কিছু না জেনে বইটা হাতে তুলে নিলে প্রথমেই প্রচ্ছদে পাঠক দেখেন যেন দুদিনের জন্য ঘুরতে এসে রিসর্টের জানলার ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে তোলা এক অদেখা কল্পিত জীবন - এক নদীর ধারে এক যুবতীর দাঁড়িয়ে দূরের দিকে চেয়ে থাকা। তারপর পাতা ওল্টাবার পর পাঠক বুঝতে পারেন আমরা এবার এক বহিরাগত হিসেবে যেন ওই দূর থেকে দেখা মেয়েটিরই বাস্তব জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি।
পনেরো বছর আগেকার গ্রামীণ ব্যক্তি-সমাজ-রাজনীতির পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাস। বাংলা ভাষার ছাত্রী শান্তা আর ফিজিক্যাল এডুকেশনের ছাত্র সন্দীপন - "ভিন্ন দুই মেরুর মানুষ তারা। একটি বিন্দুতে মিলে যাবার চেষ্টা করেছিল।" একটি তৃতীয় প্রায় অদৃশ্য বিন্দুতে যেন আছেন প্রচ্ছদ ফটোগ্রাফারের মত কলকাতা থেকে সাহিত্যসভায় কবিতা, গল্প পড়তে আসা সায়নদীপ। মাঝে মাঝে যার পাঠানো নিরীহ এসএমএস বা বহুকাল বাদে ফোনে গলার আওয়াজ শান্তার কাছে উচ্চ মাধ্যমিকের পর সিকিমে বেড়াতে গিয়ে দেখা রিংচিংপঙের সূর্যোদয়ের আগের ব্রাহ্মমুহূর্ত ফিরিয়ে আনে।
আর এই ত্রিভুজের ভেতরে বাইরে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এক জনপদ - দক্ষিণ দামোদর জনপদ। "কথার কাঁথাখানা গায়ে জড়িয়ে মঙ্গলকাব্যের দেশ শুয়ে আছে। কত কিছুই বিদায় নিয়েছে তার জীবন থেকে, তার পাড় ভাঙে, পাড় গড়ে, তবু সে শান্ত, অনেকটা দামোদরের মতই। বর্ষায় মানুষেরই দোষে সে মানুষের দুঃখের কারণ।"
"দুঃখনদী পাড়ের বাসিন্দা" শান্তা মঙ্গলকাব্য পাঠের সঙ্গে প্রতিনিয়ত তার চারপাশের জীবনের মিল খুঁজে পায় - "নিজের মনে সে কথা ভাঙে, গড়ে"। ডায়েরীর আগের পরের পাতা আটকে সে সেইসব ব্যক্তিগত গবেষণা সন্দীপনকে পড়তে দেয় - "মহাকাব্য বা মঙ্গলকাব্যের যুগ এটা নয়। এ যুগ অধিবাস্তবতার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের।...মঙ্গলকাব্যের দেশে কাব্যের চরিত্র গুলো কখনো কখনো ভুশ করে ভেসে ওঠে।... রূপকথার দুয়োরানী সুয়োরানীর মত লহনা, খুল্লনা, রঞ্জাবতীদের চাওয়া পাওয়ার ভেতর লুকিয়ে আছে বিদেশী শাসকের মতই আজকের দেশীয় শাসকের রাজনীতি। তবু দেবতার ছদ্মবেশে সবলের অত্যাচার নেমে আসে আজও চাঁদবেনে, ধনপতি, বেহুলাদের ওপর। এখানকার জল মাটির স্বভাবের মতই এখানকার লোকজন। ম্যাসাকার করে দেবার মত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এখানকার মানুষের মধ্যে নেই।" বড়জোর পুকুর বোজানো বা দোকানঘর দখলের চেষ্টা। যতই হোক, মাহুদ্যা আর ভাঁড়ুদত্ত দুর্যোধনের মত বিপুল ধ্বংসলীলার খলনায়ক নয়।
ডায়েরির বাকি আটকানো পাতাগুলোর মধ্যে যেখানে সন্দীপনের পাঠের অধিকার নেই, সেখানে পাঠক পড়তে থাকেন মাঘী উৎসব, ভাদু গান, ইতু পুজো, টুসুর ভাসান, মাঠফলার, গাজন, পুণ্যিপুকুর ইত্যাদি বহু ব্রত লোককথা বৃত্তান্ত আর ধীরে ধীরে শান্তার একক স্মৃতি থেকে তা হয়ে ওঠে এক জনপদের সম্মিলিত স্মৃতিলেখ। বশরা - বিপুলদহের, পাষণ্ডর মাঠের দাঙ্গার পাশাপাশি দামুন্যার চণ্ডীমঙ্গলের মুকুন্দরাম, ধর্মমঙ্গলের ঘনরাম, রামকান্ত রায়ের 'বার মতির পুঁথি'র এই জল, হাওয়া, মাটি। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের রাজনৈতিক ডামাডোলে পড়ে দক্ষিণ দামোদর ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হওয়া, শাঁকনাড়ার প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ থেকে সুবলদার বিপ্লবী রাসবিহারী বসু - এরকম নানা ইতিহাস ছড়িয়ে আছে যে জনপদের আনাচে কানাচে।
শান্তার জীবনেও স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র এবং পারিবারিক রাজনীতির প্রভাব। সন্দীপনের সেই রাজনৈতিক বৃত্ত আবার আলাদা, যেখানে আছে তার বন্ধু অপুর একলা পথের নিষিদ্ধ রাজনীতি। মাঝে মধ্যে বাজারের কোণে কোথাও একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে অপুর বক্তৃতা করে চলা। দলমা পাহাড়ের পায়ের তলায় লাউসেনের কুঁড়েঘরে লুকিয়ে থাকা। সন্দীপন দেখে "দক্ষিণ দামোদরে ধান ফলে যত, ততই গজিয়ে ওঠে রাইস মিল। জল স্থল আর অন্তরীক্ষ - সর্বত্র ছাই আর ছাই। এও এক শিল্পাঞ্চল বটে, কৃষিকেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চল।"
এই কথনের মধ্যে নানা সত্য উচ্চারণ উপন্যাসটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। চরিত্রগুলো সাদা কালোয় মেশানো ধূসর রঙের বলেই আরো যেন চেনা চেনা লাগে। কোনরকম চমক ছাড়াই পাঠককে এই অপরিচিত এক মঙ্গলকাব্যের জনপদের জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ টেনে রাখে - "মিষ্টির রসে ডুবে থাকা মাছি উঠে আসতে পারে না সেই রসকুন্ড থেকে। নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ধের মত এদিক ওদিক ঘোরে। আয়ু থাকলে সে বাঁচে আরও কিছুদিন। কিন্তু তার দৃষ্টির ঘোরাফেরা একটি নির্দিষ্ট সীমায়, জীবনকালও সেই গণ্ডির ভেতরেই সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষের জীবনই এই। এই অঞ্চলের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একরকম। নিশ্চেষ্ট, উদ্যমহীন।"
অথচ এই সীমাবদ্ধ জীবনের মতই এই বইটিও যেন বা এক জাঁকজমকহীন অন্তঃসলিলা নদীর মত, মাটির ওপর থেকে যার অস্তিত্ব দেখা যায় না, কিন্তু চোখ বুজে মাটিতে কান পাতলে শোনা যায় তার নিরন্তর বয়ে যাবার স্রোতশব্দ। সেজন্যই শেষ পর্যন্ত এই বই পাঠকের মনে থেকে যায়।
দক্ষিণ দামোদর জনপদ
লেখিকাঃ কৃষ্ণা মালিক
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
মূল্য – ৩৫০ টাকা