১৭. ১০. ২০২২, সকাল ৯-২৩, লোহাঘাটের পথে
একদম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সাড়ে আটটায় আমাদের ছ' জনকে নিয়ে Ertiga গাড়ি রওনা দিল লোহাঘাটের উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে রইল মেঘে ঢাকা আলমোড়া শহর; কিছুক্ষণ আগে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আশ্রমের সিঁড়ির পাশে ফুটে থাকা জংলা গোলাপ দেখছিলাম, সে জায়গা বিলকুল ঢাকা ধোঁয়ায়। স্বামী বিবেকানন্দের দীর্ঘকায় মূর্তি দাঁড়িয়ে রইল পাহাড়ের ঢালের গায়ে ওই আশ্রমকে নিয়ে – লাল, সবুজ টিনের চাল, ছোট ছোট কাঠের জানালা, নিচু সিলিংয়ের মঠ-অফিস, ফুলের আলুথালু সমারোহ নিয়ে।
ড্রাইভারজী গাড়ি চালিয়ে স্পিকারে চালালেন একটা কুমায়ুনি গান – মেঠো সুর, তালের একটা গান, কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিমী যন্ত্রানুষঙ্গ। এমনটাই নিয়ম, এর আগেও দেখেছি। ২০০১ সালে যখন এসেছিলাম কুমায়ুনে, তখনও আমাদের ড্রাইভার ঠাকুরজি সকালে গাড়ি চালাতে শুরু করে প্রথমে অনেকক্ষণ একটা কুমায়ুনি গান চালিয়ে রাখতেন – প্রতিদিন নতুন নতুন পাহাড় আসতো, বাঁক আসতো, গন্তব্য আসতো, কিন্তু ঠাকুরজির ওই গান বদলাতো না। তখন আমি মধুবালার প্রেমে (হ্যাঁ মুঘল-এ-আজমের মধুবালা) জাস্ট ছারখার হয়ে যাচ্ছি; এবং ঠাকুরজির চালানো সেই গানে "মধুবালা" কথাটা থাকায় আজও আমার গানটির সেই দুটি লাইন মনে রয়ে গেছে, যদিও নিদারুণ এক অপভ্রংশ হয়ে। তখন শুনে যা কানে ঠেকতো, সেটাই তুলে দিচ্ছি –
"মেরি মধুবালা, তু চ্যাংটা ঘুঁক্যাঁয় রে
ম্যায় যাময়ু দিল্লি, জরা যাঁহা পিব্যায় দে।"
যাই হোক, সে সব আগেকার লজ্জার কথা, আজ এত অব্দিই থাক। কিন্তু এবার বিপত্তি হলো, ইনি কুমায়ুনি গান চালানোয় আমাদের তিনজনের কোনও বিশেষ বক্তব্য না থাকলেও সুনন্দা কেবলই ছটফট করতে লাগলো অন্য গান চালানোর জন্য। ড্রাইভারজি অবস্থা দেখে কুমায়ুনি গান থামিয়ে ব্লুটুথে কানেক্ট করে দিলেন সুনন্দার ফোন। শুরু হলো, "ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে", "তুমি রবে নীরবে"। অবাঙালি রাজ্যে পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভে এস্রাজের সঙ্গে "তুমি রবে নীরবে" চালালে যা অবশ্যম্ভাবী, গাড়ির গতি পড়তে শুরু করলো। আপাতত খুব চিন্তায় আছি, ধসপ্রবণ সরু রাস্তা। ড্রাইভারজি হাই তুলছেন।
বেলা ১২টা, পথে
জাগেশ্বরধামে থামা হলো মাঝে। পাহাড়ের কোলে বহু, বহু শতাব্দী প্রাচীন কিছু ছোট-বড় মন্দির, বেশিরভাগ মন্দিরই শিবের। এই মন্দিরগুলি কবে নির্মিত জানা যায় না; সপ্তম শতাব্দীতে আচার্য শঙ্কর এসে মন্দিরগুলির কয়েকটিতে পূজার প্রচলন করেন। তারপর মূলত কৌর্য এবং চন্দ বংশের উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে মন্দিরগুলি renovated হয় – জানতে পারি।
পাহাড়ি এলাকার তুলনায় বেশ বড় একটা প্রায় সমতল চত্বরে মন্দিরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দণ্ডায়মান। একদিকে মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ হচ্ছে, বাকি আরও মন্দিরগুলোয় পুজো হচ্ছে, কিন্তু মোটের উপর ছিমছাম, শান্তির পরিবেশ। পুরোহিতদের প্রতিপত্তি নেই, জোর করে দক্ষিণা-আদায় করা নেই, বাবার সঙ্গে ভক্তের কোনও গিভ-এন্ড-টেক সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা নেই। যে যেমনভাবে পুজো দিতে চায়, দর্শন করতে চায়, করতে পারে।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তিতলির কাছে আসল ব্যাপার হলো, মন্দির চত্বরে অনেক সপরিবার বাঁদর আছে। তারা একে অন্যের উকুন বাছছে, আদর করছে, করতে করতেই ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মেরে ভাগিয়ে দিচ্ছে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক বাঁদরের মধ্যে আজ একটা হেস্তনেস্ত হবেই। গৃহযুদ্ধ লাগল বলে!
দুপুর দেড়টা, পথে
আলমোড়া থেকে বেরিয়ে জাগেশ্বর অব্দি দীর্ঘ পথ জুড়ে ছিল পাইনবন; কখনও জমাটবাঁধা অন্ধকারের মতো, কখনও বা পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে – তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরও দূরের পাইনবন, পাহাড়, রুপোলি চিকচিক করা নদীর রেখা। সূর্যের আলো পাইনপাতার ফাঁক দিয়ে মেঘ কাটিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সারা উপত্যকায়; সেই উইলফ্রেড আওয়েনের কবিতার মতো, সূর্য যেন উপচে পড়ছে ঘাসের, পাতার, ফুলের শরীর থেকে।
একটু আগে পেরিয়ে এলাম দুটো নদীর সঙ্গম। দুটোই পাহাড়ি নদী – ভারি মিষ্টি নাম – গোরি আর কারী। গোরির জল সবুজ, আর কারীর জল কালো। সঙ্গমে এই দুজন মিলেছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে – মেশেনি। মিলিত হয়েও, কেমন আপসহীন বোঝাপড়ার ঢঙে সবুজ আর কালো পাশাপাশি বইছে, মাঝখানে কোন এক অদৃশ্য প্রাচীর যেন তাদের আলাদা করে রেখেছে একে অন্যের থেকে!
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও তিতলির কাছে আসল ব্যাপার হলো, রাস্তায় মাঝেমাঝেই প্রচুর বাঁদর দেখা যাচ্ছে। তিতলির চোখে, বাঁদরদের সামনে হিমালয় একেবারে গোহারান হেরে যাচ্ছে। ন্যাশনাল হাইওয়ের উপর আয়েসে শুয়ে থাকা, নিজেদের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণে ব্রতী কিছু ছাগলও দেখেছি আমরা।
বিকেল ৫-১২, লোহাঘাট রেস্ট হাউজ
অবশেষে পৌনে তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছেছি লোহাঘাট। ছোট একটি জনপদ; মূলত মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমকে কেন্দ্র করে অনেক হোটেল-দোকানপত্র গড়ে উঠেছে লোহাঘাটে। লোহাঘাট অবস্থিত পাদদেশে, কয়েকটি পাহাড়ের মাঝের উপত্যকায়। আলমোড়া থেকে রাতে পাহাড়িয়া অন্ধকারে তাকালে আলো যেমন জ্বলতে দেখা যেত নীচের দিকে, লোহাঘাট থেকে তেমনই দেখা যাচ্ছে উপর দিকে – অমিতাভ দা বলছিল তিতলিকে। পাশাপাশি আরও খেয়াল করলাম, পাদদেশে বলে লোহাঘাটে তাপমাত্রা একটু বেশির দিকে বটে, কিন্তু একইসঙ্গে বেশিটা সময়ই ছায়ায় কাটানোর ফলে এখানকার ঠাণ্ডাও বেশ একটু স্যাঁতস্যাঁতে।
লোহাঘাটের সরকারি রেস্ট হাউজে আমাদের বুকিং – একেবারে হোটেলের ঘিঞ্জি ভিড় যেখানে, তার থেকে একটু সরে; তবে একেবারে নির্জনে মোটেও নয়। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ডে এক ধরণের শান্তি, নীরবতা আছে। ফুলগাছে রঙিন ফুল ধরেছে, লেবুগাছে ফলে আছে সদ্য সবুজ-পেরোনো কমলা। দোতলায় বিরাট একটা চার-বিছানার ঘর পেয়েছি আমরা তিনজন। সকাল থেকে চান হয়নি; এসে ব্যাগপত্তর রেখেই ছুটলাম খেতে। এই রেস্ট হাউজে ততক্ষণে লাঞ্চ আওয়ার শেষ; তাই বেরিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। গরম গরম রুটি, ডাল আর পনীরের তরকারি দিয়ে অমৃতবৎ আহার সেরে অমিতাভ দা বললো, "পেট যতটা ভরলো, তৃপ্তি যেন তার চেয়ে অন্তত ২৫% বেশি।" অমিতাভ দা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের অধ্যাপক, নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে একটু ধরে খেলেছে সে কারণে হয়তো; আমি ঐ একই কলেজের হয়ে বলছি, ৭৫% এর নীচে আমি নম্বরই দেবো না আজকের দুপুরের এই অপরাহ্নভোজের তৃপ্তিকে। একটু পোড়া, আঁকা বাঁকা কোণার গরম রুটির স্বাদ আলাদা এ' সব তল্লাটে।
রাত ১০-৩০
আমাদের আশ্রমিক এই রিট্রিটের একমাত্র আশ্রমহীন দিন ছিল আজ। লোহাঘাট এসে কোথাও যাওয়ার ছিল না আজ, তাই সন্ধেটা এ'কথা - সে'কথায় কেটে গেল। রাতের খাওয়াও এখানে বেশ তাড়াতাড়ি, ন'টার মধ্যে শহর ঘুমিয়ে পড়ে কমবেশি।
অমিতাভ দা'র সঙ্গে কথা হচ্ছিল আলমোড়ার শেষ দু' দিনের সান্ধ্য প্রার্থনা নিয়ে। ওঁ বললো, "পরশুর প্রার্থনার সময়ে – হয়তো জীবনে প্রথমবার – বিবেকানন্দকে অনেকটা সময় ধরে ভালোবাসলাম। আদর করা বলে না? – তেমনভাবে আদর করলাম বিবেকানন্দের বোধগুলোকে – যে'সব বোধের আড়ালে, কারণ হিসেবে হয়তো লুকিয়ে আছে সাঙ্ঘাতিক আঘাত, লাঞ্ছনা, অপমান।" বিবেকানন্দের আঘাতের কথা কমবেশি আমিও পড়েছি; মেলাতে পারলাম। কিভাবে আঘাতে একেবারে ছিন্নভিন্ন হতে হতেও শেষ অব্দি সেইসব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন নিজের জীবনের ব্রতর সামনে, পড়েছি। অমিতাভ দা বলে চলে, "তিনি ব্রহ্মজ্ঞ নন শুরু থেকেই, তাই তাঁর উত্তরণ আছে, সেই উত্তরণ দেখা যায়, অনুভব করা যায়", আর আমারও মনে হতে থাকে, আমাদের এই অসমর্থ মানবজমিন থেকে সেই কারণেই বোধ হয় আমরা বিবেকানন্দকে এমন আদর করতে পারি।
বিবেকানন্দের কথা শুনলে, তাঁর আঘাতের কথা শুনলে, উত্তরণের কথা শুনলে আমার চোখে জল আসে, কান্না পায়। প্রণাম করতেও ইচ্ছে করে না, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে তাঁকে। আজও অমিতাভ দা'র কথা শুনতে শুনতে সেই অনুভূতি এল, তবু কাঁদতে পারলাম না। আমাদের, আমার অপারগতা – কান্নায় কোথায় যেন বাধে। এত জটিল হয়ে গেছি, এত সঙ্কোচ, এত দ্বিধা, এত দ্বন্দ্ব যে কান্নার মতো আনন্দী নদীর উৎসতেই বাঁধ দিয়ে দিই।
আমার সেই সময় খালি মনে পড়তে থাকে ঠাকুরের কথা – কেন কে জানে। মনে হয়, কিভাবে ঠাকুর কত মানুষকে, কত বিচ্ছিন্ন, ভিন্ন স্বভাবের মানুষকে আশ্রয় দিয়ে গেছেন। তাঁদেরই একজন বিবেকানন্দ। ঠাকুরকে নিয়ে যে-সব গান লিখেছেন বিবেকানন্দ, বা তাঁর পরের গুরুভাইরা, সে সব গানে কী সরল, সহজ আনন্দ! সেই গানগুলিই যেন ঠাকুরের স্বভাব। সেই আনন্দে নিজেকে ছোট লাগে, 'আমার' বলে দাগিয়ে দেওয়া সমস্ত কষ্ট, শোক ঝরে পড়তে থাকে; মনে হতে থাকে আনন্দ এত সহজ, তবু কেবল 'আমার' বলে ডাকতে পারবো – এই অহংকারেই কি দৈন্যকে এতদিন জড়িয়ে বসে আছি?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।