ছোটবেলায় পিসিমনিদের কাছে খুব শুনতাম আমার জন্মের আগে আগে মানে আমার মা যখন বিয়ে হয়ে আসেও নি তখন মৃত্যু শয্যায় থাকা আমার ঠাকুমা, আমার বাবাকে নাকি বলেছিল,পরের জন্মে তিনি তার ছেলের কাছে সন্তান হিসাবে আসতে চান, আর ভদ্রলোক ও বলেছিলেন, "এসো, তবে ছেলে হয়ে এসো মেয়ে হলে তো তোমাকে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে"।
আমার গ্রাম্য অথচ শিক্ষিত মায়ের মুখে শুনেছি বিয়ের আগে মা দাদু কে বলত 'চাষীর বাড়ি না শহরে আমায় বিয়ে দিও। দাদু কথা রেখেছিলেন। কিন্তু বিয়ে হয়ে এসে মা যা দেখল তাতে মায়ের কাছে শহুরে ভাবনাচিন্তার কল্পনা কোথাও একটা হোঁচট খেল.... পা থেকে মাথা পর্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ননদ জা ভাসুর নিয়ে তার ভরা সংসার। প্রায় দ্বিগুন বয়সী স্বামীটিও কম যাননা, তিনি আসলে তাঁর দাদা দিদিদের হাতের পুতুল, এবং আসলে যে যুগে ছেলেরা বিয়ের সময় দাসী আনতে যাচ্ছি বলত তিনি সেযুগেই পড়েছিলেন। খালি তার মা তার বিয়ের আগে গত হওয়ায় একথাগুলো তিনি বোধহয় তার দিদি দাদাদের বলে ছিলেন এটুকুই যা তফাত।
আর তাই ননদ জা ভাসুর পরিবেষ্টিত শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই বুঝে গিয়েছিল যতই পাড়াগাঁয়ে সম্ভ্রান্ত চাষীর ঘর থেকে বেরিয়ে শহরে বিবাহের সাধ তাঁর গ্রাম্য স্কুল মাস্টার বাবা পূরণ করার চেষ্টা করুন না কেন, আসলে "টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস" করা শুরু হল। মুখচোরা মেয়েটির কাছে সেদিন তার বাবার মানসম্মান নিজের সুখের থেকেও অনেক বেশি বলে মনে হয়েছিল। আর তাই মানিয়ে নিতে চেয়েছিল সবকিছুকে । সেকালে মধ্যবিত্ত বাঙালির ডেসটিনেশন পুরীতে মধুচন্দ্রিমায় শ্বশুরবাড়ির গুষ্টিসুদ্ধ লোকের সাথে যাওয়ার কারণে মধুর অভাব থাকলেও মানিয়ে নিতে কসুর করেনি সে। অবিবাহিত ননদদের সাথে অশান্তি এড়াতে সুবিবেচনার সাথে স্বামীকে বলেছিল সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসার থেকে হলিডে হোমের ঘরে বসে স্বামীর গীতাপাঠ শুনতে তার অনেক বেশি ভাল লাগবে। অদ্ভুত ভাবে মধ্যবয়সী স্বামী ভদ্রলোক ধর্মকর্মে স্ত্রীর মতিগতিতে যারপরনাই খুশি হয়ে একবারও খোঁজ নেননি তরুনী স্ত্রীর মনে অন্য কোনও স্বপ্ন থাকলেও থাকতে পারে কিনা। আধুনিক মনস্ক শিক্ষিত কলেজপাশ সদ্য যুবতী সবটুকুকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।কেননা এক গ্রাম্য স্কুল শিক্ষকের শিক্ষায় মূল্যবোধ ও রুচিবোধের কোনও অভাব কখনও ঘটেনি।
তারপরেও বহুবছরে বহুসাধ নিজের মনের মাঝেই রেখে দেওয়া প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় আসা মহিলাটিকে কদিন আগেও যখন আড্ডা দিতে দিতে জানতে চাইলাম এতগুলো বছর কিভাবে কাটালে, উত্তর এল অতগুলো বছর আগে উপায় কি ছিল বল্, ছোট থেকে তো শিখেছিলাম স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর। যতই ওই সময়ে শহরের কলেজ থেকে গ্র্যজুয়েশন কমপ্লিট করি না কেন আসলে তো গ্রাম মফস্বলে বেড়ে ওঠা মুল্যবোধ বিসর্জন দিতে পারিনি। বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলে একটা সময়ের পরে কিন্তু দাদা -ভায়েদের সংসারে ঝি গিরি করতে হত, তার থেকে তো নিজের সংসার অনেক ভাল। আর তোদের মত কথায় কথায় অতগুলো বছর আগে বিয়ে ভাঙা এত সহজ ছিল না। আজও তো মেয়েরা বিয়ে ভাঙলে লোকে তাদের দিকেই আঙুল তোলে সেখানে অতদিন আগে অত সাহস আমার ছিল না। গ্রাম ঘরে ঢিঢি পড়ে যেত। তার থেকে এ অনেক ভাল।
অথচ ভাবি এই মানুষটাই নিজের সন্তান ও সন্তানসমদের ভাল থাকার জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারা রদ করার জন্য সব কিছু কে অতিক্রম করে ভারতীয় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে লিখিত আবেদন করতেও পিছপা হননি।কেউ কিছু বললে বলতেন সমাজ আবার কি? সমাজ তো আমি আর তুমি, সমকামী বিসমকামী বুঝিনা, গর্ভে থাকা সন্তান ছেলে না মেয়ে নাকি অন্য কিছু জানার দরকার নেই, সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতেই মায়েরা চায়, আর তাই আমাদের মত তথাকথিত যৌনতার বাইরে থাকা সন্তানদের পাশে দাঁড়ানোয় এতটুকু পিছপা হননি যে মানুষটা তিনি আমার গর্ভধারিনী ভেবে আজ নিজের পিঠটা নিজেই চাপড়াই...
ছেলেবেলার কথা মনে হলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলেবেলাটা অনেক বেশি ভাল ছিল। ঠাকুমার পুনর্জন্মের ইচ্ছা আর কিছু না হোক আমার মেয়েলিপনা বা ঠাকুমাপনায় কোনও অসুবিধা ঘটায় নি।তাই একটা বয়স পর্যন্ত চুড়ি হার টিপ চাইলেই পেতাম। আমার সব কিছুতেই সকলের প্রশ্রয় একটা থাকতই।
আমার প্রথম পাঁচ বছরের জন্মদিনে মনিমা, মানে আমার বাবার ছোট বোন আমাকে জাতকের গল্প উপহার দিয়েছিল।তারও অনেক আগে সঠিক বোধ তৈরী হওয়ার আগের ভোরবেলাগুলো যখন পিসা যে কিনা দাদাদিদিদের ডাকমত একসময় পুসুমা হয়ে গেছিল, তার সঙ্গে খুব ভোরবেলাঘুম ভেঙে সকালে উঠয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে / আমি যেন সেইকাজ করি ভালমনে' আওড়াতাম সেদিন থেকেই নিজের অজান্তেই নিজের মূল্যবোধ তৈরী হতে শুরু করেছিল।