একটু মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ নেওয়া যাক।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী বাঙালিরা কটা অনুষ্ঠান করে, এবং বাংলাদেশের প্রবাসী বাঙালিরা কটা অনুষ্ঠান করে? তুলনা করলে স্তম্ভিত হয়ে যাবেন।
তার ওপর এই ফেব্রুয়ারি মাসের রক্ত জমে যাওয়া শীতে প্রত্যেক বছর নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সামনে নদীর ধারে হু হু করে উত্তর মেরুর হাওয়া আসে -- হাড় কাঁপিয়ে দেয়। সেখানে অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করে বাংলাদেশী বাঙালিরা গান গায়, এবং মাতৃভাষার বন্দনা করে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী বাঙালি? আর হাসাবেন না।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বাংলাদেশের বাঙালিকে ইনফিরিয়র মনে করে, এবং তাদের নীচু চোখে দেখে। তার ওপর আবার মুসলমান। ওরা তো মানুষই নয়।
অথচ, মুসলমান বাঙালিরা রক্ত দিয়েছিলো ভাষা দিবসে একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২। সে শহীদদের সবাই ছিল মুসলমান। রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম, শফিউর। সুখী সুখী হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে সে ইতিহাস।
আমরা যারা দীর্ঘকাল প্রবাসে কাটালাম, এবং বাংলাদেশী বাঙালিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম, বাঙালি মুসলমান লেখক, শিল্পী, নাট্যকার, কবি, গায়ক, গায়িকা, এবং অন্যদিকে ট্যাক্সি ড্রাইভার, রেস্টুরেন্ট পাচক, সুপারমার্কেট কর্মী, হোটেল পরিচারক পরিচারিকা, ন্যানি, আরও হাজার বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশলাম, আমরা দেখেছি বাংলা ভাষাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য অবদান।
সত্যি কথা বলতে, প্রবাসে বাংলা ভাষা বলতে ওই "নীচু চোখে দেখা" বাংলাদেশীরাই। তাঁদের সাপ্তাহান্তিক হাজার বাংলা স্কুল। তাঁদের সাপ্তাহিক বাংলা কাগজ। তাঁদের সাহিত্য ও রাজনৈতিক পত্রপত্রিকা। তাঁদের নাটক, তাঁদের গানের অনুষ্ঠান। তাঁদের করা ভরতনাট্যম থেকে রবীন্দ্র-নজরুল গীতিনাট্য।
বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার আইডেন্টিটি হলো বাংলা ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরও তাই ছিল। কিন্তু এখন হিন্দী আগ্রাসন এবং সস্তা মার্কিনি প্রজাতির ইংরেজি আগ্রাসন তা ধ্বংস করে দিচ্ছে প্রতিদিন। পশ্চিমবঙ্গের খুব কম জায়গাতেই বাংলা ভাষা এখন বেঁচে থাকার আইডেন্টিটি। বিশেষ করে তথাকথিত শিক্ষিত, ভদ্রলোক, শহুরে, আধাশহুরে বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক বিষয় নয়।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষার হাত ধরে উপনিবেশিক জীবনদর্শন থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এবং তারা নতুন দেশ পেয়েছে লক্ষ মানুষের রক্তের ও সম্মানের বিনিময়ে।
আমরা আমাদের ইতিহাস, চেতনা, জীবনদর্শন সম্পূর্ণ হারাতে চলেছি। আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, জগদীশ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র থেকে সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সারদামণি, রাসমণি আর কোনো বিশেষ আইডেন্টিটি বা অহঙ্কার বহন করে না। লালন, নজরুল, রোকেয়া, মুজিব, ভাসানি তো ... বাকীটা আপনারা জানেন।
নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশীদের স্কুলে বাংলা পড়াতাম উচ্চতর বিভাগে। একবার গ্রীষ্মকালে মুক্তমঞ্চ এথেন্স পার্কে দেখেছিলাম সেলিমা আশরাফের সত্তর কি আশি শতাংশ মুসলমান ও কুড়ি অথবা ত্রিশ শতাংশ হিন্দু ছাত্রছাত্রী সমবেত কীর্তন গাইছে। একপাশে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন মান্না দে -- তাঁর বন্ধ চোখ দিয়ে বেরোচ্ছে অশ্রু। নিজের চোখে দেখা।
তা আজকের এই অভাগার দিনে সে সব গল্প কে শোনে?
কিন্তু "আমি কি ভুলিতে পারি?"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।