২০. ১০. ২০২২, সকাল ৮-২৩, বিবেকানন্দ আশ্রম, শ্যামলাতাল
বিবেকানন্দ আশ্রমের মেন গেট থেকে বেরোলেই, ডান হাতে একটা বহু পুরোনো সিঁড়ি নেমে গেছে জঙ্গলের মধ্যে। সকাল, দুপুর – কোনও সময়ই সূর্যের আলো এই সিঁড়ি পথে ঠিকমতো পড়ে না। তাই হালকা বা গাঢ় সবুজ, পুরু শ্যাওলার স্তরের উপর দিয়েই একপ্রকার এগিয়ে চলা। তবু ভালো – শেষ কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নি; নাহলে যা পিছল হয়ে থাকতো এই পথ!
যাচ্ছি কোথায়? এই জায়গা যার নামে, অর্থাৎ শ্যামলাতাল – সেইখানে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে সেই সিঁড়িপথ নামতে থাকে; কোথাও কোথাও জঙ্গল একটু পাতলা হলে দূরে যায় সেই সবুজ জলাধার। সরু শ্যাওলা-মোড়া পথটি শেষে গিয়ে পড়ে পিচের, আধভাঙা গ্রাম্য পথে – তালের ঠিক পাশেই। এদিক-সেদিক আর কিছুই নেই; কেবল একটি চা-বিস্কুট-সিগারেটের দোকান আর তালের একদম গা দিয়ে একটি প্রাইমারি স্কুল। চা-তেষ্টা মেটাতে আমরা দু-কাপ চায়ের কথা পাড়তেই সত্তর-পেরোনো ভদ্রলোক আঁচ বাড়িয়ে গরম জল চাপালেন। শীতের জায়গা বলেই, এখানকার স্থানীয় কুকুরদের অনেকেরই বড় বড় লোম অভিযোজনগত ভাবেই – তারা কয়েকজন রোদ পোহাচ্ছে।
হাতে চায়ের কাপ এসেছে কি আসেনি, পাহাড়ি রাস্তা ধরে অন্তত জনা চল্লিশ কচিকাঁচা এসে পড়লো। এরাই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী। কোথা থেকে আসছে এরা? খালি চোখে যত দূরেই তাকাই, গ্রাম তো দূরস্থান, একজোট হওয়া কিছু বাড়িও চোখে পড়ে না। অদ্ভুতভাবে জঙ্গলে ঢেকে আছে এখানে মানুষের বসতি। পশুরা যেভাবে গাছের আড়ালে, ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, বা কেমোফ্লাজ করে রাখে নিজেদের, এখানে মানুষবসতিও তেমনি জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে; সমতল থেকে আসা আমাদের অপটু চোখে সে সব ধরা দেয় না।
এতক্ষণ চায়ের দোকানে আমাদের সঙ্গে বসে আরেকজন যে ভদ্রলোক বসে চা খাচ্ছিলেন আর আধা হিন্দি, আধা কুমায়ুনিতে কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন আমাদের, এখন বুঝতে পারলাম তিনি এই প্রাইমারি স্কুলের টিচার। তাঁকে দেখামাত্রই ছোটরা তারস্বরে "গুড মর্নিং স্যর" বলতে শুরু করলো! ওরে! সেই বাঘা বায়েনের মতো আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, "বাপ রে, কী তেজ!" তালের স্থির জল, স্থির নীল আকাশ, মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাওয়া জঙ্গল কাঁপিয়ে দিয়ে ওদের সমস্বরে "গুড মর্নিং" যেন কোথা থেকে মোহনার নদীর জোয়ার এনে ফেললো। সেই মাস্টারমশাই এইসবে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে, একবারও ফিরতি 'গুড মর্নিং' না বলে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন বটে (যা নিতান্তই দৃষ্টিকটু), কিন্তু তাতে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ ঠেকায় কে!
সকাল ৯-২১প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডী (রেলিং) টপকে চলে যাওয়া যায় একেবারে তালের কাছে। ঘন সবুজ জল, হ্রদের মাঝখানে প্রায় ৩৫-৪০ ফুট গভীরতা (ওই মাস্টারমশাইই বললেন), আর চারদিকে পাহাড়-জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। যেন একটা খুব গভীর, কানা উঁচু কাপে কেউ জল ভরে রেখেছে। আশেপাশে কোনও বড় জলের উৎস নেই, কিভাবে এই তালের জলের লেভেল সারাবছর, বছরের পর বছর এক থাকে, কে জানে।
হ্রদের পাশে একটি পাকা, মাথা-ঢাকা বসার জায়গা – সেখানেই বসেছি আমরা। সেই বিশ্রামছাউনির থামগুলোর গায়ে, সিলিংয়ে লেখা "Binita", "Mintu", "Aman + Kavita", "Shukla" প্রভৃতি। বিনীতা কোথায় আজ, কোথায়ই বা মিন্টু, অমন আর কবিতা শেষ অব্দি একসঙ্গে থাকতে পারলো কিনা – কিসুই জানি না। শুধু তারা এবং তাদের মতো অনেকে তালের পাশের এই বিশ্রামের জায়গাটিতে আত্মপরিচয় লিখে এবং ইতস্ততঃ কেকের প্যাকেট, মদের বোতল ফেলে অসহনীয় নোংরা করে গেছে। তবে তার পাশাপাশি এ'ও বলতে হয়, এত প্রত্যন্ত জায়গাতেও এখানে সরকার থেকে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করা হয়েছে; শুধু তাইই নয়, রাস্তার ধারে তৈরি করা সেই জায়গাতেও আলাদা দুটি ভাগ করা – একটি কাঁচের সামগ্রী ফেলার জন্য, অন্যটি প্লাস্টিকের সামগ্রীর জন্য। প্লাস্টিক waste যে আলাদা করে সংগ্রহ করা দরকার, এই সচেতনতা এতদূরে, প্রায় মানববর্জিত একটি জায়গায় দেখে ভালো লাগলো বৈকি; কিন্তু সমস্যা শেষ অব্দি সেই মানুষেই। কেউ যদি শেষ অব্দি ওটুকু এগিয়ে গিয়ে ফেলে না আসতে পারে, কোন সরকার আর কী করবে!
তালের দিকে মুখ করে আছে এই তল্লাটের একমাত্র (সম্ভবত) প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই যে একটু আগে কচিকাঁচারা এসেছে, তাদের এখন প্রেয়ারের জন্য লাইনে দাঁড় করাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন টিচাররা। কেউ কেউ ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে; তাদের ডাকতে গিয়ে সেই মাস্টারমশাইও না চাইতেই জড়িয়ে পড়ছেন সেই খেলায়। কেউ বা একটা টুকটুকে লাল প্লাস্টিকের ব্যাট নিয়ে একমনে শ্যাডো প্র্যাকটিস করে চলেছে, মোটেও সে প্রেয়ারে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার মেজাজে নেই এখন। যা হোক, তাদের অনেক কষ্টে একজোট করা গেল। প্রথমে স্থানীয় একটা সুরে ভারি মজা করে একটা গান গাওয়া হলো। তারপর জন-গণ-মন – আজও, এখনও শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়, আগামীতেও দেবে! পাহাড় নেমে মিশেছে হ্রদের জলে, জঙ্গল উঠে গেছে নীল আকাশের কাছে, তার মাঝে "বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছল জলধিতরঙ্গ!"
বেলা ১২-৪৫আজ তিতলির শরীরটা একটু বিগড়েছে সকাল থেকে – সম্ভবত হজমের সমস্যা থেকেই অম্বল হয়ে এক দু'বার বমি হলো। আশ্রমের দুপুরের খাবার আমরা বারোটা নাগাদ খেতে গেলেও, ও যায়নি। খাওয়ার শেষে ওর জন্য এক মুঠো ভাত, ডাল, কয়েক টুকরো শসা আর একটুখানি আলু-পটলের তরকারি নিয়ে এল অমিতাভ দা। সেই খেয়ে, দুপুরে কিছুটা ঘুমিয়ে এখন অনেকটা ফিট মনে হচ্ছে। আমার উপর গুরুদায়িত্ব – তিতলিকে দিনে অন্তত দুটো করে গল্প শোনাতে হচ্ছে; হয় ভূতের, নয় জঙ্গলের। তার জন্য আমারও হোম ওয়ার্ক করতে হচ্ছে। ভূত এবং জঙ্গল – এই দুয়েই একসময় আমার যথেষ্ট উৎসাহ থাকলেও, ভূতের ব্যাপারে উৎসাহ কালক্রমে হারিয়েছি অনেকটাই। Wildlife নিয়ে এখনও খুব ভালোলাগা থাকলেও, তেমন একটা বই পড়া হয় না। তবু গতকাল কেনেথ এন্ডারসনের বই থেকে জঙ্গলের পথচলা নিয়ে, সেই পথচলার নিয়ম নিয়ে তিতলির সঙ্গে অনেকটা গল্প হয়েছে। হিংস্র পশু আছে যে-সব জঙ্গলে, সেখানে প্রকৃতির 'এলার্ম কল' শোনার জন্য কিভাবে নিজের চোখ কান খোলা রাখতে হয়, নিজেকে আড়াল করতে হয়, সেইসবও বলছিলাম। আজ বোধ হয় ভূতের গল্প...
বিকেল ৩-১৫বিরজানন্দ ধামের বাইরের ছোট ছোট বেঞ্চের একটায় বসে আছি, আর ভেবে চলেছি – যে পথে এসেছি, ঘুরে ফিরে আসছি, বারবার আসার চেষ্টা করছি, তা সমুদ্র। সেই পথে এসে যা করছি, যতবার করছি, যা করবো ভাবছি, তা সমুদ্র থেকে তুলে নেওয়া এক আঁজলা জলের মতো। যেখানেই যাই, যা-ই করি, আঁজলার চেয়ে বেশি জল তো ধরবে না। এখন কথা হলো, আঁজলায় যে সমুদ্রের জল ধরে আছি – এটুকু জানা, এইটুকুকে সত্যি বলে জানা। সমুদ্রকে আঁজলায় ধরার চেষ্টা বৃথা, হাস্যকরও বটে। আমার আঁজলা আর সমুদ্রের মধ্যে একমাত্র, এবং সত্যিকারের যোগ হচ্ছে – ওই সমুদ্রের জলই আমি ধরেছি।
প্রতিবার জল মুঠোয় নেবো, আর সমুদ্রকে ধরতে পারিনি ভেবে ফেলে দেবো। আমার বোঝা প্রয়োজন, হাতে যেটুকু জল নিয়েছি, তা সমুদ্র নয় বটে; কিন্তু যে সমুদ্রকে আমি চাইছি, তার সমুদ্রত্ব এই হাতের জলেই আছে। বুঝতে হবে।
সন্ধে ৭-৪৫ আজ বিকেলে প্রার্থনার আগে আশ্রমে ছোট্ট একটা সেশন হলো, ত্রিপুর মহারাজ টুকরো-টাকরা নানা কথা বললেন। "ধৈর্য্য আর উৎসাহ, দুইই প্রয়োজন। ধৈর্য্য বিনা উৎসাহ এই পথে কার্যকরী নয়, উৎসাহ বিনা ধৈর্য্যও স্থবির।" আজ আশ্রমে তেড়ে শিলাবৃষ্টি হলো। দূরের এক একটা পাহাড়ে শিল ঝরাতে ঝরাতে এগিয়ে এল আশ্রমের পাহাড়ে। প্রতিটা দূরের পাহাড় যেন এক একটা দেশ; মেঘ ভেঙে শিল ঝরছে যখন, সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাকি পাহারগুলোয়। আজ হেমন্তকালের দ্বিতীয় দিন। "Failure is not in the defeat. It is in not attempting to rise again."
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।