, কারণ অবাধ্যতার শাস্তি এখানে বন্দুকের গুলি। কদিন আগেই খবরের কাগজে এমন খবর আমরা দেখেছি। তাই সে বলে, -ইসব মেকাপ কা কামাল বাবুজি। মেকাপ উতার দুঙ্গি, তো দেখোগে...
কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। পুরুষটি বলে মেকাপ তুলে দিতে পারো, চোখ তো একই থাকবে, ঠোঁটের গড়ন কী আর পাল্টায়, মেরি জান, মেরি বুলবুল!
ট্রাকের মাথায় সারা রাত লুকিয়ে থেকে সে যাত্রায় রক্ষা পায় হিয়া।
লৌন্ডা নাচিয়েকে এইসব খপ্পর থেকে অটুট বেরোতে হয় অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে। কেউ পারে কেউ পারে না। যে নাচিয়েরা হারিয়ে যায় তাদের নাম আর কখনো কেউ নেয় না। যারা অত্যাচার, বিশ্রী যৌনরোগের শিকার হয় তাদের কপালে অশেষ দুর্ভোগ। আর যারা মোটামুটি অক্ষত বেরিয়ে আসতে পারে, আর কখনো যাব না, এই প্রতিজ্ঞা তিনশ তেত্রিশ বার করেও আবার তারা রেলগাড়ি ঝমাঝম চাপে। কারণ চারপাশের ঘৃণা আর কর্মহীনতা।
একটা মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে তো ! তাই শিলিগুড়ির একটি এনজিও থেকে নাচতে যাবার সময় রূপান্তরকামীদের মধ্যে দেদার বিলি করা হয় কন্ডোম আর নানা ওষুধবিষুধ। বেঁচেবর্তে ফিরে এসো তো বাপু, তারপর দেখা যাবে।
তবে হিয়ার গল্প যদি এখানেই শেষ হতো, তাহলে নারীদিবসে আলাদা করে তার কাহিনী ফেঁদে বসতাম না।
গ্র্যাজুয়েশন তো আগেই কমপ্লিট করেছিল সে, নাচানিয়ার জীবন ভালো না লাগায় সে চলে আসে কলকাতায়। তার পাশে দাঁড়ায় প্রান্তকথা, বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় যে এনজিও-র কর্ণধার। প্রয়োজনীয় ট্রেণিং শেষ করে সে এখন একটি কর্পোরেট হাসপাতালে ওটি এটেন্ড্যান্ট। ভারতে প্রথম রূপান্তরকামী যে এখানে পৌঁছতে পেরেছে। হিয়াকে খুব সুখী লাগে যখন সে বলে, -এই হাতে কতো বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে। নিজে তো কখনো মা হতে পারব না। সন্তানকোলে মায়েদের হাসিমুখ দেখলে সার্থক লাগে।
কিন্তু আমরা তো পাল্টাইনি, সমাজও পাল্টায়নি। তাই অনেক আগে যে শিশু মাথায় গামছার বিনুনি পাকিয়ে, লিপস্টিক পরে মেয়ে সাজতে চাইতো বলে অনেক নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে, তাকে এখনো সারাদিনের পরিশ্রমের পর অনেক কষ্টে জোটানো চিলতে ভাড়া বাড়িতে ফিরে জামাকাপড় পাল্টাবার সময় চমকে উঠতে হয়। ঘুলঘুলিতে উঁকি মারছে কারো উৎসুক চকচকে চোখ।
সারা জীবনভোর এই নিগ্রহের মাঝে হতাশ লাগে, ওর খুব হতাশ লাগে। এই মাইনেতে চলে নাকি মালদায় বাবার অতো বড় সংসার ! আর প্রেম ? নিজের সংসার ? অসুখবিসুখ ?
হিয়া মুখে বলে না, কিন্তু ওর অন্যমনস্ক চোখ দেখে মনে হয় লৌন্ডা নাচের প্রচুর কাঁচা পয়সা, পুরুষের চোখে কাঙখিত হয়ে ওঠার ঝলমলে কিন্তু বিপদসংকুল দিন আর বর্তমানের এই কৃচ্ছসাধন, হীনমন্যতা আর সমাজের একচোখোমির মধ্যে যে বৈপরীত্য তা ওকে পীড়া দেয়।
হিয়া নাচানিয়া আর হিয়া ওটি টেকনিশিয়ানের নীরব দ্বন্দ্বের কোনো আসান নেই জেনে ওর মধ্যেকার লড়াকু নারীসত্ত্বাটিকে কুর্ণিশ করে আমি বিদায় নিই।
বেঁচে থাকো হিয়া ! এই লড়াইতেও জয়ী হও !
নাম পরিবর্তিত, ছবিটি হিয়ার অনুমতিক্রমে দেওয়া।
“কেন রূপান্তরকামীদেরই রক্ষিতা হিসেবে চায় এরা ? এর পেছনে রয়েছে সহজ হিসেব। রক্ষিতা পুরোপুরি নারী হলে সন্তান, সন্তানের পেছনে সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি নানান ল্যাঠা। সামাজিক বিধিনিষেধ অব্দি গড়ায় ব্যাপারটা। উল্টোদিকে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে কোনো রূপান্তরকামীকে জড়িয়ে রাখা গেলে টাকাপয়সার ব্যাপারটাও অনেকটা হিল্লে হয়। সেইই তখন 'নাচানিয়া'-র পেশা থেকে আনা রূপাইয়ার ভাগ দেবে তার বাবুকে। সেক্স তো সেক্স, পয়সা, প্রেস্টিজ সব উশুল।“
প্রতিভা দি,
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বোধহয় বাদ পড়েছে। এটি হচ্ছে, উভকামীতা। সমাজে এই শ্রেণী নিছক কম নেই, যারা বৈচিত্রতার সন্ধানে রূপান্তরকামীদের কামনা করেন।
ওপারে যা “লৌন্ডা“ এপারে বৃহত্তর ময়নসিংহ-সিলেট হাওরাঞ্চলে তাই-ই “ঘেঁটু“ বা “ঘাঁটু“ নাচগান হিসেবে পরিচিত একটি প্রাচীন সামন্ত সংস্কৃতি ছিল, যা এক-দেড়শ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে বলে জানা যায়। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের লেখা ও পরিচালনায় এই নিয়ে একটি সিনেমাও আছে, নাম – “ঘেটুপুত্র কমলা“। সেই সিনেমা থেকে এই ভিডিও ক্লিপিং দেখতে পারো :
হিয়াদের কথা আর কে ভাবে, তোমার মতো, এমন করে দিদি? আরো লেখ।