সে সব অনেক বছর আগের কথা। যে সংগঠনে আমার কাজের শুরু,একবার কোলকাতার উপকন্ঠে সেই সংগঠনের সকলকে নিয়ে এক আবাসিক কর্মশালার আয়োজন হয়েছিল। আমার মত অন্য যৌনতায় বিশ্বাসী এতগুলো মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো আমার সেই প্রথম। আমরা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাসকরা বিভিন্ন মানুষ। এই চারদিনব্যাপী কর্মশালার মাঝে এই যে মনের আদান প্রদান, গ্রাম, শহর, মফস্বল,আধা মফস্বল বিভিন্ন রকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত বিভিন্ন বয়সের মানুষ আমাদের এক এক জনের অভিজ্ঞতাও এক এক রকমের।
কেউ গাজনের গান গায়, কেউ শীতলা মনসার পালা গায়,কেউ ছবি আঁকে, কেউ নাচ, কেউ অভিনয়, কেউ হাতের কাজ, সেলাইফোঁড়াই, কেউ রান্না ভালবাসে। এত শুধু রামধনুর সাতরঙ নয়, সপ্তসুরের সমাহার
সবকিছু ছাপিয়ে একটাই যোগসূত্র সকলেই জন্মসূত্রে সমজন্মলিঙ্গগত পরিচয়ের মানুষের ওপরেই শারিরীক ও মানসিক আকর্ষন বোধ করি। আবার কেউ কেউ নিজের জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ে স্বস্তিবোধ করি না। সকলেই আসলে নিজের মত মানুষদের ভাল রাখতে চাই। নিজেকেও ভাল রাখার রাস্তা খুঁজে পেতে চাই ।
শুধু ড্রপ ইন সেন্টারের পরিসর না এই সমস্ত কর্মশালা ছিল আমাদের মত মানুষদের কাছে অক্সিজেন। সারাদিনের পড়াশোনার পর সন্ধ্যেবেলা হয় কালচারাল অনুষ্ঠান নয়তো ভালো কোনও মুভি দেখা যার মধ্যে দিয়ে কমিউনিটি মবিলাইজেশন কমিউনিটি মোটিভেশনের গল্প পাওয়া যায়। আর এই সময় টা খোলসের বাইরে বেরিয়ে এসে সাজগোজের সময়। যারা সারাবছর পুরুষ শরীরের খাঁচায় নারী মন নিয়ে ছটপট করেন তারা তথাকথিত মেয়েদের সাজপোশাকে নিজেদের মধ্যে কার নিজেকে একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করতেন তখন।
ওয়ার্কশপের প্রথম দিন সকালে জেন্ডার সেক্স সেক্সুয়ালিটি ও সাজগোজ নিয়ে আলোচনায় একটা বিতর্ক তৈরী হয়েছিল। আসলে অনেকেই তথাকথিত মেয়েলি সাজগোজের পক্ষে। অনেকেই মনে করত সেটা তার অধিকার। আমিও বিপক্ষে ছিলাম না । তবে আমি মনে করতাম অধিকার পেতে গেলে অনেক বেশি দায়িত্বও নিতে হয়। তবে আমার বেড়ে ওঠা দিয়ে আমি বিশ্বাস করতাম বিয়েবাড়ি বা পার্টি অনুষ্ঠানের সাজগোজ এর সঙ্গে শ্রাদ্ধ বাড়ীর সাজপোশাক কখনই এক হতে পারেনা। আমার আজও মনে হয় সাজটা নিজের জন্য অন্যকে প্রভাবিত করার জন্য না। সেটাতে সেদিন অনেকেই একমত হতে পারেনি। অতবছর আগেও বিশ্বাস করতাম নারীত্ব একটা অনুভুতি। আজও সেটাই বিশ্বাস করি। সেদিনও ভাবতাম যদি তথাকথিত মেয়ে হতেই হয় তো কোন মেয়েটা আমি হব। শরৎচন্দ্রের নায়িকা হয়ে চোখের জলে অদৃষ্টকে মেনে নেব নাকি আজকের যুগের আধুনিক নারী হয়ে বিমান চালিকা হব। আসলে সকলের ভাবনা এক না। চিরাচরিত স্বামী শাঁখা সিঁদুরের সংসারে ভারতীয় সতী নারীর আদর্শ তো আজও অনেক বেশি জ্বাজ্জল্যমান। আর তাই পুরুষ শরীরে মেয়েদেরকে নিজেদের আরও বেশি বেশি মেয়ে প্রমান করতে হয় সমাজের কাছে। যে কতির এমনি সময়ে কোমড় বাঁকেনা তারও মোড়ের মাথায় চাটটে ছেলে দেখলে নিজের অজান্তেই কোমর বেঁকে যায়। আমার এসব ভাবনা রূপান্তরকামী বন্ধুরা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি সেদিন। সবচেয়ে মজার কথা রূপান্তরকামী শব্দটাও কিন্তু অনেকের অভিধানে ছিল না সেদিন।
দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যের পর কয়েকজন বন্ধু গাজনের গান শোনাবে বলে সাজগোজ শুরু করে, শাড়ী গয়না পরচুল মিলিয়ে সুন্দর সাজ । তারপর প্রায় আস্তে আস্তে প্রতিটা ঘর হয়ে গিয়েছিল গ্রীনরুম। ক্রমশঃ বেশিরভাগ মানুষের ভেতরের মেয়ে হয়ে ওঠার বাসনা সাজপোষাকে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল সে পরিসরে। সবদেখে শুনে সত্যিই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি সেদিন। সবশেষে আমার ব্যাগ থেকে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এসেছিল মায়ের নীল কালো গাদোয়াল, সঙ্গে ম্যচিং নীল মিনাকরা কুন্দনের হার দুল। মেকআপ বক্স।পাশের ঘরের অভীক দিয়েছিল কাল হাইনেক হাতা কাটা ব্লাউস। দাড়ি আর শাড়ির সংঘাত না মানলেও সাজতে সাজতে মেরুন লিপস্টিক ঠোঁটে দেওয়ার পর জীবনে প্রথমবার গোঁফ গিয়েছিল চুরি।আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারিনি। অনেকের কাছেই সকালের আমি হয়ে গেছিলাম অচেনা।
রাতের বেলা মেকাপ তোলার সময়ে কেউ কেউ সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছিল কেউ কেউ। আর তাতেই আবেগ প্রবণ হয়ে গিয়েছিল অনেকে। সিঁদুরের স্বীকৃতি জীবনে জুটবে না এ সত্যটা অনুধাবন করে কেঁদে ফেলেছিল কেউ বা। মনে হয়েছিল সিঁদুর তো অনেক দূর সম্পর্কের স্বীকৃতি কজন পায়।
আসলে সামাজিক ফ্রেম অফ রেফারেন্সটা এত বেশি করে মাথায় গেঁথে বসে যায় যে সমলিঙ্গের সম্পর্কেও সেই নারী-পুরুষের তথাকথিত সম্পর্ক,বিয়ে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেই সম্পর্কের স্বীকৃতি বলে মনে হয়। নিজেদের অজান্তেই আমাদের সঙ্গীরা মনের ভেতর সঙ্গী/ বন্ধু / পার্টনার না হয়ে শুধুই বর-বৌ/ স্বামী স্ত্রীর খাঁচায় ঘুরতে থাকে। অভিধানটাও এত সেকেলে যে সেখানেও অন্য শব্দের কোনও অপশান নেই। তথাকথিত সিসজেন্ডার হয়েও কেউ কেউ মনে মনে শাঁখা-সিঁদুরের ফ্যান্টাসির লালনও করতে থাকি। আর তাই তো দশমীর সিঁদুর খেলায় অংশ নেওয়া বা দোলের লাল আবিরের আধিপত্য ও আমাদের জীবনে কয়েকগুন বেশি।
আসলে মনে মনে তো সমাজ নিয়মে সিঁদুরের স্বীকৃতিটাই লালিত হয়। আর হাইলি পলিগ্যামাস সম্পর্কের মাঝখানেও প্রেমিকপুরুষের হাতের সিঁদুর,সম্পর্কের অধিকার নিয়ে কখনও কখনও আরও বেশি নেশা ধরাতে সক্ষম।
সে রাতে সকলেই বুঝেছিল একচুটকি সিঁদুরের কিমত কতটা। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিল কান্নার রোল। সকলের জীবনেই কোনও কোনও সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার চাপা স্মৃতি বেড়িয়ে এসেছিল কান্না হয়ে।
সারারাত মানুষগুলোকে সামলে ছিল যে দুজন মানুষ তাদের অবদান ভোলার নয়। দুই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়িকা, দুই কাউন্সেলর।
একজন বহুবছর এই প্রজেক্টে আমাদের সঙ্গে কাজ করলেও অন্যজনকে আমরা বেশিদিন পাইনি। অনেক পরে শুনেছিলাম সংগঠনের আর্থিক সহায়তা অনুমোদনের জন্য কোনও এক পদস্থ আমলার অঙকশায়িনী হওয়ার প্রস্তাব না মেনে নিতে পেরে চলে যেতে হয়েছিল নাকি তাকে। প্রান্তিক মানুষদের পাশে থাকতে এগিয়ে আসা একজন মুলস্রোতের মানুষকে হয়তো সংকীর্ণ প্রান্তিকতার দায়ে হারিয়ে ছিলাম আমরা। যদিও কোনও প্রামান্য নথি এব্যাপারে নেই তাও "যা রটে তার কিছুটাও বটে"।