এটি সন্ত কবিরের একটি দোঁহা:
তিনি মানুষের কাছে ভালোবাসার দূত
আমার পথকে এত ভয় কেন তোমার?
এই শিরোনামে যে কবিতাটি তাতে জি.এন.সাইবাবা প্রশ্ন করছেন আমি তো নাস্তিক নই যে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রচার করে; আমি তো অজ্ঞেয়বাদী নই যার মস্তিষ্কে নানা সংশয় গিজগিজ করে; আমি সেক্যুলার নই যে সমস্ত ধর্মের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে থাকে; আমি যুক্তিবাদী নই যে নিখাদ যুক্তির ভিত্তিতে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে; আমি ধর্মদ্রোহী নই যে তোমার সাবেকি জীবন, পুজাপাঠকে বানচাল করার চেষ্টা করে। আমি তো ভালোবাসা বিতরণ করি, তাহলে আমার পথকে এত ভয় কেন তোমার?
গোকারাকন্ডা নাগা সাইবাবা, একজন শিক্ষক, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, দলিত ও আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত একজন সমাজকর্মী। জীবনসঙ্গিনী বসন্ত কুমারির জন্মদিনে একটি চিঠিতে তিনি তাঁর বিস্ময় ব্যক্ত করেন। বলেন, আমরা তো সামান্য কর্মী, সামান্য উপায়ে সামান্য মানুষদের জন্য কাজ করি! তাহলে এই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র কেন আমাদের আশা, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের স্বপ্নকে ভয় পায়? আমরা কি কাউকে কোনও ভাবে কষ্ট দিয়েছি? কারো ক্ষতি করেছি? কেন আমাদের জীবনের ওপর এই আক্রমণ? কেন আমাদের স্বপ্নগুলোকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়? কেন আমাদের আশা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়?
রাষ্ট্র মূক, নিরুত্তর। পাঁচ বছর বয়স থেকে ভিন্ন ভাবে সক্ষম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামলাল আনন্দ কলেজের এই জনপ্রিয় অধ্যাপক রাষ্ট্রের কাছে এতোই বিপজ্জনক যে ২০১৭ সাল থেকে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে নাগপুরের একটি আলোবাতাস হীন অন্ডা সেলে নির্বাসিত করা হয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে দেখার জন্য তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। মার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য জামিনের আবেদন করেন, তখনো তা নাকচ হয়ে যায়। ২০২০ সালে নাগপুর জেলের ২০০ বন্দি ও ৮৫ জন কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হন। সাইবাবা তাঁর নিজের শারীরিক অসুস্থতা এবং জেলে ক্রমবর্ধমান করোনার প্রকোপের কারণে আবারও জামিনের আবেদন করেন, সেটাও নাকচ হয়ে যায়।
সাইবাবার দোষ তিনি আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে সরব ছিলেন। ছোটোবেলা থেকে ৯০% প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি হাতের তালুতে একটা চপ্পল লাগিয়ে, হাঁটু ঘষে সারা দেশ চক্কর মারতেন। দুর্গম অঞ্চলে আদিবাসীরা তাঁকে পিঠে করে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে প্রচারকার্যে যেতেন। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘অপারেশন গ্রীন হান্ট’ এর বিরুদ্ধে তিনি প্রবল ভাবে সোচ্চার হন। তাঁর বক্তব্য এই অভিযানের উদ্দেশ্য মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চলের সম্পদ লুট করে তা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া।
এরকম একজন বলিষ্ঠ দুর্জয় মানুষ তো রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক হবেই। অতএব ইউএপিএ-র নানা ধারা চাপিয়ে তাঁকে অনন্তকালের জন্য কারাবাসে ঠেলে দাও। সাইবাবার আইনজীবীর মতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ ভুয়ো। পুরো মামলাই সাজানো এবং তাতে বিস্তর ফাঁকফোকর। তদন্তকারী অফিসার তাঁর কেস সাজানোতেও বিশেষ মন দেননি কারণ হয়তো তিনি জানতেন এই মামলার রায় পূর্ব-নির্ধারিত। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ তাঁর কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত তথ্য। যে সাক্ষীকে আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খাড়া করা হয় তিনি বলেন ডিভাইসগুলো যখন বাজেয়াপ্ত করা হয় তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি স্বীকার করেন বাজেয়াপ্ত হওয়া কোনও কিছুতে তাঁর সই ছিল না এবং এটাও কবুল করেন যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য তাঁকে সতেরো দিন পুলিশের অতিথিশালায় এনে রাখা হয়েছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার তদন্তকারী অফিসার বলেন যে বাক্সে ডিভাইসগুলি রাখা ছিল তা হারিয়ে গেছে এবং আদালতে পেশ করা যাচ্ছে না। একজন সাক্ষীকে ক্ষেতমজুর বলে আদালতে হাজির করা হয়। অভিযুক্তের আইনজীবী প্রমাণ করে দেন যে তিনি একজন হোমগার্ড যাঁকে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমেরিকার ‘ফ্রি সাইবাবা কোয়ালিশন’ এর অশোক কুম্বামু জানাচ্ছেন শেখান-পড়ান বাইশ জন পুলিশ অফিসারের জবানবন্দির ভিত্তিতে তাঁকে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং মাননীয় বিচারপতি তাঁকে কঠোরতম শাস্তিতে দন্ডিত করেন। সাইবাবা অবিচলিত, দেশের বিচারব্যবস্থাকে বিদ্রুপ করেন:
ফাঁসির দড়ি ঝোলানো সর্বত্র
পরাধীন আমলের সেকেলে গাছের ডালপালা থেকে।
কারাগারে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করার সময় গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করা হয়েছিল, যার ফলে তাঁর বাঁ হাতের রগ ছিঁড়ে যায় এবং কোনও চিকিৎসা না হওয়াতে সেটি প্রায় অকেজো হয়ে যায়। এছাড়া তিনি ষোলোটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। একটি চিঠিতে তিনি তাঁর ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষকদের লিখছেন, তীব্র ব্যথায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে; আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি একে একে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে; আমি কঠিন হৃদরোগে আক্রান্ত; মাঝেমধ্যেই আমার ব্ল্যাকাআউট হয়ে যায়, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি; আমার প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিস আছে; আমার কিডনিতে পাথর জমে গেছে; আমি জীবনের কিনারে বেঁচে আছি। তবুও তিনি তাঁর প্রিয় জায়গা ক্লাসঘরে ফিরে যেতে চান।
আমার ক্ষুদ্র কুঠুরির
ইস্পাতের খিলানে বেড়ি পরানো অবস্থায়
দিন রাত আমি স্বপ্ন দেখি
আমি আমার ক্লাসঘরে আছি।
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তিনি অদম্য, মৃত্যুকে তিনি অস্বীকার করেনঃ
যখন আমি মৃত্যুকে অস্বীকার করি
আমার বন্ধন শিথিল করে দেয়।
আমি বেরিয়ে আসি
বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে
ঘাসগুলি কেঁপে ওঠে বিপুল হরষে।
আমার হাসি তাদের অসহিষ্ণু করে,
আমাকে আবার তারা কয়েদ করে।
কারাগার থেকে লেখা সাইবাবার এই কবিতা ও চিঠির সংকলনটি শুধুমাত্র যন্ত্রণা, বেদনার একটি কারাকাহিনী নয়, তাঁর জীবনসঙ্গিনী বসন্ত ও মানুষের কাছে নিবেদিত ভালোবাসার এটি একটি নৈবেদ্য। বসন্তের চিঠির জন্য আকুল হয়ে তিনি লেখেন,
কুঠুরির অন্ধকারে
আমার দুর্বল চিত্তের ছিদ্র থেকে
বহমান রক্তের আলোয়
আমি তোমার চিঠি পাঠ করি।
বসন্ত তাঁর প্রিয় সঙ্গীর মতো একই রকম অনমনীয়, মেরুদণ্ডসম্পন্না নারী। হাজারো কষ্ট সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের সম্মুখে তিনি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন না, যাতে তাঁরা তাঁকে দুর্বল না ভাবে। তাঁরা দুজনেই জানেন,
আমার সফরসাথী,
আমার প্রিয় সঙ্গিনী,
কোনও সংশয়ই নেই
প্রেম ও ঘৃণার মধ্যে
এ এক সরাসরি যুদ্ধ।
অসহনীয় একাকিত্ব ও চরম শারীরিক দুরাবস্থা সত্ত্বেও সাইবাবা বসন্তকে আবেদন করেন,
তোমার স্বপ্নের জানলাগুলি বন্ধ করে দিও না
আমি ঝড়ের মতো তোমার সাথে দেখা করতে আসছি।
তাঁর কারাবাসকালীন ভারতবর্ষ যে একটি বৃহৎ কারাগারে রূপান্তরিত হচ্ছে এটা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। ‘নাউ উই হেভ মোর ফ্রিডমস’ কবিতায় তিনি লিখছেন, যেদিন রোহিত ভেমুলা, ‘আমি আমার জাত দ্বারা পরিচিত হতে চাই না’, ঘোষণা করে আত্মাহুতি দিলেন, সেদিন আমার বুকটা কেঁপে উঠল; যেদিন হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখর জানিয়ে দিলেন ‘আদিবাসী আর নাচবে না’, সেদিন আমার পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল; আর যে দিন হাদিয়া আদালতে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করলেন, ‘আমি স্বাধীনতা চাই’, আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। ‘আ ট্রু স্টোরি অফ মাই হেভেন এন্ড হেল’ কবিতায় তিনি দেশে মাহার আর চামারদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা, নিপীড়নের কথা লিখলেন। ভবিষ্যতের একটি স্মার্ট সিটিতে মাহার নিজের আত্মমর্যাদা জাহির করার জন্য একটা সাইনবোর্ড ভেঙে ফেললেন; চামার সেখান থেকে একটা মৃত গরুকে সরাতে অস্বীকার করলেন; দুজনেই দেশদ্রোহী সাবস্ত্য হলেন। মাহার গেলেন স্বর্গে আর চামার নরকে। দু জায়গাতেই তাঁদের ঈশ্বরের বিষ্ঠা পরিষ্কার করার পবিত্র কাজ দেওয়া হল; সেটাই তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা করে যাচ্ছেন এই জীবনে এবং পরবর্তি জীবনে। তবুও তিনি ‘ওড টু লাইফ’ লেখেন, সেখানে পাবলো নেরুদাকে স্মরণ করেন,
‘সুন্দরের সাথে আমার একটা ভালোবাসার চুক্তি আছে।
মানুষের সাথে আছে একটা রক্তের সম্বন্ধ’।
এত প্রাণবন্ত, জীবনমুখী মানুষও কখনো হতাশায় নিমজ্জিত হন। লেখেন,
বহু দূরের এক স্টেশনে
এক রাতের হুইসেল শোনা যায়
যেন ধ্বস্ত সভ্যতার এক প্রেত।
অন্ডা সেলে অতর্কিতে ঢুকে আসা একটা চড়াইকে কাতর মিনতি করেন,
বন্ধু/ প্রতি রাতে তুমি এস/ আমি ভীষণ একা।
কিন্তু সেটা সাময়িক। আবারও তিনি দৃপ্ত কন্ঠে জানান দেন,
এখনো আমি মৃত্যুকে প্রত্যাখ্যান করি।
কিন্তু হায়
তারা তো জানে না আমায় কীভাবে হত্যা করতে হবে,
কারণ আমি সীমাহীন সবুজের ঝঙ্কার
এত বেশি ভালোবাসি।