প্রথম প্রকাশিত বইটির সূচীমুখ লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমর মিত্র প্রতিভা সরকার সম্পর্কে বলেছেন, "উনি সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়, রিপোর্টাজ পড়েছি, ওঁর প্রতিবাদের ভাষা আমি জানি। কিন্তু সেই গল্পের ভাষা তো ছোটগল্পের ভাষা নয়। ছোটগল্প তো না চেনা ভূখণ্ডকে আবিষ্কার করা। ছোটগল্প এক অজানা ভূখণ্ডের দিকে যাত্রা, লেখক জানেন না তিনি কোন পথে কোন 'অবশেষে' গিয়ে পৌঁছবেন। সাহিত্যই এক অনিশ্চিত যাত্রা। সেই অনিশ্চিত যাত্রায় তিনি কতদূর যাবেন, তা-ই নির্ণয় করবে তার গল্পের হয়ে ওঠা। ল্যাপটপ খুলে তাঁর ফাইলে চোখ রেখে আর সরাতে পারিনি। তাঁর জয় হয়েছে। হ্যাঁ, আমি এমনিভাবে হেরে গিয়ে জিতে যেতে চাই। এ লেখক অনেক দূরের যাত্রী। প্রথম বই, সেই বই আমাকে অভিভূত করেছে। তাঁর কলম শিল্পিত ও সজাগ।"
মা বলেন, জন্মানোর সময়েও নাকি সময় পার করে জন্মেছি। তবে পড়াশুনোটা আবার সেরেছি জেট-গতিতে। বোধহয় সময়টা পুষিয়ে নিতে। এদিকে লম্বা সময় ধরে পরীক্ষা আর সিলেবাসে ডুব দিয়ে বহু সাহিত্য মাধুরীই অধরা রয়ে গেল ছাত্রজীবনে। পরে জীবন যুদ্ধে এসে আরো এক প্রস্থ পিছিয়ে যাওয়া। সবমিলিয়ে যাকে বলে হালের সাহিত্য পড়া বা ওসব নিয়ে চর্চা, কাটাছেঁড়া বিশ্লেষণ এসব করার মন মানসিকতাই হারিয়ে বসেছিলাম।
ছয়ে ছোট বন্ধুটির ঠ্যালায় টাল সামলাতে না পেরে আবার খুঁজে পাচ্ছি নিজের বাঁচার রসদ। হারিয়ে যাওয়া তেপান্তরের মাঠ। আমলকী গাছের শিরশিরানি শিস। পালহীন নৌকোয় দাঁড় বাইতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেই ছুট্টে চলে যাই বিছানার হেডবক্সে রাখা চলতি আধ-পড়া বইটির কাছে।
প্রথমবার পড়ে বেওকুফ বনে বইটিকে সাদরে তুলে দিয়েছিলাম আমার হালে বিয়ে করে সংসার পাতা ডাক্তারণী বোনঝিকে। 'মেয়েরা'! এই বিষয়টা বইটিতে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যে প্রতিটি মেয়ে নিজের চলার পথের পাথেয় টুকু কুড়িয়ে নিতে পারবে অনায়াসে। যা সে সময় আমার বোনঝির খুব দরকার ছিল।
ফরিশতা ও মেয়েরা! কোথা থেকে যে শুরু করি বুঝে উঠতে পারছিনা। বইটি ঘরে ফেরত আসার পর আবার একবার গোটা বইয়ের তেরোটি গল্প তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় বারের পড়ায়ও ততটাই নতুন লাগলো যা কিনা প্রথমবার লেগেছিল। বরং বেশ কিছু বিষয় আরো আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। চারপাশের নতুন নতুন অধরা বিষয়গুলো তাঁর গল্পে স্থান পেয়েছে।
'ফরিশতা' গল্পটিতে সেই মানুষের কথা বলা হয়েছে যে মানুষ নয়, ফরিশতা। দেবদূত! এক ভিস্তিওয়ালার গল্প। যে কবরে জল ছেটায়। মৃত্যুর পরও ঘুমন্ত প্রাণদের তেষ্টা মেটান। চাতক তৃষা চরিতার্থ করতে ভিস্তিওয়ালার হৃদয়ঢালা জলদান! এ-কি রূপক! সঙ্গে অ-সম ধর্মের ভালোবাসার পবিত্র টান। যার আকর্ষণে সামিল হয়ে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পায় ভিস্তিওয়ালা।
'ফরিশতা-২: নাপাক' এই বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। রাবিনা, এই গল্পের মুখ। দুই বোনের পর 'জন্ম নেওয়া একচিলতে পুরুষ-খোকা, আবদুল সাহেবের পুরুষকারের বিলম্বিত চিহ্ন!' এদিকে মৌলবি মশাই বলেন, 'ছি মা, মেয়ামাইনষের এত জিদ নাপাক। খোদাতাল্লা নারাজ হন।' বেশ কিছু ইসলামিক কুপ্রথার কথা এভাবে নির্বিবাদে এসেছে গল্পের হাত ধরে। সঙ্গে রয়েছে এক নিখাদ প্রেমিকের তার ভালবাসাকে আগলে রাখার আকুলতা। এই আপাত বিরোধী বিষয়গুলোই কিন্তু সত্য। বাস্তব। কোনো ইজম বা সংঘ এই ভাবনাগুলো ভাঙতে পারে না। গড়তেও পারে না।
এইসবই বহুবছরের লালিত অসংখ্য ভালোমন্দের মধ্যে গুটিকয়েক, যা কখনো কামড়াতে আসে। কখনো আবার শীতল ছায়া দান করে। সমাজমুখী লেখক তাই তাঁর গল্পে গোটা চিত্রটা প্রতিবিম্বিত করে রেখেছেন। বিষয়টিকে নিজেদের অনুযায়ী গ্রহণ করা একান্তই পাঠকের দায়।
'ক্ষত' সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা একটি গল্প। মেয়েদের উপর শারীরিক অত্যাচার যে বয়স, সম্পর্ক কোনো কিছুরই ধার ধারে না, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। পড়তে পড়তে গা শিউরে ওঠে। এ-ও সম্ভব!! তবে রোজকার খবরের কাগজে যা দেখি, তারই রেপ্লিকা। তবে চোখের সামনে ছবির মত মেলে ধরলে ক্যান যে এখনো বেকুব বনে যাই!
'আত্মজা' গল্পটি আমার এযাবৎ পড়া ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম সেরাগুলির একটি। কোথাকার জল যে কোথায় গড়িয়ে গেল! ভাবলে সব তালগোল পাকিয়ে যাবে। গল্প বলার ধরণ যে এমনও হতে পারে, শেষ অবধি না গেলে তা বোঝার জো নেই বাপু! এক অদ্ভুত অন্যরকম দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা হয়েছে মেয়েদের জীবনের অসহায়তা। স্পয়লার দেব না বলেই আর বলতে পারছিনা। তবে এটুকু বলতে পারি যে লেখকের নিজেকে এবং বইটিকে সার্থকনামা করতে এই একটি গল্পই যথেষ্ট। আহা রে! ভাবলেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আরেকটা হাড় হিম করা ভালো গল্প হচ্ছে 'দেবদাসী'। এই কী আদি অকৃত্রিম ভারতের চিত্র! আচ্ছে দিন, বেটি বাঁচাও কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আমাদের সমাজে চলা কুপ্রথার কথা বলেই কিন্তু লেখক ক্ষান্ত হননি। চলেছে এসব সমস্যার শেকড় সন্ধান। সঙ্গে একই মুদ্রার ও পিঠের চাকচিক্যময় হাতছানির বর্ণনাও রয়েছে শৈল্পিক মুনশিয়ানায়। এই গল্পটিও কিন্তু সেই এযাবৎ পড়া ভালো ছোটগল্পের দলেই পড়ে। "অসুখ করলে ঝাড়ফুঁক ছাড়া গতি নেই। হাসপাতালে মরে গেলে আপার কাস্ট ড্রাইভার হলে এ্যাম্বুলেন্সেও তুলবে না। সাইকেলে বেঁধে বা ঘাড়ে করে মরা নিয়ে যেতে হবে। 'হে দেবী ইয়ালাম্মা, আমার হুদুগা, হুদুগি, মানে ছেলে অথবা মেয়েকে ভালো করে দাও। ওরা তোমার সেবা করবে সারাজীবন।' মেয়েটার বয়স হয়তো তখন পাঁচ। না জেনেই সে হয়ে গেল যোগাম্মা বা দেবদাসী।" আরো এক জায়গায় বলা হচ্ছে- "যে কঠিন জীবন এরা কাটায় সেখানে দৈব মহিমায় বিশ্বাসী না হয়ে কোনো উপায় নেই। ব্যাঙ্গালোরের আই টি হাব কিংবা কলকাতার শপিং মল আমার দেশ নয়। এখানে যা দেখছ, ভালোমন্দ মিলিয়ে সেটাই ভারতবর্ষ। তোমার আমার দেশ।" কী অকপট স্বীকারোক্তি!
প্রতিটি গল্পে বিভিন্ন শ্রেণীর, নানান বয়সের, হরেক কাজের সঙ্গে জড়িত মেয়েদের জীবনের ওঠাপড়া, সমস্যা, অত্যাচারের কাহিনী আঁকা হয়েছে নিপুণ কলমের টানে। গল্প 'তেভাগু'। এতে 'পেশা ফুরনো এক বুড়ি বেবুশ্যে' যেমন আছে; তেমনি রয়েছে 'গ্রামের চৌহদ্দি না পেরোনো তেভাগু'। যাকে 'ছ্যাতলা পড়া দাঁত বার করে' গোপাল বলে, 'ট্রাক বালু খুদতে আসে। আমি যেমন তোরে খুদি।' বইটির এই কোণে ওইপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গ্রাম ভারতের আজন্ম লালিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অঙ্গুলি নির্দেশ। 'নিমগাছ খুব পবিত্র গাছ। ধর্মের গাছ। ওষুধের গাছ। মা বলত। বহু যুগের পর কোনো নিমগাছের বাকলে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ফুটে বেরোয়। তখন আর সে গাছ থাকেনা। দারুব্রহ্ম হয়ে যায়।' এই নিমগাছ তলায়। তাই তো তেভাগু।
বলছিলাম না! সমাজের কোনো স্তরের মেয়েদের দুঃখের কথা বাদ যায়নি তাঁর কলম থেকে। এর আরো একটি প্রমাণ হল 'পাগলি'। "উথলপাথল ঝড়ের মধ্যে লাল সবুজ চুড়ি পরা পাগল মেয়ে কালো ঢেউখেলানো মেঘের পাহাড় মাথার পেছনে নিয়ে ধূলো, কুটো, পাতা আর ছেঁড়া কাগজের ঘূর্ণির ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে।" এ-তো শুধু বর্ণনা নয়। পাগলীর জীবনের এক প্রতিচ্ছবি যেন ফুটে উঠেছে এই সামগ্রিক পরিবেশে। একইসঙ্গে রয়েছে সুতপা। যার "এই ডাক্তারবাবু আই ভি এফ স্পেশালিস্ট। আবার ডেট পেতে পেতে কম করেও তিন-চার মাস।" সে-ও তো "সব দুঃখ একাকীত্ব ভুলবে বলে কোমর অবধি ঝুঁকে পড়ে রেলিঙের ওপর। আর হাওয়া এসে বিলি কাটে কপালের ওপর তার ঘর্মাক্ত খুচরো চুলে।"
নিজের আদরের মেয়েটিকে সাঁতার বা জিমন্যাস্টিক শেখাতে চান? বা অন্য কোনো খেলাধূলা? ভাববেন দু’বার। কারণ আমার আপনার সমাজের চোখের এখনো পূর্ণবয়স্কতা আসেনি। সে তো আর সমাজের দোষ নয় বলুন! আমি আপনি ওসব প্রথাবহির্ভূত কাজে মেয়েদের দেখতেই বা চাইবো ক্যান! আদেখলাপনা খানিকটা কম করলে ক্ষতি তো কিছু নেই! তবু! তাই অগত্যা!
'বডিগার্ড' গল্পটি একজোড়া পিচুটি হীন স্বচ্ছ চোখের পাহারাদারি। এর পাশাপাশি "এই যে যতক্ষণ এখানে থাকি, চোখ দিয়ে চেটে খান আপনারা। আমার তখন একজোড়া চোখের দরকার হয় যে এই চ্যাটচ্যাটে পিচুটির মত চাউনিগুলোকে গল্প বলিয়ে ভুলিয়ে দেবে। বডি এণ্ড মাইণ্ড গার্ড।"
বর্তমান সময়ের আরো নানান টাটকা জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে রয়েছে আরো কয়েকটি গল্প। বিয়ে ভেঙে যাওয়া, এর দায় কি আদৌ কারো হয়! এ তো এক ইক্যুয়েশন। বা পারমুটেশন কম্বিনেশনের খেলা। 'মনের বাঘ'। এরকমই একটি দারুণ গল্প।
'জন্মান্তর' গল্পের স্বর্গীয় ভালবাসার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। পড়ে অনুভব করতে হবে। চুপ করে বসে ভাববেন, এ-ও হয়!! যার শেষ লাইনটি দেখুন। 'ছ--মাস লড়াই করবার জন্য অনেক সময়।' এই একটিমাত্র লাইনেই সব বলে দিয়েছে যেন!
'বিবাহ' গল্পটিও আদিবাসী বিয়ের রীতি পরম্পরায় মেয়েদের কথা। তাদের জীবনগাথার হাত ধরে এক নিম্নবুদ্ধির সহজ সরল ছেলের প্রেম রতন ধন খুঁজে ফেরা।
পাঞ্জাবের এক মহিলা বিহীন গাঁয়ে বিয়ে হয়ে আসে মালদা'র অনু ওরফে এখনের আন্নু। গল্পের নাম 'জল'। যেখানে শ্বশুর-বর-ভাসুর-দেওর সবার একই দ্রৌপদী!! চমকে যাবেন না। যে দেশে এখনো আইনের চোখ বাঁচিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যা করে পুরুষত্বের বিজয়গাথা লেখা হয় ধ্বজা উড্ডীন করে, সেদেশে বাপকে তার প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে বলতেই হবে, " ওয়ে পুত্তর, ভুলে গেছিস নাকি, খরিদ করবার টাকা দিয়েছিলাম আমি। শর্ত তো এ-ই ছিল, না?"
বইটির শেষ গল্প 'মরণ'। এখানে এই সময় সেইসময় সব মিলেমিশে একাকার। কী মশাই একবিংশ আর হেনা-হিংস! সবই স্বপ্নধ্বংস! "রক্তশূন্যতায় ভুগছিল মা। ভাইয়ের জন্মের পর। কিন্তু ভালোবাসার জন্য রক্তশূন্য হয়ে গেছিল বলে মায়ের জন্য আমার বহুত খারাপ লাগে এখনও।" আরেক জায়গায় লেখক বলেছেন, "কন্যা, প্রেমিকা, বউ, মা সবগুলো ভূমিকায় ভালো করা যে কী চাপ! অনেক মেয়ে আজকাল মা হবে না ঠিক করে ফেলে তার পেছনে এই চাপের অবদান অনেক।" প্রতিভা যেন সমস্ত মায়েদের হয়ে রক্তাক্ত কলমে মিনমিনে গলায় বলেন, "সন্তানের করতলে অবহেলার রক্তচিহ্ন সহ্য করা কি সহজ কথা!"
যারা মেয়েদের কথা বলেন, যারা পেছনে ফিরে তাকাতে জানেন, যারা পিছিয়ে পড়া আত্মজনের সুহৃদ, যারা সকল দেশের সেরা এই জন্মভূমিকে নিয়ে গর্ব করেন, সবাইকেই বলছি। একটুখানি সময় বার করে মাত্র ১০৫ পাতার এই বইটি পড়ে নিন। না পড়লে কি মিস করবেন তা পড়ার পর না হয় দুলাইনে আমাকে জানাবেন!
গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনার এই বইটির দাম মাত্র ৯০ টাকা। তাই বইপোকাদের বলছি, উঠতি গল্পকারদের বলছি, শিগগিরই বইটি অর্ডার করে এনে পড়ে নিন। ফিডব্যাক অবশ্যই জানাবেন।
ফরিশতা ও মেয়েরা
প্রতিভা সরকার
গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা
দাম- ৯০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান :
বইটি অনলাইন কেনা যেতে পারে কলেজস্ট্রীট ডট নেট-এ।
বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।