এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • রুপোর মত সাদা, কাঁচের মত হালকা - পর্ব ১

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৯৩২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৬ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    ফরাসী পাবলিক আর্ট-কালচার ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও যে বেশ নাড়াচাড়া করেছে সে কথা আজকাল ভাবতেই অবাক লাগে! তারা নিজেরা পিছিয়ে গেছে নাকি বাকি বিশ্ব এগিয়ে গেছে কে জানে! সে প্রায় ১৩০ বছর হতে চলল লোহা দিয়ে আইফেল টাওয়ার খাড়া করেছিল – যার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি না দিলে এখনো আমাদের প্রিয়তমের সাথে মধু দিন যাপনের পরিসমাপ্তি হয় না! আইফেল টাওয়ার নিয়ে তো বেশ বড় একটা লেখাও লিখেছিলাম কিছু দিন আগে।

    তো শুধু লোহা নয়, আধুনিক যুগের আরো এক বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ধাতু নিয়ে ফরাসীরাই মনে হয় সবচেয়ে আগে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল।  সেই ধাতুর আকরিক ভৌগলিক কারণে দেশে পাওয়া যেত বলে ফরাসীরা তার সম্পূর্ণ ফয়দা উঠিয়েছিল ১৮৫৬ থেকে ১৮৮৬ সালের মধ্যে প্রায় ২০০ টন ধাতু উৎপন্ন করে।  সেই ধাতুর গুণাগুণ দেখে শুধু ইঞ্জিনিয়ার-রাই নয়, যাদের কল্পনা শক্তি একটু বেশী সেই সাহিত্যিকরাও আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন।  আর সেই সময়ে কল্পবিজ্ঞানের লেখক জুল ভার্ণ-এর থেকে আর তো কেউ বড় ছিলেন না! (এখনও নেই মনে হয় – তবে সেটা অন্য ব্যাপার)।  তিনি তাঁর বই “ফ্রম আর্থ টু মুন” এ ১৮৬৫ সালে লিখে ফেললেন, “ ... এই চমকপ্রদ ধাতু রূপোর মত সাদা ভাবের, সোনার মতন অবনিশ্বর, লোহার মতন দৃঢ়, তামার মতন জুড়ে দেওয়া সহজ, আর কাঁচের মতন হালকা।  এই ধাতুকে আকার দেওয়া সোজা, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে এর আকরিক, বেশীর ভাগ পাথরেই কিছু না কিছু থাকে এই ধাতুর আকরিক, লোহার থেকে এক-তৃতীয়াংশ হালকা।  সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে এই ধাতু যেন আমাদের ‘প্রোজেক্টাইল’-এর জন্য একদম কাষ্টম-মেড”।  এখানে ‘প্রোজেক্টাইল’ বলতে জুল ভার্ণের কল্পিত রকেটের কথা বলা হচ্ছে যাতে করে মহাকাশ এবং চাঁদে মানুষ পাঠাবার কথা লিখছিলেন তিনি তাঁর বইতে।  ছবিতে জুল ভার্ণের সেই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি। 
     
     
    ও হ্যাঁ, এত যে হিন্ট দিলাম, বিঝতে পারলেন তো যে কোন ধাতুর কথা বলা হচ্ছে।  যাঁরা এখনো ধরতে পারেননি – তাঁদের জন্য বলা, এখানে হচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের কথা। 
     
    আজকের দিনে কারো বাড়িতে খেতে গিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের থালায় খেতে দিলে সেটা বেশ সম্মানজনক জিনিস নয় বলে সামাজিক ভাবে মনে করা হচ্ছে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু ভাবতে পারেন মাত্র দুশো বছর আগেও ব্যাপারটা এমন ছিল না! অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অ্যালুমিনিয়ামের দাম এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কদরও বেশী ছিল সোনার থেকে। সম্রাট নেপোলিয়ানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের খেতে দেওয়া হত অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্রে আর তার থেকে একটু নীচু মর্যাদার অতিথা খেতেন রুপোর থালাবাসনে।  সেই সময় যাঁদের পয়সা ছিল এবং যাঁরা ফ্যাশন ভালোবাসতেন তাঁদের পরিবারের মহিলারা অ্যালুমিনিয়ামের গহনাপত্র অঙ্গে চড়িয়ে ঘোরাফেরা করতেন।  
     
    সেই তত আগের কথাই বা বলি কেন, এই ইদানিং কালেও অ্যালুমিনিয়ামের গহনার বেশ প্রচলন ছিল। সাথের ছবিটি ১৯৫৫ সালে ইতালিতে অ্যালুমিনিয়ামের গহনার এক বিজ্ঞাপন। কিন্তু তত দিনে অ্যালুমিনিয়াম আর তত মহার্ঘ্য নেই - বরং নেমে এসেছে প্রায় ফ্যাশন জুয়েলারীর পর্যায়ে। 
     


     তাহলে এবার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে অ্যালুমিনিয়ামের গল্প তাহলে শুরু হল কোথায়? নেপোলিয়ানের সময়ের আগে কি তাহলে অ্যালুমিনিয়াম ছিল না? এ প্রশ্ন বেশ একটু জটিল – জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের জীবন ঘিরে যেমন জড়িয়ে থাকে অনেক উপকথা, তেমনি অ্যালুমিনিয়ামের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথেই তার সাথেও যুক্ত হয়েছে অনেক গল্পকথা – অনেকক্ষেত্রেই যার সত্যি মিথ্যা যাচাই করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।  

    বাজারে প্রচলিত উপকথা আছে যে অ্যালুমিনিয়ামের গল্প শুরু হয় যীশুখ্রীষ্টের জন্মের ৫০ বছর আগে।  প্লীনি নামে প্রাচীনকালের একজন তাঁর ‘হিষ্টোরিয়া ন্যাচারালিস’ বইতে লিখেছেন যে রোমের এক স্বর্ণকার সম্রাট টিবেরিয়াস-কে এক নতুন ধাতু উপহার দিয়েছিল যা ওজনে খুবই হালকা এবং প্রায় রুপোর মত চকচকে।  স্বর্ণকার সম্রাট-কে আরো বলে যে সে নাকি মাটি থেকে এই ধাতু নিষ্কাষণ করেছে এবং সেই পদ্ধতি একমাত্র ভাগবান আর সে জানে।  কিন্তু এই গল্প বলার পর হল হিতে বিপরীত – সম্রাটের নতুন ধাতুর প্রতি আগ্রহ জন্মালেও, অন্যদিক তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, মাটি থেকেই যদি এমন ধাতু নিষ্কাষণ করা যায়, তাহলে তাঁর সংগ্রীহিত সোনা এবং রূপোর কি হবে? ক্রমে ক্রমে এই নতুন ধাতুর কাছে পুরানো ধাতু হেরে যাবে না তো! এই সব ভেবেচিন্তে, স্বর্ণকার-কে পুরস্কৃত না করে, সম্রাট তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিলেন।  কিন্তু একটু তলিয়ে দেখা যাবে যে এ শুধু গল্পই – কারণ মাটি থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাষণের জন্য যে রাসায়নিক জ্ঞানের দরকার তা রোমান সময়ে আমাদের জানা ছিল না।  এই পদ্ধতিতে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাষণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।  
     
    শুধু অ্যালুমিনিয়াম-ই নয়, আরো অনেক ধাতুর জন্যই আমাদের প্রায় ইদানিং কালের আধুনিক সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।  এর মূল কারণ হচ্ছে, এই সব ধাতু মুক্ত অবস্থায় প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না।  এই সব ধাতু অক্সিজেন ইত্যাদির সাথে জড়াজড়ি করে যৌগ আকরিক হিসাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। সেই সব আকরিকের যৌগ থেকে ধাতু নিষ্কাষণের জন্য দরকার ছিল ছিল ‘এনার্জি’ (শক্তি) এবং নানাবিধ রাসায়নিক কলাকৌশল যা মানব সমাজকে রপ্ত করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।  তাই পৃথিবীর ভূত্বকের প্রায় ৮.২% অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে গঠিত হলেও আমাদের শুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম পর্যপ্ত পরিমাণে পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।  প্রাচীন সময়ে মোটামুটি নয়-টি পদার্থ আমাদের অগ্রজেরা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন – এর মধ্যে পাঁচটি ভূত্বকে এমনি এমনি প্রাকৃতিক ভাবে মুক্ত অবস্থাতেই পাওয়া যেত – সোনা, রুপো, তামা, কার্বন এবং সালফার।   একটু নজর দিয়ে খুঁজলে এগুলো পাওয়া যেত এবং ভূত্বম থেকে পৃথক করে ব্যবহার করা যেত।  বাকি চারটি পদার্থ -  সীসা, টিন, পারদ এবং লোহা বেশ বেগ দিয়েছিল মানব সমাজকে।  প্রাচীন কালের আবিষ্কারক-দের প্রচন্ড কৃতিত্ব দিতে হবে এই জন্য যে দশকের পর দশক, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা পরীক্ষা করে তাঁরা পদ্ধতি বের করতে পেরেছিলেন কি ভাবে সেই সব পদার্থের যৌগ থেকে ধাতু-গুলিকে নিষ্কাষিত করা যাবে।
     
    [ক্রমশ: - উৎসাহ বজায় থাকলে]
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • প্রবন্ধ | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৯৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 220.244.***.*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৩:০০527012
  • দারুন শুরু হয়েছে সুকি। চলুক আরো। 
  • Supriyo Mondal | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৯527054
  • লিখে যাও সুকি। তোমার কাছ থেকে একটু তোমার সাবজেক্ট শিখি....
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন