প্রথম পর্ব
আমাদের দেশে ‘দর্শন’ বলে আলাদা কোনো বিষয় কখনও ছিল কি? বেদে, উপনিষদে যা আছে বা মহর্ষি কপিল, কণাদ, জৈমিনি, ব্যাস, মধ্বাচার্য, রামানুজম, শঙ্করাচার্য ইত্যাদিরা যা বলে বা লিখে গিয়েছিলেন তৎকালে তা ‘দর্শন’ নামে বিবেচিত হতো কি? সম্ভবত না। প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ ও অপার বৈচিত্র্যময় এই জগতের দিকে তাকিয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও কৌতূহলী হয়েছিলেন অগাধসলিলা সরস্বতী নদীর তীরের আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষেরা। তারই ফল স্বরূপ যেগুলি বিবেচিত হয়েছে সাংখ্য, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা, উত্তরমীমাংসা, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ইত্যাদি হিসেবে, এগুলির ভিতর দিয়ে তাঁরা যা বলতে চেয়েছিলেন নিজেদের জীবন-চর্যায় তাই তাঁরা প্রতিভাত করে গিয়েছিলেন, যার অন্ত বোধিতে বা মুক্তিতে। এমনকি বস্তুবাদী চার্বাকেরাও চর্যায় ছিলেন বস্তুবাদী দর্শনানুগ। অর্থাৎ, আদিতে দর্শন আসলে জীবন-চর্যার নামান্তর ছিল ও পরিশেষে জীবনের অন্তিম লক্ষের সন্ধানী। এসব দূর অতীত বা সুপ্রাচীন কালের কথা। স্বতন্ত্র একটি বিষয় হিসেবে ‘দর্শন’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বহু পরে মূলত পাশ্চাত্যের হাত ধরে। আমাদের নিকটবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর দর্শন বলে যা পরিচিত বলা বাহুল্য তা জোরালো ভাবে পাশ্চাত্যেরই অবদান। এর সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে George Edward Moore-র আধুনিক বাস্তববাদের হাত ধরে, প্রসারিত হাল আমলের Slavoj Zizek পর্যন্ত। প্রফেশনাল দার্শনিক বা পেশাগত দার্শনিক, এই ব্যাপারটা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা-বিশ্ববিদ্যালয় ও তার সঙ্গে গড়ে ওঠা ‘দর্শন’ নামক বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন অঙ্কের অধ্যাপক বা ইতিহাসের অধ্যাপকের কাছে তাঁর চর্চিত বিষয়টির সঙ্গে নিজের জীবনের বা যাপনের যেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না এই পেশাগত দার্শনিকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। অর্থাৎ, যা তিনি বলেন বা পড়ান/পেশা ও তাঁর জীবন অসম্পৃক্ত। এই প্রসঙ্গেই আমরা আলোচনা করব ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একশ ব্যক্তির তালিকায় স্থান পাওয়া একমাত্র দার্শনিক Ludwig Wittgenstein-কে নিয়ে।
Wittgenstein-এর জন্ম ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। Wittgenstein-এর বাবা Karl Wittgenstein ছিলেন তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। আট সন্তানের সবচেয়ে ছোট ছিলেন Ludwig Wittgenstein। প্রত্যেক ভাই বোনই অত্যন্ত প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন। এদের মধ্যে এক ভাই মাত্র চার বছর বয়সে সঙ্গীত রচনা করে মোৎসার্টের সমতুল্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। তৎকালীন ভিয়েনার সংস্কৃতির পীঠস্থান এই পরিবারটিতে অনেক গণ্যমান্য মানুষের যাতায়াত ছিল, Sigmund Freud যেমন তাঁদের একজন। Ludwig Wittgenstein শুরুতে দর্শনের ছাত্র ছিলেন না। তাঁকে বার্লিনে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠানো হয়। এরপর ১৯০৮ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। এই সময় গণিতের লজিসিজম বা যুক্তিবিজ্ঞানের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েন বিশেষত Bertrand Russell ও Gottlob Frege-এর লেখা ঐ বিষয়ের উপর দুটি বই পড়ে। ১৯১১ সাল নাগাদ Russell-এর সঙ্গে কেমব্রিজে দেখা করে জিজ্ঞেস করেন ‘Will you please tell me whether I am a complete idiot or not?’। Russell কেন জানতে চাইলে উত্তরে বলেন ‘If I am a complete idiot I shall become an aeronaut but if not I shall become a philosopher!’। ভাবীকাল জানে Russell নিজের উত্তরসূরি হিসেবে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন এই Wittgenstein-কেই। এরপর Wittgenstein নরওয়ে চলে যান এবং একটি কুঁড়ে ঘরে নিমগ্ন ভাবে নিজের দর্শনচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯১৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর এখনকার মূল্যে প্রায় চার কোটি টাকা অস্ট্রিয়ার দরিদ্র অথচ সম্ভাবনাময় শিল্পীদের মধ্যে দান করে দেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত কবি Rainer Maria Rilkeও ছিলেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরির আর্মিতে যোগদান করেন। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া, মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা। তাঁর মনে হয়েছিল, যে দার্শনিক সমস্যাগুলি নিয়ে তিনি ভাবছেন তাতে এই যুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া তাঁকে একধরণের নৈতিক শুদ্ধতা দেবে, তিনি সমস্যাগুলি সমাধানের আরও কাছাকাছি যেতে পারবেন! ইচ্ছে করে খুব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা গুলিতে যেতেন এবং এই অসমসাহসিকতার জন্য বেশ কয়েকবার তিনি পুরস্কৃতও হন। যুদ্ধের ভয়াবহতা Wittgenstein-এর মত অতি-সংবেদনশীল মানুষের উপর গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তাঁর প্রখ্যাত ‘ট্রাক্টেটাস লজিকা-ফিলজফিকাস’ গ্রন্থ রচনার কাজ এর মধ্যেই চলতে থাকে। এই সময়ে পোল্যান্ডের একটি গ্রন্থাগারে Leo Tolstoy-এর লেখা ‘দা গস্পেল ইন ব্রিফ’ এই বইটি তিনি খুঁজে পান। এটি প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বইটি তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে, বারংবার পড়তে থাকেন এবং অন্য সৈনিকদেরও পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দা ম্যান উইথ গস্পেল’। ইতালিতে বন্দি ছিলেন এবং ১৯১৯ সালে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে নিজের বিশাল পৈতৃক সম্পত্তির সমস্তটাই ভাই বোনদের মধ্যে দান করে দেন। ১৯১৯-২০ এই সময় সন্ন্যাসীদের একটি মঠে মালির কাজও নেন। ‘ট্রাক্টেটাস লজিকা-ফিলজফিকাস’ গ্রন্থ রচনার কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে যায় এবং বইটি ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র বই, এছাড়া দু-একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
Wittgenstein-এর ভাবনার পরিসরটি ছিল দর্শনের দর্শন নিয়ে। অর্থাৎ, ‘দর্শন’, এই ডিসিপ্লিনটি নিয়েই তাঁর ভাবনা ছিল। তিনি মনে করতেন দর্শনের সমস্যাগুলির কোনো সমাধান হয় না। আড়াই-তিন হাজার বছর আগে যে সমস্যা গুলি নিয়ে আলোচনা হতো আজও সেই সমস্যাগুলি নিয়েই আলোচনা হয়। অর্থাৎ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না?, পরম সত্ত্বা কী?, সত্য কী?, আত্মা কী?, আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা আছে কি না? ইত্যাদি যে প্রশ্নগুলি, এইগুলির ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোনো ঐক্যমত নেই। কেবল তর্ক ও পাল্টা তর্কের বেড়াজালে আমরা আটকে থাকি। এর কারণ হিসেবে বলতে চেয়েছেন, দর্শনের এই সমস্যাগুলির উদ্ভব হয় দার্শনিকেরা ভাষার যুক্তিকে ঠিকঠাক মত বুঝতে পারে না বলে! এই বইতে ভাষার যুক্তিকে ঠিকঠাক মত বিশ্লেষণ করে তিনি মনে করেছিলেন সমস্ত দার্শনিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। এই প্রকল্পটি তিনি শুরু করেছিলেন এই বলে, কেউ যখন কিছু বলে অন্য কেউ সেটা বোঝে কি ভাবে? একজন যখন ভাষায় কিছু প্রকাশ করে তখন সে ভেবে বা চিন্তা করে সেটা প্রকাশ করে, আর যা প্রকাশ করে তা জগতের কোনো কিছুকে বর্ণনা করে। অর্থাৎ এখানে তিনটি জগতের ধারণা পাওয়া গেল, ভাবনার/চিন্তার জগৎ - ভাষার জগৎ - বস্তু/বাস্তব জগৎ। তাহলে কোনো কিছু ঠিকঠাক মত বুঝতে গেলে এই তিনটি জগতের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকতে হবে। যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক আমার যেহেতু একে অপরের সাথে ভাষাগত সংযোগ স্থাপন করতে পারি কাজেই এই তিনটি জগতের মধ্যে নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটিই উনি নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন।
তখন ইউরোপে মর্ডানিজমের যুগ চলছে, সমস্ত কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার যুগ, অর্থাৎ বিচারের পদ্ধতি হবে অবরোহী (a priori)। এই বইতে Wittgenstein এই অবরোহী পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিলেন। যুক্তি পাল্টা-যুক্তি নির্ভর এই পদ্ধতিতে ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে বলে মনে করা হতো যেহেতু এতে সমস্যা সমাধানের সূত্র বের করার জন্য মানুষের ইন্দ্রিয়গুলির উপর বা অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করা হতো না। তিনি বলেছিলেন জগতের একটি অবরোহী গঠন বা রূপ আছে, একইভাবে চিন্তার/ভাবনার এবং ভাষারও একটা অবরোহী গঠন বা রূপ আছে। এই তিনটি মিলে যায় বা কোইনসাইড করে বলেই আমাদের ভাবনাটা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি, আমাদের ভাষা বাস্তব জগতকে উপস্থাপিত করে এবং যে শুনছে বা পড়ছে সে বুঝতে পারে। এখন এই ভাষার যুক্তিটা ঠিকমত বুঝতে গেলে ভাবনার ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা টানা প্রয়োজন। কিন্তু সীমানা টানতে গেলে আমাদের জানতে হবে সীমানার বাইরে বা সীমানার ওপারে কি আছে, না হলে সীমানাটা টানবো কোথায়? ভাবনার সীমানার বাইরে থাকবে যা ভাবা যায় না বা চিন্তা করা যায় না, কিন্তু think the unthinkable যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাই এর পরিবর্তে তিনি বললেন চিন্তার সীমারেখা টানতে পারবো না ঠিকই, কিন্তু ভাষার সীমারেখা টানা যেতে পারে অর্থাৎ অর্থপূর্ণ ভাষা ও সীমানার বাইরে থাকবে অর্থহীন ভাষা। এই ভাষার সীমারেখা দিয়েই চিন্তার/ভাবনার সীমারেখাও নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ, চিন্তা ও ভাষা সমব্যাপক বা কোএক্সটেন্সিভ। তার মানে অর্থপূর্ণ চিন্তাকে সবসময়ই অর্থপূর্ণ ভাষায় রূপ দেওয়া যাবে। অর্থপূর্ণ বচন/বাক্য সেই গুলিই যা জগতের কোনো ঘটনাকে বর্ণনা করে। অর্থপূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে যে বচন/বাক্য দিয়ে, শুধুমাত্র সেইগুলিই বলা যায়। Wittgenstein-এর ভাষায় যা বলা যায় তা স্পষ্ট করে বলা যায়। আর যেটা বলা যায় না, তার মধ্যে তিনি ফেলছেন লজিক, ম্যাথেম্যাটিক্স, এথিক্স, রিলিজিয়ন, এস্থেটিক্স, মেটাফিসিক্স এইগুলিকে। এরা জগতের কোনো ঘটনার বর্ণনা করে না, তাই বলেছিলেন, এদের সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়। কিন্তু এগুলি সম্পর্কে যখন বলা হচ্ছে কিছু বলা যায় না তখন সেটা বলছি কী ভাবে? অর্থাৎ আমরা জানছি কী ভাবে যে এগুলি সম্পর্কে কিছু বলা যায় না? আমরা যখন বলছি এগুলি সম্পর্কে বলা যায় না তখন এই অর্থপূর্ণ কথাটা বলছি কী ভাবে? এর পিছনে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, এদের সম্বন্ধে অর্থপূর্ণ ভাবে বলা যায় না ঠিকই কিন্তু তাহলেও আমরা এদের ব্যাপারে জানতে পারি কারণ এরা নিজেরা নিজেদেরকে দেখায় (they manifest themselves)! তার মানে ‘অর্থপূর্ণ’ ও ‘অর্থহীন’ হল যথাক্রমে ‘বলা’ ও ‘দেখানো’।
এখন যা বলা যায় সেই সব যৌগিক জটিল বাক্যকে/বচনকে ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে এমন একটি বচন পাওয়া যাবে যাকে আর ভাঙা যাবে না, একে তিনি বলেছেন লজিকাল অ্যাটম অফ ল্যাঙ্গুয়েজ। একে ভাঙলে আমরা আর কোনো বাক্য/বচন পাবো না ঠিকই, কিন্তু যা পাবো তাকে নাম দিয়েছেন ‘নেমস’। এই ‘নেমস’ কিন্তু সাধারণ অর্থে নাম বলতে আমরা যা বুঝি তা নয়, এটা একটি টেকনিক্যাল শব্দ। সাধারণ নামকে বিশ্লেষণ করা যায় বা সংজ্ঞায়িত করা যায়, কিন্তু এই ‘নেমস’কে যদি সংজ্ঞায়িত করতে হয় তাহলে তাকে শুধুমাত্র সংজ্ঞায়িত করা যাবে উদ্দিষ্ট বস্তুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অর্থাৎ, ‘শব্দটির অর্থ হল এই’ এইভাবে। এই সংজ্ঞা তখনই সম্ভব যদি উদ্দিষ্ট বস্তুটি সামনাসামনি উপস্থিত থাকে। তার মানে ‘নেমস’ সরল বস্তুকে সূচিত করে। অন্যদিকে জগতকে Wittgenstein দেখেছিলেন বস্তুর সমষ্টি হিসেবে নয়, বরং তথ্যের সমষ্টি হিসেবে। কারণ ভাষা যা বর্ণনা করে তা বস্তু নয়, বরং তা বস্তু সম্পর্কিত তথ্য। এই তথ্যকেও একই ভাবে বিশ্লেষণ করে করে আমরা পাব অ্যাটমিক ফ্যাক্ট, একে ভাঙলে আমরা আর অন্য ফ্যাক্ট পাবো না ঠিকই কিন্তু যা পাবো তাকে বলেছেন ‘অবজেক্ট’। এই ‘অবজেক্ট’ হল লজিকাল অ্যাটম অফ ওয়ার্ল্ড। একই ভাবে চিন্তার/ভাবনার ক্ষেত্রেও ঐ একই রকম বিশ্লেষণ করে লজিকাল অ্যাটম অফ থট পাওয়া যাবে। এই ‘নেমস’ এবং ‘অবজেক্ট’ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এক নামের যেমন একাধিক অবজেক্ট থাকতে পারে না, একই ভাবে এক অবজেক্টের একাধিক নামও হতে পারে না। নাম আছে অবজেক্ট নেই বা অবজেক্ট আছে নাম নেই এরকমও হতে পারে না। তিনটি জগৎ অ্যাটমিক পর্যায়ে এইভাবে পরস্পর সংযুক্ত থাকে বলেই উপরের পর্যায়ে যে জটিল প্রপোজিশনগুলি পাওয়া যায় বা জটিল বাক্য/বচনগুলি পাওয়া যায় তার একটা সুনির্দিষ্ট অর্থও পাওয়া যায়। অর্থটি দিচ্ছে এই ‘নেমস’ আর ‘অবজেক্ট’, যেহেতু এর দ্বারা ভাষা ও জগৎ পরস্পর সম্পর্কিত। Wittgenstein বলেছিলেন একটা বচনকে বচনই বলা যাবে না যদি না তার সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে।
উপরে যা বলা হল তা যা বলা যায় তাই নিয়ে তাঁর বক্তব্য। আর যেগুলি বলা যায় না সেগুলিও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যেমন লজিক, ম্যাথেম্যাটিক্স, এথিক্স, রিলিজিয়ন, এস্থেটিক্স, মেটাফিসিক্স, কারণ এরাই দেখায় যে উপরে বলা ভাবনার/চিন্তার জগৎ - ভাষার জগৎ - বস্তু/বাস্তব জগৎ আসলে একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়। Russell, Frege ও পরবর্তীতে Rudolf Carnop-এর মত পদার্থবিদের দ্বারা প্রভাবিত Wittgenstein ‘ট্রাক্টেটাস লজিকা-ফিলজফিকাস’ গ্রন্থে তাঁর এই বক্তব্যগুলিকে সাজিয়েছিলেন অনেকটা ম্যাথেমেটিকাল ডিডাকশনের ভঙ্গিতে। তাই এই বইটি প্রথম দর্শনে অস্বস্তিকর ও বিভীষিকাময়। যুক্তির এই কঠিন বিন্যাসের পর Wittgenstein আবার এমনকিছু কথা বলেছেন যা মিস্টিকাল। বলছেন ‘I wonder that the world exists’। জগতকে দেখে আমরা যে বিস্মিত হচ্ছি, জগতকে যে আমরা অনুভব করতে পারি,এটাই মিস্টিকাল! এটা হচ্ছে কারণ জান্তে বা অজান্তে আমরা জগতকে অনন্তের প্রেক্ষাপটে দেখি, যাকে বলে sub specie aeternitatis। এথিক্স, এস্থেটিক্স, আর্টও আমাদের এই একই অনুভূতি দেয়।
হ্বিটগেনস্টাইন নিয়ে চমৎকার আলোচনা শুরু হয়েছে।
কিন্তু প্রথম প্যারার ভারতীয় দর্শন নিয়ে বক্তব্যের সঙ্গে কিঞ্চিৎ দ্বিমত পোষণ করছি।
১ বেদ, উপনিষদে অবশ্য কোন সিস্টেম্যাটিক দার্শনিক আলোচনা নেই। বিভিন্ন হাইপোথেসিস বা দৃষ্টিকোণের বর্ণনা মাত্র আছে।
২ কিন্তু এর পরের যুগে যে ষড়দর্শন (সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা ও বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসা) এর সূত্রগ্রন্থগুলো রচিত হোল তা রীতিমত দার্শনিক সিস্টেমের রচনা। এদের প্রত্যেকের আলাদা মেটাফিজিক্স এবং এপিস্টেমোলজি আছে। অর্থাৎ সৃষ্টি,(কসমোলজি) জীব্জগত ও ঈশ্বর( অন্টোলজি) নিয়ে বা তার উদ্দেশ্য (টেলিওলজি) নিয়ে সূত্র, এবং জ্ঞানতত্ত্ব (এপিস্টেমোলজি) মানে কী বা কাকে প্রমাণ ধরা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। পাশ্চাত্ত্য দর্শনের ডিডাক্টিভ লজিকের থ্রি-স্টেপ সিলোজিসমের পরিবর্তে এখানে রয়েছে পঞ্চপদী বা ফাইভ স্টেপ সিলোজিসম, তাতে বাস্তব জীবনের উদাহরনের মাধ্যমে ইন্ডাক্টিভ ও ডিডাক্টিভের সমন্বয়ের ঝোঁক রয়েছে। এছাড়া ১৪ শতাব্দীতে রচিত মাধবাচার্য্যের সমস্ত দর্শনগুলোর সংক্ষিপ্ত বইটির নাম 'সর্বদর্শন সংগ্রহ'। অর্থাৎ তখন এই মত গুলো দর্শন নামেই পরিচিত ছিল। এছাড়া সূত্রগুলোর উপর ভাষ্য, টীকা, দীপিকা-- একের পর এক লেখা হয়েছে। তাতে অন্যমতগুলোর সঙ্গে বিতর্ক রয়েছে।
৩ শংকরাচার্য,রামানুজ, কুমারিল ভট্ট --এরা সব মূল সূত্রগ্রন্থের উপর ভাষ্যই লিখেছিলেন। তার সঙ্গে এদের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ যোগ ছিলনা। যেমন শংকরের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওঁর 'ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা' থিওরির কোন মিল নেই।
৪ বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে ইউরোপীয় দর্শনে আধুনিকতার সূচনা হয়েছে ১৬শ শতাব্দীতে, রনে দেকার্তের র্যাশনালিজম বা যুক্তিবাদ থেকে যার মতে সবকিছুই, এমনকি ঈশ্বরকেও যুক্তিসিদ্ধ হতে হবে। সেই সময় নবদ্বীপে বিশুদ্ধ দর্শনচর্চা নব্যন্যায়ের মধ্যদিয়ে চরমে পৌঁছেছিল।
লেখা চলুক, অপেক্ষায় আছি।
রঞ্জনবাবু আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। ভারতীয় দর্শন নিয়ে ভবিষ্যতে পৃথক কোনো প্রবন্ধ লিখলে অবশ্যই আপনার উল্লেখ করা বৈশিষ্ট্যর কথা মাথায় রাখবো। সবগুলি পর্ব পড়ার পর সম্পূর্ণ লেখাটি কেমন লাগলো জানালে উপকৃত হব। পুনর্বার অনেক ধন্যবাদ।
ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকটেটাস গ্রন্থের মূলকথা এত সহজ করে লিখেছেন, খুব ভালো লাগছে পড়তে I পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম Iঅনেক ধন্যবাদ I
বীথিকাদেবী আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে অত্যন্ত ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।
বেশ ভালো লাগছে। অঙ্কের মত করে আমাদের ভাবনাচিন্তাকে বলা।
শুভদীপবাবু খুব ভালো লাগলো আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে। অনেক ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর বিষয় নির্বাচন এবং অনুপুঙ্খ
বিশ্লেষণ
রক্ষিতবাবু খব ভালো লাগলো আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে। অনেক ধন্যবাদ।