কলকাতার কলেজ ষ্ট্রীটে বাংলাদেশ বই মেলা চলছে। আগামীকাল শেষ হবে দশদিন ব্যাপী এই বই মেলা। বাংলাদেশের বই কলকাতায় মেলা করে বিক্রি হচ্ছে এইটা দারুণ একটা ব্যাপার। উদ্বোধনের দিন প্রধান অতিথি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, "বইয়ের চাহিদা চিরন্তন। সেই চাহিদা চিরদিন জেগে থাকবে আমাদের হৃদয়ে। আর এই বইতো আমাদের দুদেশের মধ্যে এক নতুন সেতু গড়ে তুলেছে।" কোন সন্দেহ নাই, সেতু তৈরি করে দিচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে সব হচ্ছে এক তরফা! বাংলাদেশের বই কলকাতায় মেলা করে, আয়োজন করে বিক্রি করছেন অথচ ভারতীয় বই এখানে আসতে দিচ্ছেন না। একুশে বই মেলায় ভারতীয় বই প্রবেশ নিষেধ। বেশ, ভাল, একুশে বই মেলাকে যদি শুধু মাত্র বাংলাদেশি প্রকাশকদের জন্য নির্ধারিত বই মেলা করে রাখতে চাই আমরা তাতে কোন সমস্যা নাই। তাহলে অন্য সময় ভারতীয় বইয়ের জন্য আলাদা করে বই মেলার আয়োজন করা হোক। এখন যেমন কলকাতায় বাংলাদেশ বই মেলা হচ্ছে তেমন করে, এতে সমস্যাটা কই?
এমন না যে জন্মের পর থেকেই ভারতীয় বই একুশে বই মেলায় নিষিদ্ধ। সম্ভবত ৯৮ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বই প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় একুশে বই মেলায়। আহমদ ছফার ঐতিহাসিক প্রতিবাদ! শওকত ওসমানকে ধরে নীলক্ষেত নিয়ে গিয়ে ভারতীয় লেখকদের নাম বলে সমানে বই বের করতে থাকলেন, এরপরে বললেন শওকত ওসমানের বই বের করার জন্য। দোকানদার শওকত ওসমানকে চিনেনই না! ছফা বললেন 'যদি আজকে আমরা ভারতীয় বইয়ের প্রবেশ বন্ধ না করতে পারি তাহলে ওই দেশের তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের বই দিয়ে আমাদের দেশের দোকানপাট ভর্তি থাকবে আর তোমার মত লেখকদের কেউ চিনবেও না।' মোটামুটি এইটাই ছিল গল্পটা। ফলাফল এরপরে সবাই মিলে ভারতীয় বই প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা দিল!
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে এখন কতজন শওকত ওসমানকে চিনে! বহু শিক্ষিত মানুষকে দেখছি জীবনে নামও শুনে নাই উনার। চাকরির পরীক্ষার জন্য নাম মুখস্থ করছে শওকত ওসমান, ক্রীতদাসের হাসি লিখছেন! জীবনে ধরেও দেখে নাই ক্রীতদাসের হাসি বইটা। আজও অপরিচিতই তিনি। আহমদ ছফাও হয়ত তেমনই থাকতেন। কিন্তু তিনি এত বেশি বর্ণিল, এত কিছুর সাথে জড়িত, নানা কাজে বিতর্কিত এক চরিত্র যে উনাকে অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু লেখক ছফা কয়টা বই মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ে? না কি ওই চাকরির পড়ার মত করে নাম মুখস্থ করা শুধু!
ছফা যাদের লেখার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন যে তৃতীয় শ্রেণীর লেখক ধারণা করা হয় সুনীলের কথাই বলেছেন। প্রথম কথাই হচ্ছে সুনীল তৃতীয় শ্রেণীর লেখক না। মান এদিক সেদিক হতেই পারে। সব লেখাই কাল উত্তীর্ণ হবে এমন আশা করার কিছু নাই। আসল কথা হচ্ছে জনপ্রিয় লেখক হওয়া তো দোষের কিছু না। তিনি যখন শওকত ওসমানকে না চেনার জন্য ভারতীয় লেখকদের দায়ী করছিলেন তখন কী তিনি হুমায়ুন আহমদের কথা একবার জিজ্ঞাস করে ছিলেন? দুই বাংলা মিলেও তখন হুমায়ুন আহমেদের ধারে কাছেও কেউ নাই। শুধু তখন না, হুমায়ুন আহমেদ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিনই তাই ছিলেন, মৃত্যুর পরেও সম্ভবত তিনিই বিক্রীতে সেরা! আচ্ছা, এই প্রথাগতের বাহিরে কাজী আনোয়ার হোসেনকে ছফা সাহেব কই রাখবেন? বাংলার বুকে মাসুদ রানা কোন জায়গায় গিয়ে বসে আছে এইটা কল্পনা করাও অন্য কারো জন্য কঠিন। ইমদাদুল হক মিলনের বইও শওকত ওসমানের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়, এই দায় সব সুনীলের ঘাড়ে ফেললে মুশকিল না?
মানুষ উৎকৃষ্ট সাহিত্য বেশি পড়বে না, একটু ঝকমকা জিনিসই বেশি পড়বে, সারা দুনিয়াই তাই পড়ে। এর জন্য দোষ দিয়া লাভ নাই কাওকে। শওকত ওসমানকে অসম্মান বা ছোট করছি না, শুধু আমার ধারণার কথা বলি, সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের( মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ) পরবর্তী যুগের লেখকদের মধ্যে সেরা হচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আমি অন্তত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সমকক্ষ কাওকে দেখি নাই বা পড়ি নাই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই কী হুমায়ুন আহমেদের চেয়ে বেশি বিক্রি হত না কম হত বা হয়? কেন হয়?
আমি শুধু বলতে চাচ্ছি এইটা একটা খোঁড়া যুক্তি। তখনকার সময়ের জন্য যদি তা সঠিক হয়েও থাকে এখন সময় দ্বার উম্মুক্ত করার।
দেশে এখন ঘটা করে হিন্দি সিনেমা আনা হয় অথচ বই আনলে জাত যাবে! যেটা হওয়া উচিত ছিল অবারিত, উম্মুক্ত সেটাকে নানা আইন কানুন দিয়ে বেঁধে রাখছি আর যেটাকে যথা সম্ভব দূরে রাখা উচিত ছিল ওইটাকে দাওয়াত দিয়ে এনে মানুষকে দেখাচ্ছি! পশ্চিমবঙ্গের বই মেলা এখন সময়ের দাবী। গত বছর একবার সম্ভবত শুনেছিলাম প্রকাশকদের মিটিং সভা হচ্ছে এই ব্যাপারে। এরপরে আর খবর নাই। মিটিং করে বের হয়ে সবাই মিলে সম্ভবত হিন্দি সিনেমা দেখতে বসে গেছে! সিনেমা শেষ হলেই একটা ফয়সালা হবে এনশাল্লাহ...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।