১৪. ১০. ২০২২, সকাল ৮-৫১, বেরিলি থেকে হলদোয়ানির পথে
বেড়াতে আসার রোম্যান্টিক বিবরণের জন্য বিস্তর সময় পড়ে আছে, ও কথা হবে। কিন্তু তার আগে কয়েকটা কাজের কথা জানিয়ে রাখি এই রুটে যাঁরা আসবেন/আসতে চান/আবার আসবো, তাঁদের জন্য –
১) কুয়াশা বা কোনও বিশেষ ফল্ট যদি না ভোগায়, কলকাতা স্টেশন থেকে বেরিলি আসার জন্য এই সাপ্তাহিক ট্রেনটি (কলকাতা-নঙ্গলড্যাম গুরুমুখী সুপারফাস্ট) তুলনাহীন! রাত দুটোয় লকনউ স্টেশন ঢোকা অব্দি অন-টাইম, এমনকি বিফোর-টাইম টেনেছে। তারপর ভোররাতে ভারী কুয়াশার জন্য একটু দেরী হলো; সব মিলিয়ে ৪৫ মিনিট লেটে বেরিলিতে ঢুকেছে – সোয়া ছটার বদলে সাতটা।
২) স্লিপার ক্লাসে এলাম, বাথরুমের পাশের ক্যুপে সিট পড়েছিল। অথচ বাথরুমের গন্ধ এল না গোটা জার্নিতে। সময়ে সময়ে ক্লিনিং স্টাফ এসে কামরা পরিষ্কার করে গেলেন।
৩) এই ট্রেনে প্যান্টরি কার নেই। আপনার থেকে অর্ডার নিয়ে আসানসোলে লাঞ্চ, আর মোগলসরাইতে ডিনারের ব্যবস্থা করে দেবেন ওঁরা; তবে এসব ক্ষেত্রে নিজের খাবার carry করা সবসময়ই ভালো।
বেরিলিতে নেমে স্টেশন থেকে অটোয় ১০০ টাকা দিয়ে পৌঁছে গেলাম সরকারি বাস টার্মিনাসে। সেখান থেকে হলদোয়ানি যাওয়া সরকারি বাসে – এমনিই রোজকার অফিসযাত্রীদের বাস; ভাড়া মাথাপিছু ১৪৪ টাকা।
বেলা ১১-১৫, পথে
হলদোয়ানি থেকে আলমোড়ার জন্য রওনা হওয়া গেল। ছোট অল্টো গাড়ি, পিছনে আমরা তিনজন, সামনে ড্রাইভার আর তাঁর এক বন্ধু। গাড়িতে রফি-লতা-আশা-কিশোরের সব দুর্দান্ত গান চলছে; একটাই সমস্যা – সবকটাই রিমেক, এবং অত্যন্ত বাজেভাবে, বেসুরে গাওয়া।
বেলা ১-৩০, পথে
দীর্ঘ জার্নিতে যা হয়, ঠিক তাইই হয়েছে। বাঙালির চা-তেষ্টা পেয়েছে। যত ড্রাইভারজী'কে বলে "চায়ে পিনা হ্যায়", ততবার সে বলে "হাঁ জি বিলকুল, গরমপানি!" আমরা ভাবি, ছাতা এতে আবার বলার কী আছে? চা গরম পানি দিয়েই তৈরি হবে না তো কী খেজুরের রস জাল দিয়ে হবে! আজব! একের পর এক চায়ের দোকান পেরিয়ে যায়, গাড়ি আর থামে না। তৃষ্ণার্ত হিন্দিতে আবার বলি, "ভাইসাব রোক কে! চায়ে পিবো!" উত্তর, "জি, গরমপানি!" আমিও বললাম, "হাঁ জি, পতা হ্যায়, গরম পানি! বস অব পিনা হ্যায়!" শেষে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে বসে আর কী, ড্রাইভারজি একটা রেস্তোরাঁয় দাঁড় করালেন। গজগজ করতে করতে নেমে দেখি, ওমা! এই জায়গাটারই নাম 'গরমপানি'! কপাল আমার! তিনি আমাদের বলতে চাইছিলেন যে গরমপানিতে গিয়ে গাড়ি থামাবো, তখন চা খাবেন। আর আমরা যাদবপুরের মিলন দা'র ক্যান্টিন যাওয়া লোক, চা চাইলে বৌদি পিছন ফিরে চিৎকার করতেন, "একটা গরমজল!" কুমায়ুনে মিলন দা'কে বয়ে আনে এখন মাথা কাটা যাচ্ছে!
বেলা ২-১৭, পথে
তিতলির এই প্রথম হিমালয়ে আসা। প্রথমবার হিমালয়ে এলে যেমন সবই স্বপ্নবৎ লাগে, মানুষমাত্রেই লালমোহন গাঙ্গুলি হয়ে যায়, তিতলিরও সেই দশা! "কী"-এর পর 'অপূর্ব', 'অবিশ্বাস্য', 'অভাবনীয়', 'সুন্দর', 'অদ্ভুত' – যা হাতের কাছে আসছে, ও পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বসিয়ে চলেছে, খাবারকেও 'ভোজন' বলছে। ড্রাইভারজি গাড়ি চালাতে চালাতে ওর কথা শুনে হাসছেন; একবার বললেন, "জানেন, আপনাদের বেটি তো কেমন সুন্দর ওর মাতৃভাষায় কথা বলছে আপনাদের সঙ্গে! আমাদের ছেলেমেয়েরা আর ওদের মাতৃভাষা – কুমায়ুনি – বলতেই চায় না। হিন্দি বলে দিনরাত।" শুনে মনে হয়, আমরা কেমন সমগ্র উত্তর ভারতকে হিন্দি-সাম্রাজ্য করে দিই, অথচ উত্তরাখণ্ডের এই মানুষেরা কেমন হাহুতাশ করছেন নিজেদের মাতৃভাষাকে হিন্দি গিলে ফেলেছে বলে। হয়তো উত্তরের সব প্রদেশেই এমন অনেকে আছেন, যাঁর মাতৃভাষা হিন্দির জোয়ারে ভেসে গেছে।
প্রসঙ্গ বদলায়; ড্রাইভারজির এক ছেলে, এক মেয়ে – স্কুলে পড়ে। এখনকার ছোটদের চাহিদা ও পাওয়ার অঙ্ক কত ভিন্ন আগের সময়ের চেয়ে, তিনি বলেন। "আমার প্রথম পাওয়া বলতে ছিল, একটা Atlas কোম্পানির সাইকেল, তাও ক্লাস টুয়েলভ পাশ করে পেয়েছিলাম", একরকম নালিশের সুরেই বললেন।
We connect on our loyalty to the bygone values!
সন্ধে ৮-৫৬, আলমোড়া রামকৃষ্ণ কুটির
সন্ধে না বলে রাত বললেই চলে। চারদিক শুনশান, নিস্তব্ধ।
আলমোড়ার রামকৃষ্ণ কুটিরে এসে পৌঁছেছি বেলা তিনটে নাগাদ। আগের দিন থেকে শুরু করে এই দীর্ঘ জার্নির ধকল এই ক' ঘন্টায় এক্কেবারে পুষিয়ে গেছে!
যাঁরা এখানে এসে থেকেছেন, জানেন এর সৌন্দর্য্য! সে জিনিস ব্যাখ্যা করতে চাওয়া বৃথা। শুধু এটুকু বলি, সামনে যতদূর চোখ যায়, শুধু পাহাড় আর উপত্যকায় রোদের খেলা। দিনের প্রহরে প্রহরে রোদ বদলে যাওয়া...
বিকেল গড়াতে না গড়াতে শনশন হাওয়ার দাপট বাড়ে খুব। গাছের পাতারা ঝরঝর করতে থাকে, ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিঁ দুরকম ডাকে ডেকে ওঠে – একটা ডাক শিসের মতো। অন্ধকার হয়ে আসে পাহাড়ের ঢাল, মেঘ জমে সাদা হয়ে থাকে উপত্যকা, রোদ কোথায় মিলিয়ে গিয়ে আকাশের পশ্চিম রূপরেখায় এক আশ্চর্য সন্ন্যাসরঙ লাগে, মহারাজ আলাপচারিতার ফাঁকে হেসে বলেন, "রাতে সাবধানে থাকবেন, বেশ শীত হবে কিন্তু। আপনাদের কলকাতার ভালো শীতের চেয়েও বেশি।"
ঠাকুর-মা-স্বামীজী'র প্রার্থনাঘরটি ছিমছাম আভিজাত্যে ভরা। হলুদ আলো, কাঠের দেওয়াল, মেঝেয় পুরু কার্পেট পাতা; উপাস্য তিনজন, এবং তুরীয়ানন্দজির ছবিতে প্রথামাফিক পরিমিত ফুলসাজ। প্রার্থনাগানের শেষে মহারাজ বলেন, "কেউ কোনও গান গাইতে চাইলে, গাইতে পারেন।" 'রামকৃষ্ণ শরণম' ধরা হয়, গলা মেলাই সব্বাই। থামলে, সব চুপ। বাইরে সেই ঝিঁঝিঁর দুরকম ডাক।
বিকেলে পাঁচটা নাগাদ মুড়ি-ঝুরিভাজা আর চা টিফিন, রাতে সাড়ে আটটায় ডিনার। খাবারও যেন অমৃত – একটু গরম ঘি ছড়ানো ভাত, দুটো রুটি, কাঁচা মুগের ডাল, নিউট্রেলার তরকারি, আলু চোখা, আচার, ক্ষীর আর দুধ।
এখন প্রায় সাড়ে নটা। হাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে আছি উপত্যকার দিকে তাকিয়ে। দূরে শহর, গ্রাম – একগুচ্ছ, বা অল্প কয়েকটা আলো জোনাকির মতো জ্বলছে, কাঁপছে বাতাসের পরতে পরতে। কিছুদূরে নবীকৃত আলমোড়া শহরে শপিং মলের আলো; রাতের পাহাড়ের গায়ে অশালীন ভাবে ঝকমক করছে নীল রঙে লেখা 'CITY MALL'। চোখ ফিরে যায় জোনাকির দিকে, আরও দূরের শহর বা গ্রামের দিকে। কোথাও কোথাও পাহাড়ের অনেকটা তল্লাট জুড়ে কেবলমাত্র একটু আলো। ওই গ্রামে কী একটাই বাড়ি? একটাই পরিবার? একজন মানুষ? আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলে, একা এবং কয়েকজন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।