হিন্দি মে কিঁউ গুজরাতি মে বোলো।
আমি তো গুজরাতি জানি না। সদ্য গুজরাট এসেছি। ভাঙা হিন্দিতে জবাব দিই আমি।
কমসে কম চুনাও কে গুজরাতিতে কী বলে সেটা বাতাও।
হাফ হাতা ফতুয়া। লম্বা জুলফি। চোয়াড়ে শ্যামলা লম্বাটে মুখ। হিন্দি সিনেমায় মাঝে মাঝে দেখা যায় এই মুখ। একটু ভয় জাগানো।
আমি বের হয়ে আসি। আগের দিন বহুবার ফোন করে এসেছি বিজেপির রাজ্য অফিসে। কেউ ধরে নি।
বের হয়ে সামনের দোকানগুলোতে যাই। টুপি পরা বোহরা মুসলিম। নাম বলে পরিচয় দিই, নির্বাচনী সমীক্ষা করতে চাই, কলকাতার, আজকাল পত্রিকার জন্য।
আমার নাম জেনে বলেন, নিজের নাম বলবেন না, বলবেন, ইমানুয়েল। গতকাল বিজেপির অফিস ভাঙচুর করে অফিসের দখল নিয়েছে। তাই ফোন খারাপ। ওর নাম নরেন্দরভাই। আদবানি সাহেবের খাস লোক।
আবার যাই বিজেপির দপ্তরে। বলি 'চুনাও'কে বলে গুজরাতিতে 'চুখা'। জানতে চাই, কী হবে বিধানসভা নির্বাচনে।
জিতেগা ভাই জিতেগা।
আর কোনো কথা বলেন না।
কেন জিতবেন?
বিজেপি ত্যাগী শঙ্কর সিং বাঘেলা তখন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিজের বাসভবনে ডেকে খাতির করে কথা বলেছেন। সারা ভারতেই তখন কলকাতার সাংবাদিকদের আলাদা সম্মান। কিন্তু নরেন্দরভাই আলাদা লোক।
গুজরাট আসার আগে মকসো করে এসেছি, কোন দলের কোন নেতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেখানে কেশুভাই প্যাটেল আছেন, আছেন কেশুভাই রানা, প্রবীণ তোগাড়িয়া। আর কারো নাম তেমন নেই।
আমি বিজেপির দপ্তর থেকে বেরিয়ে এসে লিখি, নরেন্দরভাই।
এরপর সুরাট যাওয়া। ট্রেনে উঠি দেখি ফাঁকা জায়গা। ব্যাগ রাখা। কয়েকজন তাস খেলছেন। একটু জায়গা দিতে বলি। হিন্দি নয় ইংরেজিতে।
একজন বলেন, আংরেজি কিঁউ গুজরাতি মে বোলো।
বাকিরা হাততালি দিয়ে ওঠেন।
আমি সরে গিয়ে তিন ঘন্টা রাস্তা দাঁড়িয়ে আসি। কাগজের স্টলে যাই অভ্যাস বশে। দেখি আনন্দবাজার। দুদিনের পুরানো। সেখানে বড় খবর, এসইউসির ডাকে প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজির দাবিতে বন্ধ সম্পূর্ণ সফল।
বামফ্রন্টের রাজত্বে ১৯৯৮ এ এসইউসির এই বন্ধে বিচলিত বামফ্রন্ট সরকার ইংরেজি ফেরানোর চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে বলে খবর।
কলকাতা ফিরেই বাংলা ভাষায় শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ভাষা ও চেতনা সমিতি গড়ে তুলি ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮।
গুজরাট মহারাষ্ট্র যেখানেই গেছি দেখি গুজরাতি বা মারাঠিতে সব নামফলক। গুজরাটে বাসের নম্বর পর্যন্ত গুজরাতিতে। দুটোই দেশের তখন শিল্পোন্নত রাজ্য। আর পশ্চিমবঙ্গ চাইছে ইংরেজি।
বাংলায় নামফলক লেখার দাবিতে লড়ি। কলকাতা বইমেলায় ১৯৯৯ এ গিল্ড অফিস অবরোধ করি। বইমেলায় স্টলের নাম বাংলায় লেখা আবশ্যিক হয়। ২০০৪ -এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক করে ঠিক হলো, কলকাতায় আসামের ভাষা শহিদ দিবসে ১৯ মে বাংলায় নামফলক লেখার দাবিতে আন্দোলন ও অভিযান হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো খুব কড়া বক্তৃতা করলেন লেনিন মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে। এবার শুরু হল দোকান দোকান যাওয়া। সেই অভিযানে সামিল কিংবদন্তী শৈলেন মান্না, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এসেছিলেন আসিয়ান জয়ী কোচ সুভাষ ভৌমিক। তাঁর দলের ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে। এবং তিনি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,পিকে, শৈলেন মান্না সবার সামনে। প্রথমেই পড়ল কেসি দাস। লিখবে না।
কেন লিখবেন না?
গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা সুভাষ ভৌমিকের। সঙ্গত করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
লিখবো না। ইচ্ছে।
আচ্ছা, এই লিখে দাও তো বাংলায়।
আমি তো তুলি আর সাদা তেল রঙ নিয়ে হাজির।
লিখে দিলাম বাংলায় কেসি দাস।
কেসি দাস দেখবেন তারপর থেকে সব ভাষায় কেসি দাস লিখেছে।
এরপর একটার পর একটা দোকান। অবাঙালি দোকানদাররা রাজি হয়ে যান। বাঙালিরা তর্ক করেন। যাঁরা অরাজি তাঁদের দোকানে বাংলায় লিখে দিই।
সুভাষ ভৌমিক ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তর্কের জবাব দেন।
দাবি জানান।
নবজাগরণ, ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি এবং ভাষা ও চেতনা সমিতির যৌথ উদ্যোগে এই অভিযানে বাংলার বহু লেখক শিল্পী যোগ দেন। সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত পাণ্ডে, জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আজিজুল হক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, তপন মিত্র, সমর নাগ, রঞ্জন সেনগুপ্ত, শৈবাল মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, জিয়াদ আলি, দিলীপ চক্রবর্তী। ছিলেন সজল রায়চৌধুরী, রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপ্না দে, চিত্রা লাহিড়ী, মধুছন্দা তরফদার, স্বপন সোম, রত্না মিত্র, দেবাশিস দত্ত, বাহাউদ্দিন, আবদুল মালেক, দেবাশিস ও তপন দাস, আলতাফ আহমেদ, অধীর রায়, ব্রততী মজুমদার,
সুদূর আসাম থেকে চলে আসেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংগঠক নীতীশ ভট্টাচার্য এবং বিহার থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মানুষ পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়।
আমরা বহু দোকান গেলাম। সবাই রাজি।
ঝামেলা বাধে রিবকের দোকানে। দোকানদার আমাদের সংগঠনের কর্মী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিল ছাত্র শান্তনু বেজকে ধাক্কা মারেন। এতে প্রয়াত শিল্পী পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় সপাটে এক চড় মারেন মালিককে। কাচের দরজা ভেঙে চুরমার ধাক্কাধাক্কির ফলে।
পরদিন একটি কাগজ খবর করে, 'বাংলাবাজ দুর্বৃত্ত' বলে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বিধায় পড়ে যান।
একটু বিব্রত। কিন্তু পরেরবার আসেন। নিজে পোস্টার মারেন। দীর্ঘদিন পর রঙ তুলি হাতে নেন লেখক সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত।
কথা ছিল, ঠিক এক মাস পর আসবো দেখতে।
বাংলার বৃহৎ সংবাদপত্র নিন্দা করেছে। আমাদের ভয় ছিল সুভাষ ভৌমিক আবার আসবেন কি না?
সুভাষ ভৌমিক যথারীতি এলেন। যাঁরা লিখেছেন তাঁদের ধন্যবাদ দিলেন। বাকিদের সাতদিন সময় দেওয়া হলো।
এরপরের অভিযান গড়িয়াহাট মোড়। সেখানেও সুভাষ ভৌমিক সব হাজির। সঙ্গে শ্রী লেদার্সের মালিক সত্যব্রত দে সহ বহু লেখক শিল্পী।
এরপরের অভিযান রবীন্দ্র সদন, পার্ক স্ট্রিট এলাকা। পরের বছর ১৯ মে বেলেঘাটা এলাকায়। সেখানেও ছিলেন।
আসেন ২০০৫-এর পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আকাদেমির সামনে। শৈলেন মান্না পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
কেন আসেন?
সুভাষদার জবাব ছিল, বাংলা ভাষা না বাঁচলে বাঙালি বাঁচবে না। বাঙালিত্ব মরে গেলে ময়দানের ফুটবলও মরে যাবে।
কথাটা খাঁটি সত্য।
বাংলা বাঙালি বাঙালির সংস্কৃতি শিক্ষা খাবার ফুটবল জীবনচর্যা একসূত্রে গাঁথা।
একটা বাদ দিয়ে আরেকটা হয় না। আমাদের আন্দোলনের ফলে কলকাতা পুরসভা তৎকালীন মহানাগরিক বিকাশ ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেয়, কলকাতায় সমস্ত দোকান ও প্রতিষ্ঠানকে বাংলায় নামফলক লিখতে হবে।
লড়াকু ফুটবল খেলোয়াড় কোচ প্রশিক্ষক
সুভাষ ভৌমিক প্রণাম শ্রদ্ধা।
সৌজন্যে অশোক দাশগুপ্ত, সম্পাদক, আজকাল