মারচেন্ডাইজিং যখন করতাম তখন আমাকে প্রায় অনেক সময়ই চীনে মাল অর্ডার করতে হত। বায়ারের মনোনীত থাকলে চীন থেকে হোক আর মঙ্গোলিয়া থেকে হোক, ওইটাই নিতে হত। বছরের শুরুর দিকে মানে জানুয়ারি মাসের দিকে অদ্ভুত একটা কাণ্ড হত প্রতি বছর। চাইনিজরা অর্ডারের জন্য চাপ দিত। বলত যা অর্ডার করার করে দেও, সামনে আমাদেরকে লম্বা সময়ের জন্য পাবা না! আমি প্রথম দিকে বুঝতাম না বিষয়টা। ব্যবসা করতে বসছ, দুনিয়া জুড়ে তোমাদের এই কাজের কত নাম ডাক, আর তোমরা বলতেছ পাব না, মানে কী! সিনিয়ররাও যখন চাপ দিত, ম্যানেজার এসে বলত সব আগেভাগেই অর্ডার করে কাজ শেষ করে ফেলেন, না হলে কিন্তু কান্নাকাটি করতে হবে মালের জন্য। বিষয়টা পরিষ্কার হয় আরও একটু হেদাগুতা খাওয়ার পরে। জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রায় শেষ পর্যন্ত চাইনিজ নববর্ষ! ওরা কোন কাজ করবে না এই সময়, প্রায় বন্ধই থাকে বলা চলে সমস্ত অফিস। পরবর্তীতে শুনছি যে কেউ কেউ না কি শাখা অফিস একটু আধটু খোলা রাখে। কিন্তু আমি আমার ছোট্ট চাকরি জীবনে একবারের জন্যও পাই নাই। পরবর্তীতে জানার সুযোগ হয়েছে যে চীনা বর্ষপুঞ্জি কত পুরাতন আর ওরা এইটা কত আয়োজন করে পালন করে।
থাই বর্ষপুঞ্জি আছে, বার্মিজ বর্ষপুঞ্জি আছে, কোরীয় বর্ষপুঞ্জি আছে। এরা সবাই নিজেদের মতো করে পালন করে নিজেদের নতুন বছরের প্রথম দিন। চাইনিজদের মতো বিশাল আয়োজন না হলেও যার যার মতো করে পালন করে সবাই। বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে আয়োজন হয় আরেকটা বর্ষপুঞ্জি, তা হচ্ছে নওরোজ বা ইরানি বর্ষপুঞ্জি। ইরানিরা যে এইটা কত মজা করে কত আগ্রহ নিয়ে পালন করে তা বলে বুঝানো মুশকিল। ইরানি সিনেমার প্রতি আগ্রহ থেকে তাদের বেশ কিছু অভিনেতা, পরিচালকদেরকে অনলাইনে নানা জায়গায় ফলো দিয়ে রাখছি, তাদের নানা পোস্টে দেখা যায় তাঁরা কতটা সম্মান করে নিজেদের সংস্কৃতিকে। নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত অভিনেত্রী গুলশিফতে ফারহানিকে এবার দেখলাম জামাল কদু গানের সাথে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নাচতেছে। বুঝা যাচ্ছিল তিনি ইরানের বাহিরে থেকেও কতটা মিস করছেন নওরোজকে। তো যা বলছিলা আর কি, ইরানিদের নববর্ষ উৎসব দেখার মতো হয়। এখন অনলাইনের যুগ, কেউ চাইলেই ইউটিউবে দেখতে পারেন।
দুনিয়া জুড়ে নানা জাতির এমন আলাদা পঞ্জিকা আছে। নিজস্ব বর্ষপুঞ্জি আছে। তারা সমস্ত আবেগ দিয়ে নিজেদের নববর্ষকে পালন করে। আবার দুনিয়ায় এমন ম্যালা জাতি আছে যাদের এগুলা কিছুই নাই। অন্যেরটা দিয়াই কাজ চালায়। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ নাচানাচি করে, মাল খায়া টাল হয়ে যায়।
এরপরে দুনিয়ায় আসে এক অদ্ভুত জাতি, বাংলাদেশি বাঙালী! এত বেহুশ জাতি এই দুনিয়ায় আর আছে বলে মনে হয় না। তারা এক বাক্যে এইটা পালন করা হারাম বলে রায় দিচ্ছে। আমাদের নিজস্ব একটা পঞ্জিকা আছে। নিজেদের নববর্ষ আছে, এইটা গর্বের না? না! পারলে ধরে মারে! এই রোগের চিকিৎসা আমার জানা নাই। সংস্কৃতি আর ধর্মের একটা ক্যাচাল লাগিয়ে দিয়ে ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষের উপরে এরপরের দায়িত্ব দিয়ে চুপ করে বসে থাকে এই ছাগল গুলো। ইসলাম শুধু এই অঞ্চলেই আসে নাই, আরও নানা দিকে গেছে আরব থেকে। কিন্তু কেউ নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধর্মকে টেনে নেয়নি। ইরান ফার্সি ভাষার দেশ। ফার্সি ভাষার নানা শব্দ আমাদের বাংলায় চমৎকার করে ঢুকে বসে আছে। নামাজ, রোজা, বেহেশত, দোজখ এগুলা সব ফার্সি শব্দ। ফার্সি ভাষার মানুষ ধর্মকে মানে ইসলামকে মেনে নেওয়ার সময় কেন আরবিকে অত্যাবশ্যকীয় করল না? এই প্রশ্নটা কোনদিন করেছেন? উল্টা তাদের নামাজ রোজাকে আমাদের ভিতরে নিয়ে নিছি আমরা। বাংলায় এগুলার বিকল্প নাই? এখন যদি কেউ বাংলা ব্যবহার করে? আস্ত রাখবেন? শুধু ইরানি না, তুর্কি, মিশরীয়, আফগান, উজবেক কেউই নিজেদের নিজস্বতাকে ভুলে ধর্মকে গ্রহণ করে নাই। সব জায়গায় তাদের ভাষা, সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই ইসলামকে কবুল করেছে। কোথাও কোন সমস্যা হয়নি, ইসলামেরও কোন ক্ষতি হয়ে যায়নি। সব জঞ্জাল এসে হাজির হয়েছে আমাদের এখানে।
সব কিছুতে মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের দালাল বলা অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু এই সব দেখলে মনে হয় যে কোথাও না কোথাও পরাজিত শক্তির একটা চেষ্টা থাকেই বোধহয়, যাদের প্রচেষ্টার ফল হচ্ছে এই সব। কারণ ভাষার সাথে দ্বন্দ্ব, সংস্কৃতির সাথে বিরোধ এই দেশে এদেরই সব সময় ছিল, এখনও আছে। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল আইয়ুব খান, তার প্রতিবাদে সেই বছর থেকে জোরেশোরে আয়োজন করে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ পালন। যা আজ অবধি চলমান। এদের বিরোধ তখন থেকেই। তাই সব সময়ই দেখি প্রগতিশীল যে কোন কাজে এই শক্তির হারাম অস্ত্র প্রয়োগের চেষ্টা। শহীদ মিনারে যাওয়া হারাম, নববর্ষ পালন হারাম, টিপ পরা হারাম! এক হুজুর বললেন নববর্ষে পরার জন্য কেউ পাঞ্জাবি কিনলে তিনি সরাসরি জাহান্নামে যাবেন! ফেসবুকে আশ্চর্য এক জিনিস হচ্ছে নানান রঙের রিয়েকশন বাটন। নববর্ষ সংক্রান্ত প্রতিটা পোস্টের নিচে এই ছাগলেরা হা হা রিয়েকশন দিয়ে ভাবছে তারা প্রচুর পয়েন্ট কামাই করছে, তরতর করে বেহেশতে চলে যাবে সবাই!
প্রতি বছর লেখি নববর্ষের দিনে। মেজাজ প্রতিবারই খারাপ হয়। আশা কথা হচ্ছে কুত্তার ডাকাডাকিতে নববর্ষ পালনে এখন পর্যন্ত খুব একটা হেলদোল হয় নাই। মানুষ ঝাঁপিয়ে পরে নববর্ষ পালন করে। বাংলাদেশে, ঢাকা শহরের অন্যতম সেরা পরিচয় এখন বাংলা নববর্ষ পালন। নিজেদের খাটি বাঙালী বলে দাবী করা পশ্চিমবাংলায়ও নববর্ষে ঢাকার আশেপাশেও যেতে পারে নাই এত বছরেও। সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব একটাই, তা হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। সাধারণ জনগণের অংশ গ্রহণে এমন বিশাল আয়োজন আর একটাই হয়, তা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রতি বছর তবুও এরা কই থেকে এসে হাজির হয়? সংস্কৃতিকে ধর্মের মুখোমুখি কেন দাঁড়া করায়? হুমায়ূন আজাদের মতো আমারও প্রশ্ন -
যে তুমি ফোটাও ও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ
জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ
কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম
কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলায় গুচ্ছগুচ্ছ জাম,
যে তুমি বহাও নদী, পাললিক নদীর ভেতরে
লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে,
যে তুমি উঠাও চাঁদ মেঘ ছিঁড়ে নীলাকাশ জুড়ে
বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে ,
যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে
বলিকার সারা দেহ ভরে দাও তিলেতিলে রূপে
আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে,
যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভির ওলানে
খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী
আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ- করে তোলো কবি,
যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-
সে তুমি কেমন করে, বাঙলা, সে তুমি কেমন করে
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছ পালেপালে শুয়োরকুকুর?
শুভ নববর্ষ সবাইকে। যে হারাম হারাম করে মাথা নাড়ছেন তাকেও। আপনে মাথা নাড়লেও নববর্ষ পালন হবেই, রেহাই নাই কোন। শুভ নববর্ষ কাছে পিঠের সকল শুভানুধ্যায়ীকে। মঙ্গল হোক সকলের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।