অনুলেখকের ভূমিকা: গত ২৬ ডিসেম্বর, রাইট টু এডুকেশন এবং জয়েন্ট প্লাটফর্ম ফর আকাডেমিশিয়ানস, এই সংস্থা দুটির উদ্যোগে একটি অনলাইন আলোচনাচক্র আয়োজন করা হয়েছিল।
সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, রতন খাসনবিশ। এর পরে একে একে বক্তৃতা করেন, বিজু কৃষ্ণান, দীনেশ অ্যাব্রোল, সাইনাথ এবং সবশেষে রতন খাসনবিশ। প্রথম পর্বে আমরা ইতিমধ্যেই, উদ্যোক্তাদের অনুমতিক্রমে, কিছুটা সংক্ষেপিত অনুলিখন সহ বিজু কৃষ্ণন ও দীনেশ অ্যাব্রোলের বক্তব্যের অনুলিখন প্রকাশ করেছি। এই রইল তার লিংক।
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=20573
এই দ্বিতীয় পর্বটিতে, গ্রামীণ জীবন ও কৃষি বিষয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক পি সাইনাথ এবং অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশের বক্তব্যের সংক্ষেপিত অনুলিখন, রাইট টু এডুকেশন ফোরামের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হল। এই আলোচনাসভাটি গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এবং মূলত বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে যে মতাদর্শের ভূমিকা থাকে তার অবশ্যম্ভাবী উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও, আলোচনাটি, বক্তাদের গুণেই দলীয়, বিশেষত নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে খুব সম্পর্কিত কিছু হয়ে ওঠেনি। এই আলোচনা কৃষির সঙ্গে জড়িত নন এমন মানুষকেও ভাবাতে বাধ্য করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এই পর্বে ব্যবহৃত প্রতিটি লিংকই অন্তত ১০ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই অর্থেই প্রকাশিত ছিল।
ওয়েবিনারটির ভিডিও ইউটিউবে রয়েছে, যাঁরা সভা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের মত করে অনুলিখন বা টীকা পড়তে অনাগ্রহী, তাঁরা ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
শুভোদয় দাশগুপ্ত এবং নন্দিনী মুখোপাধ্যায়দের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছাড়া এই অনুলিখন, তার অনুমোদন সংগ্রহ অসম্ভব হত। ঈশিতা মুখোপাধ্যায়কে অনেকবার বিরক্ত করেছি, ছোট ছোট প্রশ্ন নিয়ে। এঁদের তিনজনকে আবারও আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমি সচেতন যে আজ সভায় বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, উচ্চশিক্ষিত সক্রিয় আন্দোলনকারীরা রয়েছেন। কেমন ভাবে এই কৃষক আন্দোলন আমরা দেখতে পারি তা নিয়ে আলোচনার জন্য পাঁচটি বিষয় তুলে ধরব বলে ঠিক করেছি।
প্রথমত, এই কৃষি আইনগুলি নিয়ে আমরা কথা বলছি, সেগুলি বৃহত্তর কৃষি সংকটের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক নয়। কৃষকরা অসম্ভব বীরত্বের সঙ্গে এই আইন রদ করানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু এ কথা পরিষ্কার থাকা দরকার যে, এমনকি এই আইনগুলি বাতিল হয়ে গেলেও এই সংকট মিটবে না, কিন্তু আইন গুলি থাকলে, সংকট গভীরতর হবে। আমার পূর্ববর্তী বক্তা, বিজু কৃষ্ণন এবং দীনেশ আব্রোল এটা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন।
দ্বিতীয়ত ক্ষুধার সংকট, কৃষি আইন সঞ্জাত পরিস্থিতি, কৃষির সাধারণ সংকট, মহামারীর সময়ে শ্রমিকের অবস্থা, পরিযায়ী শ্রমিকের নিদারুণ অসহায়তা,আমাদের দেশের ক্ষুধা বা পুষ্টির সমস্যা, এগুলি সবকটি, আমাদের দেশের নীতির গঠনের মধ্যেকার গভীর অসাম্যের সঙ্গে জড়িত।
তৃতীয়ত এই কৃষি আইন, শুধু কৃষকের সমস্যা বলে ভাবলে ভুল হবে। এটা সত্যি কথা বলতে কি সকলের সমস্যা। প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের সমস্যা।
চতুর্থত আমাদের একটু দেখতে হবে, এই প্রসঙ্গে আইনের পক্ষে মতামত দেওয়া বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী, এবং তাঁদের উৎসাহিত করা মিডিয়ার ন্যক্কারজনক ভূমিকাটির চরিত্র টি ঠিক কী? যার ফলে কৃষকের এবং দেশের ক্ষতি হচ্ছে।
সর্বশেষে আমরা দেখব, মানুষ কী ভাবে এর বিরোধিতা করতে পারেন।
শুরু করা যাক। বৃহত্তর কৃষি সংকটের কথা আপনারা শুনছিলেন। এই আইন গুলোর দিকে একটু তাকানো যাক। প্রথমে যেটা বলে নিতে চাই, এই আইন গুলো কিন্তু সুদূর প্রসারী এবং বিশাল অংশের মানুষের জীবন এর দ্বারা প্রভাবিত হবে।
এপিএমসি আইনের ১৩ ও ১৫ নং অনুচ্ছেদ [1] এবং কন্ট্রাক্ট ফার্মিং আইনের ১৮ ও ১৯ নং অনুচ্ছেদ [2] কী বলছে? কেন্দ্রীয় সরকারের কোন কর্মচারী, রাজ্য সরকারের কোন কর্মচারী, “এবং যে কেউ", যাঁর উদ্দেশ্য সৎ বা উদ্দেশ্য সৎ রাখার ইচ্ছা রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা যাবে না, কোন বিরোধ উপস্থিত হলে। অর্থাৎ শুধু যে অপরাধ বা আইনভঙ্গ হয়ে গেছে তার বিচার তো চাওয়া যাবেই না, যা হয় নি, তার ব্যাপারেও আইনি সুরক্ষা দেওয়ার বিচিত্র এবং ভয়ানক অপব্যবহারের সম্ভাবনা সহ এই অনুচ্ছেদগুলি লেখা হচ্ছে। তো আমরা একটু খতিয়ে দেখি, এই 'এবং যে কেউ' টা কারা। এট বোঝা খুবই সহজ, কাদের রক্ষা করতে চাইছেন সরকার। চাষিরা বোঝেন, বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা বুঝেও বোঝেন না। বড় বড় কর্পোরেশনগুলির কর্মচারীদের জন্যই এই সুরক্ষা কবচ। বলে রাখি, আম্বানি আদানিরা শুধু নন, আরো অনেক কর্পোরেট ই কৃষিজাত পণ্যের আশ্চর্য লাভজনক ব্যবসায়ে রয়েছেন। যেটা দাঁড়িয়েছে, এই আইনগুলি কর্পোরেশনদের কার্যত লাভের উদ্দেশ্যে যথেচ্ছাচার করার অধিকার দিয়ে দিচ্ছে। কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। বোঝা খুবই সহজ, কাদের রক্ষা করতে চাইছে সরকার।
এই কাঠামোটাকেই আরো কড়াভাবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা হয়েছে কোথায় জানেন! কর্নাটকের গোহত্যা বিরোধী আইনটিতে। এই আইন পাস করাতে না পেরে অধ্যাদেশ [3] হিসেবে চালানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, সেখানে সুরক্ষা কবচ দেওয়া হয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ইত্যাদি অতি দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সদস্যদের। এবং ভয়ংকর বিষয় হল, বলা হচ্ছে, যারা গোহত্যার বিরুদ্ধে থাকবে, তাদের সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা হবে। আমি এই কথাগুলি বলছি এই কারণে, যে আপনাদের বোঝা দরকার, খুব বাছা বিশেষ সামাজিক রাজনৈতিক শক্তিগুলিকেই স্বেচ্ছাচারী হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীদেরই বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট, কালেকটর যেকোনো কৃষির চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইনের মামলার বিচার করতে পারবেন বলে বলা হচ্ছে। দেশের আইনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলো, যেমন ধরুন দিল্লির বার কাউন্সিল কিন্তু নিজেদের অসোয়াস্তির কথা [4] জানিয়েছে। তারা বলেছে এই আইনে জেলা আদালতগুলি শেষ হয়ে যাবে। ঐ যে শুরুতেই বলছিলাম না, এটা শুধু কৃষকের বিষয় না। সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিককে বিচারের অধিকার দেওয়া হয়েছিল [5], এই নতুন আইনগুলির ফলে, বিনষ্ট হবে সাংবিধানিক অধিকার।
রেশন ব্যাবস্থাকে এই কৃষি আইনগুলি প্রভাবিত করবে। খাদ্য সুরক্ষার সমূহ বিপদ হবে। প্রণীত আইনে ব্যবহৃত ভাষা যদি দেখেন, আপনার মনে একেবারেই কোন সন্দেহ থাকবেনা, কাদের সুবিধের জন্য এই আইন আনা হয়েছে।
সরকার পক্ষের, বৃহৎ কর্পোরেটের পক্ষের বুদ্ধিজীবী খুব যত্ন করে একটি কাজ করেছেন। এপিএমসি মান্ডি, এম এস পি এগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা মানুষের মনে তৈরি করছেন, যেন এগুলি দেশের পক্ষে ভয়ানক অহিতকর, ক্ষতিকর বস্তু।
ভারতীয় কৃষকের জীবনে ন্যূনতম মূল্যের মান্ডির ভূমিকা কী তা বোঝার আসলে একটা খুব সোজা পদ্ধতি আছে। ঠিক সরকারি স্কুল, সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র যেমন সাধারণ, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে শস্তায় শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পাবার একমাত্র মন্দের ভালো উপায়, এপিএমসি তেমনই সমস্ত সমস্যা সত্ত্বেও চাষির ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার একমাত্র উপায়। কেরালা তামিলনাডু ইত্যাদি কয়েকটা রাজ্যের বাইরে সরকারি স্কুলের অবস্থা ভালো না। সাধারণ পরিবার কি তাঁদের ছেলেমেয়েদের ট্যাব, স্মার্ট ফোন দিয়ে অনলাইন পড়াশুনো করতে পাঠাতে পারেন? এই অবস্থায় সরকারি স্কুলই লাখো বাচ্চার মোটামুটি ন্যূনতম মানের পড়াশুনো শেখার একমাত্র জায়গা। এবং শুধু তাই নয়, আজ স্কুলের দুপুরের খাওয়াটাই হয়তো অনেক ছেলেমেয়ের সারাদিনের একটা মোটামুটি পুষ্টি সংগ্রহের একমাত্র উপায়। আমরা কি বলে বেড়াই, সরকারি স্কুল তুলে দেওয়া হোক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র তুলে দেওয়া হোক। আমি তো বলি, সরকারি স্কুল হল শিক্ষাক্ষেত্রের এপিএমসি, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র হল স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এপিএমসি। সাধারণ মানুষ একমাত্র এগুলোর মাধ্যমেই শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিষেবা আয়ত্তের মধ্যে পেয়ে থাকেন। অবশ্যই মান্ডি ব্যবস্থার নানা পরিবর্তন দরকার, কিন্তু সেই পরিবর্তন কৃষকের স্বার্থে হওয়া জরুরি। এখন যে আইন এসেছে, সেটা ঠিক সংস্কার না, এই প্রক্রিয়াটি চালানো হচ্ছে, কৃষি বাজারে ভারসাম্য টাকে কর্পোরেটের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এবার আসি বৃহত্তর কৃষি সংকটের কথায়। কর্পোরেটের পক্ষ থেকে ভারতীয় কৃষি দখল প্রচেষ্টা, এই গোটা পাঁচেক শব্দই বৃহত্তর কৃষি সংকটকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। দিল্লির বাইরে যে সব কৃষক আন্দোলনে রয়েছেন, তাঁরা এটা পরিষ্কার বোঝেন। কর্পোরেটের শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন ই আমাদের সময়কার সবচেয়ে বড় লড়াই।
এর পরে আমরা একটু দেখে নিই, বৃহত্তর কৃষি সংকট ঠিক কী ভাবে ব্যাপ্ত হচ্ছে। আবার কয়েকটি শব্দে বলার চেষ্টা করি। গ্রামীণ এলাকার চুড়ান্ত বাণিজ্যায়ন। ফসল বিশেষে কৃষির খরচ ৩০০-৪০০% বেড়েছে। কৃষকের রোজগার খুব স্বাভাবিকভাবেই তার কাছাকাছি নেই। আমি এর আগে আড়তদারদের সম্পর্কে বলেছি। তারা কি ধোয়া তুলসীপাতা, তামিলনাদুর তরঙ্গারুরা হোন কিংবা বিহারের ঠেকেদার, অবশ্যই না। কিন্তু মজাটা হল, আমার ভাবলে মাঝে মাঝে বেশ আশ্চর্য লাগে, এই আইন তাঁদেরকে কৃষকদের কাছাকাছি আনছে। পাঞ্জাবে যেমন ধরুন জাতির দিক থেকে আড়তদার মধ্যে অনেক রকম জাতির লোকেরা এখন রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের ব্যবসা, জীবন জীবিকার উপরে কর্পোরেট ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ে আসা আক্রমণ সম্পর্কে সবাই সচেতন।
আপনাদের বোঝা দরকার, কৃষি সংকট পেশার জায়গা থেকে, আদি বাসস্থান থেকে মানুষকে অপসারিত করছে। একটা হিসেব দিচ্ছি। ১৯৯১ থেকে ২০১১ র মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়ন, মানে প্রায় দেড়কোটি মানুষ কিন্তু কৃষির প্রাথমিক পেশা থেকে সরে গেছেন, জমির অধিকার হারিয়েছেন। এবং এটা বাড়ছে। কোথায় যাচ্ছেন তাঁরা, খুব আকর্ষণীয় কর্ম সংস্থান কোথাও তৈরি হচ্ছে কি? কেউ কৃষি শ্রমিক হয়ে গেছেন, কেউ শহরগুলোতে পরিযায়ী শ্রমিক হয়েছেন। মহামারীর সময় যখন পরিযায়ী শ্রমিকরা পাগলের মত বাড়ি ফিরছিলেন, অনেকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরছেন কেন, প্রশ্নটা আসলে হওয়া উচিত ছিল, এঁদের যেতে হয়েছিল কেন? তাঁতিরা, মৃৎশিল্পীরা, কাঠের কাজের সঙ্গে জড়িত মানুষেরা, তাঁরাও তো এইভাবেই বাধ্য হয়েছেন, অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি দিতে। সুতরাং উৎপাদক কৃষকের সমস্যা গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত সকলকেই প্রভাবিত করেছে।
কোভিডের মহামারী আমাদের একটা সাহায্য করেছে, সমাজ হিসেবে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আভ্যন্তরীণ অসাম্যকে বেআব্রু করেছে। এবং ধনতন্ত্রের প্রকৃত চেহারাটাও বেরিয়ে এসেছে। আমাদের বেশির ভাগ সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অসাম্যজনিত সমস্যাই কোভিডের আগেও ছিল, কিন্তু কোভিডের আগে মানুষের চোখের সামনে এভাবে উঠে আসেনি।
মহামারীর প্রথম ৪ মাসে আমাদের দেশের গর্বের ১২০ জন বিলিওনেয়ার তাঁদের সম্পত্তি বাড়িয়ে ফেলেছিলেন প্রায় ৩৫ শতাংশ। এখন তাঁদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪৩৫ বিলিয়ন ডলার। এঁদের মধ্যে মুকেশ আম্বানি, মহামারীর আগে শুধু ২০১৭ তে তাঁর তখনকার সম্পত্তির উপরে আরো ১৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার জুড়তে পেরেছিলেন। প্রায় এক লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গোটাটাই নীতির পরিবর্তনের সুবিধা গ্রহণ করে। মাত্রাটার ধারণা দেবার জন্য বলছি, এক কোটি আশি লক্ষ শ্রমিক যদি তাঁদের এমএনরেগা র কাজ একদিনও না-বিশ্রাম করে এক বছর টানা পরিশ্রম করেন, তাহলে মোটামুটি এরকম অঙ্কের টাকার পারিশ্রমিক মূল্য তৈরি হবে।
মহামারীর সময়ে এই অনলাইন পড়াশুনোর ব্যবসা এত বাড়ল, হিসেবটা কীরকম? বাইজু, সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাম্যটাই সবচেয়ে ভয়াবহ। ক্ষুধার ভয়াবহতা নিয়ে কিছুটা মানুষের তবু সচেতনতা আছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাম্য নিয়ে কোন সচেতনতাই নেই। ধরুন পশ্চিমবঙ্গে, কজন শিশুকন্যার হাতে স্মার্ট ফোন আছে? এই প্রশ্নটা কারো মাথাতেই আসে না। অর্থনৈতিক অসাম্য এবং শিক্ষার পরিষেবা গ্রহণ করার ক্ষমতা অবশ্যই ওতপ্রোতভাবে জড়িত [6]।
সারা দেশের তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে কেরালায় গ্রামীণ পরিবারগুলির কাছে বেশি কম্পিউটার আর ইনটারনেট রয়েছে, গোটা দেশের অবস্থা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। আমি যে তথ্য ব্যবহার করছি, সেটা মহামারীর আগের সরকারি তথ্য, বুঝতেই পারছেন মহামারীতে এই অসাম্য বাড়বে বই কমবে না।
আচ্ছা আমাদের মূল বিষয়ে ফিরি। একটা মজার খবর দিয়ে নিই। ২০১১ সালে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবার গ্রাহ্যতা নিয়ে একটা কমিটি তৈরি হয়েছিল। গুজারাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এই কমিটির অধ্যক্ষ ছিলেন। তারা রিপোর্টে লিখেছিল, এম এস পির নিচে কোন বেচাকেনা হওয়াই উচিত না [7]।
লেখচিত্র - ১ - কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের বিতর্কিত টুইট
প্রচারের একটা যুদ্ধ চলছে। ন্যূনতম মূল্যর ব্যাপারে প্রচুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ র নির্বাচনের প্রচারে, ২০১৮ তে অরুণ জেটলির বাজেট ভাষণে বলা হয়েছিল, এই সব প্রতিশ্রুতি পালন হয়ে গেছে [8]।
যেটা বলছিলাম, সরকার পক্ষ থেকে একটা প্রচারযুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশ বিদেশের সরকারপক্ষের উচ্চপদস্থরা মিডিয়াতে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে এটা নাকি বড়লোক চাষিদের আন্দোলন। সারা দেশে কৃষক পরিবারের জাতীয় গড় আয় ৬৪২৬ টাকা [9]। প্রতি পরিবারে ৪-৫ জন লোক রয়েছেন। পাঞ্জাবে এটা ১০৮০০ টাকা। বিহারে এটা ৩০০০ টাকা মত। তো আমরা কি সকলে বিহারের গড়ে পৌছনোর প্রচেষ্টা করব?
লেখচিত্র ২- নাবার্ড এর ২০১৬-১৭ র পরিসংখ্যান অনুযায়ী কৃষির সংগে জড়িত পরিবারের রাজ্যভিত্তিক গড় আয় [10]
সুস্থবুদ্ধির শিক্ষাব্রতীরা, সচেতন মানুষরা যে যেখানে আছেন, এই বিষয় গুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে, যে যেভাবে পারেন এই প্রচারযুদ্ধের মোকাবিলা করুন। 'দেশ বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও' সমিতি গঠিত হওয়া উচিত। একদম মৌলিক কতগুলি দাবি থাকা উচিত।
ক - এই আইনগুলি প্রত্যাহার করতে হবে
খ - কৃষি সংকট আলোচনার জন্য লোকসভার বিশেষ অধিবেশন হওয়া উচিত
গ - বড় বড় কৃষিজাত পণ্যের কোম্পানিগুলির বিক্রয় সম্ভারের বয়কট অভিযান
ঘ - কৃষি ও কৃষকের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি
ঙ - স্থানীয় বিষয় সংক্রান্ত দাবি
আমি মনে করি, আন্দোলন এখনই গড়ে তোলা উচিত।
আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
পূর্ববর্তী বক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। অর্থনীতিবিদ হিসেবে সরাসরি আমার বক্তব্যে আসি। ভারতীয় কৃষি ধনতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ধনতন্ত্রের নিজস্ব যুক্তিটি কী?
যে ক্ষেত্রগুলিতে ধন বিনিয়োগের প্রয়োজন কম, সেই ক্ষেত্রগুলিতে লাভের হার কম হবে, আর যে ক্ষেত্রগুলিতে ধন বিনিয়োগের প্রয়োজন বেশি সেখানে লাভের হার বেশি হবে। আমি যদি কৃষিতে ১০০ টাকা বিনোয়োগ করি, যেহেতু কৃষিতে বিনিয়োগ করছি, লাভের হার বেশি হবে না। ধনতন্ত্রের ব্যবস্থার মধ্যে থাকা একটা দেশ, একটা সমাজ, এর সঙ্গে মোকাবিলা কী ভাবে করে? যদি বাজারে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকে, এবং দেশে গড় লাভের হার বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে কৃষির কম লাভের হার কিছুটা পুষিয়ে দেয় অন্য ব্যবসা, অন্য ক্ষেত্র। ধনতন্ত্রে শিল্প এবং কৃষির মধ্যে প্রতিযোগিতা সুসম নয়, এবং কখনোই, লাভের সাধারণ হার বলে দেশে কিছু নেই, তাই কৃষিক্ষেত্র সব সময়ে আর্থিক দিক থেকে চাপের মধ্যে থাকে, সেখানে লাভের হার কখনও বাড়ে না। তার ফলে কৃষি থেকে বিনিয়োগে সরে গেছে, যাচ্ছে শিল্পের দিকে। যেটা হচ্ছে, আমরা পরিভাষায় বলি - 'পারিশ্রমিক-দ্রব্য বিভেদ' [11]।
এবার ধরুন একটা দশার কথা ধরা যাক, যেখানে বিনিয়োগে প্রতিটি টাকা শিল্পে যাচ্ছে এবং কৃষিতে আদৌ বিনিয়োগ নেই। এর পরে এক ধরনের পরিবর্তনের তাগিদ তৈরি হয়, বিশেষ করে কৃষি যদি শিল্পের উপরে চাপ না তৈরি করতে পারে, শিল্পের থেকে কিছু বিনিয়োগ রাষ্ট্রের মাধ্যমে কৃষিতে এসে পৌঁছয়। রাষ্ট্র শিল্প থেকে নিয়োগ রাশি সংগ্রহ করে, কর ইত্যাদির মাধ্যমে, এবং ভরতুকি হিসেবে কৃষিতে বিনিয়োগ করে। ব্রিটেন, জার্মানি, আমেরিকায় এটাই ঘটেছে এবং ঘটছে। এর সরকারি উদ্দেশ্যটি হল, কৃষিতে লাভের হার বাড়ানো। জার্মানিতে ধরুন বিসমার্কের আমলে এটা ঘটানো হয়েছিল, একে বলা হত, "রাই এবং ইস্পাতের বিবাহ" [12]। ব্রিটেনে ইতিহাস রয়েছে, রিকার্ডোর কাজে যেটার উল্লেখ রয়েছে, সেই ভুট্টা আইন বাতিল" [13] ইত্যাদির ইতিহাসে আমি যাচ্ছি না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাসক / নীতি প্রণেতারা মেনে নিতে বাধ্য হন, শিল্পকেই কৃষির ভরতুকি নিশ্চিত করতে হবে।
আরেকটা তত্ত্ব আছে, তুলনামূলক সুবিধার যুক্তিতে, যে একটা দেশের শিল্পজাত দ্রব্যকে অন্য দেশের কৃষিজাত পণ্য আমদানিতে সহায়তা করবে। কোনো দেশই এই দ্বিতীয় কাজটা করতে চায় না, কারণ সকলেই খাদ্য সুরক্ষা চায়।
ইন্দিরা গান্ধীর আমলে, আমাদের দেশে, যখন ধনতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটছিল, এই বিষয়্টা তখনকার চিন্তা ভাবনায় উঠে এসেছিল। কৃষিকে ন্যায্য মূল্য দেবে কে? কে ভরতুকি দেবে, যাতে কৃষিতে বিনিয়োগ ফিরে আসে! ইন্দিরা সরকার ঠিক করেছিলেন রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। শিল্প থেকে কর সংগৃহীত হবে, কৃষিতে ভরতুকি দেওয়া হবে। সেটাই এই এপিএমসি, এমএসপি ইত্যাদির পেছনের ভাবনা।
লেখচিত্র ৩ - প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু গত ১৬ই জানুয়ারি ২০২১-এ ট্রেডভিস্টা সংস্থার সূত্র দিয়ে এই টুইটটি করেন
১৯৯০ এর দশকে এই চিন্তাটাকেই আক্রমণ করা হয়। নিও লিবেরাল অর্থনৈতিক ভাবনার কাঠামোর পক্ষ থেকে। বুদ্ধিজীবীরাও ভাবতে শুরু করেন, ভরতুকি কেন দেওয়া হবে? এটা সকলেই জানেন, তাও আরেকবার বলে নিই, কৃষি সর্বত্র ভরতুকি পেয়ে থাকে [14]। এবং সেটা না হলে, কৃষিতে কেউ বিনিয়োগ করবে না, কারণ কৃষিতে লাভের হার সর্বত্রই কম। এবং কৃষিতে বিনিয়োগ না এলে ন্যূনতম খাদ্য সুরক্ষা থাকবে না।
ইউ পি এ ওয়ান-এর সময় একটু অন্য ঘটনা ঘটে। একটা কৃষি কমিশন তৈরি হয়, এবং বিশদেই আলোচনা হয়। স্বামীনাথন কমিশন তাদের রিপোর্টে একটা এম এস পি র উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেন, কৃষিতে বিনিয়োগ যাতে একটা লাভের মুখ দেখতে পায়। মোদী সরকার কী ভাবে এই রিপোর্ট গ্রহণ করেছে, এবং কৃষির সঙ্গে জড়িত সকলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন আপনারা জানেন। তাহলে প্রশ্নটা এসে দাঁড়াচ্ছে, কৃষি যদি ভরতুকি না পায়, কৃষি টিকবে কি করে? এই নতুন আইনগুলি আমাদের কতগুলি কঠিন পরিস্থিতির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। ভরতুকি না থাকলে, কৃষিতে ন্যূনতম লাভ, বিনিয়োগের কোনও উদ্দেশ্য চরিতার্থ হওয়ার উপায় থাকবে না, কৃষি আমাদের অর্থনীতিকে যে ভারসাম্য প্রদান করে থাকে, সেটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে। খুব অল্প অংশের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে এই ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। রেশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, খাদ্য সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি মাঝে মাধ্যেই দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাও থাকছে।
অতএব মানুষকে বোঝাতেই হবে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিল্প ও কৃষির মধ্যেকার অসম প্রতিযোগিতায়, কৃষিতে সব সময়েই ভরতুকি প্রয়োজন, আপনার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যর বিষয়্টিতেই জোর দিন। মাণ্ডির বাইরেও ক্রয় বিক্রয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পালনের বাধ্যবাধকতাও থাকা জরুরি। এই ভরতুকি শিল্পকেই দিতে হবে। রাষ্ট্রকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গুরুচন্ডা৯ সম্পাদকমন্ডলী ও বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্তকে ধন্যবাদ অগ্রাধিকার দিয়ে এই কাজ করবার জন্য।
এবারের কিস্তিটি অনেক গ্রে এরিয়া কভার করেছে।
কি মতামত দেয়া যায়? সাইনাথের আইনের কিছু গ্রে এরিয়া নিয়ে ভিন্ন মতামত আছে, সার্বিক আইন নিয়ে নেই। রতন খাসনবিশ কি বলতে চেয়েছেন, সেটা জটিল জার্গন থেকে উদ্ধার করতে পারলাম না।
তবে, নাসা সায়েন্টিস্ট আর এক্লেইমড সিনেমা মেকার বেদব্রত পাইনের লেখা টেখা পড়ার পর।...
.এমএসপি, ২৩ টাতে। দুধ, পোল্ট্রিতে এমএসপি নেই, এবং এগুলো বহুজাতিক বজ্জাতদের নিগড়ে। ২৩ + ২ = ২৫ ধরে নেই? নাকি বাজরা বাদ দেব? যাকগে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ৩০টা ধরে নেই।
এখন কোনো এক মহাজাগতিক বর্ষে (নিশ্চিন্ত থাকুন, এরকম কোনো দিন আগেও আসেনি, পরেও আসবেনা) যবের অত্যধিক উৎপাদন হয়ে গেল, সেটা এমএসপির নীচে কেনা যাবে না।
তখন কে কিনবেন? পুঁজিবাদীরা? সরকার? না বোধিসত্ব দাসগুপ্ত? না রতন খাসনবিশ? সাইনাথকে সেই ড্রট থেকে চিনি, ওনাকে ধরছি না।
২৭ মার্চ ২০২১ ০১:৪৪ প্রশ্নটা বোঝা গেলনা। চাষী যদি সমান পয়সা ইনভেস্ট করে কোনো বছর বেশি যব উৎপাদন করে, তাতে এমএসপিতে যতটা ডিমান্ড বেচে বাকিটা নষ্ট করলেও, অন্তত চাষীর ক্ষতি হবেনা সেটা নিশ্চিত করা যাবে। ডিমান্ড ত একই থাকবে কারন যারা কিনবে, যেখান থেকেই কিনুক, তাদের এমএসপিতেই কিনতে হবে।