স্বাতী ভট্টাচার্য— আমাদের আজকের বিষয় আজকের ভারতে অর্থনীতি এবং রাজনীতির সম্পর্ক, এবং আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আজকে আমরা একজন এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলব যাঁর গোটা কর্মজীবন এটার ওপরেই, বহু লেখালেখি চিন্তাভাবনা করেই তিনি এসেছেন এবং আমাদেরও ভাবিয়েছেন। আমরা যারা মনের দিক থেকে বড় হওয়ার অনুশীলন করি, তার কাছে অধ্যাপক অমিত ভাদুড়ীর বইগুলো, তাঁর আর্টিকেল, তাঁর লেকচার এই প্রত্যেকটি অত্যন্ত মূল্যবান। বিশেষত তাঁর ডেভেলপমেন্ট অফ ডিগনিটি বইটি আমাদের সকলকে ধাক্কা দিয়েছে, নতুন করে ভাবিয়েছে, বিতর্ক তৈরি করেছে। তাঁর মতো মানুষের নতুন করে পরিচয় দেওয়ার হয়তো প্রয়োজনই নেই। তবু অনুষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, তাই আপনাদের সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিই অধ্যাপক অমিত ভাদুড়ী প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে পড়াশোনা করেছেন এমআইটিতে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকেই তাঁর পিএইচডি এবং পড়িয়েছেন প্রেসিডেন্সিতে। তারপরে জেএনইউ, কেরালার সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস, স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটি ছাড়াও অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নরওয়ের অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যেমন পড়িয়েছেন, সেরকমই তিনি যুক্ত থেকেছেন গবেষণার সূত্রে ফেলো হিসেবে। ইউনাইটেড নেশনস অর্থাৎ রাষ্ট্রপুঞ্জ সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও কাজ করেছেন। অধ্যাপক অমিত ভাদুড়ী, আপনাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই আমাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। নমস্কার স্যার ।
অমিত ভাদুড়ী— নমস্কার।
স্বাতী ভট্টাচার্য— শুরুতে আমি আরও একটি কথা বলি। আজকে এই সুযোগটা যারা করে দিয়েছেন প্রফেসর ভাদুড়ীর সঙ্গে কথা বলার তারা হচ্ছেন মনভাসি, একটি অর্গানাইজেশন যাঁরা বাংলার লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির ডকুমেন্টেশনের কাজটি করে চলেছেন, যাঁরা এই ধরনের আলোচনা অর্থাৎ অনলাইন আলোচনা গত একবছর ধরেই চালিয়ে যাচ্ছেন—সেটা কখনও রাজনৈতিক বিষয়ে, কখনও সাংস্কৃতিক বিষয়ে এবং তাঁরা জানিয়েছেন যে তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে একটি বৈষম্যহীন সুস্থ, সচেতন সমাজ যাতে তৈরি হয়, তার উদ্দেশ্যে নানান ধরনের কার্যসূচি চালিয়ে যাওয়া। আজকে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই কৃষি সম্পর্কিত যে ডকুমেন্টারি ছবিটার ক্লিপিং আমরা দেখতে পেলাম, বস্তুত গত এক মাসের উপর বেশ কিছুদিন ধরে আমরা এই চিত্রগুলি দেখে যাচ্ছি, যা আমাদের অত্যন্ত পীড়িত করছে, আন্দোলিত করছে, আমাদের উদ্বিগ্ন করছে, ভাবিয়েও তুলেছে। আমরা সবাই একদিকে ভাবছি যে কত কষ্ট এই মানুষগুলো করছেন, কেন এর দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না, আবার সেই সঙ্গে আমরা বোধ হয় এটাও বুঝতে পারছি যে এটা এতদিনের সমস্যা, এত গভীর এবং ব্যাপক সমস্যা যে একদিনে হয়তো কিছু হওয়ার নয়। তাই আজ আমরা অধ্যাপক ভাদুড়ীর কাছে বোঝার চেষ্টা করব—স্যার, আপনি তো সত্তরের দশক থেকে এই বিষয়টা নিয়ে লিখছেন, আপনার ১৯৭৩ সালে আপনি পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো গ্রামের থেকে তথ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আপনি লিখেছিলেন যে যারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, যারা ভূমিহীন, যারা ভাগচাষী তাদের কেন এই ব্যাকওয়ার্ডনেস, কেন তারা রোজাগার বাড়াতে পারছে না। তারপর এই নিয়ে আপনি বইও লিখেছেন তারপর আজকে এত বছর পরে এসে আপনি এই কৃষি আন্দোলন দেখছেন। আপনি বলুন সমস্যাটা আমরা কীভাবে দেখব, আমাদের কীভাবে এর বিচার করা উচিত।
অমিত ভাদুড়ী— আমি পূর্ব ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিব্যবস্থা ১৯৭১-৭২ সালে প্রথম পায়ে ঘুরে দেখার চেষ্টা করি এবং বোঝার চেষ্টা করি। তখন তারপরে আমি নানা সূত্রে, আজকাল যাদের বলা হয়ে থাকে ‘আন্দোলনজীবী’, যাঁদের প্রধানমন্ত্রী ‘আন্দোলনজীবী’ বলেছেন, সেই ধরনের লোক হয়ে আমি অনেকগুলো জায়গায় কৃষি ব্যাপারে অনেক আন্দোলন দেখতে যাই। কিছু আন্দোলন আমি দেখেছি মেধা পাটেকরের সঙ্গে, কিছু দেখেছি অরুন্ধতী রায় প্রমুখর সঙ্গে ছত্তিসগড়ে এবং ভারতবর্ষের নানা জায়গায়, অধিকাংশই উত্তর ভারতে, যেখানে হিন্দিতে মোটামুটি কাজ চলে, সেরকম জায়গায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম। তা ছাড়া আমি কেরালাও দেখেছি। প্রথম যে জিনিসটা বোঝা দরকার, সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষের কৃষির কোনো স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম নেই। ভারতবর্ষের কৃষিব্যবস্থা প্রত্যেক জায়গায় বেশ কিছুটা আলাদা। যেমন ধরুন কেরালা। কেরালায় প্রায় প্রত্যেক কৃষকেরই একটা করে হোমস্টেড ল্যান্ড আছে। সবথেকে বোধ হয় বড় কাজ, যেটা সিপিএম গভর্নমেন্ট করেছিল সেটা হচ্ছে হোমস্টেড ল্যান্ড দেওয়া। ওয়েস্টবেঙ্গলে তার যে করেস্পন্ডিং কাজটা সিপিএম করেছিল, সেটা হচ্ছে গিয়ে যেটাকে বলে ওই জমিতে ভাগচাষিদের সত্তা দিয়ে দেওয়ার কথা। আমি যে সময়টায় ঘুরে দেখেছিলাম সেই সময় থেকে শুরু হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের, পরে যাতে ভাগচাষিরা শুধু তাদের ভাগ পায় এমন নয়, তাদের জমিতে মোটামুটি একটা থাকার ব্যবস্থা হয়। আমি তখন প্রথম লক্ষ করি, আমার তখনকার কিছু পুরোনো ছাত্র, আমার প্রথম জেনারেশন ছাত্র, যাদের মধ্যে কয়েকজন তখন মন্ত্রীও ছিল, এদের কৃষি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অ্যাকচুয়ালি আমারও কোনো ধারণা নেই, কিন্তু আমি তো তবু ঘুরে ফিরে দেখেছি। এরা অনেক কথা বলে কিন্তু এদের কোনো ধারণাই নেই। তার ফলে এরা শুধু ঠিক করে দেয় যে ভাগচাষিরা ওই জমিতে চাষ করার একটা কন্টিনিউয়াস রাইট পাবে। কিন্তু সেই অধিকারের সঙ্গে যেগুলো দরকার, যেমন ধরুন নিয়মিত ঋণ পাওয়া, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পাওয়া, ধানের বীজের ব্যবস্থা করা, একটা চাষ থেকে আর-একটা চাষ পর্যন্ত হাতে পয়সা থাকা সুনিশ্চিত করা — সেইসব কিছুরই ব্যবস্থা করা হয়নি। শুধু ভূমি আন্দোলন, ভূমিসংস্কার করব এবং ওই রাইটগুলো দিয়ে দেব—এইভাবে কোনো একটা সাস্টেনেবেল সিস্টেম তৈরি করা যায় না। এরপরেও অনেক জায়গায় আমি এটা অনেককে বলেছি। কিন্তু সেই প্রথম আমি নিজে পরিষ্কার এটা দেখতে পাই এবং সেই জিনিস আমার নিজের ধারণা এখনও রয়ে গেছে। যদিও এখন আর আমি পশ্চিমবঙ্গের কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে বিশেষ যুক্ত নেই, অনেকদিন অন্তত পায়ে ঘুরে দেখিনি, শুধু স্ট্যাটিস্টিকস দেখে সব বোঝা যায় না। কিন্তু আমি তখন যেটা বুঝতে পেরেছিলাম সেটা হচ্ছে গিয়ে আমাদের পশ্চিমবাংলায় কৃষি এত পিছিয়ে-পড়ার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়। তখন যাদের বলা হত জোতদার, তারা ঋণও দিত এবং সেইসঙ্গে যারা ভাগচাষি তাদের জমির প্রায় ৪০ শতাংশ ধান দিত এবং সমস্ত ঋণের খরচগুলো দিত। এখানে বোধহয় একটা গল্প বললে ভালো হয়, যেটা আমার জীবনে তখন ঘটেছিল এবং আমাকে সব থেকে বেশি ইনফ্লুয়েন্স করেছিল। তখন আমার গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে বীরভূমের কোনো একটা জায়গায় খুব জ্বর হয়, শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি তখন একটা গাছের নীচে বসেছিলাম এবং চলাফেরা করতে, হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, যদিও আমার বয়স তখন খুব কম ছিল। বেশ ভালো জ্বর এসেছিল। তখন আমি যখন গাছের তলায় ঝিমোচ্ছি, ওখানকারই এক ভদ্রলোক এসে, আমায় দেখেই বুঝতে পেরেছেন যে আমি ওখানকার চাষি নই। উনি তখন আমাকে বললেন, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন, কলকাতা থেকে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। ‘আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?’ এরকম দু-একটা কথার পরে উনি আমাকে বললেন, ‘আপনার তো দেখছি খুব জ্বর এসেছে। আপনি আমার বাড়ি চলুন।’ আমি সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে গেলাম। তিনি চাষি, মানে উচ্চ চাষি। তখন আমি কিছু জানতাম না। আমি ভদ্রলোকের বাড়িতে গেলাম। দুদিন বোধহয় ছিলাম। দু-রাত্রি বোধহয় ছিলাম, যতদূর মনে পড়ছে এবং তৃতীয় দিন জ্বর নিজে থেকে সেরে গেল এবং তারপর অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমি বললাম, ‘আমি যাই।’ তখন আমায় ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি তো এভাবে যেতে পারেন না, আমরা তো অতিথিকে কিছু না খাই এভাবেই ছাড়তে পারি না।’ এই দুইদিন আমি যদিও লিকুইড খেয়ে ছিলাম। যাই হোক, ভদ্রলোক আমাকে বললেন যে ‘আপনি দুপুরে খেয়ে যাবেন।’ এতে আমি বেশ খুশি হলাম, কারণ তখন বিশেষ ভালো খাবারদাবার জুটছিল না। আমার মনে আছে, তাতে লুচি এবং আলুর তরকারি ছিল। যেরকম আমাদের ট্র্যাডিশনাল বাড়িতে হয়ে থাকে, ভদ্রমহিলা পরিবেশন করছেন, আমাদের সঙ্গে খাবেন না, বুঝতেই পারছেন, যাকে আজকালকার ভাষায় বলা হয় পেট্রিয়ার্কাল সোসাইটি। যাই হোক, ভদ্রমহিলা খাবার পরিবেশন করছেন এবং আমি আর ওই ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে খাচ্ছি, তখনই দেখলাম ভদ্রমহিলার হাতে প্রচুর চুড়ি, সোনার চুড়ি। যতবার তিনি লুচি দিচ্ছেন ততবার চুড়িগুলো ধাক্কা লেগে আওয়াজ করছে। এই পার্টটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তারপর আমি অনেক খেয়ে-টেয়ে ওনাদের অনেক ধন্যবাদ দিয়ে যখন চলে আসি, তখন আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনি আমাকে একটা জিনিস বলুন তো। আপনারা তো ফুলকপির চাষ করেন, তা ফুলকপি চাষের জন্য যে জলটা লাগে তার জন্য তো আপনারা ভালো করে অনেকগুলো টিউবওয়েল বসাতে পারেন। আপনার তো মোটামুটি অবস্থা ভালো। কিন্তু এটা করেন না কেন?’ তাতে ভদ্রলোক আমাকে একটা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন, যার থেকে প্রথম আমার ওইসব লেখার শুরু হয়। ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘করতে পারি, কিন্তু বুঝলেন তো, আমার শালা, উনি তো সুদের কারবার করেন তাই… ’ বলে ভদ্রলোক থেমে গেলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, মানে টিউবওয়েল বসানোর সাথে সুদের কারবারের কী সম্পর্ক সেসব কিছুই বুঝতে পারলাম না। আস্তে আস্তে এবং তারপর আরও দু-এক জায়গায় ঘুরে, ওই বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদ আরও বেশি বাঁকুড়া—বাঁকুড়ায় অবশ্য এই সমস্যাটা অন্যরকম ছিল তখন, ঘুরে যেটা আমার কাছে পরিষ্কার হল, সেটা হচ্ছে, একই ভদ্রলোক কিংবা একই পরিবার মোটামুটি, একই এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি অনেক জায়গাতেই সুদের কারবারও করে এবং জমিও ভাগে চাষ করতে দিয়ে দেয়। তার ফলে যেটা হয় এবং এটা বোঝার জন্য কোনো বিশেষ ইকোনমিকসও দরকার নেই, আপনি দুটো সোর্স থেকে ইনকাম করেন। মানে একটা ফ্যামিলি হিসেবে, হয় আপনি নিজে অথবা পারিবারিক ভাবে আপনি দুটো সোর্স থেকে ইনকাম করেন। একটা সোর্স হচ্ছে আপনি জমি থেকে আধা অথবা ৬০% ফসল পান, কারণ আপনি জমি ভাগে দিয়েছেন। আর বাকিটা আপনি পান, যে আপনার জমিতে চাষ করে তাকে আপনি প্রত্যেক বছর যে ঋণ দেন, তার কাছ থেকে সুদ হিসেবে। তার ফলে জিনিসটা যেটা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে, আপনি এই দুটো সোর্স থেকে ইনকাম করেন এবং এই যে টাকাটা আপনি সুদ হিসেবে পান সেই টাকাটা রেগুলার ডিপেন্ড করে আপনি কত টাকা একে ধার দিচ্ছেন বা কত মণ ধান একে ধার দিচ্ছেন তার উপর। এবং মোটামুটি আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, সেটা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অঙ্ক। কমবেশি হয়, তবুও যতদূর এখন মনে পড়ছে, সেটা মোট আয়ের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ৩০% থেকে ৩৫% রোজগার হয় ঋণ থেকে আর বাকি রোজগার হচ্ছে জমি থেকে। তারপর আমি যেটা বুঝতে পারলাম, যা আমার কাছে প্রায় একটা আবিষ্কারের মতো, তা হল, আপনি যদি জমিতে জলসেচ বাড়িয়ে দেন তাহলে যা হবে, চাষের ৪০%ও যদি ওই ভাগচাষি পায়, তাহলে তার আর প্রত্যেক বছর অত ঋণ নেওয়ার দরকার পড়বে না। ফলে সুদ থেকে যে আয়টা আপনি করছেন সেই সুদের আয়টাও কমে যাবে। এখন এই ব্যালেন্স, মানে ঠিক অঙ্ক কষে ব্যালান্স নয়, মোটামুটি এই জিনিসটা এরা সবাই বুঝতে পারে, যে আমার দুটোই আয়ের রাস্তা। ফলে জমির সেচব্যবস্থা যদি ভালো করে দিই, উৎপাদনশীলতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে একদিকে আমার একটা আয়ের রাস্তা যেমন বন্ধ হবে, তেমনি আমার উপর অর্থাৎ জোতদারের উপর চাষির নির্ভরতা কমে যাবে। পশ্চিমবাংলাতে অনেক জায়গাতেই এবং বিশেষ করে যে দুটি জেলায় আমি বেশ কিছুটা ঘুরেছি, সেই দুটো জায়গা — বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদ — এই দুটো জায়গায় এইটা একটা বেশ বড় কারণ বলা যায়। এটাই প্রধান কারণ যে জন্য জোতদারদের জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর খুব একটা উৎসাহ নেই। এবং এর সঙ্গে অন্য জিনিসও আছে, সেটা হচ্ছে জমিদারি ব্যবস্থা। আগে জমিদারি থাকার জন্য ইত্যাদি কারণে মনে করা হত জমির একটা অংশ তো ভাগে দিয়েই দিতে হবে, এর জন্য আপনি কেন উৎপাদনশীলতা বাড়াবেন ইত্যাদি। এই ব্যবস্থা এখন অনেক বদলে গিয়েছে। তা আমি অল্প অল্প দেখেছি এবং যাঁরা এসব নিয়ে যথাযথ ভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে লেখালেখি করেন, তাঁরা বলেন, আজকাল এই ব্যাপারটা অনেক কমে গেছে। কিন্তু এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হল, জমি চাষ করার খরচ ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। তখন খরচটা ছিল একটা ফসলকাটা থেকে আর-একটা ফসলকাটা পর্যন্ত আপনি কীভাবে বাঁচবেন—তার জন্য আপনাকে ঋণ নিতে হবে। এখন সেটা হচ্ছে গিয়ে আপনাকে বাজার থেকে এই ইনপুটগুলো কিনতে হবে এবং তার যে দামটা হচ্ছে সেই দামটা আপনি তুলবেন কী করে। এই সমস্যাটা সারা ভারতবর্ষেই নানা রকমভাবে উঠেছে এবং আমরা যেটা আজকাল কৃষি সম্বন্ধে বলে থাকি যে ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস’, যেটা নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, সেই মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের ব্যাপারে যে জিনিসটা খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে সেটা শুধু বড় কৃষক নয়, ছোট কৃষকরাও বলছে যে জমি চাষ করার খরচ খুব বেড়ে গিয়েছে। এগুলো আমি পাঞ্জাবে যেসব জায়গায় ঘুরেছি সেখানে সরাসরি বলেছে এবং আমার যেসব ছাত্র–সহকর্মী যারা পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ এসব অঞ্চলে গিয়েছে তারাও বার বার বলে থাকে যে জমির খরচ এত বেড়ে গিয়েছে যে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস পেলে তবে, আজকের যেটা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস তাতে ধান এবং গম এই দুটো আপনি মোটামুটি অল্প কিছু মার্জিন রেখে বিক্রি করতে পারেন। আপনি যদি মিনিমান সাপোর্ট প্রাইসটা যদি না পান, তার নীচে যদি পান তাহলে ডেড লস। মানে সত্যি সত্যি তাহলে আপনাকে পকেট থেকে পয়সা দিতে হবে।
স্বাতী ভট্টাচার্য— স্যার, একটা প্রশ্ন করছি, কৃষি আন্দোলন যা আমরা দেখলাম এবং এর আগেও নানা সময়ে যেসব আন্দোলন আমরা দেখেছি গত কয়েক বছরে তার মধ্যে এই এমএসপি-টা কিন্তু আলোচনার সবচেয়ে আগে উঠে এসেছে। এর আগের পর্যায়ে ইউপিএ সরকারের সময়ে আমরা দেখতাম যে ঋণ মকুব নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয়েছিল। এই সময়ে এখনও যে সেটা নেই তা নয়, ঋণ মকুব এই আমলেও হয়েছে। কিন্তু প্রধান বিতর্কটা যেন এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি এটা নিয়েই হচ্ছে। এখন আমরা দেখছি যে, যে দাবিগুলো উঠছে চাষি বাজারে একেবারেই দাম পাচ্ছে না বা দাম পাওয়াটা খুব অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে, উলটো দিকে যেটা আপনি বলছেন যে, উৎপাদনের খরচ খুব বেড়ে গেছে। ফলে এই ধরনের দাবি আসছে যে, প্রথমত এমএসপি বাড়াতে হবে, বাজারদরের সঙ্গে প্রতি বছরই দেখছি এমএসপি বাড়ছে এর কারণ সাধারণত পশ্চিমবঙ্গে অন্তত দেখছি যে ধানের দাম বাড়ছে না। চাষি যে দামে বিক্রি করত মোটামুটি সেই দামেই গত চার পাঁচ বছর ধরে বিক্রি করে চলেছে। কিন্তু প্রতি বছর এমএসপি-টা প্রায় হাজার টাকা করে বেড়ে চলেছে—এই হল একটা। আর-একটি হল, চাষি বলছে, চাষিকে এমএসপি দিতে হবে, আরও বেশি ফসলে এমএসপি দিতে হবে এবং আরও বেশি ধান গম এবং অন্যান্য ফসল সরকারকে কিনতে হবে। যেমন, সম্প্রতি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও বলেছেন আমাদের এখান থেকে এফসিআই অত্যন্ত কম ধান কেনে, আরও বেশি ধান পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন কেনা হবে না? অর্থাৎ এই পুরো কৃষিব্যবস্থার বা চাষের রোজগার যেন সরকারি ক্রয়ের উপরই নির্ভর করছে। সরকার কিনলে তবে চাষি বাঁচতে পারবে — কথা শুনে আমাদের এমনই যেন মনে হচ্ছে। আপনি কী বলেন? অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে এই রাজনৈতিক দাবিটা কি গ্রহণযোগ্য?
অমিত ভাদুড়ী— দেখুন এর দুটো ভাগ আছে। একটা হচ্ছে আপনি যাকে বললেন উৎপাদনশীলতা। উৎপাদনশীলতা দুটো জিনিস—একটা হচ্ছে গিয়ে একটি ছোট জমিতে আপনি কত উৎপাদন করেন। ধরুন একর প্রতি আপনি কত উৎপাদন করেন? এটা আপনি জানেন মানে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় ভারতবর্ষে এটি সাধারণ ভাবে খুবই কম এবং পশ্চিমবঙ্গে অসম্ভব কম। বিহার বাদ দিয়ে এত কম উৎপাদনশীল ছোট চাষের জমি ভারতবর্ষে কোথাও নেই। এই জন্য আপনি যদি যথেষ্ট ন্যায্য মূল্য দেন, আমরা যাকে এমএসপি বলে থাকি, মোটামুটি সেই মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস আপনি যদি দেনও, তাহলেও ছোট চাষি যে ঋণের বাইরে চলে আসবে বা তার যে খুব সুবিধে হবে, তেমনটা নয়। এটা হচ্ছে একটা দিক। এর অন্য একটা দিক আছে। সেটার কথা আগে বলে নিই। তারপর গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আসছি। এর আর-একটা দিক আছে, যেটা প্রায় কেউই আজকাল বলে না, বিশেষ করে টিভিতে যে আলোচনা হয় সেখানে কেউই বলে না। এমএসপিতে যে ধান-গম কেনা হয় তার একটা বড় অংশ যায় রেশনব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য। যেটাকে আমরা বলে থাকি সাপোর্ট প্রাইসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, সেটা হল আমাদের রেশন সিস্টেম, ফেয়ার প্রাইস সিস্টেম চালানোর জন্য। অনেক চাষি, পাঞ্জাব হরিয়ানায় ছোট চাষি, ছোট চাষিদের কথাও বাদ দিন, যাদের একদম কোনো জমি নেই, খেতমজুর, তাঁরাও সবাই এখন এটাকে সমর্থন করছেন। তার অর্থনৈতিক কারণ হচ্ছে, তাঁরা বলছেন, ‘আমরা যদি এটা না করি তাহলে রেশনে চাল-গম পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’ এই দুটোকে যদি আপনি একসাথে না দেখেন তাহলে কেন এই জিনিসটি এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তা বোঝা মুশকিল হয়ে যাবে। আমরা যে টিভিতে দেখি বা শুনি, যে মহাপঞ্চায়েত — হাজার হাজার লোক যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়েছে — এইটা তো সম্ভব হত না যদি ছোট চাষি-বড় চাষি সবাই এই মহাপঞ্চায়েতে, এই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না হত। এই যে তারা যুক্ত হয়েছে, তার একটা কারণ হচ্ছে যে সরকার ঠিক করে নিয়েছে যে একদিকে যেমন আমরা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস সম্বন্ধে কিছু করব না, অন্যদিকে আমরা যেটা করব, আমরা ধীরে ধীরে ফেয়ার প্রাইস সিস্টেম বা রেশন সিস্টেমটা তুলে দেব। সেইটা এরা সবাই বুঝতে পারছে। আসলে যাদের জন্য এই আইন করা হচ্ছে তাদের যদি লাভ করতে হয় তবে তাদের কম দামে কিনতে হবে এবং বেশি দামে বেচতে হবে, এই দুটোর জন্যই দরকার একদিকে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস কমানো বা তুলে দেওয়া কিংবা উঠে যেতে বাধ্য করা, আর-একদিকে যেটা করতে হবে সেটা হল কম দামে লোকে কিনতে পারে সেটা বাদ দিয়ে দেওয়া।এ র ফলে বাজারদর যা হবে, আজকাল অধিকাংশ মানুষের যা ইনকাম তার পক্ষে কিছু কেনা আর সম্ভব হবে না। এই টু-সাইডেড রোলটা যদি আপনি বুঝতে পারেন...
স্বাতী ভট্টাচার্য— তাহলে একদিকে গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, আর অন্যদিকে কৃষকের ফসলের দামের নিরাপত্তা, আপনি বলছেন যে এই দুটো থেকেই এমএসপি-র...
অমিত ভাদুড়ী— এই দুটোর সংযোগে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন। আমি যেটা বলার চেষ্টা করছিলাম, গরিব লোকের খাদ্যের নিরাপত্তা, চাষিদের খাদ্যের নিরাপত্তা, খেতমজুরের খাদ্যের নিরাপত্তা একদিকে আর আর-একদিকে ন্যূনতম মূল্য পাওয়ার নিরাপত্তা। এবং কৃষকদের অধিকাংশেরই দাবি হল, আপনি আগে যেটা বললেন খরচ বেড়ে গেছে, জমি চাষের খরচ বেড়ে গেছে। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কৃষকদের জন্য যেটা চেয়েছিল সেটা কংগ্রেসও করেনি, এ সরকার তো এবিষয়ে কথাও বলেনি। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ ছিল যা খরচ হবে তার উপর ৫০% খরচ হিসেব করতে হবে এবং তার উপরে ৫০% যোগ করে মিনিমাম প্রাইসটা স্থির করতে হবে—এইটা একনম্বর। আর দুনম্বর হচ্ছে, দেখবে, যারা বেশি বোঝে, একটু মার্কেট ওরিয়েন্টেড ইকোনমিস্টরা বলে থাকে যে প্রচুর এমন ধরনের ক্রপিং প্যাটার্ন অর্থাৎ কী জাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে তার পদ্ধতি বদলাতে হবে কারণ এর জন্য প্রচুর জল লাগে। এখানে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের অ্যাকচুয়াল যেটা ছিল সেটা হচ্ছে ২৩ টা শস্যের উপরে, ২৩ ধরনের ফসলের উপরে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস দিতে হবে। এবং সেটাকে যদি আপনি ম্যানিপুলেট করেন যে কোনটার দাম বেশি দেব, কোনটার দাম কম দেব তাহলেই আপনি সবথেকে বেশি কৃষিতে কোন্ জমিতে কী তৈরি হবে সেটা বুঝতে পারবেন। ধরুন যে জমিতে জল পাওয়া খুব শক্ত যেমন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, সেখানে আপনি কখনও ধান চাষের চেষ্টা করবেন না কিংবা পাট, পাটের চাষ করলে যে প্রচুর জলের অপচয় হয় সেটা যদি আপনি কমিয়ে দিতে পারেন। পাট যদিও খাদ্যশস্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু অন্য জিনিসের দাম বাড়িয়ে, যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে প্রাইস ইনসেনটিভ দিয়ে কোন্ কোন্ ফসল কোথায় হবে তা আপনি স্থির করে দিতে পারেন।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
প্রোফেসর অমিত ভাদুড়ির বইটির নাম 'ডেভেলপমেন্ট উইথ ডিগনিটি' । পুরো নাম 'ডেভেলপমেন্ট উইথ ডিগনিটি: এ কেস ফর ফুল এম্প্লয়মেন্ট' ।
ডেভলপমেন্ট ওফ ডিগনিটি কথাটার এই প্রসঙ্গে কোনো মানে হয় কি? উন্নয়নের অর্থনীতিতে সম্মানের উন্নয়ন না সম্মানের সাথে উন্নয়ন?
উল্লিখিত গল্পটি খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেয় অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ইন্টারলিংকড ট্রানসাকশান। অর্থাৎ গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় ল্যান্ড লেবার ও ক্যাপিটাল মার্কেট জড়িয়ে আছে।
ওয়াটার ইনটেনসিটি অনুযায়ী ক্রপ প্যাটার্ন স্থির করা মার্কেট ইকোনোমিক্স ছাড়াও পরিবেশের কারণে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ওয়াটার সিকিউরিটি ও সাস্টেনিবিলিটি আজকের কৃষিতে অবশ্য বিবেচ্য। চালের বদলে গম চাষ আর ভাতের বদলে রুটি খাওয়ার অভ্যাস- এগুলোর দিন এসে গিয়েছে। সাস্টেইনবল ডেভেলোপমেন্ট করতে হলে লাইফস্টাইল চেঞ্জ আনতে হবে বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলছেন।
আমারও প্রশ্নঃ অধ্যাপক ভাদুড়ির "ডেভেলপমেন্ট উইথ ডিগনিটি" প্রায় দেড় দশক আগে পড়েছি। 'ডেভেলপমেন্ট অফ ডিগনিটি" কি নতুন কোন বই না টাইপো? প্রশ্নটি স্বাতী ভট্টাচার্যকে।
নতুন আঙ্গিকে বিষয়টিকে দেখা গেল। ধন্যবাদ
এই সাক্ষাৎকার টির জন্য ধন্যবাদ।