সন্দেহ মানুষকে পাগল করে। শুধুমাত্র অকারণ সন্দেহ কত সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। রণ-র দাদাভাই আর বৌদিভাই এর সম্পর্ক বিয়ের পর আপাত দৃষ্টিতে ভাল ছিল। দাদা ভাই চাকরি সুত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকত। আর বৌদিভাই ও কোলকাতার কলেজে লেকচারার পদে কাজ শুরু করে বিয়ের পরে পরেই। রণ-দের এলাকায় আমি সন্ধ্যে বেলায় পড়তে যেতাম। রাত হয়ে গেলে বা বৃষ্টি বাদলায়, কখনও বা ছুটির দিনেও মাঝে মাঝে রণর সাথে থাকি। আমার তখনকার কলেজটাও ছিল ওদের বাড়ির কাছেই। আমার থাকাটা ওদের বাড়িতে খুব স্বাভাবিক ছিল। আমাদের বাড়িতে সকলেই জানত রণ-র নাচ টা আমার ভালবাসা। তাই কখনও অসুবিধে হয়নি। সকলের সঙ্গে হইচই করে ভালই কাটছিল। আমরা তিনজনে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডাও দিতাম কখনও কখনও। বৌদিভাই মাঝে মাঝে বাপেরবাড়ি আর মাঝে মাঝে এবাড়ি মিলিয়ে থাকত রণর মায়ের পরামর্শে। একবার ছুটিতে দাদাভাই বৌদিভাইদের বাড়ি থেকে ফিরে বলা কওয়া শুরু করল বৌদিভাইদের পাশের ফ্ল্যাটের ওর দাদার বন্ধুর সাথে নাকি বৌদিভাই-এর সম্পর্ক আছে। একথা শুনে বৌদিভাই খুব অবাক হয়েছিল। রণর মা বিষয়টাকে পাত্তাই দেন নি। রণ রাতের বেলা আমাকে বলতে এলে আমিও পাত্তা দিইনি। তখনও জানিনা কর্মস্হলে ফিরে গিয়ে দাদাভাই আরও বড় বোম ফাটাবে। ওখানে গিয়ে দাদাভাই জানাল বৌদিভাইয়ের মত মানুষের সাথে দাদাভাই থাকতে চায়না। এমনকি রণ আর বৌদিকে নিয়ে কুতসা করতেও ছাড়েনি। অনেক পরে জেনেছিলাম কুতসার উৎস এপাড়ায় থাকা দাদাভাইয়ের বন্ধুরা। ততদিনে যদিও ওদের মধ্যেকার বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে গেছে। রণর মায়ের বৌদিভাইকে সমর্থন টা রণ-র দাদাভাই আর ওর কাকাপিসিরা কিছুতেই মেনে নেয়নি। ওদের সকলের মনে হয়েছিল রণ’র মায়ের শাশুড়ি হিসাবে বৌমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। রণ’র দাদা তার পর চাকরি ও ঠিকানা বদলে ফেলে স্বেচ্ছানিরুদ্দেশে চলে যায়। শুধু জেঠিমার অসুস্থতার কারণে বৌদিও সেই মুহুর্তে সম্পর্কটা থেকে বেড়িয়ে যায়নি। আর তাছাড়া তখন হয়তো আশা করছিল যদি দাদাভাই ফেরত আসে।
এ ক'বছরে আমার আর রণ’র সম্পর্কটা অনেকটাই থিতু। আস্তে আস্তে রণ’র বাড়ির সব কিছুতেই আমি একজন হয়ে গেছি। মনে পড়ে,যেদিন পারিবারিক মিটিং এর পর বৌদিভাই এবাড়ী থেকে চলে যাবে ভেবে তৈরী ছিল সেদিন সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। রণ’র মা আর রণ যে মুহুর্তে ঘরের বাইরে যায়, রণ’র কাকিমা বৌদিকে নিয়ে যা নয় তাই বলতে থাকে তখনও কোনও কথা বলিনি। কিন্তু রণ আর বৌদিকে নিয়ে যখন কথা বলে তখন আমি প্রতিবাদ করি, বলে উঠি, "কেউ জানুক আর না জানুক আমি জানি এটা মিথ্যে "। রণ’র কাকিমা কে সমর্থন করে তার কথায় যোগ না দেওয়ায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। সেদিন তিনি তারপর বাড়ি চলে যান। কয়েকদিন বাদে রণ’র কাকু হঠাৎই রণর বাড়িতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে সেদিনের প্রসঙ্গ তুলে আমাকে বলেন, "তুমি তো বাইরের লোক, তুমি কেন এসব ব্যাপারে কথা বলে কাকিমাকে অপমান করেছো,এটা তোমার ঠিক হয়নি"! আমার হয়ে রণ উত্তর দেয়," বাইরের লোকের সামনে বাড়ির বৌকে নিয়ে আলোচনাটা কে শুরু করেছিল।" রণর মাও জানাতে ভোলেন না, তাঁর বাড়ির সব দায়ে বিপদে আমার থাকার কথা। এবং উনি এও জানান আমাকে উনি নিজের ছেলের মতই দেখেন। সুতরাং তাঁর বাড়ির ব্যাপার তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন কে কি করবে।
উনি তাতে প্রবল অপমানিত বোধ করে বেড়িয়ে যান।
যদিও এ ঘটনাটা আমার মনে গেঁথে গেছে সেদিনের পর থেকে। আজ আমি নিজের বাউন্ডারি আর এক্তিয়ার নিয়ে অনেক বেশি সচেতন।
দাদাভাই বৌদিভাইএর টানাপোড়েন টা আমাকেও মাঝে মাঝে ভাবাত। আমি জানতাম আমাদের এই সম্পর্কটাও সমাজের চোখে কোনওদিন স্বীকৃতি পাবে না। যেখানে দাদা ভাই আর বৌদির আইনি, ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এক লহমায় 'না' হয়ে যেতে পারে সেখানে আমার আর রণ’র ভালবাসা আমাদের, একান্তই নিজেদের। টুবাই, ওর দিদি, বৌদিভাই, রণ-র তুতো -বোনেরা বিষয়টা নিয়ে সকলের আড়ালে অল্প অল্প মজা করলে, আজকাল রণও সে মজাতে যোগ দেয়। একটা অলিখিত স্বীকৃতি, প্রচ্ছন্ন ভালবাসা, সব সময়ই আমাদের দুজনকে ঘিরে থাকে। ওটুকুই আমার পাওয়া।
রণ তো শুধু আমার ভালবাসা না, রণ’র নাচও তো আসলে আমার ভালবাসা। রণ’র রেওয়াজ, রণ’র অনুষ্ঠান, রণ’র নাচের পোশাকের যত্ন সবই আসলে বড় বেশি আমার। আস্তে আস্তে রণ’র সাথে রণ’র প্রতিটা অনুষ্ঠানে আমি নিজের অজান্তেই রণ’র ছায়াসঙ্গী। ঘুঙুর আর সেতারের মিলমিশ আমায় এক অন্যরকম জগতে হারিয়ে নিয়ে যায়। পড়াশোনার সাথে সাথে এভাবেই শাস্ত্রীয় নৃত্য কত্থক হয়ে ওঠে আমার সংসার, আমার প্রেম আমার ভালবাসা।