১৬. ১০. ২০২২, সকাল ৭-৫৫, আলমোড়া রামকৃষ্ণ কুটির
আগের দিনের তুলনায় আজ উঠতে একটুখানি দেরীই হলো। সাড়ে ছটায় ঘুম ভাঙার পর নিত্যকর্ম সেরে যখন তিনজন গিয়ে পৌঁছলাম খাবার ঘরে, তখন ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে, সকালের মন্ত্রপাঠও শেষ ততক্ষণে। অবশ্য উপাসনাঘরে ভিড়ভাট্টা ছাড়াই বসা শ্রেয়। গতকাল টুরিস্টদের একটি দল এসে উঠেছে এই আশ্রমে। বাঙালি – বলাই বাহুল্য; এবং একেবারে notorious, কান ঝালাপালা করে দেওয়া বাঙালি! এঁদের দলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে – এঁরা একসঙ্গে দল বেঁধেও খেতে আসেন না, আবার খুব এলোমেলো ভাবে একে অন্যের অনেক আগে পরেও আসেন না। এঁরা কেমন একটা ভাঙা ভাঙা লাইনের মতো করে আসেন; এবং তার ফলে মিনিট কয়েকের তফাতে একই জায়গা দিয়ে একই বিষয়ে আজেবাজে বকতে বকতে দু'তিনজন করে এগিয়ে যান। দল বেঁধে এলে সুবিধে হতো – বাজে কথাটা একজনই বলতেন, বাকিরা "হ্যা হ্যা" করতে করতে চলে আসতেন, বা তারা যদি বাজে বকার কম্পিটিশনও করতেন, একসঙ্গে যা হবার হয়ে যেত। কিন্তু এখানে আমরা যারা ওই পঞ্চাশ সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠছি বা নামছি, প্রতি বাঁকে বাঁকে যেন বাজে বকার সম্মেলন!কাজেই, এঁরা সকালে মন্ত্রপাঠের সময়ে গিয়ে উপস্থিত হলে আমাকে যে রিট্রিটের অন্য অর্থ ব্যবহার করে কেটে পড়তে হতো, অনুমান করতে পারি।
আজকের ব্রেকফাস্ট টিপিকাল রামকৃষ্ণ মিশন ডেলিকেসি – আটার পুরি আর ছোলার ডাল। রামকৃষ্ণ মিশনের সেন্টার বদলে বদলে যায়, কিন্তু এই আটার পুরির স্বাদ বদলায় না। ছোলার ডালটা অবশ্য একটু অন্যরকম – টমেটো দিয়ে টক টক করে তৈরি করা।
বেলা ১০-৩৪
বেশ ঘন্টা দেড়েক সময় কাটানো গেল উপাসনাঘরে। প্রায় ফাঁকা, একেবারে পিনপড়া স্তব্ধতা। আমার থেকে একটু এগিয়ে বসা প্রদ্যুমন, নিবিষ্ট হয়ে ধ্যান করছে। তারও সামনে বসে আছেন এক ব্রহ্মচারী মহারাজ; নিজের উত্তরীয়টি গায়ে জড়িয়ে জপ করছেন সম্ভবত। প্রয়ান্ধকার ঘরটিতে যেটুকু আলো ছড়িয়ে আছে, ঠাকুরের আসনের সামনে জ্বলা হলুদ আলোই তার উৎস। বাইরে খুব মেঘ আজ। বর্ষার মেঘ নয়, কুয়াশা মেঘ। গতকাল এই সময়ে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল নীচের উপত্যকা মেঘের আড়াল কেটে; কিন্তু আজ সেরকম লক্ষণ নেই। সকালের সেই ভারী মেঘ কেটেছে বটে, কিন্তু একটা ভেজা, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে বাইরে।
অল্প কিছু সময় জপ করে, শেষে ধ্যান সারলাম। ধ্যানে আমার বরাবরের সমস্যা (হয়তো অনেকেরই) – মনোনিবেশ করবো কিসের/কার উপর? কোনও ঈশ্বরমূর্তি? ঠাকুর? মা? স্বামীজী? কোনও জ্যোতির্বলয়? আলোকবিন্দু? এখনও দেখি, এক এক সময়ে এক একটি বিষয়ে মনোনিবেশ ভালো হয়। তারপরের প্রশ্ন – স্মরণ যে করবো, কোথায় স্মরণ করবো তাঁকে? নরেন্দ্রপুরের বলরাম মহারাজ বলেছিলেন, স্মরণ সবসময় নিজের বুকের মধ্যিখানে করতে। ঠাকুরেরই কথা, বুক ডঙ্কাপেটা স্থান; ওখানে স্মরণ করলে ধ্যান ভালো হয়।
ভালো ধ্যান কাকে বলে জানি না, আমি বেশিরভাগ সময়ই আলোকবিন্দুকে ভাবি বুকের মাঝখানে। যেন কেউ তুলো ঘষার মতো ওই আলোকবিন্দু ঘষে দিচ্ছে আমার বুকের মাঝে। কখনও বা ঠাকুরের মুখও ভাবি। এই দুয়েই দেখি, কিছুটা মন লাগে আমার। গোলপার্ক মিশনের মেডিটেশন রুমে মাঝে নিয়মিত ধ্যান করে বিষয়টাকে একটু বাগে এনেছিলাম; কিছু মাসের অনভ্যাসে আবার একটু পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের রোজকার জগৎ, কাজকর্ম, বোঝাপড়া, লেনদেন এইসব থেকে এত ভিন্ন, এত দূরে অবস্থিত, এবং বেশি সময়ই এত বেশি করে এইধরণের অস্থায়িত্বে গা ডুবিয়ে বসে আছি, যে স্থায়ী, ধ্রুব কিছুকে স্মরণ করা, মনন করা এক একসময় দুঃসাধ্য মনে হয়।
বেলা ১২-৪৫
এখানে একটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে এসে – রায় পরিবার। বাবা, মা এবং মেয়ে, তিনজনে শ্যমলাতাল হয়ে এসেছেন আলমোড়ায়। ভদ্রলোক সাউথ-ইস্টার্ন রেলের চাকুরীজীবি ছিলেন, এই বছর জানুয়ারিতে রিটায়ার করেছেন। মেয়েটি সারদা মিশন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী, জার্নালিজমে। কথায় কথায় বেরিয়ে এল, আগামীকাল তাঁরাও যাবেন লোহাঘাট, আর পরশু মায়াবতী। এতটা অব্দি ওঁদের প্ল্যান আমাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। (তারপর পরশু থেকে অবশ্য ওঁরা ক'দিনের জন্য থেকে যাবেন অদ্বৈত আশ্রমেই; আর আমরা মায়াবতী থেকে আবার লোহাঘাট ফিরে তরশু বেরিয়ে পড়বো শ্যমলাতালের উদ্দেশ্যে।) তাই, ওঁরাই বললেন – আলমোড়া থেকে লোহাঘাট যাওয়াটা যদি আমরা দুই দল একসঙ্গে একটা গাড়ি ভাড়া করে করি, তাহলে খরচটাও কম হয়, একই গন্তব্যে যাওয়াও যায় কম কাঠখড় পুড়িয়ে। বেশ কথা, তাইই হোক। সেই অনুযায়ী একটা ৬-সিটার গাড়ি বলা হলো, সে আগামীকাল সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে আমাদের আশ্রম থেকে তুলে নেবে। যাওয়ার পথে বোধ হয় জাগেশ্বর শিবমন্দির ঘুরে যাওয়া হবে। সে হোক; আগামীকাল লোহাঘাট পৌঁছে আর কোথাও যাওয়ার নেই, কাজেই তাড়াও নেই কোনও।
কলেজে-পড়া মেয়েটির (সুনন্দা) সঙ্গে তিতলির বেশ ভাব জমে গেছে। তাঁদের কটেজের উঠোনে বসে তিতলি এখন ওর আলমোড়া আসার যাত্রাপথের কথা ইংরাজিতে লিখছে দিদির দেওয়া একটা কাগজে। আমরাও ওদের কটেজের বাইরেই দাঁড়িয়ে কথা বলছি এই-সেই। এরই মধ্যে, ফেরার দিন শ্যমলাতাল থেকে বেরিলিতে আসার জন্য আর গাড়ির অবকাশ না রেখে ট্রেনের টিকিট কেটে নিল অমিতাভ দা। শ্যমলাতাল থেকে একটু দূরের স্টেশন টনকপুর। ওখান থেকে ১১-২৫ এর জনশতাব্দী এক্সপ্রেস নিয়ে দুপুর আড়াইটার মধ্যেই পৌঁছে যাবো বেরিলি। তারপর সেখান থেকে সাড়ে চারটের ট্রেন কলকাতা ফেরার। এইসব নিয়ে কথাবার্তা চলছে; এমন সময় কটেজের চাল থেকে ধুপধাপ করে লাফিয়ে নামতে থাকলো গাদা গাদা বাঁদর, এবং বেশিরভাগের কোলেই এক্কেবারে পুঁচকে বাচ্চা। দেখেই বোঝা গেল, এরা কেবল দল নয়, পরিবার নয়, একান্নবর্তী পরিবারও নয়, গোটা জ্ঞাতি-গুষ্টি সমেত কোনও নেমন্তন্নে যাচ্ছে, যেমন জামাইষষ্ঠীতে দেখি লোকাল ট্রেনে পিলপিলিয়ে লোকজন এন্ডি-গেন্ডি সমেত যাচ্ছে ভোজ গিলতে।
বিকেল ৫-৪৭
আলমোড়ায় এবারের মতো আমাদের শেষ সন্ধে নামছে। সূর্য চলে গেছে সেই বড় পাহাড়ের আড়ালে। আজ সারাদিনের অনেকটাই মেঘ-না-কাটা, তাই সূর্য একটু নিস্তেজ হতেই আবার ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে সামনের উপত্যকাগুলো। ইনিয়ে বিনিয়ে নীচ থেকে উঠে আসছে পাহাড়ি রাস্তা ... বাস আসছে, প্রাইভেট গাড়ি আসছে। আর বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ দিন; তারপর শীতের তিন মাসের জন্য অতিথিদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে এই আশ্রম, ঘুমিয়ে পড়বে ছোট ছোট কুটিরগুলো। ঝিম মেরে থাকবে পর্যটন; বাস, গাড়ি কমতির দিকে এগোবে।
আশ্রমের অফিস থেকে একটা সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে; ওখানেই নেমে একটা ধাপে দাঁড়িয়েছি আমরা। পাইন গাছে জমাট বাঁধা ছায়ার মতো ঝুলছে পাইন কোন। মনে পড়ে, ২১ বছর আগে যখন প্রথমবার কুমায়ুনে এসেছিলাম, কৌশানীর পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা অজস্র পাইন কোন কুড়াতাম আমি আর রুনি দি।
জংলার ফুটেছে স্থলপদ্ম, বেগুনি ঘন্টাফুল। ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে শুঁয়োপোকা, জাল বুনছে মাকড়সা। পাহাড়ের গায়ে কাটা রাস্তা ধরে উপরে উঠে আসছেন মহারাজ – প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু করবেন এবার; নীচে আশ্রমের ছোট্ট জমিতে শাক, সবজির ফলনও দেখভাল করতে হয় তাঁকেই, সেখান থেকেই আসছেন। আশ্রমের অধ্যক্ষ তিনি, সন্ন্যাসের এই সংসার সামলাতে হয় তাঁকে। আমাদের দিকে তাকিয়ে, হেসে, দুয়েক কথার শেষে এগিয়ে যান। এখন দূরের উপত্যকার আর কোনও রঙ নেই; পুরোটাই ছায়া। তার সামনে আরও গাঢ় অন্ধকার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়ি গাছগুলো, ঝিরিঝিরি সরু পাতা নিয়ে। শনশন হাওয়া শুরু হয় আবার; দূরের আকাশে সদ্য জলরঙ করতে শেখা শিশু কমলা যেন কিছুটা বেশি ঢেলে দিয়েছে।
তবু, আগামীকাল আলমোড়া ছেড়ে যাওয়ায় বিষাদ থাকলেও, পিছুটান নেই। যে কোনও কিছু ছেড়ে যাওয়াতেই এক ধরণের 'sense of an ending' অনুভব করা প্রায় অনিবার্য; কিন্তু ছেড়ে যাওয়া, চলে যাওয়ায় এখন আর অপ্রাপ্তিবোধ কাজ করে না। যে ক'দিন রইলাম, যা পেলাম, যেটুকু পেলাম, এ-ই কি কম নাকি?
সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে; খোল, মন্দিরা, তবলা আর হারমোনিয়াম মিলে সে কী আনন্দের গান! এই সব গান আনন্দ ছাড়া আর কিছুই মনে করায় না। যা থাকার, যাঁর থাকার, আছেন। কথামৃতে দক্ষিণেশ্বরের ঘরের কথা মনে পড়ে; জমায়েত হয়েছেন ভক্তেরা। গুরুগম্ভীর ঈশ্বরপ্রসঙ্গ নয়; এ কথা, সে কথার পর – "নরেন, গান ধর!"
সে' সব দিন হয়তো আর নেই; কিন্তু আছে সেই আনন্দ, সেই ভাব, সেই স্পর্শ। যে সত্যিকারের, চাওয়ার মতো চাইবে, তার কাছেই আছে। আর আছেন এক বিবেকানন্দ; হিমালয়ের কোলে এই আশ্রমকে আগলে দাঁড়িয়ে আছেন, আরেক হিমালয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।