এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  অর্থনীতি

  • তৈরী পোশাক শিল্পে নীলকর ভূত

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | অর্থনীতি | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১৪৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • শৈশবে একটা প্রশ্ন আমায় প্রায়ই তাড়া করতো। যে দেশটি জিতে নেয় অলিম্পিকের অধিকাংশ সোনা, প্রতিবছর নোবেল পদকগুলোর বেশীরভাগ শোভা পায় যার  ক্রোড়ে, যার রয়েছে এমন সব অতিকায় কোম্পানি যাদের একেকটির আয় গোটা বাংলাদেশের জিডিপিকে  ছাড়িয়ে যায়, সেই দেশটিকে    কেন এক গোলার্ধ পেরিয়ে ছুটে আসতে হয় বাংলাদেশে? ভীড় জমাতে হয় বাংলাদেশের জীর্ণ-শীর্ণ বাংলাদেশী গার্মেন্টসগুলোতে? আশ্চর্য হল, প্রশ্নটা থেকে এই পরিণত বয়সেও মুক্তি মেলেনি আমার, সুযোগ পেলেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমায় শৈশবের মত!   

    যখন বাংলাদেশের রানাপ্লাজায় সহস্রাধিক লোক জীবন দিয়ে পৃথিবীর সব থেকে বড় ইন্ড্রাস্টিয়াল দূর্ঘটনাগুলোর একটি জন্ম দেয়, তখন একটি আমেরিকান আর্টিকেল বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল, যার শিরোনাম ছিলঃ “বাংলাদেশ ফ্যাক্টরি কলাপসঃ হু রিয়েলি পেইস ফর আউয়ার চিপ ক্লোথস?” এটা সেই সময় যখন বাংলাদেশের টি শার্ট আর জিনসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছিল আমেরিকান সমাজে। কী ছিল বাংলাদেশে তৈরী পোশাকে? এগুলো কি সেই ঢাকাই মসলিনের মত ফিনফিনে ছিল যে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ৫০ মিটার কাপড় এঁটে দেয়া যায়, আর পশ্চিমা তরুণ-তরুণীরা সেই দিয়াশলাই খেলার লোভেই পা বাড়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এর শপিং মলে? মজার ব্যাপার হল, গায়ে-গতরে মসলিন যুগের মত পাতলা না হলেও বাংলাদেশের এই জমানার পোশাকগুলি কিন্তু দামের দিক থেকে ভয়ানক পাতলা। প্রায় এক গোলার্ধ দূরের একটি দেশের মানুষের পোকামাকড়ের মত ঘরবসতি, তাদের সস্তা শ্রম, আর সস্তা সব নিয়মকানুন যাকে অল্প মূল্যেই বদলে দেয়া যায় – সেই গল্পগাঁথা, যা আগে ছিল প্রদীপের আড়ালেই, তা-ই উন্মোচন করে দেখিয়েছিল রিপোর্টটি! কিন্তু যে মানুষগুলি ছিল কারিগর, তাদের যে কালের বিবর্তনে শ্রমিক বানিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে রিপোর্টটি ছিল একেবারেই নীরব।

    বাংলাদেশ গর্ব করে পৃথিবীর নাম্বার টু গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার। ইউরোপে প্রতি তিনজনের একজনের গায়ে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এর টি শার্ট। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজনের একজনকে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ জিন্স পরতে। ১৯৭৮ সালে ফ্রান্সের প্যারিস ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংকের একটি ক্ষুদে চালান দিয়ে যার যাত্রা শুরু, সে-ই আজ ২৮.১৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি নিয়ে আভ্যন্তরীণ রপ্তানি বাজারের ৮২% ও  বৈশ্বিক তৈরী পোশাক বাজারের ৬.৪% দখল করে বসে আছে।  সর্বসাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৈরী পোশাক খাতের রপ্তানি-প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ দেশটির নাম হল বাংলাদেশ।  মৌলিক ও নিম্ন-মধ্য ক্যাটেগরির পোশাক উৎপাদন যার দৈনন্দিন ব্যবহার এমনকি যুদ্ধও ঠেকাতে পারেনি – তা-ই গড়ে দিয়েছে এমন বুনিয়াদ বাংলাদেশের জন্য। তো অর্থনীতির দিকপাল ও নীতিনির্ধারকরা এই শিল্পেই দেখছেন বাংলার প্রাণভোমরা, আর তাই সেট করে নিয়েছেন ৫০ বিলিয়ন ডলারের একটি অতিকায় রপ্তানি টার্গেট অদূর ভবিষ্যতের জন্য।  

    এককালে নীল ব্যবসাকে নিয়ে এমন গর্ব করা হত বিদ্বসমাজে। রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকানাথ, প্রসন্ন ঠাকুরের মত লোকেরা এর পক্ষে কলম ধরেছিলেন। ১৭৭২ সালে যে নীল ব্যবসার সূচনা হয় ফরাসীদের হাতে চন্দননগরের নিকটবর্তী গোন্দলপাড়া গ্রামে, কালে কালে তার লাগাম পুরোই চলে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ১৭৯৬ থেকে ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত নামমাত্র সুদে কোম্পানি প্রায় এক কোটি সিক্কা টাকা ঋণদান করে। উৎপন্ন নীল পাউন্ড প্রতি এক টাকা চার আনায় কিনে নিত কোম্পানি আর লন্ডনের বাজারে পাউন্ড প্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকায় বিক্রি করতে। তো ইংরেজদের জন্য এই চরম লাভজনক ব্যবসার মাঝে দেশেরও লাভ দেখতে পেয়েছিলেন অনেকেরই মতে বাংলার প্রথম শিল্পপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।  তিনি ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারির ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় ‘একজন জমিদার’ নামে লিখেছেন, “ এ দেশে যার ভূ-সম্পত্তি আছে এবং যিনি নিজে তার জমিদারী দেখাশোনা করেন, তারই কাছে এ কথা সুবিদিত যে নীলচাষের জন্য কি বিরাট পরিমাণ পতিত জমিতে আবাদ হয়েছে এবং নীলচাষের মালিকরা যে দেশ জুড়ে টাকা ছড়াচ্ছেন, তাতে দেশের নিম্নশ্রেণীরা কেমন স্বচ্ছন্দে দিনপাত করছে। আগেকার দিনে যে সব চাষী জমিদারের জবরদস্তিতে বিনামূল্যে বা অল্প পরিমাণ ধানের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হত তারা এখন নীলকরদের আওতায় খানিকটা স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে; তারা প্রত্যেকেই নীলকরদের কাছ থেকে মাসিক চার টাকা বেতন পাচ্ছে এবং অনেক মধ্যবিত্ত যারা নিজেকে ও পরিবারকে প্রতিপালন করতে পারত না তারা নীলকরদের দ্বারা উঁচু বেতনে সরকার প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হচ্ছে। এখন তারা জমিদার বা বেনিয়ার খামখেয়ালি ও মর্জি দ্বারা নির্যাতিত হয় না।“

    ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর টাউন হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে  দ্বারকানাথ মত প্রকাশ করেন, “নীলের চাষ যেখানে হচ্ছে তার কাছাকাছি জায়গার জমির দাম বেড়ে গেছে ও চাষাবাসেরও খুব দ্রুত উন্নতি হয়েছে।“ আলোচ্য সভাতেই রাজা রামমোহনকে বলতে শোনা যায়ঃ “নীলকরদের সম্বন্ধে আমি বলতে পারি যে, বাংলা ও বিহারের কয়েকটি জেলায় নীলকুঠিগুলির কাছাকাছি অঞ্চলে আমি ঘুরেছি। আমি দেখেছি যে, নীলকুঠির আশেপাশের বাসিন্দারা নীলকুঠি থেকে দূরের জায়গার লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড় পরে ও ভাল অবস্থায় বাস করে।“ আলোচ্য সভায় বিশিষ্ট জনেরা যে মত ব্যক্ত করেন তার সারাংশ হল, সভ্য ইংরেজদের মাধ্যমে আমাদের সভ্যতার অভাব ঘুচবে, ইউরোপীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ দান আমাদের দেশের ব্যবসার উন্নতি ঘটাবে, অর্থনীতির চেহারাটাই আমূল পাল্টে দেবে।  

    ইতিহাস সাক্ষী যে, আমাদের দেশজ অর্থনীতির চেহারাটা চিরকালের জন্যই পালটে গিয়েছিল তখন থেকে।  ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির তদন্তকালে ডেভিড হিল নামে ইস্ট ইন্ডিয়ার সরকারে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নীল চাষে বাংলাদেশের কোন উন্নতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন,  “গ্রামের চেহারার (অর্থাৎ রাস্তাঘাটের) যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, কিন্ত জনসাধারণের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি।“ ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেন, “তিনি (ইংরেজ নীলকর) প্রজাদিগের নীলের অত্যল্প অনুচিত মূল্য ধার্য করেন। নীলকর সাহেব স্বাধিকারের একাধিপতিস্বরূপ, তিনি মনে করিলেই প্রজাদিগের সর্বস্ব হরণ করিতে পারেন, তবু অনুগ্রহ ভাবিয়া দাদনস্বরূপ যৎকিঞ্চিৎ যাহা প্রদান করিতে অনুমতি করেন, গোমস্তা ও অন্যান্য আমলাদের দস্তুরি ও হিসাবানাদি উপলক্ষে তাহারও কোন না অর্ধাংশ কর্তন যায়! একারণ প্রজারা যে ভূমিতে ধান্য ও অন্যান্য শস্য বপন করিলে অনায়াসে সম্বৎসর পরিবার প্রতিপালন করিয়া কালযাপন করিতে পারে, তাহাতে নীলকর সাহেবের নীল বপন করিলে লাভালাভ দূরে থাকুক, তাহাদিগকে দুশ্ছেদ্য ঋণজালে আবদ্ধ হইতে হয়।“

    ইউরোপীয়দের নীলব্যবসাকে আরো জাঁকিয়ে তোলার জন্য রামমোহন-দ্বারকানাথ ও আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে গভর্নর-জেনারেল লর্ড বেন্টিংকের সমর্থনসহ একটি আবেদন পত্র পৌঁছুনো হয় ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে। কিন্তু কিছু বনেদী জমিদার এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আর একখানি পত্র প্রেরণ করেন ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে যার মূল ভাষ্যঃ “যে সব জেলায়  নীলকররা বা অন্যান্য লোকেরা নিজেদের বাসস্থান স্থাপন করেছেন সেখানে জনসাধারণ অন্যান্য স্থানের জনসাধারণের চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কেননা নীলকররা বলপূর্বক ঐসব জমি দখল করেছেন এবং ধানগাছ নষ্ট করে নীলচাষ করেছেন (ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ার এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের অভাবের তাই কারণ)। …ভারতের অধিবাসী বিশেষ করে যাদের পদমর্যাদা আছে বা যারা উচ্চশ্রেণীভুক্ত – ভূসম্পত্তি ব্যতীত তাদের জীবিকার্জনের অন্য কোন পথ নেই। এই অবস্থায় যদি তাদের জমিদারী (যা বকেয়া খাজনার জন্য প্রকাশ্যে নিলাম হতে পারে) বিদেশী দ্বারা ক্রয় করতে দেয়া হয়, তবে জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য এবং পদমর্যাদা রক্ষার্থে তাদের অত্যন্ত দুঃখ কষ্টে দিনযাপন করতে হবে।“  

    এই জমিদারেরা শ্রেণীস্বার্থেই কথা বললেও তাদের বক্তব্যে নীলচাষের সত্যিকার শ্রী’টা ঠিকই ফুটে উঠেছিল। তখনকার দেশী জমিদারেরা নীলচাষ মেনে নিতে না পারলেও বর্তমানে দেশী শিল্পপতিরা আরএমজি চাষ দুবাহ বাড়িয়ে গ্রহণ করছেন, মালয়েশিয়া ও কানাডায় সেকেন্ড হোমের বিনিময়ে তারা বিশ্বের রিটেইল মোগলদের হাতে তুলে দিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি অর্থ, আর ওদিকে আমাদের শ্রমিকদের হতে হচ্ছে দগ্ধ হয় বাহ্যিক আগুনে, নয়তো আভ্যন্তরীন জীবনের ন্যূনতম দাবী না মেটাতে পারার আগুনে। নীলচাষের মতই রাশি রাশি  সুযোগ-সুবিধার যুক্তি ছোঁড়া হয় আমাদের তৈরী পোশাক শিল্পের জন্যও । আর রাশি রাশি বঞ্চনা ও সংকোচনের ইতিহাস থেকে যায় আড়ালে। নীল চাষের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে ছিল শোষণ; আর ছিল জমির উর্বরতা-হানি ও এতদসংশ্লিষ্ট দূষণ। আধুনিক কালের তৈরী পোশাকের শিল্প-যাদুতে একই রকম শোষণ ও দূষণ আরো পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে দেখতে পাওয়া যায়!   

    প্রথমে শোষণের ব্যাপারটিতে আসা যাক। শুমেখার তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’-এ একটি আফ্রিকান টেক্সটাইল মিল পরিদর্শনের কথা জানান যেখানে গিজগিজ করছিল ধনী দেশ থেকে আমদানিকৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি। স্থানীয় তুলো টপ কোয়ালিটি সুতো উৎপাদনে যথেষ্ট নয় বলে কারখানাটিকে এমনকি প্রয়োজনীয় কাঁচামালও ধনী দেশ থেকে আমদানি করতে হত। এরকম উন্নয়ন মডেলের আরো উদাহরণ মেলে শুমেখারের বইটিতে যেখানে সাবান বা খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন পড়ত সু-শোধিত ও শোভিত সব কাঁচামাল যা শুধু ধনী দেশেই মিলত অতি চড়া মূল্যে। এদিকে দেশীয় অব্যবহৃত কাঁচামাল আবার রপ্তানি হত ঐসব ধনী  দেশে অতি স্বল্প মূল্যে। শুমেখারের কথায়ঃ “দরিদ্র দেশগুলিকে ঠেলে দেয়া হত ধনী দেশের উৎপাদন পদ্ধতি ও ভোগ-মানকে লুফে নিতে, যা দরিদ্র দেশগুলির স্বনির্ভরতার সব সুযোগকে বিনষ্ট করে দিত। এর অবধারিত ফলাফল ছিল, দরিদ্র দেশগুলির অজান্তেই একটি নয়া উপনিবেশবাদের গোড়াপত্তন।“  কেউ যদি একটি বাংলাদেশী পোশাক কারখান পরিদর্শন করেন, তাহলে শুমেখারের পরিদর্শিত কারখানাটিকে অবিকল দেখতে পাবেন, সন্দেহ নেই।

    আমাদের তৈরী পোশাকের বাজারদরে আগে থেকেই ভাটার টান ছিল, যা ইতোমধ্যে ঠেকেছে তলানীতে। রানা প্লাজার মত দুনিয়া কাঁপানো দালান ধ্বসের পর রিটেইল পুঁজিপাতিরা অ্যাকর্ড ও আল্যায়েন্স নামে দুটো কারখানা পরিদর্শক গড়ে তুলেছে, যাদের কাজ হল গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে আরো পরিবেশবান্ধব করে তোলা। ইতিমধ্যে ১৫৭ টার মত গার্মেন্টস কারখানা পাস করেছে টেকসই হওয়ার পরীক্ষায়; ৩০ শতাংশ কম শক্তি  খরচ করে তারা রূপান্তরিত হয়েছে ‘গ্রিন’ ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু   এই পথে করতে হয়েছে যে সাধনা, ঝরাতে হয়েছে ঘাম, তার দাম দিচ্ছে না রিটেইল ক্রেতারা। প্রায় ১৫-২০ শতাংশ খরচ বেড়ে গেলেও গার্মেন্টসগুলোর বরাতে কেবল জুটেছে মাত্র ২ শতাংশ কর-ছাড়, আর একখানা সার্টিফিকেট ‘লিড’ নামক আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান হতে। কাঁচামাল , পরিবহন খরচ কয়েক গুণ বাড়লেও পোশাকের মূল্য ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছে বিদেশী ক্রেতারা প্রতিযোগীতার দোহাই দিয়ে। একটা হিসেবে দেখা যায়, রিটেইল মূল্যের মাত্র ১০-১৫% জুটছে বাংলাদেশের কপালে, অথচ এক্ষেত্রে ৩০% একটি স্বীকৃত মানদ্বন্ড আন্তর্জাতিক আঙিনায়। বাংলাদেশের নোয়ানো মাথার পুরো সুযোগ যে নেয়া হচ্ছে, তার একটি বড় প্রমাণ হল - যে  পণ্যটি শক্তিশালী তুরষ্কের কাছ থেকে কিনতে হয় ৫ ডলারে, সে একই পোশাকের জন্য মাত্র  ২ ডলার গুঁজে দিয়ে পথ দেখতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে। আবার মাল দেয়ার পরেও আটকে রাখছে, এক তরফা অর্ডার বাতিল করছে দাপুটে বিদেশী রিটেইল ক্রেতারা, মাঝে মাঝে যাদের স্রেফ ঈশ্বর ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না। করোনা পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩২ টি বাংলাদেশী গার্মেন্টস প্রখ্যাত আমেরিকান ব্রান্ড ‘সিয়ার’ এর বিরুদ্ধে মামলা করে বিপুল পরিমাণ অর্ডার বাতিলের ঘটনায় সংক্ষুদ্ধ হয়ে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল ও ২২.৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ইতিমধ্যেই শিপমেন্ট হয়ে গেলেও  দিন শেষে বাদীদের বিধিতে বরাদ্দ হয় মাত্র ৬.৩ মিলিয়ন।

    এবার আসা যাক দূষণের বিষয়ে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক-যুক্ত তরল বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে শোধন করে ব্যবহার করতে হবে বা ফেলে দিতে হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গবেষণায় আমাদের নদনদীর দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে টেক্সটাইল কারখানাগুলো।  অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর জীব বৈচিত্র্য তছনছ করা, মাছের মারি ঘটনাো ও  নদীর উপর নির্ভরশীল ফসলগুলোকে হত্যা করা – এসব অপরাধে আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছিল পোশাক-সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানাগুলো। কর্মসংস্থানের রসগোল্লা গিলিয়ে চোখ অনেক দিন বন্ধ বেঁধে রাখার পর,  অবশেষে  ‘তৈরী পোশাক’ শিল্পটি  ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষিত হয়েছে আমাদের ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২১’ এর সংযোজনীতে। ১৯৯৭ সালের বিধিমালায় শুধুমাত্র কাপড় রঙ করার রাসায়নিক প্রক্রিয়াটি লাল তালিকায় ছিল। ‘ওয়াশিং’ কারখানাগুলি ছিল ‘কমলা’ বা কম ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায়। নতুন বিধিমালায় ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘লাল’ তালিকায় যুক্ত হয়েছে টেক্সটাইল খাতের সমন্বিত প্রাকৃতিক ও সিনথেটিক টেক্সটাইল মিলগুলো (স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং), টেক্সটাইল ডায়িং কারখানা (দৈনিক উৎপাদন ২৫ টনের বেশী হলে), এবং ওয়াশিং কারখানা (দৈনিক উৎপাদন ২৫ টনের বেশি হলে)।  বিধিতে বলা হয়েছে, বস্ত্র শিল্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে হলে লাল তালিকায় বর্ণিত শর্তগুলো মেনে চলতে হবে। কিন্তু এই কাগুজে বাঘ দূষণ-সিংহকে কতখানি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে! বলতে কি,  যেখানে ছাড়পত্র ছাড়াই হেসে-খেলে জীবন ধারণ করা যায়, সেখানে লাল রোগের শর্তগুলো মানতে যেন বয়েই গেছে বাঘা বাঘা গার্মেন্টস কারখানাগুলির!

    একজন পশ্চিমা নাগরিক যখন অফিসের পথে হাঁটতে থাকেন, কখনো কি তার মাথায় প্রশ্ন উদ্রেক করে,  কী অঢেল পানিসম্পদ ব্যয়িত হয় তার ট্রাউজারটি ধৌত ও রঙ করার কাজে? ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশান এর একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর গার্মেন্টস  শিল্পের সুতো ও কাপড় রঙ এবং ধৌত করার কাজে ১৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশে – এটি সেই পরিমাণ তরল যা দিয়ে ৬,০০,০০০ অলিম্পিক সুইমিংপুলকে ভরে দেয়া যায়,  বা, ৮,০০,০০০ মানুষের সারা বছরের পানির কাজ নির্বিঘ্নে চলে যায়!  আমরা যে  জিন্স প্রতিদিন পাদুটোর উপর চেপে রাখি, তার ওজন প্রায় ১ কেজি, আর এইটুকু পোশাককে ধৌতকরনে খোয়াতে হয় প্রায় ২৫০ লিটার পানি। আর এ হচ্ছে মিষ্টি পানি, ভূগর্ভস্থ চ্যানেল থেকে যা পাম্প করে বের করা হয়। পানির টেবিল কিন্তু অসীম নয়; প্রতিবছর ২.৫% নেমে যাচ্ছে। আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির চ্যানেলগুলো এভাবে ক্রমেই রিক্ত হচ্ছে পোশাক দৈত্যের খাবার যোগন দিতে গিয়ে, আর  পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেবে যাওয়ার ঝুঁকিসম্পন্ন একটি ভূত্বক অবশিষ্ট রেখে যাচ্ছে!  

    আমাদের পানি সম্পদের এই মহাবিপর্যয় দেখার জন্য অবশয ভূ-গর্ভে ভ্রমণে প্রয়োজন নেই। নদীগুলো ভ্রমণ করলে খালি চোখেই ধ্বংসের অনেক চিহ্ন খালি চোখেই ধরা পড়বে। ঢাকার পোশাক শিল্পের আবাসস্থলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া তুরাগের পানি ইতিমধ্যেই কুচ কালো আকার ধারণ করেছে। নদীটার কাছে গেলেই সে এমন একটা গন্ধ ছড়িয়ে দেবে  যে কারো পক্ষে সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নেয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে ৭৮৯ টি ডায়িং ও ফিনিশিং কারখানা আছে প্রায় ৪০০০ গার্মেন্ট কারখানার চাহিদা মেটাতে। আইএফসির তথ্য অনুযায়ী,  এরাই ভূগর্ভস্থ পানির প্রধান ভোক্তা ও দূষক। অদক্ষতার সাথে ‘দামে সস্তা’র মনে হয় একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে; আর এই কারণেই হয়ত আমাদের কারখানাগুলোর বেশিরভাগই  অদক্ষ, আর এ কারণে তারা বেশী পানি, কেমিক্যাল, আর গ্যাস ব্যবহার করে। অথচ শক্তির এই নির্বিচার হত্যাকে এক চতুর্থাংশ কমানো যেত বর্তমান প্রযুক্তি দিয়েই যদি দক্ষতা ও পরিবেশের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালবাসাকে বাড়ানো যেত। বাংলাদেশ যেখানে ২৫০ লিটার পানি ক্ষয় করে এক কেজি ওজনের এক জোড়া জিন্সের জন্মদানে,  সেখানে উন্নত বিশ্বের খরচ হয় মাত্র ৭০ লিটার।

    বাস্তবতা হল, উন্নত বিশ্ব এই অল্প সম্পদও খোয়াতে রাজি নয়, তাই বাংলাদেশের মত ৩য় বিশ্বের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে এই পোশাক শিল্পের এই ‘নেসেসারি ইভিল’ ‘প্রয়োজনীয় শয়তানী যজ্ঞটিকে। আর আমরাও কানা খোঁড়ার মত উজাড় করে চলেছি আমাদের সম্পদ, কারণ এই পথের বাঁক বা খানা-খন্দগুলো তো আমাদের চেনা নেই। এই যে আধুনিক শিল্পবাদ, যা গণ বা ব্যাপক উৎপাদনের (মাস প্রোডাকশান) থিয়োরী মেনে চলে, তা কখনো আমাদের নিজস্ব ছিল না। আমাদের ছিল ঘরে ঘরে উৎপাদন যাকে মহাত্মা গান্ধী  বলতেন ‘প্রোডাকশান বাই মাস পিপল’। গান্ধীজী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দেখেছেন এই দেশজ শিল্পেই। আধুনিক শিল্পবাদকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি কারণ  অভাবকে সীমাহীন বাড়িয়ে চলা আর তার লালসা মেটাতে সম্পদের সীমাহীন শোষণ – এই নীতির উপরই নির্ভরশীল এর কলকব্জাগুলি। বৃহৎ কারখানাগুলির শোষণকে চোরের পরদ্রব্য হরণের সমতুল্য মনে করতেন গান্ধী। শিল্পবিপ্লব হতে শিল্পবাদ, শিল্পবাদ হতে আর্থিক শোষন, আর্থিক শোষনের ফলে অধিক সঞ্চয়, ফলে আর্থিক অসাম্য, আর আর্থিক অসাম্যের ফলে বিশ্বব্যাপি অশান্তি ও যুদ্ধ - এ যেন এক পাপচক্র যার জন্ম আধুনিক শিল্পবাদ হতে।

    গান্ধী শিল্পবাদ নামক পাপকে মোচনের উপায় হিসেবে দুটো ব্যবস্থাপত্র দিয়ে গেছেন বিশ্ববাসীর জন্য -  বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাবলম্বন। এ যেন এক নতুন শিল্পবিপ্লব যেখানে প্রতিটি দেশ খাদ্য ও বস্ত্রের ন্যয় মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটাবে সম্পূর্ণ নিজেদের গড়ে তোলা কারখানা দিয়ে যেখানে বিদেশ থেকে কোন কাঁচামাল আসবে না, আর বিদেশে কোন ফিনিশড প্রডাক্ট রপ্তানি হবে না। এভাবে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়বে এক আত্মনির্ভরশীল শিল্পের রূপকথা।  প্রখ্যাত মানবতাবাদী পন্ডিত আলডুস হাক্সলির মতে, “উত্তম সমাজ রচনার জন্য রাজনৈতিক পন্থা হচ্ছে বিকেন্দ্রীরকরণ, তথা দায়িত্বশীল শাসনের পথ।“ গান্ধীও চাইতেন, মানুষ যেমন আপন পায়ের উপর ভর করে চলে, তেমনি সমাজও হবে স্বয়ংক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল। হ্যা, আমদানি-রপ্তানি থাকবে, কিন্তু তা থাকবে মৌল প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর বাইরের বস্তুর জন্য।

    আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প যেন ‘সঞ্চিত জলাধার অর্থনীতি’র এক বড় উদাহরণ। বড় বড় জলাধার যেমন বাইরের বৃষ্টির জল না পেলে শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়, তেমনি যে অর্থনীতি বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভর করে বেগবান  হয়, সাময়িক চমক দেখাতে সক্ষম হলেও সে ক্রমেই শুকিয়ে  মরে যেতে থাকে। অথচ আমাদের অর্থনীতি যদি ‘অনন্ত প্রবাহিনী অর্থনীতি’র মত থাকত, আমাদের একান্ত নিজস্ব আর দেশজ প্রাকৃতিক সম্পদের বুনিয়াদেই আমাদের আর্থিক কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকতে পারত। গান্ধী সারা জীবন ‘অনন্ত প্রবাহিনির অর্থনীতি’তে বিশ্বাস করে এসেছেন; আর সে কারণেই তার নির্মিত গঠনকর্মের আশ্রমসমূহে স্বাবলম্বনের এক নজরকাড়া স্রোত বয়ে যেত। সেখানে  গম পেষা, সাফাই, সুতোকাটা, বাগানের কাজ - এসব অবশ্যপালনীয় ছিল আশ্রম-সদস্যদের জন্য। যেখানে আমেরিকান শিল্পমালিকরা বাজার দরকে ঠিক, মানে, উচ্চ রাখা ও তাদের মুনাফার পিপে কানায় কানায় পূর্ণ করতে  জাহাজভর্তি কফি বা গুদামভরা গম সমুদ্রবক্ষে ফেলে দিতে কার্পণ্য করত না, সেখানে গান্ধী আবর্জনাকেও ফেলে দিতে রাজী ছিলেন না। বরং একে কাজে লাগিয়ে সার প্রস্তুতের চিন্তা করেছিলেন। তিনি দেশীয় নিম, মহুয়া প্রভৃতি বৃক্ষসম্পদকে কাজে লাগিয়ে সাবান শিল্প; অকেজো বাঁশ, খড়, আর  চটকে কাজে লাগিয়ে  কাগজ শিল্প; আর টুকরো সুতো দিয়ে পিন, কুশন বা জামার বোতাম নির্মাণ শিল্প  গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।  গান্ধির সেই বিখ্যাত উক্তিটি এখানে স্মরণ করা যেতে পারেঃ

    “Let every house holder sit to work
    With his own hand and thus make
    Every house a big industrial farm”

    কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের সেইসব দেশজ শিল্প?  তাদের কারিগরেরা কই এখন? কোথায় আমাদের কুটির শিল্প একটি পরিবার যাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারতো? আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল কাঁসারী, শাখারী, মালাকার, কুম্ভকার, ছুঁতার শিল্পে । আমাদের বস্ত্র শিল্পে ছিল তাঁতী যারা সূক্ষ্ম সুতোর বা রেশমের কাপড় বুনতে পারত; ছিল জোলা ও যোগী যারা গামছা, লুঙ্গি, মশারি বানাত; ছিল আর এক শ্রেণীর বস্ত্রশিল্পী যারা কাঠির সাহায্যে ভেড়ার লোমের কম্বল, নারিকেলের দড়ির পাপোষ, কার্পেট, শতরঞ্চ বানাতে পারত। আমাদের ছিল শর্করা শিল্প যা যোগান দিত খেজুরের গুড়, তালের পাটালি, মিছরি। এই শিল্পের উৎপাদিত ঝোলাগুড় থেকে ভাল সার হত। এক কালে যশোরের কোটচাদপুর গ্রামে লক্ষাধিক মণ চিনি প্রস্তুত হত। আমাদের ছিল গৌরবময় ধাতু শিল্প যা ঘিরে থাকতো স্যাকরা, কামার দিয়ে। যশোরের কামারবাগে তিনশ ঘর কামার ছিল যারা যুদ্ধের অস্ত্র বানাত। সেই সময়টাতে  লোহার অস্ত্রের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হত না আমাদের। আমাদের ছিল মৃৎশিল্প যা জন্ম দিয়েছিল কুম্ভকার যারা হাড়ি-পাতিল নির্মাণ করত; আর ছিল পাল শিল্পি যাদের হাতের কোমল ছোঁয়ায় নির্মিত হত মূর্তি, টালি। বিক্রমপুরের আড়িয়লে ছিল কাগজ শিল্প যেখানে সাতশ লোক কাজ করত  এককালে।  আমাদের ছিল গৌরবময় দারু শিল্প; বিক্রমপুরের মাটির নিচে যার বহু নিদর্শন মিলেছে।  কাঠের মূর্তি, নৌকা, চেয়ার, টেবিল, গরুর চাকা ইত্যাদি ছিল এই শিল্পের ভাস্কর্য! আমাদের চর্ম শিল্প, কারু শিল্প, মিষ্টি, মাছ, হুঁকো, ছাতার বাট তৈরির শিল্প ছিল। ছিল পাটি, বাঁশ,  বেত,  শোলার জিনিস তৈরীর শিল্প।  ফরিদপুরের সাতৈর নামক স্থানে এমন মিহি পাটি তৈরী হত যার উপর দিয়ে এমনকি  সাপের পক্ষে চলা অসম্ভব ছিল। একটা ছোট বাঁশের চোঙ্গার মধ্যে ছয় হাত লম্বা চার হাত চওড়া শীতল পাটি পুরে দেয়া যেত।

    এই শিল্পগুলো নেই এখন, এদের কংকাল আছে শুধু। এখন আমাদের অর্থনীতিতে ইএসজি ( এনভায়রেনমেন্ট, সোশাল এন্ড গভর্নেন্স) কোড তৈরি হয়েছে,  রয়েছে প্রসপারিটি প্লান ২০৩০, ডেল্টা প্লান ২১০০, বাংলাদেশ ব্যাংক সাস্টেইনএবল ফাইনান্স পলিসি। এই নীতিগুলোতে দেশজ শিল্পগুলোর পুনর্জন্মের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কিভাবে তা অর্জিত হতে পারে তা সুস্পষ্ট করে বলা নেই। আসলে তৈরী পোশাক শিল্প থেকে দূরে সরে আসার মধ্যেই নিহিত দেশীয় শিল্পগুলোর প্রাণভোমরা। অথচ তৈরী পোশাক শিল্পের ভূত এমনি ছায়া বিস্তার করেছে সর্বত্র যে, নীতি-নির্ধারক বা বিশেষজ্ঞগণ তাকে এড়িয়ে উন্নয়ন নীতি রচনার কথা মনে হয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না! পোশাক শিল্প যখন নিজের ধ্বংসের সিড়ি নিজেই ধরেছে, তখন একে বাঁচাতে অকেজো পোশাক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে সার্কুলার ফ্যাশন আর পরিবেশ বান্ধব পোশাক শিল্পকে স্বল্প সুদে ঋণদান – ইত্যকার ব্যবস্থাপত্র জারি করছেন আমাদের নীতিনির্ধারকগণ।
    বিশ্বব্যাংকের একজন প্রধান অর্থনীতিবিদ একদা মত প্রকাশ করেছিলেন যে, উচ্চ দূষণ ঝুঁকিতে থাকা শিল্পগুলো তৃতীয় বিশ্বে স্থানান্তর করা হতে পারে খুবই ভাল একটি উদ্যোগ। এটি যে শুধু ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ, তা নয়; বরং দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সবার জন্যই খুব উপকারী। এই নীতি বাস্তবায়িত হলে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মানুষেরা কিছুটা আয় বিসর্জন দিয়ে অধিকতর বিশুদ্ধ বায়ুর বিলাসিতা উপভোগ করবে। অন্যদিকে, দরিদ্র দেশের মানুষেরা কিছুটা বাজে বায়ু সেবন করেও সুখেই থাকবে কারণ বিনিময়ে তারা তাদের আয়কে বাড়িয়ে নেয়ার নিশ্চিত সুযোগ লাভ করবে।

    আমাদের দেশজ শিল্পগুলোর কারিগরেরা ছিল শিল্পী। যেভাবে এককালে নীলকুঠিগুলি আমাদের কৃষকদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল, ঠিক সেরকম করেই আধুনিক কালে আধুনিক তৈরী পোশাকের কুঠিগুলি আমাদের কারিগরদের প্রায় দাস-শ্রমিকে পরিণত করেছে। একটি শিল্প যেখানে কারিগর থাকে, সেখানে সৃষ্টিশীলতা থাকে। আর যেখানে দাস-শ্রমিক, সেখানে থাকে শোষণ, আর যার অবধারিত ফল ধ্বংস! আমরা কি সেই পথেই হাঁটছি?

    (সমাপ্ত)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:৫৬523694
  • ভীষন প্রয়োজনীয় লেখা। সঠিক বাস্তবটা তুলে ধরেছেন। আবার রোবটিক্সে খুব উন্নতি হয়ে গেলে কর্মীর বেতন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা মিটে গেলে,  দেশেই ন্যূনতম মূল্যে উৎপাদন করা যাবে। তখন উন্নত বিশ্ব আবার ম্যানুফ্যাকচারিং নিজের দেশে ফিরিয়ে নেবে যদি পরিবেশের তেমন ক্ষতি না হয়। কিংবা তৃতীয় বিশ্বের কারখানা গুলোকেই বাধ্য করবে রোবোটিক্স ও অটোমেশন ব্যবহার করতে, কম্পিটিটিভ প্রাইসের দোহাই দিয়ে।
  • tutul shree | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১৭523708
  • Darun
  • একক  | 103.154.***.*** | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:২৬523710
  • এদেশে স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষীর খেয়েছিলো গুজরাটি শিল্পপতিরা। আমরা কল কারখানার পেছনে ইনভেস্টর খুঁজি স্বাধীনতা ইভেন্টের ইনভেস্ট কারা ছিলো ? কারা পয়সা ঢালতো জাতীয় কংগ্রেসের যজ্ঞে ??? তাদের ইন্টারেস্ট কী ছিলো ?এই যে বাঙালিরা গান বাঁধলো মায়েরদেওয়ামোটাকাপড় , ব্যাপক সাকসেসফুল হলো সেই জিঙ্গল তার ফায়দাতুল্লো কারা ?? ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইম্পোর্টার যারা বিদেশী কাপড় বেচতো তারা কি দেশদ্রোহী ছিলো নাকি বড়োলোকি স্বদেশীয়ানার ভিকটিম ?? গান্ধীর নিজেরছেলে হরিলাল ম্যানচেস্টারের কাপড় বেচে  দেশের শত্রু হলেন সবাই আঙ্গুল তুললো সেই হরিলাল কি গণশত্রু না একমাত্র কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন বিদ্রোহী ?? 
     
    বাঙালি একটু ভেবে দেখুক। অন্যের স্বার্থে জিঙ্গল বাঁধা অনেক হয়েছে। ক্যাপিটালিজম - কলোনিয়ালিজম কিছুই মিথ্যে নয় , তেমনি দেশের স্বার্থ আর দশের স্বার্থ ও এক নয়।
  • যোষিতা | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৩৫523731
  • "এই যে বাঙালিরা গান বাঁধলো মায়েরদেওয়ামোটাকাপড় , ব্যাপক সাকসেসফুল হলো সেই জিঙ্গল তার ফায়দাতুল্লো কারা ??"
    বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল -> পরবর্তীতে ন্যাশানাল টেক্সটাইল কর্পোরেশন -> এখন এনটিসি
  • aranya | 2601:84:4600:5410:f40e:8a43:d9a:***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৪523733
  • খুবই ভাল, জরুরী লেখা। @মামুন yes
  • হীরেন সিংহরায় | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:২৮523734
  • অসাধারণ লেখা মামুন। অনেক অজানা তথ্য জানলাম । একটা ভয়ংকর ভবিষ্যতের মুখোমুখি। একটা কথা বলতেই হয়- ইংল্যান্ডের গ্রামে একদা হাতের কাজ পারিবারিক ক্ষুদ্র শিল্প ছিল। ছোট ছোট দোকান ছিল। আজ কেবল সুপার মার্কেট। 
  • | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:১২523736
  • খুব ভাল লেখা।
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:২৮523742
  • @রমিত চট্রোপাধ্যায় দাদা 
    পাঠ ও সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। রোবোটিক্স হয়ত পাশা উলটে দেবে। 
    @টুটুল শ্রী দিদি
    অনেক ধন্যবাদ উৎসাহদানের জন্য। 
  • Ranjan Roy | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:০৩523767
  • মামুন ভাই,
    টুপি খুললাম।
    অনেকদিন বাদে এমন তথ্যসমৃদ্ধ কিন্তু ভাবনা উসকে দেওয়া লেখা পড়লাম।
    বাংলাদেশের গারমেন্টস্‌ শিল্প নিয়ে ভাসা ভাসা জানতাম।
     
    এবার ওখানকার শ্রম আইন এবং গারমেন্টস্‌ শিল্পে এই দিকটার ছবি নিয়ে একটু লিখুন।
     
     
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০০:১৬523793
  • @একক,
    ''স্বাধীনতা ইভেন্টের ইনভেস্ট কারা ছিলো ? '' আপনার প্রশ্নটা অনেক ভাবাল। আমি এভাবে বুঝলাম যে আসলে রাজা যায় রাজা আসে দিনের আর বদল হয় না। অথবা স্বাধীনতা একটা অলীক ধারণা। বিদেশী প্রভুরা গেলে আরও অনেক প্রভু জেগে উঠে যাদের জন্ম মর্ত্যধামেই আকাশ থেকে নয়। খোদ স্বদেশী মাটিতেই। 
    ঠিক বুঝেছি কী? 
    মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:৪৩527078
  • @রঞ্জন রয়
    অনেক ধন্যবাদ,দাদা। যদি সময়-সুযোগ মেলে, অবশ্যই লিখব। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন