এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • হেমাঙ্গে অমেয় মায়া

    Samaresh Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৫৯৯ বার পঠিত
  • সেদিন তারটা হাতে নিয়ে সরমা বললেন, "তোর বাবার তো দোকান ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই, তুই আমায় কদিনের জন‍্য বেনারস নিয়ে যাবি রাজু? দাদা তার পাঠিয়েছে মায়ের শরীর‌টা ভালো যাচ্ছে না।" রজত তখন সবে ষোলো পেরিয়েছে। তবে গড়ন লম্বা চ‌ওড়া। রাজুর মা সরমা‌‌র চেহারা‌ও বেশ ভালো। মায়ের ধাত‌ই পেয়েছে রাজু।

    সরমা বেনারসের সুবর্ণ‌বণিক সম্প্রদায় আঢ‍্য পরিবারের মেয়ে। সোনারপুরা এলাকায় তিনপুরুষের প্রবাসী বাঙালি। রজতের বাবা কমলাকান্ত শীল‌ও সুবর্ণ‌বণিক‌। ভবানীপুরে ছোট্ট একটা বাড়ি ও সোনার দোকানের মালিক। বিক্রিবাটা মোটামুটি। সোনার বেনেদের মধ‍্যে সচরাচর নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ‍্যেই বিয়ে-থা হয়।

    বেনারসে সরমা‌র বাবার‌ও ছিল সোনার দোকান, ঐ সোনারপুরাতেই, চিন্তা‌মনি গনেশ মন্দির এলাকায়। সরমারা এক ভাই এক বোন। বাবা মারা যেতে ওর দাদা অবিনাশ‌ই ঐ দোকান‌টা চালান। দাদার তিনটি মেয়ে। বড় হেমাঙ্গিনী, মেজ পূরবী, ছোট উদিতা। দাদার না থাকলেও বৌদি অপর্ণার ছিল খুব ছেলের শখ। তবে ছোট মেয়ে উদিতা‌র জন্মের দু বছর বাদে পুত্রসন্তানের অপূর্ণ সাধ নিয়েই মারা গেলেন অপর্ণা। তিন মেয়ে ও বিধবা মাকে নিয়ে দাদা বেনারসের পৈত্রিক আবাসে‌ই রয়ে গেলেন।

    এককালে চালু দোকানের বিক্রিবাটা ক্রমশ পড়তে দেখে বছর কয়েক আগে অবিনাশ বাজার থেকে বেশ কিছু ধার নিয়ে পুরোনো দোকানটা নতুন ভাবে সাজিয়েছেন। নতুন কারিগর এনে নতুন ডিজাইনের গহনা তৈরী হচ্ছে। ফলে এখন দোকান‌টা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে তিনটে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। সোনার বেনেদের মধ‍্যে বিয়েতে এখন‌ও ভালো পণপ্রথার চল আছে। বাজারে ধার শুধতে হবে। সেইসব চিন্তা‌তেই হয়তো দীর্ঘ‌দেহী, একদা সুস্বাস্থ্যের অধিকারীঅবিনাশকে এখন পঞ্চাশে পা রাখা‌র মুখেই একটু ম্রিয়মাণ, বয়স্ক দেখায়।

    তবে ভগবান সবদিক দিয়ে কাউকে মারেন না। অপর্ণা খুব সুন্দরী ছিলেন। অবিনাশ‌ও যৌবনে ছিলেন বেশ সুপুরুষ। তাই দাদার তিনটে মেয়ে‌ই অপরূপ সুন্দরী হয়েছে। হেমাঙ্গিনী তো যেন ডানাকাটা পরী। সত্যিই সোনার অঙ্গ যেন। যেমন উজ্জ্বল ফরসা রঙ, তেমনি মুখশ্রী। হেমাঙ্গিনী সচরাচর বাঙালি মেয়ের নাম হয় না। তবে বহুদিন বেনারসে থেকে হয়তো দাদার মধ‍্যে কিঞ্চিৎ উত্তর ভারতীয় প্রভাব পড়েছে।

    …. ২ ….

    গতবছর দাদা হেমাকে নিয়ে দুদিনের জন‍্য ভবানীপুরে এসেছিলেন। তখন সতেরো‌র হেমাকে দেখে সরমার‌ই ঘোর লেগে গেছি‌ল তো রজতের আর দোষ কী। তখন সদ‍্য পনেরোর রজত কৈশরের খোলস ছাড়ছে। দু বছরের বড় মামাতো দিদিকে দেখে ওর চোখ ট‍্যারা হয়ে গেছে। পূরবী তখন চোদ্দ আর উদিতা এগারো। ওরা আসেনি তবে দাদা ওদের কিছু ছবি এনেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই বড় হলে ওরাও দিদির মতোই ঝলমলে দেখতে হবে। দাদার কন‍্যাভাগ‍্য ভালো। মনে হয় মেয়েদের বিয়ে দিতে বেগ পেতে হবে না দাদাকে। বাড়ি বয়ে এসে পাত্রপক্ষ নিয়ে যাবে ওদের।

    এর আগে একবার দাদা বছর ছয়েক আগে তিন মেয়ে ও মাকে নিয়ে এসেছি‌ল ভবানীপুরে। তখন ওরা সবাই ছোট। হুটোপুটি করে খেলেছে একসাথে। ঐ বয়সের পর থেকে ছেলেমেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে বাহ‍্যিকভাবে অনেক পরিবর্তন হয়। তাই গতবছর রাজু সতেরোর হেমাকে দেখে ছ বছর আগে দেখা এগারো‌র হেমাকে মনেই করতে পারলো না। হাঁ করে তাকিয়েছিল। দেখে সরমা‌র খুব মজা লেগে‌ছিল।

    হেমার বয়সে তাঁর‌ও রূপ ছিল আগুনের মতো। দশাশ্বমেধ ঘাটে চান করে উঠে তখন অনেক পুরুষকে তাঁর রূপের সরোবরে নীরব মুগ্ধতা‌য় অবগাহন করতে দেখেছেন। পরিস্থিতির‌ ফেরে নারী‌র সৌন্দর্য্য সুন্দরী‌ রমণী‌র ভাগ‍্যে হয়ে দাঁড়াতে পারে আশীর্বাদ বা অভিশাপ।

    পিঠোপিঠি দু বছরের বড় মামাতো দিদি হলে কী হয় ওরা তো আর জন্মাবধি যৌথপরিবারে একসাথে বড় হয় নি। তাই বহু‌দিন বাদে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠা হেমাকে হঠাৎ দেখে রাজু মুগ্ধতার বিহ্বলতা‌য় অভিভূত হয়ে গেছি‌ল। যে দুদিন দাদা ভবানীপুরে ছিল রাজু হেমাকে ছায়ায় মতো সঙ্গ দিয়েছে।হেমা‌‌ও রাজুকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছিল। ওর চুল ঘেঁটে আদর করে বলেছে, "ওমা কত বড় হয়ে গেছিস রে তুই! বেশ লম্বা চ‌ওড়া হয়েছিস তো! আর কিছুদিন বাদে তো রীতিমতো হ‍্যান্ডসাম ম‍্যান হয়ে যাবি। দেখবি মেয়েরা তখন তোকে দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না"। স্বভাব লাজুক রাজু হেমাদির এহেন প্রশংসায় লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

    এবার একবার বলতে‌ই যে রাজু কেন পত্রপাঠ বেনারস যেতে রাজি হয়ে গেল তা ঠিক‌ই বুঝেছে‌ন সরমা। রাজু তড়িঘড়ি ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করে আনলো। দাদাকে টেলিগ্ৰাম করে পৌঁছনোর তারিখ জানি‌য়ে দিন চারেক বাদে ফেরার টিকিট কাটার কথা জানালো। ঘরকুনো কমলাকান্ত‌কে ছেড়ে বেশিদিন কখনো বাড়ির বাইরে থাকেননি সরমা।

    বেনারস গিয়ে সরমা বুঝলেন মায়ের শরীর এমন কিছু খারাপ হয়নি। আসলে সেই যে মেয়েটা বিয়ে করে চলে গেল তারপর গত উনি‌শ বছরে মোটে বার চারেক এসেছে এখানে। আর উনি গেছেন কলকাতা‌য় বার তিনেক। বয়স হয়েছে, কবে বাবা বিশ্বনাথ তাঁর চরণতলে ডেকে নেন ঠিক আছে। কিছুদিন ধরে মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাঁর। তাই এটুকু ছলনার আশ্রয় নিয়ে অবিনাশ‌কে বলে তার করিয়ে সরমাকে ডেকে পাঠিয়েছে‌ন।

    সরমার সাথে রাজুকে দেখেও চোখ জুড়িয়ে গেল দিদার। একদম মামার বাড়ির ধাত পেয়েছে ছেলেটা। সরমা বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থেকে মায়ের সাথে নানা গল্প করেন। মায়ের সাথে কাশী বিশ্বনাথ, সংকটমোচন হনুমান ও আরো নানা মন্দিরে যান। বেনারস তো মন্দির নগরী। মন্দিরের শেষ নেই।ওদিকে সেই চারটে দিন যেন রাজুর স্বপ্নের মতো কেটে গেল। একটু দুরে বলে সেবার সারনাথ যাওয়া হোলো না। তবে একদিন গেল রামনগর ফোর্ট, একদিন ঘুরে এলো BHU থেকে। বাকি সময় গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ালো। গঙ্গা আরতি দেখলো। দুদিন গঙ্গা‌য় নৌকাবিহার‌ও হোলো।

    তিনটি ভিন্ন বয়সের ঝলমলে সুন্দরীর সাথে ঘুরে বেড়াতে দেখে সমবয়সী অপরিচিত কিছু ছেলে রাজুকে বেশ ইর্ষান্বিত হয়ে দেখছিল। সেবার বেনারস থেকে চলে আসার সময় রাজুর বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। হিসেব মতো তার কারণ হ‌ওয়া উচিত ছিল ওর থেকে বছর খানেক ছোট বছর পনেরোর ঐশী কিশোরী পূরবী। কিন্তু মানুষের মন সর্বদা হিসেবে‌র রাজপথে চলে না। প্রায়শই তা ঘুরে মরে পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে।

    …. ৩ ….

    মাস দশেক বাদে দাদা খবর পাঠালো হেমাঙ্গিনী‌র বিয়ের ঠিক হয়েছে। বিয়ের পর ও চলে যাবে আফ্রিকার কেনিয়ায়। ওর খুব ইচ্ছে যাওয়ার আগে একবার কলকাতার দুর্গাপুজো দেখে যায়। অবিনাশ আসতে পারবে না। ওর শ‍্যালক যাবে ছ দিনের জন‍্য কলকাতা‌য়। ওর সাথে‌ই পাঠিয়ে দেবেন হেমাকে।দাদা অনুরোধ করেছেন রাজু ওর হেমা‌দিকে কলকাতার পুজোতো দেখা‌বেই তবে হেমার খুব শখ একবার ধর্মতলা‌য় শহীদ মিনারের মাথায় চড়ে চারপাশের দৃশ‍্য দেখা‌র। মামা জানেন শহীদ মিনারে এখন গেলেই কাউকে উঠতে দেওয়া হয় না। তবে শ‍্যালকের এক আত্মীয়‌র লালবাজারে জানাশোনা আছে। সে পুলিশ পারমিশন করিয়ে দেবে। রাজু যেন ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে হেমার ঐ শখটা মিটিয়ে দেয়।

    মাকে পাঠানো মামার চিঠিটা পড়ে রাজুর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। হেমাদি বিয়ে করে কেনিয়া চলে যাবে! তখন‌ও অবধি রাজু আফ্রিকা বলতে জানতো সাহারা মরুভূমি। বিভূতিভূষণের 'চাঁদের পাহাড়' না পড়েও বন্ধুদের মুখে শুনেছি‌ল উগান্ডা, কঙ্গো অঞ্চলের সেই কিংবদন্তী‌তে জড়ানো রুয়েনজুরি পর্বতমালা‌র কথা যা ওখানকার আদিবাসীদের কাছে সত‍্যি‌ই Mountains of the Moon বা চাঁদের পাহাড় বলে‌ই পরিচিত। সেই কেনিয়ার পূর্বে উপকূলীয় মোম্বাসায় শঙ্কর গেছি‌ল রেল লাইন নির্মাণের চাকরি নিয়ে। কেনিয়া তো এখান থেকে বহুদুরে? এতোদুরে চলে যাবে ও?

    ষষ্ঠী‌র দিন সকালে হেমা ওর মামার সাথে এলো ভবানীপুর। একাদশীর দিন ফিরে যাবে বেনারসে। নবমী‌র দিন বিকেলে শহীদ মিনারে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেছে। হেমা আফ্রিকা চলে যাচ্ছে, একবার দেখতে চায় এই সব ইনিয়ে বিনিয়ে আবেদন করে অনুমতি পাওয়া গেছে।কতো উৎসাহ নিয়ে এলো হেমা কলকাতার দুর্গাপূজা দেখতে। এমনি‌তে হাসছে, স্বাভাবিক‌ভাবেই কথাবার্তা বলছে কিন্তু তবু ওর প্রতিমা‌র মতো সুন্দর মুখে হালকা বিষন্নতা‌র ছোঁয়া। নবমীর দিন রাজু ওর হেমাদি‌কে ভিক্টোরিয়া‌ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে গড়ের মাঠে এক জায়গায় বসে কাতর গলায় বলে, "তোর এতো দুরে বিয়ে ঠিক হোলো কেন রে? ভারতে কোথাও ছেলে পাওয়া গেল না?"

    হেমা হেসে বলে, "তোর মা, মানে পিসির তো বিয়ে হোলো কলকাতা‌য়। কত আর দুর বেনারস থেকে বল, মাত্র এক রাতের জার্নি। তাও ঠাম্মাকে কতবার আক্ষেপ করতে শুনেছি, পিসি নাকি বিয়ের পর মোটে বার চারেক গেছিলেন বাপের বাড়ি। আমার বিয়ে কেনিয়া না হয়ে কেরালায় হলে‌ই বা কী হোতো বল? যদি ভাগ‍্য, সুযোগ, পরিস্থিতি সহায় না হয় কেনিয়া‌ও যা, কেরালা‌ও তাই।"
    রাজু বলে, "যার সাথে তোর বিয়ে হবে তিনি কী করেন ওখানে"?

    -"ভদ্রলোকের ওখানে কাঠের ব‍্যবসা।"
    -"ভদ্রলোক! তোর থেকে অনেক বড় নাকি?"
    -"আমার থেকে বছর নয়েক বড়, মানে আঠাশ ধর। তবে গুজরাতী মানুষ‌টাকে দেখে খারাপ লাগলো না"।
    -"গুজরাতী! কেন? বাঙালি ছেলে পাওয়া গেল না?"
    -"আমাদের মতো ওনারাও বেনারসে কয়েক পুরুষের প্রবাসী গুজরাতী। সোনারপুরা তো মিনি বেঙ্গল। ছোট থেকে আশপাশে অনেক বাঙালি দেখে, তাদের সাথে মিশে বাংলা‌ ভালো‌ই জানেন। আমায় দেখতে এসে তো উনি আমার সাথে বাংলাতেই কথা বললেন।"

    - "বিয়ের যোগাযোগ‌টা হোলো কী করে"?

    - "ওনার বড়দা‌ হসমুখভাইয়ের বেনারসে অনেক‌ দিনের কাপড়ের ব‍্যবসা। বাবা হসমুখ কাকুর থেকে দোকানে‌র জন‍্য কিছু ধার নিয়ে শোধ করতে পার‌ছিলেন না। উনি আমাদের বাড়ির সবাইকে চেনেন। অনেকদিনের পরিচিত। মাঝে মাঝে আসেন। খুব সজ্জন মানুষ। বাবাকে কখনো ধার শোধের জন‍্য চাপ দেননি। মাস দুয়েক আগে একদিন বাড়িতে এসে বাবার সাথে যখন কথা বলছিলেন আমি আড়াল থেকে শুনতে পেয়ে যাই"।

    - "কী?" রাজুর যেন তর সয় না।

    - "উনি বলছিলেন, অবিনাশবাবু, আমার ছোট ভাই মনসুখ কেনিয়ায় অনেক পরিশ্রমে একটা কাঠের ব‍্যবসা দাঁড় করিয়েছে। উদ‍্যমী ছেলে। স্বভাব চরিত্র খুব ভালো। এতোদিন ব‍্যবসা‌‌র জন‍্য অনেক ঘোরাঘুরি করতে হোতো বলে বিয়ে করতে চায় নি। এখন থিতু হয়েছে বলে রাজি হয়েছে। আমরা ওর জন‍্য জানাশোনার মধ‍্যে কোনো সুশীলা মেয়ে খুঁজছি। হেমাকে আমাদের খুব পছন্দ। আপনারাও নিরামিষাশী, কোনো অসুবিধা নেই। হেমা তো সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। আমরা ওকে আদর করে বরণ করে ঘরে তুলবো। যদি রাজি থাকেন ওর বিয়েতে আপনাকে কোনো খরচ করতে হবে না। দোকানের জন‍্য যা ধার নিয়ে‌ছেন তাও ফেরৎ দিতে হবে না। তবে আমার ভাই মনসুখ এখন আঠাশ, হেমা‌র থেকে ন বছরের বড়। বয়সের তফাৎটা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে। হেমা হয়তো রাজি নাও হতে পারে। যদিও মেয়েরা আঠারোর পর যে কোনো বয়সের পুরুষের পত্নী হ‌ওয়ার উপযুক্ত। একবার বলে দেখুন। যদি ও মানতে চায়। তবে ও রাজি না হলে কিন্তু জোর করবেন না"।

    রাজু বলে "মামা কী বললেন"?

    হেমা বলে, "বাবা ওনার কথা শুনে প্রথমে কিছু বলতে‌ই পারেন নি। অমন লম্বা চ‌ওড়া মানুষটা কী করুণ ভাবে মুখ নীচু করে বসেছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল বাবা তখন ভাবছি‌লেন যে দোকানের জন‍্য নেওয়া ধার শোধ করতে পারেন নি বলে মেয়েকে বেচে দিতে হচ্ছে। শেষে যেন অনেক কষ্টে বললেন, আমায় একটু ভাবতে সময় দিন।"

    - "তারপর"? রাজু গভীর কৌতুহলে জানতে চায়।

    - "বাবা দু দিন যেন আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ালেন। চোখে চোখ রাখতে পারছিলেন না। তৃতীয়‌ দিন দোকান থেকে ফিরে রাতের খাওয়ার পর, বোনেরা শুয়ে পড়তে দেখি বাবা একা ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে কাছে গিয়ে বললাম, বাবা, তোমায় কিছু বলার ছিল। বাবা চমকে উঠেও স্বাভাবিক ভাবে বলতে চাইলেন, কী রে হেমা? আমি বললাম, বাবা আমি হসমুখকাকুর সব কথা শুনেছি। জানি আড়াল থেকে কারুর কথা শোনা অনুচিত তবে কথাটা আমাকে নিয়ে হচ্ছিল বলে একটু শুনে আর সরে যেতে পারলাম না। বাবা আমি রাজি। তুমি কাকুকে হ‍্যাঁ বলে দাও"।

    - "তারপর?" রাজু যেন চোখের সামনে কোনো সিনেমা দেখছে। ঘাসের ওপর উৎকণ্ঠায় সোজা হয়ে বসে।

    - "সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ঝকঝকে জোৎস্না‌য় ভেসে যাচ্ছে ছাদ। তবু আমার দীর্ঘ‌কায়, সুপুরুষ বাবার মুখটা যেন নিদারুণ কষ্টে বেঁকে গেল। কী বিষন্ন লাগছিল দেখতে। একটা কথাও বলতে পারলেন না বাবা। শুধু আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্ফুটে বলে ফেললেন, মা আমার, কতো বড় মনের তুই!"

    একটু চুপ করে যায় হেমা। আঁচলে‌র খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বলে, "তখন বাবার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছি‌ল আমার মুখে। কতদিন পর বাবা আমায় ওভাবে আদর করলে‌ন, সেই ছোটোবেলায় যেমন করতেন। জানিস রাজু, আমি‌ও না তখন কেঁদে ফেলেছিলাম, তবে কষ্টে নয়, অদ্ভুত একটা আনন্দে। আমার একটা হ‍্যাঁ-তে কতজন আনন্দ পাবে ভেবে। বাবার দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। আবার হাসবে বাবা। আমার হবু বরকে দেখে, কথা বলে মনের দিক থেকে‌‌ও বড় মানুষ মনে হয়েছিল। তাহলে বোন দুটোর বিয়েতে আমি‌ও দিদি হিসেব কিছুটা সাহায‍্য করতে পারবো।"

    রাজু বলে, "কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সবার ভালো‌র জন‍্য তুই নিজেকে উৎসর্গ করে দিচ্ছিস। তোর কাছাকাছি বয়সের কোনো ভালো ছেলের সাথে তো অনায়াসে বিয়ে হতে পারতো তোর, এ যা করছিস তুই পরে পস্তাতে হবে না তো"?

    হেমা বলে, "মেয়েদের রূপ, যৌবন, তুচ্ছ না হলেও ক্ষণস্থায়ী ব‍্যাপার। হয়তো বড়জোর চল্লিশ বছর অবধি মেয়েদের আকর্ষণীয় লাগতে পারে। আগেকার দিনে বেশী বাচ্ছাটাচ্ছা হয়ে তো তিরিশে‌‌ই কতো মহিলা ফুরিয়ে যেতেন। পুরুষদের তো সন্তানধারণের ধকল স‌ইতে হয় না। তাই পুরুষ‌মানুষ অনেকদিন তরতাজা থাকে। এমন‌ও তো হতে পারে আমার সমবয়সী সুপুরুষ কারুর সাথে বিয়ে হলে সে সুপুরুষ বলে‌ই বিয়ের অনেকদিন পরেও তার প্রতি অনেক মহিলা আকর্ষিত হতে পারেন। তখন সে আমার প্রতি আগ্ৰহ হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ওকে দেখে, কথা বলে মনে হয়েছে আমাকে বিয়ে করে ও যেন হাতে চাঁদ পাবে। আমায় আদর, যত্নে মাথায় করে রাখবে। এসবের কোনো মূল‍্য নেই বলছিস?"

    রাজু আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, "তুই ঠিকই বলছিস, আমি তোর মতো করে এভাবে ভেবে দেখিনি। তুই সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছিস রে।"

    হেমা বলে, "আমার একটা সিদ্ধান্তে এতগুলো মানুষ খুশি হবে, আমার কেন ভালো লাগবে না বল। আমি‌ই বা খারাপ থাকবো কেন। মেয়েদের রূপ একটা বড় ফ‍্যাক্টর হতে পারে কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে হৃদয়। কোনো বড় মনের পুরুষের উদারতা, হৃদয়ের প্রসারতা তার বাহ‍্যিক রূপকে ছাপিয়ে যায়। তাই নটি বছর বা কয়েক হাজার মাইলের দূরত্বের ব‍্যবধান আমার কাছে খুব বড় কিছু বলে মনে হয়নি। হয়তো ও সুপুরুষ নয় কিন্তু মানুষ‌টিকে দেখে আমার খাঁটি মনে হয়েছে। আগেকার দিনে তো এর থেকেও বেশী বয়সের ব‍্যবধানে বিয়ে হোতো।"

    রাজু তবু ব‍্যথিত মুখে বলে, "তুই কতো দুর চলে যাচ্ছি‌স, আবার কবে দেখা হবে কে জানে, একদম ভালো লাগছে না আমার"।

    হেমা বলে, "শুনেছি দেশের বাইরে থাকলে নাকি দেশের জন‍্য মন কাঁদে। আমি‌ও আসবো মাঝে মাঝে। ও বলছিল কেনিয়া নাকি খুব সুন্দর জায়গা। ওখানে আছে পৃথিবী‌বিখ্যাত সব বিশাল অরণ‍্য - মাসাইমারা, আম্বেসেলী, কাকামেগা। আছে কিলিমাঞ্জারো পর্বত। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি‌ও নাকি পশ্চিমী দেশের মতো বড় শহর, মনেই হবে না একদা অন্ধকার মহাদেশের একটি দেশের নগরী। তুই‌ও সময় পেলে আসবি আমার কাছে। তোকে বেড়াতে নিয়ে যাবো ওসব জায়গায়। জন্মে থেকে তে এতোগুলো বছর বেনারসের ঘুপচি গলি দেখেই বড় হলাম। এবার না হয় উন্মুক্ত জায়গায় গিয়ে শ্বাস নেবো। খারাপ কী। তবে এবার ওঠ, চল, নিয়ে যাবি না আমায় শহীদ মিনারের মাথায়?"

    - "ওমা তাইতো! সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। চল চল আমরা ছুটে যাই রাস্তা অবধি" বলে রাজু বিস্তৃত মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু ক‍রলো। দীর্ঘাঙ্গী হেমাঙ্গিনী‌ও আঁচলটা কোমরে গুঁজে ভাইয়ের পিছনে ছোটে। সরমার দেওয়া কমলা কোটা শাড়ি‌র সরু সুতোর মিহি বুনোনে অনেক চৌখুপি‌তে সৃষ্টি হয়েছে মায়াবী স্বচ্ছ‌তা। হাতে চটি নিয়ে সবুজ ঘাসে ফরসা পা ফেলে ছুটন্ত হেমার সতেজ শরীরের আভা যেন ঐ শাড়ি‌র অসংখ্য জালি বাতায়ন দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ‍্য!

    …. ৪ ….

    ভিক্টোরিয়া‌র সামনে‌ই পেয়ে গেল একটা ট‍্যাক্সি। চারটে‌র মধ‍্যে‌ই পৌছে গেল শহীদ মিনারে‌র নীচে। সেদিন ওপরে ওঠা‌র জন‍্য ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। কর্তব্যরত পুলিশ‌ কর্মীটি অনুমতি‌পত্র দেখে খাতায় তারিখ, সময় দিয়ে স‌ই করিয়ে বলে দিলেন ওপরে গিয়ে রেলিং থেকে যেন নীচের দিকে না ঝোঁকে। একবার একজন পড়ে গেছি‌লেন ওখান থেকে। আর পাঁচটার মধ‍্যে যেন নীচে নেমে আসে। হেমা বলে, "এমা, রাজু, তাহলে কী হবে?"

    বছর পঁয়তাল্লিশের পুলিশ‌ কর্মী‌টি একটু অবাক হয়ে বলেন, "কেন? কী হয়েছে?"
    হেমা বলে, "কাকু, আমি বেনারস থেকে এসেছি শহীদ মিনারের ওপর থেকে গঙ্গা‌য় সূর্যাস্ত দেখবো বলে। দুমাস বাদে বিয়ে হয়ে চলে যাবো আফ্রিকা, আবার কবে এখানে আসবো কে জানে। পাঁচটার মধ‍্যে নীচে চলে আসতে হলে তো সূর্যাস্ত‌ই দেখা হবে না। আমি কাগজে দেখেছি, আজ সূর্যাস্ত পাঁচটা দশে"।

    হেমার চেহারা‌টাই যা একটু বড়সড় কিন্তু মুখটা নিস্পাপ সুন্দর। ওর কথা বলার ধরণটাও আদুরে সরলতা মাখা। মনের দিক থেকে খুব কর্কশ মানুষ না হলে ওকে দেখে, ওর কথা শুনে নরম হয়ে যাওয়া খুব‌ই স্বাভাবিক। পুলিশ‌ কর্মী‌টির মুখে‌ও যেন নিমেষে খেলে যায় হালকা মেঘের ছায়া। কে জানে হয়তো তাঁর‌ও আছে হেমার মতো কোনো মেয়ে।

    বলেন, "তুমি তো এখনও ছেলেমানুষ, এর মধ‍্যে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে? আফ্রিকা‌য়"? বড় করে মাথা নেড়ে সায় দেয় হেমা। উনি বলেন, "ঠিক আছে, আমার ছটা অবধি ডিউটি। সূর্যাস্ত দেখে ছটা‌র মধ‍্যে নেমে এলেও চলবে। আমি সিঁড়ির লাইট জ্বালিয়ে রাখবো। আমি তিন বছর হোলো নীচে এই গেটেই ডিউটিতে আছি, সাথে আরো দুজন আছে, চাইলে‌ই উপরে যেতে পারি, তবু আজ অবধি কখনো সূর্যাস্তের সময় ওপরে গিয়ে দেখার কথা মনেই হয়নি। অথচ তুমি কতদুর থেকে দেখতে এসেছো। যাও দেখে এসো। নেমে এসে বোলো, কেমন লাগলো"।

    মানুষের গিজগিজে ভীড় - অফিস ফেরতা বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল, রাস্তা দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা জলের ধারা ডিঙিয়ে কেউ ব‍্যস্ত হয়ে ছুটছে বাসের দিকে, সুলভ শৌচালয়ের ছাদে কিছু কাক গাছবাড়িতে ফেরার আগে শেষবারের মতো করে নিচ্ছে কর্কশ আলাপ, রাস্তায় উড়ছে এঁটো শালপাতা, চায়ের কাপ, ফুটপাতে ঝিমোচ্ছে ঘেয়ো কুকুর, শীর্ণ এক তরুণী ভিখারিনী ভাড়া করা নির্জীব শিশু কোলে ভিক্ষে করছে, সকাল থেকে এক‌ই কথা বলে বলে ক্লান্ত হকার আবার একটা বাসে উঠে বিরস মুখে বলছে - "এই যে দাদারা, ভায়েরা, চুপচাপ বসে না থেকে, টুকটাক মুখ চালান, তিনটে চার আনা, একটা দশ, যত চুষবেন তত রস", ...
    শহীদ মিনারের মাথায় সেই শেষ বিকেলে তখন নীচের এহেন বিবর্ণ নিত‍্যনৈমিত্তিকতার লেশমাত্র নেই। ওপরে তখন স্বর্ণালী আলোয় বহুদুর অবধি ভাসছে বিস্তীর্ণচরাচর। দুর থেকে অনেক কিছু‌ই সুন্দর লাগে। কাছে এলেই স্পষ্ট হয় কিছু মলিন‌তা। মিনারের ওপরে উঠে খুশি‌তে উচ্ছ্বসিত হয়ে যায় হেমা। কতদূর যে দৃষ্টি চলে যায় অবাধে!

    ঐ তো দক্ষিণে দেখা যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। শ্বেত গম্বুজের মাথায় ব্রোঞ্জের পরী ডানা মেলে বাজাচ্ছে বাঁশি। একটু আগে ওখান থেকেই তো এলো ওরা। পশ্চিমে গঙ্গা। অস্তমিত সুর্যের রঙে লালচে হয়ে গেছে জল। মানুষের উদ্ভাবনা ও উদ‍্যমের উজ্জ্বল সাক্ষর হয়ে উত্তর পশ্চিম দিশায় গর্বিত ভঙ্গিতে দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাওড়া ব্রীজ। তার রজতশুভ্র ধাতব শরীরে‌ও পিছলে যাচ্ছে সোনা রঙ। আফ্রিকা‌য় গেলে হেমার গুরুজন বর ওকে ব্লু নাইল ও হো‌য়াইট নাইলে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছে। গোল্ডেন নাইল বলে কিছু নেই। অস্তরাগে‌র আলোয় দক্ষিণে কোমরে মেদুর বাঁক নিয়ে এলায়িত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা স্বর্ণালী গঙ্গা‌ও দারুণ মোহময়ী লাগছে। নদী‌ তো নারী‌র‌ই মতো। তার পাহাড়ি উদ্দামতায় প্রেয়সীর উচ্ছলতা, সমতলে তাকেই আবার মনশ্চক্ষে লাগতে পারে মাতৃসমা।

    উচ্ছল আনন্দে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে হেমা। শহরের নানা আবিল নীচতা তখন পড়ে আছে অনেক নীচে। হেমা‌র ছটফটে আনন্দ দেখে‌ও রাজুর ক্রমশ মন খারাপ হয়ে আসে। গঙ্গার দিক থেকে ধেয়ে আসা রে রে হাওয়ায় শাড়িতে অনভ‍্যস্থ হেমার কমলা কোটার আঁচল উড়ছে পতাকার মতো। বেপথু হয়ে হাসছে হেমা খিলখিলিয়ে। বেনারসে ও সালোয়ার কামিজ‌‌ই পরে। এখানে দামাল হাওয়ায় সামলাতে পারছে না শাড়ি।

    একবার পাড়ার দুর্গাপুজোর ঠাকুর বায়না করতে পাড়ার বড়দের সাথে রজত‌ও গেছি‌ল কুমার‌টুলি। কিছু ঠাকুরের গায়ে তখন দুধেআলতা রঙ করা হয়েছে। ফরসা কোনো মানবীর ত্বকের মতোই লাগছিল। চার সন্তানের জননী দৈবশক্তিপুঞ্জ‌জাত অনন্ত‌যৌবনা ঈশানীর দুধে আলতা পীনপয়োধরা সম্পদ দেখে রাজু বিমোহিত। তখন‌ও অবধি বাস্তবে কোনো যৌবনবতী নারী‌র নগ্নসৌন্দর্য দেখা‌র সুযোগ হয়নি। কোন শিশু‌কালে বুকের দুধ খেয়েছে তা আর স্মৃতি‌তে‌ও নেই। কিন্তু ঐ মৃন্ময়ী মূর্তির নিটোল বক্ষসৌন্দর্য দেখে সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল - বাঃ, কী সুন্দর!

    হেমার হঠাৎ খেয়াল হয় রাজু কেমন বিষন্ন মুখে থম মেরে মিনারের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। দুরে কিছুই দেখছে না। এক ঘোরলাগা দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। কী যেন ছিল সেই দৃষ্টিতে। হেমা থমকে যায়। দিগন্ত আড়াল করে ওর পেলব অস্তিত্ব নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, "কী হয়েছে রে? এমন প‍্যাঁচার মতো মুখ করে আছিস কেন?
    সদ‍্য সতেরোর রাজু হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে, "তুই কতো দুরে চলে যাচ্ছি‌স, একদম ভালো লাগছে না"।
    হেমা বলে, "এ্যাই দ‍্যাখো পাগল ছেলের কাণ্ড। এ্যাত্তো করে বোঝালাম তখন ওখানে তাও তুই সেই এক সাপের মন্ত্র আউড়ে চলেছিস? পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদে নাকি?"

    হেমা রাজুর মুখটা দু হাতের তালুতে ধরে। এভাবে পুরুষ‌ই চিরকাল তালুতে নিয়েছে নারী‌র অধর। হেমা রাজুর মাথায় মাথায়। ওর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলে, "বোকার মতো কাঁদছি‌স কেন তুই? কী হয়েছে তোর?" রাজুর মুখে ঝাপটা মারে হেমা‌র শ্বাসের উষ্ণতা‌, ওর শরীর ছুঁয়ে উঠে আসা চন্দন সুগন্ধি‌র আবেশে চোখ বুঁজে আসে রাজুর। হেমা দেখছে ঈশ্বর পুত্রের মতো সুকুমার মুখে উপরোষ্ঠে সোনালী পাটের মতো হালকা রেখা, গালে মোলায়েম নবী‌ন গুল্মের উন্মেষ। ওর সুকোমল তালুতে ধরা এক কিশলয় পুরুষের অমল মুখ।

    অনেক চেষ্টায় রাজু বলতে যায়, "তোকে আমি … তুই চলে গেলে … তোকে ছেড়ে …" আর কিছু বলতে পারে না। ওষ্ঠরঞ্জনী ছাড়াই হেমা‌র রক্তিম নরম ওষ্ঠ থামিয়ে দিয়ে‌ছে রাজুর কম্পিত ওষ্ঠ থেকে উঠে আসা অবুঝ আবেগ। আর কিছু শুনতে চায় না হেমা। কী হবে শুনে? সাধ থাকলেও তো সবাই‌কে খুশি করার সাধ‍্য ওর নেই। সেই স্বর্ণালী বিকেলে গঙ্গার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে‌ছিল হেমা। আবার এক দমকা হাওয়ায় শাড়ি উড়ে যায়। চোখ মেলে রাজুর‌ আবার‌‌ও মনে হয়, বাঃ কী সুন্দর! হেমাঙ্গে কমলা ব্লাউজে আবৃত হেমা‌র সজীব নবী‌ন কমনীয়তা কোনো সুদক্ষ শিল্পী‌র কল্পনা‌জাত মৃন্ময় সৃষ্টি‌র থেকে কোনো অংশে কম সুন্দর নয়।

    আর নিজেকে সামলাতে পারে না রাজু। হেমার বুকে মুখ ডুবিয়ে চন্দনগন্ধী পেলব নম্রতা‌য় তলিয়ে যায়‌ ও। এই নম্রতা তৃষ্ণার্ত শিশু, অবুঝ কিশোর, অশান্ত পুরুষ‌কে চিরকাল জুগিয়েছে প্রাণদায়ী তৃপ্তি, আশ্বাস,শান্তি। ওর হেমা‌দির বুকে মুখ গুঁজে রাজু প্রলাপের মতো বলে যায়, "তুই যাস না, তুই অতো দুরে যাস না"। নোনা জলে ভিজে যায় হেমার অনাঘ্রাতা বুক। দুহাতে রাজুকে বুকে জড়িয়ে ওর মাথায় চুপটি করে চেপেথাকে হেমার‌ গাল। চোখে নামে কুয়াশা। সেদিন বেনারসে চন্দ্রালোকিত ছাদে ওর বাবার চোখে‌ও নেমেছি‌ল অঝোর ধারা। এ মেয়ে সবাই‌কে এমন কাঁদায় কেন মায়ায়?

    এতো পরিকল্পনা করে এসেও হেমার সেদিন দেখা হোলোনা মিনার শীর্ষ থেকে সূর্যাস্ত। তখন ও ভুলেই গেছে তা। ওর অমেয় মায়ায় ভরা সুকোমল বুক থেকে তখন সূর্যোদয়ের উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে প্রাকযৌবনে উপনীত এক কিশোর। তার আবেগ‌অবুঝ। পরে সাংসারিক বোধে‌র উন্মেষে হয়তো কেটে যাবে। তবে সেই শেষ বিকেলের নির্জন মিনার শীর্ষে ওর বিহ্বল ভাইটার অবুঝ অস্থিরতা নিজের পেলব মায়ায় জড়িয়ে শান্ত করতে গিয়ে হেমাও অনুভব করে অচিন আনন্দের স্বাদ। সূর্যাস্ত দেখতে না পাওয়ায় দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার জন‍্য সে আনন্দ‌ও কম নয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৫৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন