১৫. ১০. ২০২২, সকাল ৭-৩০, আলমোড়া রামকৃষ্ণ কুটির
যাকে বলে, এক ঘুমে রাত কাবার! জার্নির যত গা ব্যথা, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি ছিল, সব উধাও! এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ৫-৫০ নাগাদ। এমনিতে ঘুম থেকে উঠে আমার মিনিট কুড়ি লাগে এই জগতের সঙ্গে ধাতস্থ হতে – প্রথমে কিছুক্ষণ বিছানায় বোম ভোলানাথ হয়ে বসে থাকি, "এ কোন পৃথিবী"-মর্মে। আজ এসব কিছুই হলো না; উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম একাই, উপাসনাঘরের দিকে। শীতের জায়গা, তাই উপাসনাঘর একটু দেরী করেই খোলে সাড়ে ছটা নাগাদ। আমরা আছি তুরীয়ানন্দ কুটিরে; সেখান থেকে প্রায় ৫০-৬০ সিঁড়ি নীচে নেমে উপাসনাঘরে যেতে হয়, তার পাশেই খাবার ঘরও। যাওয়ার পথে দেখলাম, সামনের যে পাহাড়-উপত্যকার সারি আগের দিন বিকেলে ঢেউয়ের মতো লাগছিল, দূরে দেখা যাচ্ছিল সুতোর মতো কৌশী নদীর রেখা, আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা হঠাৎ বেরিয়ে আসছিল আড়াল থেকে আর নিমেষেই আরেক বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছিল, আজ সেই সব মেঘের সমুদ্রে ঢেকে গেছে। আমি নিজেই হেঁটে যাচ্ছি মেঘের মধ্য দিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে। রাতের মতোই স্তব্ধ চারদিক, তবু সূর্য উঠলে রাতের নির্জনতা যেন কিছুটা ভাঙে, আলোর যেন নিজস্ব এক স্বর আছে। ঝিঁঝিঁ ডাকের বিরাম নেই এই ভোরেও; পাশের অচেনা এক ফুলগাছের মাথায় বসে একটা পাখি ডাকছে। তাকালাম। পাতার ভিড়ে তাকে খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো – কালো পালকে মোড়া সে তার কমলা ঠোঁটটি ফুলের ভিতর ঢুকিয়ে মধু শুষছে।
যেহেতু এইবার হিমালয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য রিট্রিট, তাই ধ্যান এবং পাঠ – তাতেই সময় দেবো ভেবে রেখেছি। সঙ্গে এনেছি কথামৃতের তৃতীয় খণ্ড, আর Kindle থাকায় স্বামীজীর Complete Works ও তাতে নিয়ে আসা গেছে। ভোরের চাপা ধুনোগন্ধ, ফুলগন্ধ মাখা উপাসনাঘরে বসে কথামৃত পড়ছি, আর মন বারবার চলে যাচ্ছে নরেন্দ্রপুরে – সেখানেও হোস্টেলের ঠাকুরঘরে এই গন্ধ ভেসে বেড়াতো ভোরবেলা। কলকাতা থেকে পনেরোশ' কিলোমিটার দূরে এই আলমোড়া শহরে উপনিষদ-গীতা পাঠ করা হচ্ছে এই উপাসনাঘরে, আমার ধ্যানে নরেন্দ্রপুরের সেই সুবাসিত ঘর-জানালা, আর আমার সামনে রাখা কথামৃতের পাতায় ১৮৮৪ সালের জুলাই মাসে রথের পুনর্যাত্রায় বলরাম বসুর বাড়িতে ঠাকুর এসেছেন, ভিড় করেছে ভক্তেরা, আলাপ চলছে, গান-খুনসুটি চলছে। একটা ছোট্ট মেয়ে এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে বলছে, "আমি তোমায় নমস্কার করলুম, দেখলে না।" ঠাকুর সহস্যে মেয়েটিকে আভূমি প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলেছেন গান গাইতে। মেয়েটি বলছে, "মাইরি, গান জানি না।" ঠাকুরই উলটে তাকে সঙ্গে নিয়ে মজা করে গাইছেন, "আয় লো তোর খোঁপা বেঁধে দিই, তোর ভাতার এলে বলবে কি!"
সকাল সাড়ে নটাসকালে সাবুর খিচুড়ি খেয়ে আরও কিছুটা সময় কাটিয়েছি পাঠে; তারপর হঠাৎ আশ্রমের একজন বললেন, "বিটিয়া কো দিখাইয়ে, আজ মৌসম বড়িয়া হ্যায়!" আমি আর অমিতাভ দা চললাম 'বিটিয়া'কে নিয়ে আশ্রমের বাইরের ভিউ-পয়েন্টে। কী দেখবো, এখনও জানি না।
মেঘ কেটে গেছে এখন অনেকটা। সকালের সেই সমুদ্র থেকে মুখ বার করছে ছোট ছোট উপত্যকারা। এক বাঁদরগোষ্ঠী নেচেকুঁদে এ বাড়ি সে বাড়ি ঢুকছে, ছুটছে, খাচ্ছে, আর তাদের অধ্যক্ষ এক বাড়ির তে-কোণা চালে বসে প্রজাদের পর্যবেক্ষণ করছেন। ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ আর বাঁদর পেরিয়ে যখন দূরে তাকালাম, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে বরফশৃঙ্গের সারি – নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, হাতিপাহাড়, নন্দাদেবী, পঞ্চচুল্লী। সবুজ পাহাড়, ছোট ছোট বাড়িঘরের পিছনে আলগা নীল আকাশে চিত্রার্পিত হয়ে আছে তুষারশুভ্র হিমালয়!
বেলা ১-১৭একজনের সঙ্গে আলাপ হলো, এই পৌনে বারোটা নাগাদ। নাম প্রদ্যুমন ভাণ্ডারি – হলদোয়ানির ছেলে; পড়াশুনা শেষ করে এখন কাজের সূত্রে আলমোড়ায় থাকেন। সপ্তাহে কয়েকদিন এসে আশ্রমে স্বেচ্ছায় কিছু কাজ করে দেন হাতে হাতে। প্রদ্যুমন দুই ইচ্ছের মাঝে বন্দি – নেভিতে যাওয়া, আর সন্ন্যাসী হওয়া। প্রথম ইচ্ছের তুলনায় দ্বিতীয় ইচ্ছে এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে; কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা, চাকরি, দায়দায়িত্বের কথা ভেবে সম্পূর্ণ একটা ঝাঁপ দিতে পারছেন না প্রদ্যুমন। এখানে কথা বলছেন মহারাজদের সঙ্গে; নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। পাচ্ছেন, কিন্তু মন ভরছে না। অমিতাভ দা, আমার সঙ্গেও কথা বললেন – বিবেকানন্দের লেখা পড়েই এই পথে আসার জোর পেয়েছেন। কী করা উচিত তাঁর? জিজ্ঞেস করেন। আমি, আমরা বলার কে? শুধু বলি, সময় দিন নিজের ভাবনাকে আরও, যাতে পরে অনুশোচনা না আসে কোনও পথেই। যদি সেই শক্তি চান, আপনাকে সন্ন্যাসী করাও তাঁর হাতে; সংসারী করাও।
বিকেল ৪-১২দুপুরে খাওয়ার পর হাঁটতে বেরিয়েছিলাম কাছেই, কিলোমিটার খানেক। পাইন, আর আরও কত নাম না জানা গাছে ঢাকা পথ। এই আলো, এই ছায়া। আমাদের দিনগুলোর মতো পথ এগিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও।
লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেই অমুক মন্দির, তমুক জায়গায় বিবেকানন্দের ব্যবহৃত ঘর ইত্যাদি দেখতে যেতে বলছেন। কিন্তু না, এবার সে সব থাক। আশ্রমে এসেছি এসব থেকে দূরে থাকতেই। বিবেকানন্দের ব্যবহৃত সামগ্রীতে আমার তেমন উৎসাহ নেই, যতটা আছে তাঁর কথায়, বিশ্বাসে, দর্শনে।
তাই ধ্যান, পাঠ আর প্রকৃতির বাইরে এবার আর কিছু নয়।
সন্ধে ৮টাআজ বারবারই দেখা হয়ে যাচ্ছে প্রদ্যুমনের সঙ্গে; প্রতিবারই সে আসছে একগাল হাসি, আর কিছু প্রশ্ন নিয়ে। ঠাকুর কথামৃতয়ে কী বলছেন? বিবেকানন্দের কোন কথা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে? ঠাকুর আর স্বামীজীকে পড়ে তারপর কি মায়ের কথা পড়া উচিৎ?
তাঁকে সামান্য কিছু উত্তরই দিতে পারি। স্বামীজী নিয়ে অল্পবিস্তর কথা হয়। মেইল আইডি আদান প্রদান করি; বলি যোগাযোগ রাখবো।
আগামীকালও হয়তো দেখা হবে ওঁর সঙ্গে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।