মায়াবতীর পথে যেমন গহীন জঙ্গল পেয়েছিলাম, ততটা না হলেও, জায়গায় জায়গায় এক এক পশলা জড়ানো-মড়ানো অরণ্যে আলোছায়ার খেলা দেখে গায়ে কাঁটা দেয়। মাঝে গাড়ি থামিয়ে একটা ভিউ পয়েন্টে গেলাম; পাশের চা-দোকানের মানুষটি বললেন, "যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তিন দিন আগে এখানে বাঘ এসেছিল।" আমাদের বুড়ো ড্রাইভারজি বলেন, "বাঘ, ভালুক, সবই আসে। কিন্তু কী জানেন তো, যতক্ষণ না আপনি জঙ্গলের সঙ্গে কোনও 'ছেড়খানি' করছেন, জঙ্গল আপনাকে কিচ্ছু করবে না।" প্রকৃতির, জঙ্গলের নিয়ম আমাদের মানুষদের দু-মুখো নিয়মের চেয়ে বিস্তর আলাদা। আমরা নিজেরা unpredictable, তাই জঙ্গলকেও তেমন ভেবে নিয়ে এগোই। তিতলি এখন আমার কাছে কেনেথ এন্ডারসনের লেখা জঙ্গল বিষয়ক নানা কথা শুনছে।
সন্ধে ৮-১৫, শ্যমলাতাল বিবেকানন্দ আশ্রম
মাঝের দীর্ঘ সময় জুড়ে আজকের দিনপঞ্জিতে খুব বেশি কিছু লেখার নেই, কারণ সকাল ১০-৪৫ নাগাদ শ্যমলাতাল আশ্রমে এসে পৌঁছনোর পর থেকে এখানকার নৈঃশব্দ্য, প্রকৃতি আর আশ্রমিক জীবনকে যেভাবে আমার সারা গায়ে মেখে নিচ্ছি, তাকে শব্দে প্রকাশ করা একটু হলেও কঠিন। ১৯১৫ সালে স্বামী বিরজানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রম কয়েক বছর আগে ১০০ পেরিয়েছে। সেই সময়কার পুরোনো বাড়ির গড়ন, গঠন এক রেখে renovate করা হয়েছে। সেই সময়ের পরেও বেশ কিছু বাড়ি – বিশেষ করে ভক্তনিবাসগুলি তৈরি হয়েছে। আমরা যে বাড়িতে আছি, তার নাম 'বিবেকানন্দ ধাম'। দোতলা বাড়ি, সব মিলিয়ে চারটে ঘর। একতলার ২ নং ঘরে (four-bedded) আমরা আছি। নিচু কাঠের সিলিং, মাথায় হুড়কো লাগানো পুরোনো, অসমান দরজা। সমস্ত ব্যবস্থা আছে প্রয়োজন অনুসারে, কিন্তু কোথাও বাহুল্য নেই; অত্যন্ত সাধারণ, ছিমছাম আশ্রমিক একটি যাপনের মধ্যে আমাদের এনে ফেলেছে শ্যমলাতাল। ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালে, অনেকটা নীচে সবুজ জলের সেই 'তাল' বা হ্রদ দেখা যায়, যার নামে এই জায়গার নাম।
পাহাড়ের একটিই ধাপে গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ আশ্রম; দীর্ঘাঙ্গী সব পাইন গাছ সারা আশ্রম জুড়েই। তাদের ডালে বসছে, উড়ে যাচ্ছে হাজারো পাখি। কালো লম্বা লেজের এক পাখি সারা দুপুর ধরে নিরলস 'কোয়া, কোয়া' করে ডেকে, শেষে বিকেলের রোদে উড়ে গেল দূরের পাহাড়ের দিকে। বিরজানন্দ ভবনের সামনের বেঞ্চিতে বসে দেখি – প্রকৃতির মধ্যে, প্রকৃতিকে আঘাত না করে মানুষের অবস্থান। একদল হনুমান গাছ থেকে নামছে, হৈহৈ করছে; মানুষ এলে টুপটাপ এদিক সেদিক সরে পড়ছে। চলে গেলে আবার ফিরে আসছে। কমলালেবু গাছে ছোট ছোট লেবু টসটসে কমলা হয়ে ধরে আছে।
সন্ধে নেমে আসে শ্যামলাতালে। সূর্য ডুবে যায়। পড়ে থাকা অপস্রিয়মান আলোয় দূরের ঘন অরণ্যে গাছের ডালে ডালে দোল লাগে। হয়তো এক ঝাঁক পাখি, হয়তো বাঁদরের দল। ওই গাছেদের, জংলার ভিড়েই হয়তো শ্বাপদ এগিয়ে চলেছে জলের দিকে, শিকারের দিকে।
উপাসনাঘরে আলো জ্বলে ওঠে। ঘনশ্যাম মহারাজ এসে চুপটি করে বসেন আসনে, ধ্যানে। আরও মহারাজরা আসেন। তাঁদের একজন বড় ভালোবেসে-বেসে সন্ধের গানগুলি গান – শুনি সেই সুর, "স্থাপকায় চ ধর্মস্য, সর্বধর্ম স্বরূপিনে, অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ"। আমার সমস্ত আনন্দ ফিরে আসে। এখানে এই যে ঠাকুর, মা, স্বামীজীর সামনে বসে একজন মহারাজ ভালোবেসে বেসে গান গাইলেন সন্ধেবেলা... সবাই গাইলাম সঙ্গে.. এটা আনন্দের। মহারাজদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট আছে, অনেক ছেড়ে আসা আছে। কিন্তু তাও, সে সব সরিয়ে রেখে আশ্রমের কাজ করছেন; আমরা খেতে বসলে এসে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছেন, সবাই ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে কিনা, কিছু প্রয়োজন কিনা; হাসপাতালে চিকিৎসা করছেন খরচ ছাড়া; স্থানীয় গ্রামের বাচ্চাদের বিনামূল্যে প্রাইমারি এডুকেশন দিচ্ছেন। আমার মনে হতে থাকে, ওই তিনজনের কোলে আবার ফিরে এসেছি।
(ইন্টারনেট কানেকশন খুব ভোগাচ্ছে। তাই ছবি দিতে পারলাম না আজ।)