দেশে সর্বনাশা কাণ্ডের তো অভাব নাই। কয়টা লেখব? তামাশা তো চলছেই, থামাথামির কোন লক্ষণ তো নাই। সরকার এই কয় মাসে বিপুল আগ্রহ নিয়ে যে কাজটা করল তা হচ্ছে সংস্কার নামের এক মুলা ঝুলানো। সংস্কারের মধ্যে সবার আগে যে নাম এসেছে তা হচ্ছে সংবিধান! পরিমার্জন না সংশোধন কী হবে এই নিয়ে কত তর্ক। কেউ আগেরটাকে স্রেফ ফেলে দিতে চায়। এই মুলার একটা চেহারা অবশেষে দেখা গেছে। আমেরিকান নাগরিক আলী রিয়াজ প্রচুর গবেষণা করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সংবিধান রচিত হইছিল সেখান থেকে চার মূলনীতির তিনটাই বাদ দিয়েছেন। শুধু গণতন্ত্র টিকে আছে। এই জিনিস সামনে কোন চেহারা নিবে তা সামনেই জানা যাবে। আপাতত আলাপ ভিন্ন প্রসঙ্গে।
যেহেতু এই সরকার এবং আন্দোলনকারীরা এইটা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যে বিগত সরকার যা করে সব খারাপ তাই সব কিছুই বাতিল করে দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু থেকেই ছিল। সব বাতিল করতে গিয়ে দাগি আসামিদের ছেড়ে দেওয়া হল। খুনের আসামি বুক ফুলিয়ে বের হয়ে আসল। জঙ্গিরা ফুলের মালা গলায় বের হল। আমরা আম জনতা আমতা আমতা করতে করতে দেখতে থাকলাম এই তামশা। এই সব পরিবর্তনের যুগে ছাত্রদের বইপত্র পরিবর্তন করতে হবে না? জরুর! হাত দেওয়া হল সমস্ত শ্রেণির বইয়ে। যে কাজটা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গর্ব করত তা হচ্ছে বছরের শুরুতে, এক তারিখে বাচ্চাদের হাতে সমস্ত বই পৌঁছে দেওয়া। এইটা যেভাবেই হোক সম্ভব করেছিল তারা। আমাদের সময়ে আমরা এমন পাই নাই। মার্চ এপ্রিল হয়ে যেত বই পেতে পেতে। পুরাতন বই জোগাড় করে পড়তে হত আমাদের। এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিয়েছিল আওয়ামীলীগ সরকার। বছর শেষ হওয়ার অল্প আগে ক্ষমতায় বসে হাত দেওয়া হল বইয়ের সমস্ত কিছুতে। সিলেবাস বদল হল, প্রেস বাতিল হল, আরও নানা কিচ্ছা। বলা হল আগের সরকার বিপুল টাকা মারত এই খাত থেকে। বলা হল ভারত থেকে প্রিন্ট করাত ভারতের দালাল সরকার, এই জন্য টাকা বেশি লাগত। তারা কম টাকায় সমস্ত বই ছাপাবে। দুইদিন যাওয়ার পরে বলা হল না, ৫০০ কোটি টাকা বেশি লাগবে! কেন? বইয়ের মান উন্নয়ন করা হবে। বছর পড়ে গেল কিন্তু এখন পর্যন্ত বাচ্চারা বই পায় নাই! সর্বশেষ জানা গেছে বাজেট গিয়ে ঠেকেছে ২৩০০ কোটি টাকায়! কী সোনার ডিব্বা ছাপাচ্ছে?
পিডিএফ কপি অনলাইনে দিয়ে দিয়েছে সরকার। বেশ ভালো। আমরা দেখতে থাকলাম নতুন সিলেবাসে কী কী আছে। গণ্ডগোল লাগল এখানেই। নতুন সিলেবাসে ইচ্ছামতো জুলাই আগস্ট আন্দোলনকে ঢুকানো হয়েছে। আবু সাইদের জীবনী পড়ান হবে,গ্রাফিতির ছবি দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামত। এমনই একটা গ্রাফিতি দেওয়া হল বইয়ে যেখানে একটা গাছ আঁকা হয়েছে, গাছের এক পাতায় মুসলিম লেখা, আরেক পাতায় লেখা হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, আদিবাসী! সব ঠিক ছিল প্যাচ লেগে গেল আদিবাসী শব্দে! যখন সরকার পতন আন্দোলন চলছে তখন ঠিক আছে, এখন কেন আদিবাসী শব্দটাকে এখানে থাকবে? দেশে কোন আদিবাসী আছে? যেখানে দেশে কোন আদিবাসীই নাই সেখানে এই সব ভণ্ডামির কোন মানে হয়? এই ভূখণ্ডে আদিবাসী আমরাই, পাহাড়ে যারা থাকে তারা আবার কবে থেকে আদিবাসী হল? ওরা হচ্ছে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী! আল্টিমেটাম দেওয়া হল এই গ্রাফিতি বই থেকে সরাতে হবে!
একটু ধমকেই এই সরকার নতজানু হয়ে সব মেনে নেয়। ঠিকঠাক ইস্যুতে একটা ধমক দিতে হবে শুধু। এখানেও তেমনই হল। বই থেকে সরিয়ে নেওয়া হল আদিবাসী লেখা গ্রাফিতি। ঠিকই তো, আদিবাসী আবার কী! আদিবাসীরা ম্যালা শখ করে সরকার পতন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। লাল প্রোফাইল নিয়ে তারাও কি দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে চিল্লায় নাই? তাহলে তারা স্বাধীনতা ভোগ করবে না? স্বাধীনতা ভোগ করতে তারা পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের সামনে প্রতিবাদ জানাতে গেল। আর যারা সরকারকে ধমক দিয়ে বই থেকে গ্রাফিতি সরিয়ে দিতে পারে তারা বসে বসে দেখবে এমন অন্যায়? তারাও গেলেন। এবং লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে বেধড়ক পিটুনি দিলেন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের! হালারা নাক বোঁচা, আইছে আদিবাসী হইতে! যা ভাগ! মেরে তক্তা বানানো হল। আদিবাসী... না মানে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর লোকেরা বিশ্বাসী করতে পারছে না যে তাদের সাথে এমন হল! স্বাধীন দেশে এমন করে মারল? আগের সাথে কোন পার্থক্য নাই? এইটা কোন কথা!
আগে থেকে জানার পরেও সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি এই হামলা ঠেকানোর। যে ছাত্ররা মারল তারা এরপরে রসিকতার চরম করল। তারা এবার পাহাড়িদের মারার প্রতিবাদ জানাল! পরেরদিন আদিবাসীরা যখন আগের দিনের গণপিটুনির প্রতিবাদ করতে বের হল তখন এই সরকারের পুলিশ তাদের ধরে আবার কেলানি দিল! আবার মেরে তক্তা! এদিকে নোবেলম্যান বিবৃতি দেয় হামলার বিচার হবে, শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আবার তার পুলিশই চাকমা, মান্দি গারোদের ধরে মেরে বিছায় ফেলল! এগুলা একমাত্র এই দেশেই সম্ভব বলে মনে হয়! এদিকে ছাত্রদল এখন সুর পরিবর্তন করে বলছে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় বড় হওয়া শিবিরের পুলাপানের কাজ এইটা! রঙ্গের শেষ আছে?
আচ্ছা এবার আলাপটা একটু সিরিয়াস দিকে নিয়ে যাই। আদিবাসী শব্দে আপত্তি কেন, আদিবাসী আসলে কারা এগুলা নিয়ে একটু লেখি এবার। আদিবাসী নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভুগে দেখছি। এই ভূখণ্ডে আমরাই আদিবাসী, আর কোন আদিবাসী নাই। আদিবাসী ডাকের পিছনে রাজনীতি আছে ইত্যাদি। আদিবাসী ডাকের পিছনে রাজনীতি আছে কি না জানি না, না ডাকার পিছনে যে রাজনীতি আছে এইটা পরিষ্কার জানি।
আদিবাসী শব্দটাকে আভিধানিক অর্থ দিয়ে হিসাব করলে হিসাব মিলবে না। অনেক শব্দই আছে যার আভিধানিক অর্থ এক কিন্তু আসলে বাস্তবে অন্য অর্থ নির্দেশ করে। যেমন রাজাকার শব্দটা। এইটার আভিধানিক অর্থ সাহায্যকারি। এখন এই অর্থ দিয়া রাজাকার শব্দের অর্থ বুঝা যাবে? না। তেমনই আদিবাসী শব্দটাকে শুধুই আভিধানিক অর্থ দিয়ে চিন্তা করলে চলবে না। এর আলাদা অর্থ আছে, এর আলাদা সংজ্ঞা আছে। আমরা এই পৃথিবীতে একক কোন রাষ্ট্র না, সব দেশেই আদিবাসী আছে, সমস্যা আছে। তাই আদিবাসীর সুস্পষ্ট সংজ্ঞার প্রয়োজন আছে, সংজ্ঞা দেওয়াও আছে।
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা সিরিজের পাঁচ নাম্বার বই - আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমিকায় মেসবাহ কামাল লিখেছেন 'আদিবাসী বলতে বোঝায় এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা মোটামুটিভাবে একটি অঞ্চলে সংগঠিত, যাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং যার সদস্যরা মনে করেন যে তারা একই সাংস্কৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত। এখানে মূলত সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, কেননা সমজাতীয় সংস্কৃতিই আদিবাসীদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, এরা হচ্ছেন এক-একটি সাংস্কৃতিক একক।'
এখানে তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা দিয়েছেন আদিবাসীদের নিয়ে। তিনি লিখেছেন, - 'আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী বা আধা-আদিবাসী হলেন তারাই যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কম অগ্রসর এবং যাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিচালিত হয় তাদের নিজস্ব প্রথা ও ঐতিহ্য অনুসারে, তাদের নিজের অথবা বিশেষ কোনো আইন বা নিয়ম দ্বারা। একটি স্বাধীন দেশের অন্তর্ভুক্ত মানব সম্প্রদায়, যারা বর্তমান রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পূর্ব থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন; যাদের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে-একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা সে দেশে বসবাস করেন, অথচ সে দেশের জাতীয় কার্যাবলী পরিচালনাকে নিয়ন্ত্রণ করেন না, তারাই হচ্ছেন আদিবাসী।'
দেখা যাচ্ছে শুধু ভূমির আদি বাসিন্দা হলেই হবে না, এর আরও নানা শর্ত রয়েছে। বিশেষ করে সংস্কৃতি একটা বড় শর্ত। আবার শুধু সংস্কৃতি না, সংখ্যালঘু এবং আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের বহু আগে থেকেই যারা এখানে বসবাস করছে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ধরে রেখেছে, ঐতিহ্য আঁকড়ে রইছে তাদেরকেই আদিবাসী বলা হচ্ছে সব জায়গায়। মেসবাহ কামাল আরও দুইটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, সরাসরি সেখান থেকে কোট করছি, -
"ভারতীয় ভাষাবিদ ড. অনিমেষ কুমার পাল আদিবাসীদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন- 'যে সমস্ত সম্প্রদায় আদিকাল থেকে পাক-ভারত উপমহাদেশে বসবাস করিয়া আসিতেছে এবং যাহাদের জীবনধারা এই বিংশ শতাব্দীর চরম শিখরেও আদিম পদ্ধতিতে পরিচালিত হইতেছে তারাই আদিবাসী নামে পরিচিত।' অন্যদিকে, বাংলাদেশের নৃ-বিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরার মতে, - 'কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী বলার অর্থ হচ্ছে যে, তারাই সেই নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বংশধর। এটা স্পষ্ট যে, পুরো ব্যাপারটিই একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। কিভাবে স্থান কালের সীমানা নির্ণয় করা হচ্ছে তার ওপরই নির্ভর করছে কোনো প্রেক্ষিতে কাদের আমরা Indigensis বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বলবো।' এই যে 'স্থান কালের সীমানা নির্ণয়ে'র বিষয়টি, এর হেরফেরে- আমরা দেখতে পাব যে- আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জনসমাজ-এর বিভিন্ন অংশ অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। এধরনের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যাদের আলাদা করে শনাক্ত করা যায়, তারাই হচ্ছেন আদিবাসী। জাতিসংঘও তার সংজ্ঞায় Indigenous কথাটি এ ধরনের সম্প্রসারিত অর্থ দাঁড় করাতে চেয়েছে।"
আদিবাসী শব্দটায় সমস্যা কোথায় জানেন? সমস্যা হচ্ছে আদিবাসী সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসীদের অস্তিত্ব যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে! এইখানেই আপত্তি। অধিকার দেওয়া যাবে না! জাতিসংঘ বলেছে আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার অধিকার, নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার ইত্যাদি দিতেই হবে। এগুলা কেউই, কোন সরকারি দিতে রাজি না। রাষ্ট্র, আমাদের এই প্রাণের রাষ্ট্র মনে করে এই অধিকারের প্রতিষ্ঠা করতে দিলে এক সময় এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! এইটার থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে সহজ সরল সমাধানের পথে হেঁটেছে রাষ্ট্র, কী? দেশে আদিবাসীই নাই! যেহেতু আদিবাসীই নাই তাই তাদের অধিকারেরও প্রশ্ন নাই। খেল খতম পয়সা হজম!
যেটা কেউই বুঝে না তা হচ্ছে আপনি না করলেই সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে না। আপনি মুখ দিয়ে বলে দিলেই তা সত্য হবে না। যার যা প্রাপ্য অধিকার তা দিলে বিচ্ছিন্নতার কোন প্রশ্নই উঠবে না বরং ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেই বিচ্ছিনতার প্রশ্ন আসবে, ক্ষেত্র তৈরি হবে। আমরা গায়ের জোরে আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করছি, এরপরে তাদের অধিকারকে বন্দুকের নল দিয়ে আটকে দিতে চাচ্ছি। তারপরে কেউ টুঁ শব্দ করলে বলছি এই দেখো এরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এমন করছে, এরা দেশের শত্রু!
কেউই, কোন সরকারই আদিবাসী প্রশ্নের সমাধান করতে চায়নি। সাধের আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শান্তিচুক্তি করেছিল। ওই চুক্তি পর্যন্তই, তা আর সামনে আগায় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে গেছে আগের মতই। সেনা ছাউনির সংখ্যা বেড়েছে। পাহাড়িদের হটিয়ে হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। মানুষ পাহাড়ের বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের করে পাহাড়ের রিসোর্টে মেঘ দেখে, হাই কমোডে হাগে, ছবি তুলে বউ বান্ধবীরে কোলে নিয়ে! হাবলা পাহাড়ি আদিবাসীরা দাঁড়ায় থাকে ফুল নিয়ে, ডাব নিয়ে, পাহাড়ি তেঁতুল বেচে, বাদাম বেচে আর ভাবে এই টুরিস্ট না থাকলে তাদের কী যে হত! শিশুরা জানেই না তাদের উঠনে এসে হাজির হওয়া এই উপদ্রপ কেন যা দেখে তা দেখেই হা হা করে হাসে! অবাক দৃষ্টিতে তাকায় দেখে জোরে জোরে গান বাজায় আর উচ্চস্বরে হাসে যে শহুরে প্রাণীরা তারা মানুষের মত দেখতে হলেও কেমন জানি!
যে পাহাড়ি ঝর্নায় বম নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে সবাই মিলে গোসল করত এক সময় এখন দেখে তাদের গোসলের ছবি তোলার জন্য নানা দিক থেকে ক্যামেরা তাক বসে থাকে পাহাড়ে ঘুরতে আসা বাঙালি! সমস্ত কিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে যাদের তাদেরকে দেওয়া হবে স্বীকৃতি? জাতিসংঘ এসে পালবে ওদের? কইলেই হইল? মামা বাড়ি?
এক সময় জিয়াউর রহমান দেশের নানা জায়গা থেকে ট্রাকে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের এনে ছিল। সেটেলাররা সেই থেকে পাহাড়ে। আজকে যে বিষ জিয়া স্থাপন করেছিল সেই বিষের যন্ত্রণায় ভুগছে পুরো পাহাড়। ঢাকায় রক্ত ঝরছে এই বলে যে পাহাড় আবার তোদের কবে হল? আদিবাসী সমাজ ব্যবস্থা আমাদের মত না। এই গোষ্ঠী এখানে থাকে, বাপ দাদার আমল থেকে। কাগজ কই তোমার জমির? এই কথা বললে লাভ আছে? কাগজ নাই, যাও, এই পাহাড়ে এখন পাঁচ তারকা হোটেল হবে, তোমরা দূরে, একটু দূরে গিয়ে মর প্লিজ! এখানে সংখ্যাগুরুরা আসবে, পাহাড়ের বুকে পাক্কা পুকুরে গোসল করবে, সাঁতার কাটবে, জলকেলি করবে, মেঘ দেখবে, পাহাড় দেখবে, ঝর্না দেখবে, মদ খাবে। প্রয়োজনে কালচারাল প্রোগ্রাম হবে, সেখানে পাহাড়িরা নাচবে। আয়োজন করে পাহাড়িদের বর্ষবরণ টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হবে! রঙ কোম্পানি স্পন্সর করবে তাদের বাড়ির আলপনার! আমরা মুগ্ধ হব! এগুলা ঠিক আছে, কিন্তু বাপু তোমরা আদিবাসী বলে দাবি করো না তো! এই ভূখণ্ডে আমরাই আদিবাসী!
এই ভণ্ডামি শেষ হবে না। আমি অন্তত কোন সম্ভবনা দেখি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে তো তবু অনেক আদিবাসী থাকে তাদের কণ্ঠস্বর তবু শোনা যায়। দেশের বাকি জায়গার অবস্থা কী? সাঁওতালরা কেমন আছে? গারো, কোচ, মান্দিরা? কেউ তাদের কথা শুনে? আমি শুনতে পাই না। আমার এলাকায় যে আদিবাসীরা আছে তাদের গল্পই কতখানি জানি? আমিও ভণ্ড অনেকের মত... !
রাগ লাগে বুঝছেন! আদিবাসীদের মেরে রক্তারক্তি করে দেওয়া হল। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জুলাই আন্দোলনে ছাত্রের গায়ে হাত কেন বলে ডুকরে কেঁদে উঠত তারা এখন ফুল পাখি লতাপতা নিয়ে কথা কয়! যে অভিনেতা, অভিনেত্রীরা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে গেল কয়দিন আগে তারা এখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে ব্যস্ত! ফেস্টিভ্যাল ভেনু থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে মাথা ফাটিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে এক আদিবাসী নারী। সে ক্ষমতাও চায় নাই, টাকার ভাগ চায় নাই, বিদেশি সাংবাদিকদের ক্যামেরার বিষয়ও হতে চায় নাই। গেছিল ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে! অথচ একটা শব্দ বের হল না কথিত তারকাদের কাছ থেকে। শূয়রের পালের মত যে সমন্বয়ক তৈরি হয়েছে তারা কেউ বলল না এঁদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উল্টা পালের গোদা বরহ বলল পাহাড়িদেরকে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোন বিদেশিদের চক্রান্তে তারা না পরে! সোজা সরল কথা, আদিবাসীরা তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়, এখানে বিদেশি চক্রান্ত এসে গেল?
মাঝে মধ্যেই হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। মনে হয় আমিও ফুল পাখি লতাপাতা নিয়ে লেখি। আমিও বাতাবিলেবুর ফলন নিয়ে চিন্তা করা শুরু করি। মনে হয় লিখি ইসলামে চার বিয়ের ফজিলত নিয়ে! লেখি কেন রিয়েল মাদ্রিদ দুই এক সিজন বার্সার কাছে হারলেও চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে রিয়েলের আশেপাশে কোন ক্লাব পৌঁছাতে আরও দুই এক দশক লেগে যেতে পারে। মনে হয় এগুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু পারি না, পারি কই? মনে হয় নজরুল মত লিখি -
"বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।