দ্বিতীয় পর্ব
যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি আর দর্শন চর্চার মধ্যে যেতে চাননি। প্রথমত তাঁর ধারণা হয়েছিল ‘ট্রাক্টেটাস লজিকা-ফিলজফিকাস’ গ্রন্থে তিনি সমস্ত দার্শনিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন, দ্বিতীয় কারণ যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। পূর্বে উল্লেখিত Tolstoy-এর গস্পেল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈল্পিক সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় (যার কথা একটু পরেই আমরা বলবো) তাঁর মনে আগামী করণীয় ও তদুপরি জীবন সম্পর্কেও একধরণের আধ্যাত্মিক ধন্দ তৈরি করেছিল। এই সময় মঠে কিছুদিন মালির কাজ করার পর তিনি ঠিক করেন স্কুলে শিক্ষকতা করবেন। সেই মর্মে তিনি প্রশিক্ষণ নেন এবং ১৯২০-২৬ অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন গ্রামে শিক্ষকতার কাজ করতে থাকেন। স্কুলের বাইরেও বিনা পয়সায় ছাত্রদের পড়াতেন, গরিব ছাত্রদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন। স্কুলের মাইনে তাঁর কাছে যথেষ্ট বেশি বলে মনে হত। একবার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে এত মাইনে নিয়ে তিনি কী করবেন। প্রকারান্তরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রধান শিক্ষককে নিজের পুরো মাইনেটাই দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের এই স্পৃহা Wittgenstein-এর জীবনের একটা প্রধান দিক।
১৯২২ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের প্রধান শিক্ষক জার্মান পণ্ডিত পদার্থবিজ্ঞানী Moritz Schlick কে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, একে ‘ভিয়েনা সার্কেল’ বলা হতো। এই গোষ্ঠীতে Schlick ছাড়াও ছিলেন Otto Neurath, Rudolf Carnop-এর মত বিজ্ঞানীরা। এঁরা ‘যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদ’ নামে গাণিতিক যুক্তিবিজ্ঞান ঘেঁষা এক ধরনের দার্শনিক মতবাদের জন্ম দেন। একই সঙ্গে এ সেই সময়েরও আলেখ্য যখন ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে গিয়েছেন এবং সারা পৃথিবীর বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষত ইউরোপে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে। Wittgenstein-এর মত মানুষের হৃদয়ে রবীন্দ্র-কাব্যের কুহকী মায়া নিবিড় হয়ে উঠতে থাকে। শোনা যায় অনেক পীড়াপীড়ির পর ভিয়েনা সার্কেলে যখন Wittgenstein-কে আনা গেল, তখন তাঁর ‘ট্রাক্টেটাস লজিকা-ফিলজফিকাস’ গ্রন্থ নিয়ে ভিয়েনা সার্কেলের লোকজনদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বদলে তিনি তাঁদের থেকে দূরে উল্টো দিকে মুখ করে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে কবিতা পড়ে যেতেন। তারপর আচমকা নীরবে উঠে প্রস্থান করতেন Rudolf Carnop মন্তব্য করেছিলেন ‘I guess he is not one of us.’। তাঁদের মনে হত উনি যেন দার্শনিক নন, যেন একজন প্রফেট একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী। পরবর্তীকালে Carnop ও আরো অনেককে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়িয়েছিলেন। Tolstoy-এর ‘দা গস্পেল ইন ব্রিফ’ ছাড়াও যুদ্ধের সময়েই তাঁর হাতে এসে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলির ইংরেজি অনুবাদ তখন বের করত Macmillan Company। রবীন্দ্রনাথ এই ‘রাজা’ নাটকটির নিজের করা একটি ইংরেজি খসড়া William Rothenstein-কে পড়তে দিয়েছিলেন, কিন্তু Macmillan-কে দেন নি। ক্ষিতীশ চন্দ্র সেন নামে কেমব্রিজের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট একজন ছাত্রকে তিনি নাটকটি অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। ইনি কেমব্রিজে পড়াশুনা করতেন এবং সেই সঙ্গে আই সি এস পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমনও শোনা যায় যে এই ক্ষিতীশ চন্দ্র সেন হিউস্টান স্টেশনে বসে ট্রেন আসার আগে নাটকটির খানিকটা অনুবাদ করেছিলেন। নাটকটি এমনিতেই দুরূহ রূপক নাটক, তার উপর তিনি গানগুলি অনুবাদ করতে পারেননি যেহেতু গানের অনুবাদ করা আরো কঠিন। এই খারাপ অনুবাদটিই ঘটনাচক্রে Macmillan-এর হাতে গিয়ে পড়ে এবং Translated by Rabindranath Tagore লিখে তারা এটি ছেপে দেয়। Wittgenstein এই অনুবাদটি পড়তে গিয়ে সাঙ্ঘাতিক অভিভূত হয়ে পড়েন, কিন্তু একইসঙ্গে আশ্চর্যভাবে আন্দাজ করতে পারেন এই অনুবাদটিতে কিছু গোলমাল আছে, নাটকটির ব্যঞ্জনার মর্মমূলে গিয়ে ঠিক যেন পৌঁছাতে পারছেন না! এই অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের হাতে গিয়েও পড়ে এবং তিনি যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পরেন। পরবর্তীতে Macmillan ভুলটি শুধরে নেয়। Wittgenstein নিজেও ‘রাজা’ অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন, দুটি অঙ্ক অনুবাদও করেছিলেন। পরে ১৯৩৭ সাল নাগাদ ‘লেকচার্স অন এস্থেটিক্স এন্ড রিলিজিয়াস বিলিফ’ নামে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বক্তব্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শিল্পের দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, Wittgenstein-এর দর্শনে যে তিনটি জগতের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ ভাবনার/চিন্তার জগৎ - ভাষার জগৎ - বস্তু/বাস্তব , রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজা’ নাটকে এই তিনটি জগতের আলোআঁধারির মধ্যে বিচরণ করেন অসামান্য দক্ষতায়। নাটকটিতে সুদর্শনার যে আত্মিক অভিযাত্রা, যা নিজের রাজাকে উপলব্ধি করে আলোকিত হয়ে ওঠে, যা নিজের রাজাকে উপলব্ধি করে মানুষের তীর্থে এসে প্রণত হয়, তার কাহিনি অপরিণত মনের কৌতূহলী হাসি হেসে শুরু হলেও শেষ হয় গভীর শান্তিতে। লন্ডনের সেন্ট ম্যরিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাস্টরাল থিওলজি এন্ড স্পিরিচুয়ালিটি বিভাগের অধ্যাপক Peter Tyler, Wittgenstein-রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘Accordingly, I hope you will see by now that Wittgenstein’s choice of Tagore, and in particular The King of the Dark Chamber, for his inter-war reading was prescient for the type of academic discourse he was hoping to foster in the final decades of his life… As John of the Cross proposes – the vision of the Eternal King is dark and confusing as the boundary between the sayable and unsayable is crossed…. In summary, The King of the Dark Chamber can be taken as an allegory for Wittgenstein’s own search to articulate the truths of the spiritual life. Neither fideist, foundationalist or fundamentalist (as I have argued) the turn of the Wittgensteinian key unlocks a whole garden of mystical discourse for us his contemporary readers.’। ‘অর্থপূর্ণ’ ও ‘অর্থহীন’ অর্থাৎ ‘বলা’ ও ‘দেখানো’-র Wittgenstein কৃত যে দার্শনিক মতবাদ, তার সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের বলে যাওয়া তথ্য ও সত্যের, বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যার, ব্যক্ত ও অব্যক্তর পার্থক্যের কথা। রবীন্দ্রনাথ আলাদা করে কোনো দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেননি, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির অন্দরে শ্যেন দৃষ্টিপাত করলে বোধ ও বুদ্ধির সম্পূর্ণ মৌলিক যে প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ক্রান্তদর্শী Wittgenstein সেইখানেই খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নিজের মনন ও মেধার গূঢ় কথা গুলি। তাই হয়ত এত মুগ্ধতা।
অসামান্য একটি আলোচনা।
মুগ্ধ হয়ে পড়ছি।
আপনাদের পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে অত্যন্ত ভালো লাগলো।অনেক ধন্যবাদ।
ভিটগেনসটাইনের সংগে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। সহজ করে দিচ্ছেন কত কথা। অধীর আগ্রহ রইল পরবর্তী পর্বের জন্য।
হীরেনবাবু খুবই ভালো লাগলো আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে। অনেক ধন্যবাদ।