২০২১ সালের স্টেট রুল অনুসারে আমাদের রাজ্যের প্রত্যেক জেলায় জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমবুডসমান হিসাবে নিয়োজিত হয়েছেন।
চলুন সংক্ষেপে জেনে নিই কি বলছে এই আইন...
এই আইন অনুসারে এইচআইভি আক্রান্ত ও প্রভাবিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, বিদ্বেষ বা হিংসা ছড়ালে ৩ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে বলা হয়েছে।
এই আইনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এইচআইভি র কারণে কারও কর্মের অধিকার, কারও শিক্ষার অধিকার, কারও সম্পত্তির অধিকার, কারও চিকিৎসার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না।
কেবলমাত্র শাস্তিজ্ঞাপন এই আইনের উদ্দেশ্য নয়, বরং সংশোধনাত্মক লক্ষ্য নিয়ে এই আইন প্রণয়ন হয়েছে। এর কারনে, এই আইনে দন্ডনীয় বিধানের সংখ্যা সীমিত।
সংশোধনাত্মকবিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল অপকর্ম বা অন্যায় কাজের সংশোধন এবং অন্যায়কারীকে পুনরায় অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা, নিয়ম লঙ্ঘনকারীকে পরামর্শদান এবং তাদেরকে সেবামূলক সংস্থা বা সমাজের কল্যানমুলক কাজে সংযুক্ত করা।
এই আইনের উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষের এইচআইভি আক্রান্ত মানুষদের প্রতি আচরণগত পরিবর্তন আনা এবং একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করা।
আইনটির মাধ্যমে যে যে সুরক্ষা পাওয়া যাবে ...
- এইচআইভি সম্পর্কিত অপবাদ ও বৈষম্যের সমাধান করা
- বিভিন্ন পরিষেবাগুলি পাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করা
- এইচআইভি সংক্রামিত এবং এইচআইভি প্রভাবিত মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করা
- এইচআইভি আক্রান্তদের বিনামূল্যে রোগ নির্ণয়ের সুবিধা এবং বিনামূল্যে ART প্রদান সুনিশ্চিত করা
- পেশাগত কারনে স্বাস্থ্যকর্মীদের এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রতিরোধ করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে সুরক্ষিত করা
- অভিযোগের ক্ষেত্রে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
এই আইনের সেকশন ৩ অনুসারে
এইচআইভি সংক্রামিত ও প্রভাবিত ব্যক্তিদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষিত করতে নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে লোকপাল হিসাবে আমাদের রাজ্যের প্রত্যেক জেলায় জেলা মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিককে নিয়োজিত করাও হয়েছে।
আইন অনুসারে লোকপাল আইনভঙ্গের (মূলতঃ বৈষম্যমূলক আচরণ) কোনো অভিযোগ পেলে অভিযোগ পাওয়ার ৩০দিনের মধ্যে তাঁকে অভিযোগটির নিষ্পত্তি করতে হবে। চিকিৎসাজনিত আপদকালিন পরিস্থিতিতে বৈষম্যমূলক কোনো অভিযোগ পেলে লোকপাল ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিষয়টির নিস্পত্তি করবেন। রাজ্য সরকারের কাছে প্রত্যেক ৬মাস অন্তর লোকপাল রিপোর্ট জমা করবেন।
লোকপালের আদেশ অমান্য করলে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। আইন অনুসারে এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্ত তথ্য গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করা উচিত। এই গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হলে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
এক্ষেত্রে অভিযোগকারিকে নিজের বয়ানে লিখিত অভিযোগ করার কথা বলা হযেছে। যদি ব্যক্তি নিজে লিখতে সক্ষম না হন, তবে তাঁর বয়ানে অন্য কেউ লিখলেও অভিযোগপত্রে নিজে স্বাক্ষর করা আবশ্যিক।
আইনের সেকশন ৪ অনুসারে
কোনো সুরক্ষিত ব্যক্তির (এইচআইভি আক্রান্ত বা প্রভাবিত) বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করার উদ্দেশ্যে বা বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে কথ্য বা লিখিত শব্দের মাধ্যমে বা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে ঘৃণা বা বৈষম্যমূলক আচরণের প্রকাশ করা, তার এইচআইভি জনিত কোনো তথ্য প্রদর্শন করা প্রকাশ করা, প্রচার করা, এমনকি কোনও দৃশ্যমান বিষয় উপস্থাপনা করা, সম্প্রচার করা, বিজ্ঞাপন দেওয়া যাতে এইচ আই ভি আক্রান্ত বা প্রভাবিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ঘৃণার উদ্রেক ঘটতে পারে তেমন কোনো কাজকর্ম এই আইনের আওতায় নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়েছে।
আইনের ৫, ৬ ও ৭ নং সেকশন-এ বলা হয়েছে
- এইচআইভি পরীক্ষার পূর্বে যথাযথভাবে অবশ্যই অবহিত করে সম্মতিগ্রহণ করতে হবে
- এইচআইভি পরীক্ষা বা চিকিত্সা করার জন্য অবহিত হয়ে/ জেনে বুঝে সম্মতিপ্রদান প্রয়োজন।
- শুধুমাত্র বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া সবক্ষেত্রেই সম্যকভাবে জানিয়েই কারও এইচআইভি পরীক্ষা করা সম্ভব।
(ব্যাতিক্রমী পরিস্থিতিগুলো যেমন - যেখানে আদালত নির্ধারণ করছে/ মহামারী সংক্রান্ত সামাজিক -গবেষণার উদ্দেশ্যে যেখানে এইচআইভি পরীক্ষার জন্য পরিচয় প্রয়োজনীয় নয়, যা কোনও ব্যক্তির এইচআইভি অবস্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে নয়/ যে কোন লাইসেন্সকৃত ব্লাড ব্যাঙ্কে স্ক্রীনিং এর উদ্দেশ্যে)
এই আইনটির সেকশন ৮-এ বলা রয়েছে
কোন ব্যক্তির অবহিত সম্মতি (informed consent) ছাড়া এইচআইভি জনিত ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে কিংবা প্রকাশ করতে বাধ্য করা যাবে না। আদালতের আদেশনামা ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে তার এইচআইভি জনিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন হলে আদালত-এর আদেশনামা অনুসারে এই ধরনের তথ্যের প্রকাশ আদালতে করা যেতে পারে।
চিকিৎসার স্বার্থে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী যারা তার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত (চিকিৎসক বা কাউন্সেলর) তাদের মধ্যে করা যেতে পারে
আইনের সেকশন ৯ অনুসারে
শুধু মাত্র একজন চিকিৎসক বা কাউন্সেলর যদি মনে করেন এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির যৌন সঙ্গী এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন এবং সেই ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বিষয়টি অবগত করেননি তখন তিনি সেই ব্যক্তিকে কাউন্সেলিং করে সঙ্গীকে অবগত করতে উৎসাহ প্রদান করতে পারেন।
কাউন্সেলিং এর সময় মহিলাদের ক্ষেত্রে তার সন্তান, তার আত্মীয় বা তার কাছের কেউ এই তথ্য জানতে পারলে তাকে পরিত্যাগ বা তার সাথে সহিংস ক্রিয়াকলাপ করতে পারে যা মহিলার শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সেই যুক্তিসঙ্গত আশংকা মাথায় রাখা কর্তব্য।
সেকশন ১৩, ১৪ তে আরো বলা রয়েছে
কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার এইচআইভি বা এইডসের সংক্রমন রোধের জন্য প্রয়োজনীয় এবং সমীচীন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি এবং সুযোগ সন্ধানী সংক্রমনের চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করবে।
এইচআইভি সম্পর্কিত সকল তথ্য গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করতে হবে।
সেকশন ১৯, ২০, ২১ অনুসারে
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অভিযোগের প্রতিকারের জন্য ১০০ জনেরও বেশি কর্মী আছেন এমন প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যপরিষেবা ক্ষেত্রে ২০ জনের বেশি কর্মী আছেন এমন প্রতিষ্ঠানে একজন করে কমপ্লেইন অফিসার নিয়োজিত থাকবেন।
কমপ্লেইন অফিসার স্বাস্থ্য পরিষেবায় নিয়োজিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং যেখানে কর্মীদের পেশাগত কারণে এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে, তার পরিবেশকে এইচআইভি থেকে সুরক্ষিত করবেন। এই উদ্দেশ্যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি সার্বজনীন সুরক্ষা ও পোস্ট এক্সপোসার প্রোফাইল্যাকসিস (বা আকস্মিক ভাবে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে) ওষুধের ব্যবস্থা এবং এই সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
তিনি প্রতিষ্ঠানে এই আইনের বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি নিষ্পত্তি করবেন।
সেকশন ২২ অনুসারে
সরকারকে এইচআইভি প্রতিরোধ এবং নিরাপদ অভ্যাস সম্পর্কিত তথ্য, শিক্ষা ও বার্তার প্রসার ও প্রচার এবং কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
কন্ডোম এবং অন্যান্য সুরক্ষিত যৌনজীবন পালনের সামগ্রীর যথাযথ ব্যবস্থা এবং সুরক্ষিত যৌন আচরণ বিধির প্রসার করতে হবে।
ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহণের অভ্যাসকে খাওয়ার দ্রব্যে পরিবর্তিত করে এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা কমানো জন্য ব্যবস্হা নেওয়া ও ইনজেকশনের থেকে সুরক্ষিত রাখার সঠিক ব্যবস্থার প্রচার করতে বলা হয়েছে।
সেকশন ২৯ এ
প্রতিটি সংরক্ষিত ব্যক্তির (এইচআইভি আক্রান্ত ও প্রভাবিত) তার পরিবারের সাথে একই বাড়িতে বসবাসের অধিকার থাকবে। যৌথ বাড়ির কোনো অংশ এবং বাসস্থান থেকে বাদ না যাওয়ার অধিকার থাকবে। এবং এক সাথে থাকতে গিয়ে বাড়ির সমস্ত সুবিধাগুলি অ-বৈষম্যমূলক পদ্ধতিতে উপভোগ করার এবং ব্যবহার করার অধিকার সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
সেকশন ৩২ অনুযায়ী
মাতা পিতার এইচআইভি সংক্রমণের জন্য প্রভাবিত শিশুর সম্পত্তির উত্তরাধিকার সুরক্ষিত করা এবং বয়োঃজ্যেষ্ঠ ভাই বোনকে (১৮ বছরের কম কিন্তু ১২ বছরের বেশি) সেই শিশুর অভিভাবকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সেকশন ৩৪ ও সেকশন ৩৫-এ বলা হয়েছে
আদালতে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় আবেদনকারীর পরিচয় গোপন করে মামলার নথিতে ছদ্মনাম ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
আদালত এইচআইভি আক্রান্ত অভিযোগকারীর অন্তর্বর্তীকালীন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আবেদনটি বিবেচনা করবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের যে কোন আদেশ দেওয়ার সময়, আবেদনকারীর চিকিৎসা ব্যায় বহন করা এবং অন্যান্য এইচআইভি-সম্পর্কিত খরচের বিষয় বিবেচনা করবে।
সাধারণ সামাজিক মেলামেশায় এইচআইভি ছড়ায় না। শুধুমাত্র চারটি মাধ্যমেই HIV জীবানু একজন মানুষের শরীর থেকে আর একজন মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে...
১. অপরিশোধিত সূঁচ বা সিরিন্জ ব্যবহারে
২. অপরীক্ষিত রক্ত বা রক্তজাত পদার্থের আাদানপ্রদানে
৩. অসুরক্ষিত বা বিনা কন্ডোমে প্রবেশমূলক যৌন সঙ্গমে (unprotected sexual intercourse)
৪. HIV আক্রান্ত গর্ভবতী মা থেকে ভবিষ্যৎ সন্তানের
এছাড়া আর কোনওভাবেই HIV সংক্রমিত হয় না।
HIV আছে এমন কারও সাথে সামাজিক মেলামেশায়, এমনকি মশা মাছি হাঁচিকাশির মাধ্যমেও না।
দাড়ি কামানোর ব্লেড থেকেও না। (এক্ষেত্রে ত্বকের সংক্রমণ কিংবা হেপাটাইটিস বি/সি হতে পারে)
সরকারের তরফে এইচআইভি ও এডস আইন নিয়ে বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে।