শমীক লাহিড়ী পরিচিত সিপিআইএম নেতা। তাঁর দলের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা কমিটির সম্পাদক। টেলিভিশন মিডিয়ায় নিয়মিত আমন্ত্রণ পাওয়া দলীয় মুখ না হলেও, দলের তরুণ সমর্থকদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার কথা, সমর্থক মহলে তাঁর পড়াশুনোয় আগ্রহের কথা সুবিদিত। সাংসদ হিসেবেও অতীতে কাজ করেছেন। কৃষি ও শ্রম আইন প্রসঙ্গে সিপিআইএম এর পুস্তিকা গুলির রচয়িতা হিসেবে তাঁর নাম আমরা পাচ্ছি। এবং পাচ্ছি দলের ওয়েবসাইটে অসংখ্য স্বাক্ষরিত লেখা। তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিসংগত কথা বলার, সমাজ মাধ্যমে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে তাঁর সুনাম রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সপ্তাহে শমীকের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে, কয়েকবার ফোনে, একবার সামনা সামনি। হালকা চালেই কথা হয়েছে, খুব পেশাদারি সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। শমীকও মোটামুটি নানা ব্যস্ততার মধ্যে, ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনেছেন, এবং নিজের কথা বলেছেন, বা সমাজ মাধ্যমে বা পার্টির পুস্তিকায় তাঁর পুরোনো লেখা আমায় পড়তে দিয়েছেন। শমীকের দেওয়া অন্য তথ্য সূত্র তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়েছে। অনুলিখিত বক্তব্য প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
অনুলিখনের জন্য, বিশেষত আলোচ্য বিষয়ের টীকা আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সহযোগিতা পেলে টীকা পরিবর্ধন করা হতে পারে।
অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের সাহায্য ছাড়া এই সাক্ষাৎকার সম্ভব হত না। নন্দিনীকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
বোধিসত্ত্ব: কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম প্রশ্ন, কারা আন্দোলন করছেন?
শমীক লাহিড়ী: কেউ একা করছেন না, কোন একটা সংগঠন একা করছেন না, অনেকে মিলে করছেন, সেটাই এই পর্বের আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য। সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমিতির নিজের, কৃষক সভার আলাদা, এছাড়া সংযুক্ত কৃষক মোর্চার এদের সব ওয়েবসাইট আছে [1], ফেসবুক, কারো কারো বোধ হয় ইউ টিউব চ্যানেল সবই আছে। সেখানে একটু খুঁজলে পাবেন কারা ওঁদের সমর্থন করছেন। কী ভাবে কী শর্তে করছেন। কোথায় করছেন। যেটুকু বলার, এটা বেড়ে চলেছে, একে ঠেকানোর ক্ষমতা কারো নেই। দেখুন আমাদের বড় একটা দেশ, নানা জায়গায় নানা রকম ভাবে আন্দোলন হবে এতে অবাক হওয়ার কী আছে! আমরা এমন একটা ছোটো দেশ নই, যে দু ঘন্টায় রাজধানী পৌছবো। ওঁরা ২৭ নভেম্বর থেকে আন্দোলন আরম্ভ করেছেন। তার আগে ওঁদের এটা গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল, দিল্লিতে আন্দোলন করবেন আশে পাশের রাজ্যের কৃষকরা, আর বাকিরা নিজেদের রাজ্যে আন্দোলন করবেন। নিজেদের মত করে করবেন। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশেরর কৃষকরা সেটা করছেন। শুধু যদি পাঞ্জাবের আন্দোলনই হবে, তাহলে রাজস্থান আর হরিয়ানার রাস্তা বন্ধ কেন? শুধু যদি হরিয়ানার আন্দোলন হবে, উত্তরপ্রদেশে অত বড় বড় মহাপঞ্চায়েত সমাবেশ হচ্ছে কী করে! এরা বিজেপি কে কদিন আগে ভোট দিয়েছেন, আজ সেই আন্দোলন কারী দের ক্রোধের সামনে পড়ে, বিজেপি বিধায়কদের আলাদা করে বিশেষ নিরাপত্তা চাইতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। গোটা ভারতের কৃষি কর্পোরেট কোম্পানির হাতে দেওয়া হবে, আর কৃষকরা বসে থাকবেন সেসব হয় না।
আচ্ছা বলুন তো, আইন তৈরি হল ২০২০ সেপ্টেম্বরে, পানিপথে দু বছর আগে থেকে খাদ্য শস্যের ভাণ্ডার কী করে আদানি তৈরি করে, এরা বিনিয়োগ করার সাহস কার ইশারায় করছেন, কাদের কাছ থেকে নীতি বিষয়ে কী আগাম ইংগিত পাচ্ছেন? কী করে ভারতীয় রেল, সেখানে রেলওয়ে সংযোগ দিচ্ছে? এটা তো সম্পূর্ণ বে আইনি। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে পাঁচ লক্ষ মেট্রিক টনের শস্যভরতি গুদাম আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিন লক্ষ মেট্রিক টন, রাজ্যের অধীনের ফুড কর্পোরেশন তুলে দিয়েছে আদানির হাতে। এটা মধ্য প্রদেশে ঘটেছে। অর্থাৎ প্রায় আট লক্ষ মেট্রিক টন মজুত ও মজুতের ক্ষমতা তাদের দখলে। আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা তুলে দিচ্ছি কর্পোরেটের হাতে। এটা কেউ করে, সাধারণ বুদ্ধি কী বলে?
বোধিসত্ত্ব: গত বছরের সেপ্টেম্বরে আনা কোন আইনগুলোর কেন বিরোধিতা করা হচ্ছে? [2]
শমীক লাহিড়ী: স্পেসিফিকালি বলার আগে দুটো কথা বলে নেই, সাধারণ ভাবে বামপন্থীদের অবস্থান হল -
এক - আমরা বিভিন্ন রাজ্যের কৃষি আইন ও দেখছি, এবং যেখানে মনে করছি প্রতিবাদ করা দরকার সেখানে প্রতিবাদ করছি। আমরা মানে সেখানকার বামপন্থীরা করছেন। এবং এটাও আপনাকে স্বীকার করতে হবে, কারণ বাস্তব তাই বলছে, বিভিন্ন বিজেপি বা তার এনডিএ-র বন্ধুদের শাসিত রাজ্যে, এবং আমাদের রাজ্যে কৃষিজাত দ্রব্যের বিপণন সম্পর্কে কৃষক বিরোধী আইন অনেক দিন ধরেই আনা হচ্ছে। মিডিয়ার সাহায্যে সম্ভবত রেখে ঢেকে চলছিল, শাসকের আর পুঁজির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবার একেবারে বে আব্রু হয়ে পড়েছে, এই কেন্দ্রীয় আইনগুলিতে।
দুই - আমরা শ্রম আইনের পরিবর্তনগুলি ও কৃষিপণ্য সংক্রান্ত মানুষের স্বার্থবিরোধী আইনকে সাংঘাতিক আলাদা বিষয় হিসেবে দেখছি না। স্বল্প সময়ের মধ্যে দেখবেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির পক্ষে আমাদের বইয়ে আমরা দুটো বিষয় সংযুক্ত করে আলোচনা করেছি।
আমরা কোন আইন কেন বিরোধিতা করছি, একদম সংক্ষেপে বলছি।
কৃষি 'রিফর্ম' যেসব আইনকে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (সংশোধন), ২০২০ খুবই আপত্তিকর এবং সন্দেহজনক। মজুতদারি , মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা করপোরেট এর হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া কোন উদ্দেশ্য নেই। ন্যূনতম মূল্যে কেন্দ্রীয় সরকারি শস্য ক্রয় ক্রমশ কমানো ছাড়া আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। হিন্দুস্থান টাইমসে রোশন কিশোর এর প্রবন্ধটি পড়লে দেখবেন, উনি বলছেন, এই আইনের সমর্থনে দুটি কথা বলা হয়েছে, প্রথমত আমাদের আর খাদ্যাভাব নেই, দ্বিতীয়ত নিত্য প্রয়োজনীয় আইনে এই সংশোধন আনলে কৃষক এর ফসল বিক্রির স্বাধীনতা নাকি বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন বাড়লেই, খাদ্য রফতানি বাড়লেই খাদ্য নিরাপত্তা বেড়েছে তার কোন প্রমাণ নেই। সরকার প্রমাণ দিতে পারছে না। দ্বিতীয় কথা হল, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমির হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১১ থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ১২০ মাসে, শস্যের দাম ৫০% মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ বার, আর পচনশীল পেঁয়াজ,আলু , টমেটো সহ তরি তরকারির ১০০% মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ২১ বার, এর ভিত্তিতে কি এত বড় পরিবর্তন আনা উচিত? অথচ ঊর্ধ্বসীমার নীচের বহু পরিবর্তন সরকার গণ্যই করছে না। আবার উল্টো দিকে নির্বাচনের ফল উল্টোতে পারে এই ভয়ে কখনো কখনো হস্তক্ষেপ করছে। এটা কোন দীর্ঘমেয়াদী নীতি হল? অন্যদিকে কিশোরই বলছেন, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের তথ্য দেখিয়ে বলছেন, ২০১২-২০২০ সময়কালে, ৩১ টি শস্যের মধ্যে মাত্র দুটি শস্যে এপিএমসি মান্ডি, তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাবসাগুলির তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে ক্রয় করেছে, অর্থাৎ এপিএমসি এমনি ই দুর্বল। তাকে তুলে দেবার চক্রান্ত চলছে।
সত্যি কথা বলতে কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই উদ্দেশ্যেই বাকি তিনটে আইনের সংশোধন। কৃষিপণ্য বিপণন ও বাণিজ্য আইন (প্রসার ও সুবিধার্থ), ২০২০ টিতে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, যে কোনও ব্যক্তি যার প্যান কার্ড আছে, যে কোনও ধরনের ব্যাবসায়িক কোম্পানি, তারা বাণিজ্য করতে পারবে। ইকমার্স ট্রেডিং করতে পারবে। কৃষকরা, কৃষি শ্রমিকরা, ভাগ চাষিরা, ই কমার্স ট্রেডিংয়ে খুব দক্ষ হবেন বলে মনে হয়? আজগুবি কথা। কিছুই না, ঐ এফ পি ও বলে যে সংস্থাগুলি তৈরি করা হচ্ছে, তাদের সুবিধের জন্য এসব আইন। সরাসরি ফাটকা স্পেকুলেটিভ কারবারের পদ্ধতি কে নিয়ে আসা হচ্ছে কৃষকের জীবনের বাঁচার পদ্ধতি হিসেবে। এবং এটাকে বলা হচ্ছে কৃষকের স্বাধীনতা। সত্যিই আশ্চর্য্য রসিকতা। এটিকেই কৃষি অর্থনীতিবিদ সুধা নারায়ণ বলেছেন 'এপিএমসি বাইপাস আইন' বা মান্ডি পরিহার আইন [3]।
কৃষক (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) আইন ২০২০, আইনটি আসলে একটি সম্পূর্ণ অসম ব্যবস্থায় কৃষককে চুক্তি চাষের ঘেরাটোপে নিয়ে আসতে বলছে। কৃষির সঙ্গে জড়িত কৃষক কী প্রতিযোগিতার মুখে পড়বেন, আর কাদের জেতানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা সহজেই অনুমেয়। আর্থিক ক্ষতি হলে জমি বিক্রয়ে বাধ্য হতে পারেন কৃষক, সেই আশংকাও থেকে যাচ্ছে, সারা বিশ্বে চুক্তি চাষে ক্ষুদ্র মাঝারি এমনকি বড় চাষির ও ভরতুকিহীন অবস্থায় খুব উপকার হয়েছে, এরকম কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। পরিষ্কার কথা হল, পেপসিকো, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স ফ্রেশ, আদানি ইত্যাদি দৈত্যাকৃতি কোম্পানি, একজন ব্যক্তি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনবে না। কিনবে হোরডারদের কাছ থেকে, চুক্তি চাষের যেসব ব্যবস্থা আনা হচ্ছে, তাতে পরিষ্কার, এই নতুন বিপণন আইন কথিত স্বাধীনতা কৃষকের না, লগ্নি পুঁজির স্বাধীনতা।
প্রথম আইনটির (দ্য ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন ) অ্যাক্ট, 2020) তৃতীয় পরিচ্ছেদ এর ৮ এর ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে হচ্ছে, বিপণন, চুক্তি চাষ ইত্যাদির বিচার করবে সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারী। অত্যন্ত বিপজ্জনক বিষয়। কৃষক বিচার ব্যবস্থার কাছে যেতে পারবে কিনা বোঝা যাচ্ছে, যে দেশে আইন বলে আপনি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন, সে দেশে কৃষককে তার উৎপাদিত শস্যের বিপণনের সমস্যা মেটাতে বলা হচ্ছে স্বল্প ক্ষমতার সরকারি কর্মচারীর কাছে। আশ্চর্য্য বদ রসিকতা।
বিদ্যুৎ আইন সংশোধন করা হচ্ছে বিদ্যুৎ বণ্টনের ব্যাবসাটি সম্পূর্ণ কর্পোরেট এর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, এবং ভরতুকির বারোটা বাজানোর উদ্দেশ্যে।
বুঝতেই পারছেন, এই পরিসরে দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব না, শুধু এটুকুই বলছি, আইনগুলি পড়লেই বোঝা যাবে, কৃষকরা কেন সঠিক ভাবেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। আপনাদের সচেতন নাগরিক পাঠকদের মধ্যে আইন বিশেষজ্ঞরা পড়ে দেখে নিজেরাই বিচার করুন, এ তো শুধু রাজনৈতিক অবস্থানের প্রশ্ন না।
বোধিসত্ত্ব: এম এস পি সম্পর্কে বলা হয়, এটার কোন আইনি ভিত্তি নেই। এম এস পি, এপিএমসি , সরকারি শস্য ক্রয়, কী পরিবর্তন চাওয়া হচ্ছে একটু বলবেন?
শমীক লাহিড়ী: এম এস পি সম্পর্কে বলা হয়, এটার কোন আইনি ভিত্তি নেই। হ্যাঁ নেই, শুধুই ফসলের মরশুমের ঘোষণা এর ভিত্তি। তো আইন করতে তো কেউ বারণ করে নি। ২০১৮ তে এর দাবিতেই ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। পাঞ্জাবে এম এস পির আইনি স্বীকৃতির একটা ব্যবস্থা হয়েছে।
দেখুন ঐতিহাসিক ভাবেই, কৃষি বিষয়টা একেক জায়গায় একেকরকম। বড় দেশে এটাই স্বাভাবিক। এত বড় দেশ, এত নদী, এত দিন ধরে কৃষি হচ্ছে, বিভিন্নতা, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তো থাকবেই। আপনার কি মনে হয় এই আইনে সেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য খুব রক্ষা করা হবে? জমির ধরন, কৃষির ধরন, জমি মালিকানার ধারণ, জমি সংক্রান্ত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, কৃষিজাত দ্রব্যের বিপণন, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া সবই নানা অঞ্চলে নানা রকম। উত্তর ভারত একরকম, দক্ষিণ ভারত একরকম, পূর্বাঞ্চল একরকম, তার প্রচুর স্থানীয় বৈচিত্র্য রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র আধুনিক সময়ের ঢের আগে থেকে কৃষি হচ্ছে।
ঠিক কথা সর্বত্র এপিএমসি নেই। বা যা আছে তাতে সমস্যা নেই, সেরকম কেউ দাবিও করে নি। কিন্তু তার সমাধান তো এই আইন না। রক্ষাকবচ বাড়াতে কে বারণ করেছে! [4]
সর্বত্র মার্কেট কমিটি করতে বা অন্য ভাবে ন্যূনতম মূল্যে শস্য ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে কে বারণ করেছে? প্রচুর উৎপাদনকে আধুনিক বিপণনের যুক্তি হিসেবে দেখানো হবে, একই সঙ্গে মানুষের খাদ্য সুরক্ষা, অভুক্ত মানুষের ক্ষুধার ব্যাপারে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকার অসহায়তা প্রকাশ করবে, এ কি মানা যায় নাকি!
বিহার ও কেরালার উদাহরণ দেওয়া হয়, পরিস্থিতি দু জায়গায় ঠিক দু রকম। বিহারে ২০০৬ এ আইনের বদলের পর থেকে ন্যূনতম মূল্য কৃষকরা পান না। কেরালায় প্রতিটি কৃষি বিপণন সংক্রান্ত সমস্যায় হস্তক্ষেপ করে [5]।
বোধিসত্ত্ব: চুক্তিচাষে আপনাদের আপত্তি ঠিক কোথায়?
শমীক লাহিড়ী: আমি বিশেষ জোর দিতে চাই চুক্তি চাষের বিষয়টিতে, এটার গুরুত্ব আপনারা শিক্ষিত মানুষ, একেবারে চট করে ধরে ফেলতে পারবেন। চুক্তি চাষ শুধু না, চুক্তি চাষের যেসব আইনি কাঠামো তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, এক কথায় তা ভয়ঙ্কর। কৃষক আদালত যেতে পারবে না, তহশীল দার, এসডিও, বিডিও, কালেকটর, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে অভিযোগ করে, সমস্যা মেটার আশা করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কমানো হচ্ছে। সংবিধান যে বিচার চাইবার কাঠামো দিয়েছে প্রতিটি নাগরিককে, সেটা নষ্ট করার পরিকল্পনা করছে এই সরকার, শুধু তাদের কর্পোরেট বন্ধু দের সাহায্যার্থে। যদি চুক্তি কৃষক না মানে, কর্পোরেট জমি কেড়ে নিতে পারবে। সরকারের যা ক্ষমতা নেই, সেই ক্ষমতা কর্পোরেট দের দেওয়া হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে, সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে ছটা হিয়ারিং লাগে। তার পরেও জমির মালিকের ক্ষমতা থাকে কোর্টের কাছে যাওয়ার।
আরো বিষয় আছে, কৃষি শ্রমিকের জন্য কোন ভাবনাই এইসব আইনে নেই। যেন তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ক্ষেত মজুরের, দিন মজুরের অধিকার কি থাকবে? স্বাধীন ভাবে তার কাজ খোঁজার ক্ষমতা থাকবে কিনা কিছু লেখা নেই। ক্রীতদাস বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সম্ভবত। এক দিক থেকে কৃষির ইনডাসট্রিয়ালাইজেশন, কর্পোরেটাইজেশন করা হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিক অধিকারহীন দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ব্যবস্থাটাকে।
আমাদের এদিকে বড় চাষিদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট কিসান ইউনিয়ন ঐতিহাসিক ভাবে নেই। কৃষক সংঘর্ষ সমিতি কিন্তু সব ধরনের কৃষককে এক জায়গায় আনার প্রচেষ্টা করছে। আন্দোলন হলে কেউ ট্রাকটর এ আসছে কেউ পায়ে হেঁটে আসবে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যে তিনদিনের কৃষক দের ধরনা দেখলাম, তারা তো অধিকাংশ দিন মজুর, ক্ষেত মজুর। তামিলনাদু তে বিধান সভা অভিযান হল, সেটা তো ক্ষুদ্র চাষিদের আন্দোলন। এবারেই দেখুন না, রাজস্থান থেকে কিন্তু অত ট্রাকটর আসে নি, লোকে অন্য যে ভাবে পারে এসেছে। অন্ধ্রে গোটা লড়াইটাই ক্ষেত মজুরদের সঙ্গে হচ্ছে।
বোধিসত্ত্ব: আমাদের রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল, তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের এই বিষয়ে অবস্থান কী, সে বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
শমীক লাহিড়ী: প্রথমে আপনাকে দেখতে হবে আইনি কাঠামো টা কী ছিল, তার পরে কী ব্যবস্থা চলছিল, আর তৃণমূল সরকার কী পরিবর্তন, কেন এনেছে। তার নীতির অভিমুখ কী। আইনগুলি এরকম।
The West Bengal Agricultural Produce Markleting (Regulation) Act, 1972.
The West Bengal Agricultural Produce Markleting (Regulation) Rules, 1982.
The West Bengal Agricultural Produce Markleting (Regulation)(Amendment) Act, 2014.
The West Bengal Agricultural Produce Markleting (Regulation)(Amendment) Act, 2017.
The West Bengal Agricultural Produce Markleting (Regulation) Rule Ammendment, 2020
আমরা আশ্চর্য নই, ২০১৪ র আইনটিতে কৃষি বিপণনে, এমনকি রপ্তানি তে সরাসরি অংশগ্রহণ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে কোম্পানিগুলিকে (সেকশন - ২, ক্লজ ৩) তাদের কৃষির সংগে যুক্ত থাকার কোন প্রাথমিক শর্ত নেই। কমিশন এজেন্ট নিয়োগ করার অধিকারও দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ দালালি ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমরা মনেই করি না, আজকের কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরোধিতা করার কোন নৈতিক অধিকার তৃণমূলের আছে। আর বিরোধিতা করতে গেলে তাঁদের আনা আইন সংশোধন করতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। এই আইনে কোথাও বলাই নেই, ন্যূনতম মূল্যে শস্য ক্রয় করতে এই কোম্পানি গুলি বাধ্য হবে। কেন্দ্রীয় আইনের সংগে আশ্চর্য মিল। ২০০৩ সালেই এই ধরনের একটি আইনের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। বস্তুতপক্ষে ২০১৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা কার্যকর করেন। ক্ষমতায় এসে কো অপারেটিভ আইনে যা পরিবর্তন আনেন, তাতে কৃষক বিরোধী স্বার্থের পক্ষে কো অপারেটিভ দখল করা সোজা হয়ে যায়, এবং অন্য আইনগুলিতে যেটা বলছিলাম, সবচেয়ে বড় কথা কৃষির সংগে যোগাযোগহীন মানুষের পক্ষেও, সরাসরি ক্রয়ে অংশ্রগ্রহণ করাতে আর আসুবিধে নেই। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে প্রায় ২০০০০ কো অপারেটিভ বন্ধ হওয়ার অবস্থায় রয়েছে, এটা তিনি করেছিলেন ২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় মডেল আইনের প্রস্তাব অনুসারে [6]।
পশ্চিমবঙ্গে এপিএমসি সক্রিয় ছিল না। ১৯৭২ সালে একটা সরকারি ক্রয়ের ব্যাপারে আইন করা হয়েছিল, সেটা তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার কতটা আন্তরিক ভাবে প্রণয়ন করেছিল সেটা বড় প্রশ্ন [7]। বামফ্রন্টের আমলে কৃষক কো অপারেটিভ বেশি সক্রিয় করা হয়। তারা কিনত, কিনে সরকারকে দিত। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও করত, কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন ছিল না, বিষয়টা সমস্যাহীন ছিল এরকম দাবি আমরা করছি না। কিন্তু উৎপাদকের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ তুলে দিলে সমস্যার সমাধান হবে এই ধারণাও ছিল না।
আমাদের রাজ্যে এপিএমসি নেই, সরকারি নিয়ন্ত্রণে শস্য ক্রয় করা হয় [8]। কিন্তু এর ব্যাপকতা কমেছে, বাম আমলে প্রচুর কো অপারেটিভ ছিল, তারা কেনা বেচা করত, প্রতিযোগিতা করত, এখন তাদের সংখ্যা ও ক্ষমতা দুইই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। নানা বিধি নিষেধ নেমে এসেছে। মজাটা হল, আপনি সরকারি তথ্যে পাবেন, সব মিলিয়ে বেশি শস্য ক্রয় করা হয়েছে [9], আগের বছর গুলির তুলনায়, কিন্তু ক্রয়ের পদ্ধতিটি বেশি কেন্দ্রানুগ হয়ে ওঠায়, এর সুফল কৃষকের হাতে পৌছনোর আইনি ব্যবস্থাই আপাতত দুর্বল বা অনুপস্থিত।
লেখচিত্র - ১: পশ্চিমবঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণে শস্যক্রয় ব্যবস্থা, কৃষকের অভিজ্ঞতা
আমাদের কৃষক দের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাটা কী। ধরুন বিক্রি করতে গেলেন [10], আপনার কাছে জমির কাগজ চাওয়া হবে, তো যারা অলিখিত চুক্তির 'জমা চাষ' করে, অন্যের জমিতে চাষ করে, তারা সেই কাগজ দেবে কী করে, জোগাড় করে দিলেও তো চেক পাবে অন্যের নামে, সে টাকা তাদের হাতে পৌছবে কিনা কোন গ্যারান্টি আছে? অথচ মজা হল কৃষির সঙ্গে যুক্ত নন এরকম লোক এই কাজ করতে পারবেন, বাজার থেকে ধান কিনে সরকার কে দিতে পারবেন। ধরা যাক সরকার ১৮৬৮ টাকা দর ধরলো। ফড়েরা ১৩০০ টাকা দরে কিনছেন, সরকারকে ১৮৬৮ টাকা দরে বেচছেন, মোটামুটি ভাবে কুইন্টাল প্রতি পাঁচশো টাকার পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। অথচ কৃষকরা সেটা পাচ্ছেন না, দামটা পাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা, আর সেটাকেই কৃষকের জন্য খরচ করা হচ্ছে বলে দেখানো হচ্ছে। সারা রাজ্যে মাত্র ৫২টা কো অপারেটিভ রয়েছে যাদের মাধ্যমে প্রোকিওরমেন্ট হচ্ছে, আর গোটা রাজ্যে ৭৯ জনএগ্রিগেটর (মূলত চাল কল মালিক) আছে যাদের কাছ থেকে সরকার কিনছে।
দেখুন বাজারে একটা কিছু চলছে, সরকার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও করতে পারছেনা, এ এক জিনিস, কিন্তু আইন করে, অর্ডার করে, একটা বিস্তৃত ব্যবস্থার বদলে, কেন্দ্রানুগ ব্যবস্থা তৈরি করছে, এটা খুব ই অদ্ভুত। আপনাদের মনে এই প্রশ্ন ওঠা উচিত। আগে লোকে পাটে বা ধানে এজেন্সির কাজটা করতে নাম ভাঁড়িয়ে, এখন সগর্বে ঘোষণা করছে, আমার কৃষি র সংগে যোগাযোগ নেই, আমি শুধুই বেচা কেনা করতে এসেছি এবং সরকারি প্রক্রিয়া সেটাকে মান্যতা দিচ্ছে। আমাদের আশংকা হল পেঁয়াজ, রসুন, সর্ষের ক্ষেত্রে যেমন ডিসস্ট্রেস সেলটা বার বার হচ্ছে নতুন করে, সেটা বোরো ধানে এবার জেঁকে বসবে। মজাটা হল, নতুন কেন্দ্রীয় আইনে আরেকটা যেটা ঘটবে, আজকে যাদের ফড়ে দালাল বলছি, তাঁরাও কিন্তু আরো বড় কর্পোরেটের সাপ্লাই চেনের অংশ হয়ে উঠবেন মাত্র। ঠিক উল্টো চিত্রটা পাবেন কেরালায়, সেখানে সরকার নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করছে, স্বামীনাথন কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী দাম দিচ্ছে, কী কী কিনবে তার তালিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। নীতির অভিমুখের পার্থক্যটা আপনাকে বুঝে নিতে হবে।
কৃষক যে কম দাম পাবে, সেটাকে শুধু তার বিপদ হিসেবে দেখাটাই ভুল। সরষের তেলের দাম, বড় রিটেল প্লেয়াররা যেরকম দাম ঠিক করে দিচ্ছে, সেরকম ই চলছে। এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট এর তালিকা হ্রাস হবার ফলে ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স বস্তুটা সরকারি কর্মচারীরা কিসের ভিত্তিতে পাবেন? সেটি উবে যাবে না এরকম কোন গ্যারান্টি নেই। খাদ্য সুরক্ষা কি শুধু ফসল উৎপাদকের লাগে?
বোধিসত্ত্ব: কৃষি আইন এবং অন্যান্য ক্ষেত্র নিয়ে যদি বলেন
শমীক লাহিড়ী: যাঁরা বলছেন এটা শুধু বড় কৃষকদের আন্দোলন, যাঁদের দরদ উথলে উঠছে ছোট কৃষকের জন্য, তাঁরা মহারাষ্ট্রের রাজস্থানের আন্দোলন নিয়ে, অন্ধ্রের আন্দোলন নিয়ে, তামিল নাদুর আন্দোলন নিয়ে কী অবস্থানে? কৃষকরা আজ আন্দোলন করছেন বলে হঠাৎ যাঁদের ছোটো কৃষকের কথা মনে পড়ছে, তাঁরা শিল্পক্ষেত্রে কী করেছেন! স্মল স্কেল কোম্পানির সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছেন, যাতে বেশি লোককে সাহায্য করতে না হয়, কপর্দকহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা যে কোন সচেতন মানুষকে ধাক্কা দেবে।
দেখুন আমাদের অনেকে সমালোচনা করেন, আমরা নাকি স্পেসিফিক নই, আমরা বিভিন্ন বিষয়ে এক সঙ্গে তুলে ধরি। আসলে সরাসরিই বলছি, সংযোগ গুলো কিন্তু আমরা স্থাপন করছি না। কৃষি আইনেই ভয়ংকর সংশোধন যে সময়ে আনা হয়েছে, সেই সময়েই আনা হয়েছে শ্রম আইনে ভয়ানক শ্রমিকবিরোধী সব সংশোধন [10]। এবং দেশের গরিব, কর্মী মানুষ ও তাঁদের পরিবারের উপরে সরাসরি আক্রমণ শানানো হচ্ছে। তাঁদের কাজের, ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। অবশ্যই ৯৪ বছর আগে তৈরি আইনের সংশোধন দরকার, কিন্তু আপনাকে আমি কয়েকটা উদা হরণ দিলেই বুঝতে পারবেন, কা ঘটছেন, তৈরি করা সমস্যাটি কত গভীর।
বলা হচ্ছে ১৭৮ টাকা নাকি ন্যূনতম মজুরি হবে, কেন, তার কী ভিত্তি কিছু বলা হয় নি, আগে যা ছিল তার চেয়ে দু টাকা বেশি। ১৯৪৮-এ তৈরি আইনে বলা হয়েছিল, শুধু মজুরি না, শ্রমিকের স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৫৭ র শ্রম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং অন্যান্য অত্যাবশকীয় খরচের হিসেব আনা দরকার ন্যূনতম মজুরির নির্ধারণ প্রক্রিয়ায়। ১৯৮২ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা, উৎসবকালীন বিনোদনের কথাও গণ্য করতে হবে। ১৯৯২ সালে রাপ্টাকোস ব্রেট [11] মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলে, মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে, সমগ্র পরিবারের পুষ্টি, বস্ত্র, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বৃদ্ধ বয়সে জীবন যাপনের খরচ ইত্যাদি আনতে হবে। নতুন শ্রম আইন কোড টি তে এসবের বালাই নাই।
দ্বিতীয়ত ভয়ানক বিষয় হল রাজ্য গুলিকে কেন্দ্রীয় ন্যূনতম মজুরির থেকে কম ন্যূনতম মজুরি স্থির করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য গুলির মধ্যে মজুরি কমানোর প্রতিযোগিতা শুরু হবে।
মজুরি পরিদর্শক, যার কিনা অন্তত অনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ছিল কেউ সঠিক মজুরি না দিলে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার, তাকে বানানো হচ্ছে মজুরি উপদেষ্টা (ফেসিলিটেটর)। আইন ভঙ্গকারী মালিক পক্ষের ফৌজদারি মামলার আর ভয় থাকছে না।
সময় ভিত্তিক শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাতেও এদের এখনই অনেক কম রোজগার। এখন বলা হচ্ছে কাউকে স্থায়ী নিয়োগপত্র না দিয়েই এক বছর কাজে নিয়োগ করা যাবে। বলা হচ্ছে স্থায়ী শ্রমিকদের মতই নাকি মজুরি হবে, এটা বাস্তবে কার্যকর কতটা হবে সন্দেহ আছে।
১৯৪৭ সালের ইনডাস্ট্রিয়াল ডিসপুট আইনের পঞ্চম অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়া হয়েছে, এর ফলে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার আইনি শক্তি অনেকটা খর্ব হবে, শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে।
পি এফ, গ্রাচুইটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ছিল, বড় প্রতিষ্ঠান এগুলি অমান্য করার সাহস পেত না, কারণ অমান্য করলে ফৌজদারি মামলা করা যেত। এখন মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিলেই চলবে, শ্রমিকের কোটি কোটি টাকা প্রাপ্য না মেটানোর প্রবণতা বাড়বে।
আপনার মত কী জানি না, তবে সার্বিক বিরোধিতা ছাড়া আর কোন রাস্তা , কৃষকরা অন্তত দেখছেন না, সারা দেশ জুড়েই দেখছেন না। এবং এই কথাটাও আপনাকে বুঝতে হবে, আমরা যাঁদের অসংগঠিত শ্রমিক বলি, তাঁরা কিন্তু অনেকেই কৃষির সঙ্গে পারিবারিক ভাবে যুক্ত, সুতরাং পরিবারগুলির দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলি খুব আলাদা কোন বিষয় না।
বোধিসত্ত্ব: সার, কীটনাশক ব্যবহার, অত্যধিক ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার, উচ্চ ফলনশীল জাতের খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে এই সমালোচনাগুলি আসছে। আপনারা কী ভাবে দেখছেন?
শমীক লাহিড়ী: দেখুন এই বিষয়ে আপনাদের আগ্রহ থাকলে সরাসরি পরিবেশবিদদের সঙ্গে কথা বলুন।
আমি সাধারণ ভাবে বলতে পারি, এই আইন আর যাই হোক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আনা হয়নি, অর্থাৎ এই যুক্তিতে যাঁরা সরকারের হয়ে সওয়াল করছেন, তাঁদের অবস্থান হাস্যকর। আমি এটুকুতেই খুশি, যে পরিবেশবিদ রা আমাদের শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে অবস্থানের সমালোচনা করেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা গণতন্ত্রপ্রেমী এবং বিবেকবান তাঁরা প্রত্যেকেই এই প্রসঙ্গে আন্দোলনকারী কৃষকদের সঙ্গে রয়েছেন। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন, আমরাও শেখার চেষ্টা করছি।
বোধিসত্ত্ব: সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
শমীকের দেওয়া তথ্যসূত্রগুলি
ঈশিতা মুখোপাধ্যায়দের রাইট টু এডুকেশন সংগঠন থেকে একটা চমৎকার আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল, সেটার খোঁজ নিতে পারেন বা এই বিষয়ে আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে আমার লেখা বুকলেট দেখতে পারেন।
তবে দু রাত্রে বসে লেখা কিছু বিশদে ভুল থাকতে পারে, দেখে নেবেন একটু দয়া করে, আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সাইনাথের বই পড়ে দেখতে পারেন। মানে এই বিষয়ে কাজ করতে গেলে আপনাকে সাইনাথ পড়তেই হবে। এভরিবডি লাভস আ গুড ড্রট। বিখ্যাত বই।
২০২০র ১৯ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্থান টাইমসে বেরোনো রওশন কিশোরের প্রবন্ধটি দেখতে পারেন। কাছাকাছি সময়ে বেরোনো The Wire পত্রিকায় প্রকাশিত কবির আগরওয়ালের প্রবন্ধ দেখে নিতে পারেন। আমাদের দলের নেতা হান্নানদার কয়েকটা বক্তৃতা আছে।
আপনাদের ওয়েবসাইটের লেখক/বিশ্লেষক/পাঠকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা শান্তাকুমার রিপোর্ট, স্বামীনাথন রিপোর্ট, সমস্ত আলোচ্য আইনগুলি, রাজ্যস্তরের যে আইনের উল্লেখ আমি করলাম, সেগুলো নিজেরাই পড়ে নিন। আমাদের অবস্থানের ভাল মন্দ আপনার নিজের খোঁজা তথ্য দিয়েই বিচার করুন। রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করুন, কিন্তু সমস্ত ধরনের কৃষকের সঙ্গে শ্রমিকের সঙ্গে থাকুন।
কো অপারেটিভ আইনের পরিবর্তন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে ২০ হাজার কো অপারেটিভ এর ক্ষমতা হ্রাস বা শস্য ক্রেতা হিসেবে কিছু কো অপারেটিভ বা কিছু এগ্রিগেটরের সংস্থার সংখ্যাগুলি শমীকের দাবি, এই সংখ্যা গুলি আমি স্বাধীন ভাবে যাচাই করতে পারিনি। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বা সংশ্লিষ্ট আইনের পরিবর্তনে কো অপারেটিভ এর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পরিবর্তন অস্বাভাবিক কিছু না, ঘটতেই পারে। আর কৃষিজাত পণ্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় ও তার বিপণন যে সব কো অপারেটিভের ঘোষিত উদ্দেশ্য তাদের কার্যক্রম পরিচালকের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতেই পারে। সবটাই কৃষক স্বার্থবিরোধী সব সময়ে কিনা বলা কঠিন, সাধারণ ভাবে এটুকু বলা অন্যায় হবে না, সরাসরি ক্রয়ের ভিত্তির ক্রমসংকোচনের কথা শমীক যা বলছেন, তা সত্য হবার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে পশ্চিম বঙ্গে কৃষিজাত শস্য বিপণনে কো অপারেটিভ সাংঘাতিক সফল বা আধুনিক রিটেল ব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতার জায়গায় রয়েছে কিছুতেই এ কথা বলা যায় না। কো অপারেটিভের বা সরকারি হস্তক্ষেপে উৎপাদককে সহায়ক মূল্য এনে দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মাত্রার সাফল্য অন্য কিছু বিষয়ে রয়েছে। এবং আমাদের আলোচনার সময়ে শমীকের এই দাবিটি উড়িয়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব, যে সব মিলিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে অনেক কম দামে একটা বড় অংশের খাদ্য শস্য বাজারে প্রবেশ করছে, তবে বিশদ অনুপুংখ তথ্যসংগ্রহ বা গবেষণার প্রয়োজন তো থাকবে।
অনুলেখকের সংযোজন: ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১ টা নাগাদ যা দেখা গেল তার ভিত্তিতে ওয়েব লিংক গুলি দেওয়া হল।
কোনোরকম কর্পোরেট ফান্ডিং ছাড়া সম্পূর্ণরূপে জনতার শ্রম ও অর্থে পরিচালিত এই নন-প্রফিট এবং স্বাধীন উদ্যোগটিকে বাঁচিয়ে রাখতে
গুরুচণ্ডা৯-র গ্রাহক হোন
ভাল লাগল। জরুরী প্রতিবেদন
শমীক লাহিড়ীর সাক্ষাৎকার