এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • পুরানো কথা পর্ব ৩৫

    Jaydip Jana লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৯ জুলাই ২০২১ | ২৩৬৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • পুরোনো স্মৃতির অলিগলিতে বিচরণ করতে করতে আজ মনে হয় আমার জীবনের রংবদল হওয়ার সাথে সাথে চারপাশে পালাবদলের শুরু হয়ে ছিল। ওই দিনগুলো বেশ অন্যরকম। ওই সময় আমাদের প্রজেক্ট-এর নেটওয়ার্ক-সংগঠনের খোলনলচে একটু পাল্টালো। এই সময় ওই প্রজেক্টের ডিরেক্টর হলেন বিপ্রদাস। ডিরেক্টর হয়েই সাতটা সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে তৈরী এই সংগঠনের "নেটওয়ার্ক" ভাবনাকে রূপদান করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন বিপ্র। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তখন অনেকগুলো কমিউনিটি বেসডগ্রুপ তৈরী হচ্ছিল। শুরুর দিকেও অনেক গুলো সংগঠন ছিল যেগুলো এই তথাকথিত নেটওয়ার্কের রেজিষ্ট্রেশন এর সময় নেটওয়ার্কের আওতায় ছিল না বিভিন্ন কারণে। ওদিকে ততদিনে SAATHII-র সহায়তায় "কোয়ালিশন অফ রাইট বেসড গ্রুপ" বা CRBG-র প্রচেষ্টায় কমিউনিটি বেসড গ্রুপ গুলো তৈরী ও তাদের বেসিক ক্যাপাসিটি তৈরীর কাজও শুরু হওয়ায় বিভিন্ন জেলাভিত্তিক কমিউনিটি বেসড গ্রুপগুলোর শক্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই সমস্ত সংগঠনকে নেটওয়ার্কের মধ্যে  আনার ব্যবস্থা শুরু হয় বিপ্রদাসের উদ্যোগে।


    ক্যুইয়ার কমিউনিটির মানুষজনের মধ্যে তৎকালীন সময়ে তথাকথিত উচ্চশিক্ষার ঘাটতি ছিলই। কেননা বেশির ভাগ মানুষই সামাজিক ভাবে ব্যুলিড হতে হতে স্কুল ছুট হয়ে পড়ে। আজকের শহর মফস্বলের পরিসংখ্যান দিয়ে এ পরিসংখ্যানকে মেলানো যাবে না। এই বিষয়টার জন্যই এইসময় আর্থিক সহায়তাকারী সংগঠনের উদ্যোগে আমাদের এই নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংএর উদ্দেশ্যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসাবে তথাকথিত অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু পদ তৈরী হয়। যদিও কমিউনিটি বেসড সংগঠন চাইলেই কমিউনিটি থেকে এই পদপূরণ করতে পারত। কিন্তু কমিউনিটিতে সেরকম যোগ্যতার মাপকাঠি সম্পন্ন মানুষজন না মেলায় তথাকথিত মূলস্রোতের মানুষজন এই পদগুলোতে এলেন।এতবছরের বঞ্চিত মানুষগুলো একটু একটু করে নিজেদের মত নিজেদের সংগঠনের স্বপ্ন দেখলেও শুরু হল আবেগ বনাম পেশাদারিত্বের সংঘাত। অফিস রাজনীতি কোন জায়গায় আর না থাকে।এখানেও কম বেশি শুরু হল। বিপ্রদাসের ডিরেক্টর হয়ে ওই নেটওয়ার্কের সংস্কার, শুরুর দিকে নেটওয়ার্কের সঙ্গে থাকা অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না। অনেক সংগঠনকেই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করায় আপত্তি ছিল শুরু থেকেই। নিজেদের মধ্যেকার পুরোনো দ্বন্দ্ব অনেকেই ভুলতে পারেননি। ফলে বিপ্রদাসের সঙ্গে নীতিগত পার্থক্য তৈরী হতে শুরু হল নেটওয়ার্কের অনেকের সাথেই। আর তাই অনেক ভাবেই অন্যরকম রাজনীতিতে তার কাছের মানুষগুলোকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়।


    আর তার প্রথম শিকার হল অর্চন। ন্যায় অন্যায় কথা মুখের ওপর বলতে ওর কখনোই আটকাতো না। মিথ্যা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এবং কোনও একজন তথাকথিত মহিলাকে সেক্সুয়াল অ্যবিউজের অভিযোগ আনা হল। অভিমানী অর্চন রাগে দুঃখে চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছিল। আসলে অল্প বয়সে আবেগটাই মনে হয় সবকিছু।


    এরপরের টার্গেট বড়দি, ত্রিদীপ। যে মানুষটা শুধু মাত্র নিজের লোকেদের সাথে নিজের লোকেদের জন্য কাজ করবে বলে, কর্পোরেট দুনিয়া ছেড়ে সোশাল ওয়ার্কের দুনিয়ায় এসেছিল তাকেও যৎপরোনাস্তি অপদস্হ হতে হয়েছে এ চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। সেই কোনকালে একটা ভাললাগা ভালবাসা, যখন এমন প্রজেক্ট বা কাজকর্ম হবে কিনা তার ঠিক ছিল না, সেখানে বিপ্রদাসের ডিরেক্টর হওয়াতো অনেকদূর, তবুও বড়দিকে বারবার অপমানিত  হতে হয়েছে প্রকল্পের কর্মী তো বটেই এমনকি নিজের সংগঠনের লোকেদের কাছেও। শুনতে হয়েছে বড়খুঁটিতে নৌকা বাঁধার অপবাদ। অভিমানী বড়দিও এই প্রজেক্টের চাকরিটা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো একসময়।


    এদিকে চূড়ান্ত নীতিবাগীশ বিপ্রদাস স্বজনপোষণ না করেও স্বজনপোষনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে রইলেন। যদিও ততদিনে মতপার্থক্য ও নীতিগত পার্থক্যের টানাপোড়েনে এই পদ থেকে বেড়িয়ে এসেছেন উনি। পারিবারিক কারণে ততদিনে চন্দননগরের বাসও উঠেছে তার, দূরের অন্য এক জেলায় পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে থিতু হতে হয়েছে তাকে।


    সব থেকে মজার ব্যাপার ঘটেছিলো আমার সাথে। অর্চন ততদিনে আবার নিজেকে অর্চনায় রূপান্তরিত হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। অনেক ওঠাপড়ার পরেও আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়নি। আর তাই মাঝে মাঝেই আমাদের ড্রপ ইন সেন্টারে ওর আনাগোনাও কমেনি। সেটা ক্রমশ চক্ষুশূল হয়ে উঠছিলো অনেকের কাছে। আর তাই আমার নিজের হাতে গড়া জায়গা ছেড়ে, আমার জেলার মানুষদের ছেড়ে আমায় যেতে হল অন্য ড্রপইন সেন্টারে, কাউন্সেলর হয়ে। যদিও আমার জন্য সেটা শাপে বর হল। বিতানের সঙ্গে দূরত্ব এবং বিতানের তৈরী করা বিভিন্ন  ভাবে কাজের সমস্যা ঝেলতে ঝেলতে আমিও অন্য জেলায় অন্য শহরে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আরও একটা মজা হল আমার এইচ আই ভি  নিয়ে সোচ্চার হয়ে এগিয়ে আসাটাকে পুরো প্রজেক্টের কাজে লাগানো হল। কেননা আমি তখন আর এই বিষয়টাকে নিয়ে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড়ের মধ্যে রাখতেই চাইনি। তাই মানুষের ভাল হবে এ ভাবনা থেকে এ নিয়ে কোনও অসম্মতি আমারও ছিলনা, কিন্তু  তখনও জানতাম না এরজন্য আমার ভবিষ্যৎ জীবনে আরও কতকিছু ঘটতে পারে। নতুন জায়গায় নতুন করে আমার মত মানুষের জন্য কাজ করাতেই বু্ঁদ হয়ে গেছিলাম সেদিন।


    কোলকাতা থেকে একটু দূরেএই নতুন জেলার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এখানে না এলে ক্যুইয়ার কমিউনিটির আর একটা অধ্যায়ের মুখোমুখি হতাম না আমি। আমার কাজের জায়গা শহর আর গ্রাম মিলিয়ে মিশিয়ে। ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে সাথে আর্থসামাজিক পরিকাঠামো ও পেশাগত দিকও এখানকার মানুষের আলাদা । সেই সঙ্গে ধর্মীয় ভাবনার প্রভাবে ভাবনাচিন্তার ফারাক। মুল কাজের জায়গা যদিও এইচ আই ভি  সম্পর্কিত তথ্যের প্রচার। কিন্তু কন্ডোমের ব্যবহার ও এইচ আই ভি-র রক্তপরীক্ষা করানোতে উতসাহ তৈরী করতে গেলে অনেকরকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রজেক্টের কাজ  অনুযায়ী কাউন্সেলর হিসাবে মানুষের এইচ আই ভি জনিত ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পরিবর্তন করা অত সহজ ছিল না। বুঝেছিলাম কাউন্সেলর হওয়ার অনেক দায়।


    কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম কুয়্যার-কমিউনিটির মানুষজনের এই ঝুঁকিপুর্ণ আচরণের মুল জায়গা আত্মপ্রত্যয়ের অভাব। তার অনেক কারণ, নিজেকে দিয়ে যেটুকু জানতাম তা যথেষ্ট ছিল না। আসলে যৌনস্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক স্বাস্থ্য অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। যে মানুষগুলো ছোট থেকে বড় হতে হতে পরিবার সমাজ সকলের কাছে অবাঞ্ছিত জানতে জানতে বড় হয়েছে তাদের হেলথ সিকিং বিহেভিয়ার তৈরী হওয়া অত সহজ না। তার ওপর সম্পর্কের টানাপোড়েন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব তখনও পর্যন্ত আইনি স্বীকৃতির অভাব এ সব গুলো ছিলই। আর একটা দিকের মুখোমুখি হলাম তা হল অর্থনৈতিক সমস্যা। আমার বড় হওয়া, পড়াশোনা, স্কুলিং, শহুরে প্রিভিলেজড জীবনের সঙ্গে এখানকার মানুষজনের বিস্তর ফারাক। এখানে এসে দেখলাম দিনের বেলা খেত খামারে কাজ করা তথাকথিত মেয়েলি পুরুষের অনেকেই বৌ বাচ্চা সংসার সামলাতে দুটো টাকার জন্য রাতের বেলা হিজড়া পেশার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ট্রেনে ট্রেনে ছল্লা মেঙ্গে (ভিক্ষা করা) বেড়ায়। রেলপুলিশের তাড়া খেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নামার ঝুঁকি নিতে হয়। আবার কখনও কখনও শারিরীক ভাবে খুশি করতে হয় রেল পুলিশকে। কখনও রাতের বেলা রেলস্টেশন সংলগ্ন গুডশেডের লরীর ড্রাইভার বা খালাসীর সাথে টাকার বিনিময়ে শারীরিক মেলামেশা তো আকছার ঘটে। এদের যৌনরোগ বা এইচ আই ভি  নিয়ে বোঝানো বা কন্ডোমের ব্যবহার নিয়ে বলতে গেলে প্রায়ই শুনতে হত, "কি লাভ এভাবে বেঁচে থেকে। এমনিই তো মরে আছি, এর চেয়ে এডস হলে তো তাড়াতাড়ি মরে যাব।" তারপরেও কেউ যদিও বা এইচ এই ভি পরীক্ষা করাতো, চিকিৎসার আওতায় আনা ছিল আরও কঠিন।


    এতদিন তো তথাকথিত সমকামী "পুরুষ" মানুষ খুঁজে বন্ধুত্ব করে তাদের এইচ আই ভি  সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই শুধু কথা বলতাম, কিন্তু এখানে এসে তাদের ব্যাক্তিগত কথা শুনতে শুনতে সুখদুঃখের দোসর হয়ে গেলাম পুরোপুরি। এক একজনের এক এক রকম জীবনের গল্প। বিভিন্ন বয়সের আলাদা আলাদা ওঠাপড়া।  সে গল্প এই লেখার প্রথম দিকে কিছুটা করেছি। আরও একটা বিষয় এখানে মুখোমুখি হলাম বেশির ভাগ মানুষই বিবাহিত, সংসারী ও মধ্যবয়স্ক। সমকামী হলেই ''মেয়েলি" হতে হবে, বা বিবাহিত হবে না, তেমন ভাবনা আমি অনেক আগেই কাটিয়ে উঠেছিলাম। তবে মাঝবয়সের টানাপোড়েন, পছন্দ মত যৌনসঙ্গীর অভাব কিংবা প্রত্যাখ্যান-এর টানাপোড়েন, সংসারী হওয়ার টানাপোড়েন, এই রোজকার জীবনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে মানুষগুলোর আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে তুলতে গিয়ে অদ্ভুত এক মায়ায় জড়িয়ে যেতে লাগলাম প্রতিনিয়ত। 


    প্রতিদিনের ওঠাবসায় বুঝতে পারলাম একজন মেয়েলি পুরুষ সমাজের সবজায়গায় ব্যুলি হতে হতে হিজড়া মানুষদের সাথে একাত্মবোধ করে সেই কমিউনিটিতে আশ্রয় নেন।কাউকে জোর করে হিজড়ারা সে পেশায় যেতে বাধ্য করেন না। ছোট থেকে শুনে আসা হিজড়া বাচ্চা হলে হিজড়াদের হাততালি শুনে চলে যাওয়া, বা হিজড়ারা তুলে নিয়ে যাওয়ার গল্পটা আসলে গল্পই। জননাঙ্গ ঠিক মত গঠিত না হওয়া যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হার্মোফ্রোডাইট বলে সে সংখ্যা লাখে এক। বাবা মার ইচ্ছা ও চিকিৎসকের চেষ্টায় অনেকসময় তাকে নারী বা পুরুষের প্রকট যৌনাঙ্গ প্রদান করা হলেও অনেক সময়ই সে মানুষটির ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়না। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তাই না ঘরকা  না ঘাটকা হয়ে মনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকেন অনেকেই। আসলে নারী বা পুরুষের মাঝে তৃতীয় সত্তাকে মেনে নিতে সমাজ পারেনা। আজকাল মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এর কল্যাণে একটা সুন্দর শব্দ তৈরী হয়েছে "তৃতীয় লিঙ্গ" বা থার্ড জেন্ডার। আজ যদিও আইন মোতাবেক নারীপুরুষের বাইরে অন্য বা আদারস শব্দটাও স্হান করে নিচ্ছে ক্রমশ সরকারি স্তরে। তবে সেটার সঙ্গে হিজড়া হওয়ার কোনও যোগ নেই। হিজড়া একটা নির্দিষ্ট পেশামাত্র। পুরুষের জন্মচিহ্ন নিয়ে জন্মে ভাললাগা থেকে সমকামী পুরুষ হিসাবে চলতে চলতে রুপান্তরকামীতার পথ পেরিয়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় হিজড়া পেশায় যোগ দেন। কাজের সুত্রে ও দৈনন্দিন ওঠাবসায় এও জানলাম কেউ কেউ বিবাহিত রূপান্তরকামী পুরুষও বটে। বাড়ীতে বউ-বাচ্চা নিয়ে অনেকেই দিনের একটা অংশে চাষাবাদ, খেত মজুরের কাজ করে অপর অংশে আরও একটু স্বচ্ছলতার জন্য অর্থোপার্জনের আশায়  সাজপোশাক বদলে ট্রেনে ট্রেনে পয়সার বিনিময়ে আশীর্বাদকরে বেড়ান। হিজড়া পেশাতেও বিভিন্ন  রকম মানুষ থাকেন। কখনও কখনও মহিলারাও থাকেন। বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ঘরানা বর্তমান। তারপরেও অনেকেই মানেননা ক্যাস্ট্রেশন বা ইম্যাসকুলিনেশনে কতটা পেশাগত চাপ থাকে। নিজের মানসিক চাপের পাশাপাশি পেশাগত চাপও তো একটা বিষয়। অশিক্ষার মধ্য দিয়ে পুরুষাঙ্গ বাদ বা লিঙ্গচ্ছেদন যে নারী হয়ে ওঠার রাস্তা নয় তা আর জানে বোঝে কজন। আর সেক্সুয়াল রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির খরচই বা আসে কোত্থেকে। তাই ইম্যাসকুলিনেসনই ভরসা। ওদিকে এলাকা দখলের লড়াইতে পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট হিজড়াদের নকল হিজড়া বলে দাবী করেন আর একদল ইম্যাসকুলিনেটেড মানুষ। যেহেতু জননাঙ্গ  না থাকার মিথ দিয়েই এই পেশার বাড়বাড়ন্ত সেখানে এটাকে ধরে রাখার অদম্য প্রয়াস চলতে থাকেই। ইম্যাসকুলিনেশনে কাঙ্খিত নারী হয়ে উঠতে না পারার পাশাপাশি সাধারণপৌরুষসর্বস্ব শারীরিকসুখের খামতিও মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। বিজ্ঞানসম্মত হরমোন থেরাপির পরিবর্তে গর্ভনিরোধক খেয়ে হরমোনালও শারীরিক পরিবর্তনে মেতে ওঠেন কেউ কেউ। শুরু হয় মানসিক অবসাদ। আর এখানেই ‘নগরকীর্তন’ সিনেমার গল্পের পুঁটি-র মত মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতে হতে কখনও কখনও আত্মহননের পথও বেছে নেন। হিজড়া ঘরানায় বাইরের আইনের প্রবেশ খুব কম। আগেই বলেছি এখানে একটা পাওয়ার-প্লে চলতে থাকেই। কথায় কথায় জরিমানা বা শাস্তি কিংবা বিচারের নামে সামন্ততান্ত্রিক প্রহসন চলে তার খবর বাইরে আসেনা। সমস্ত পেশাতেই রাজনীতি থাকে। এ পেশাও তার ব্যতিক্রম নয়।


    হিজড়া পেশার অনেক গুলো শ্রেনী বিভাগ আছে।কাজের সুবাদে আস্তে আস্তে পরিচিত হতে লাগলাম সে সবের সাথে। "বাধাই" বা বাচ্চা নাচানো যারা করেন বা বাড়ির শুভ অনুষ্ঠানে গিয়ে আশীর্বাদ যারা করেন তারা সবচেয়ে উচ্চ শ্রেনীর। তারপরের শ্রেনীতে পড়েন যারা বিহার উত্তরপ্রদেশের শুভ অনুষ্ঠান বা লগনে গিয়ে নাচ করেন। কৌলিন্যে এর থেকে নিচুতে যারা ট্রেন , দোকান বা রাস্তায় আশীর্বাদের বিনিময়ে রোজগার করেন বা মতান্তরে ভিক্ষা করেন বা ছল্লা মাঙ্গেন তারা। সবচেয়ে কৌলিন্য নেই মনে করা হয় সেক্স ওয়ার্ক বা "খাজরা।" ইম্যাসকুলেশন বা ছিবড়ে যাওয়া মানুষদের আবার জাতকুলমান বেশী তুলনায় বাকী যারা সেসব করেন না বা “আকুয়া” ( ইম্যাসকুলেশন করেনি যারা) তাদের কুলমান কম। এ এক আজব দুনিয়া। এখানে কারও কোনও নিয়ম চলেনা। গুরুমার তৈরী নিয়মই সব। পানথেকে চুন খসলে হয় জরিমানা বা "ডন"। প্রয়োজনে হিজরা গুরুরা কয়েকজন মিলে সালিশি সভা বা পঞ্চায়েত বসিয়ে বিচার করে করেন শাস্তিবিধান।


    আজ একবিংশ শতাব্দীতেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষই প্রথমশ্রেণীর নাগরিক। পৌরুষের অহংকারে ধাক্কা লাগে পুরুষের পৌরুষ অপেক্ষা নারীসুলভ আচরণে। তথাকথিত  মেয়েলি পুরুষদের ছেলেবেলা তাই কুসুমাস্তীর্ণ  হয়না আজও। পরিবার স্কুল পাড়া সমাজে, লেডিস, মওগা, ছক্কা, মেয়ে ন্যাকড়া বিভিন্ন বিশেষনে বিভুষিত হতে হতে মাত্রা ছাড়া ব্যুলিং এ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় যখন তখন সমাজছাড়া হওয়াটাই কপাল বলে মনে করে অনেকে। সবসময় সমাজের কাছে ব্যুলিড হতে হতে কেউ কেই বেছে নেয় আত্মহননের পথ। আর যারা বেঁচে থাকে তারা যখন দেখে সমাজে আরও একধরণের মানুষ আছে যারা তথাকথিত মেয়ে না হলেও হাবে ভাবে আচারে আচরণে মেয়ে, সমাজ অন্তত তাদের সমীহ করে ভয় পায়, ঘাঁটাতে সাহস করে না, তখন মনে মনে তাদের সাথেই মিশে সেই সমাজের অংশে মিশে যায় তারা। সেই অন্য সমাজের অনুশাসনের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব নিয়ে যত লড়াইই থাকনা কেন অর্থরোজগার তো করা যায়। নিজের মত ইচ্ছেমত সাজপোশাক তো করা যায়। এভাবেই রূপান্তরকামী পুরুষদের একটা অংশ হিজড়া পেশা গ্রহণ করে।


    গুরুশিষ্য পরম্পরায় এখানে অনেক রিচুয়াল আছে। মুলস্রোত-সমাজের অনুকরণও আছে।তবে তা অনেকবেশি সংস্কারাচ্ছন্ন। আর আছে জোরকরে সম্মান আদায়ের মধ্যে দিয়ে কথায় কথায় জরিমানা আর ক্ষমতার রাজনীতি। বাইরে থেকে যা আমরা জানি তার থেকেও অনেক বেশি গোঁড়ামি। প্রথম ধাপে লগনে গিয়ে লন্ডা নাচের চটুলতার সাথে যৌনতা ও যৌনঅত্যাচার থাকলেও ছল্লার পাশাপাশি যৌনপেশার প্রাধান্য থাকলেও বাধাইয়ের কৌলিন্যে  যৌনতা অস্বীকার করার প্রবণতা প্রবল। নইলে এই পেশাটার সমাজে কোনও প্রকার মান্যতা থাকেনা। 


    অথচ বাইরে থেকে এন জি ও মানসিকতায় থেকে ক্যুইয়ার কমিউনিটির শহুরে শিক্ষিত প্রিভিলেজড একটা অংশ বৃহত্তর সমাজের সাথে তালে তাল দিয়ে আজও মনে করে কতিদের মতান্তরে মেয়েলি পুরুষদের জোর করে হিজড়া পেশায় নামানো হয়। কিংবা পাচার চক্রের মধ্যে দিয়ে বিহার উত্তরপ্রদেশে লন্ডানাচ করতে পাঠানো হয় বা অন্যান্য মিথের মত জোর করে ইম্যাসকুলিনেশন করানো হয় আর সেগুলো আটকানো যায়। এ সমস্ত ভাবনার পেছেনে আসলে থাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ও অনুদান সংগ্রহের রাজনীতি।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৯ জুলাই ২০২১ | ২৩৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন