একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আবারও একবার আমরা আমাদের 'গরব', 'আশা' উদযাপন করব। সেই উদযাপনের আড়ম্বরে আবারও একবার আড়ালে চলে যাবে আমাদের মাতৃভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিশেষ ধরনের রাজনীতি।
এবলিজমের রাজনীতি।
কী এই 'এবলিজম’? খায়, না মাথায় দেয়? আসলে ডিজেবিলিটি স্টাডিজ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় আলোচনা ও লেখালিখি এতই কম, যে এই 'এবলিজম’ ও ‘এবলিস্ট’ এই শব্দযুগলের কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমি অনেক খুঁজেও পাই নি। তাই প্রথমেই দায়িত্ব এসে পড়ে শব্দটির মানে সর্বজনবোধ্য ভাষায় বুঝিয়ে বলা। বহুবিধ স্তরকে একপাশে সরিয়ে রেখে যদি সোজাসাপটা ভাষায় বলি তাহলে এই দাঁড়ায় যা-কিছুই প্রতিবন্ধী মানুষদের বিকাশ, উন্নয়ন ও সর্বোপরি অধিকারের পরিপন্থী —তা-ই 'এবলিস্ট', এবং যা এবলিস্ট সিস্টেমকে প্রশ্রয় দেয়, তাই হল এবলিজম। এখানে 'যা-কিছু' বলতে প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ, ব্যবস্থা, মনোভাব -সবই বোঝানো হল।
এর সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক কী? আসলে আমরা যা বলি, লিখি, বা যে ভাষায় ভাবি -তার মধ্যেও যে একধরণের সন্ত্রাস লুকিয়ে থাকতে পারে — সে সম্পর্কে আমরা সম্ভবত খুব একটা ওয়াকিবহাল নই। ধরা যাক, বাগধারা-প্রবাদ-প্রবচনের কথা। এসব তো আমাদের কথ্য ভাষা, এমনকি লেখ্য ভাষারও একেবারে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই প্রবাদ প্রবচন দিয়েই নাহয় শুরু করা যাক। স্কুলে থাকাকালীন বাগধারা অধ্যায়ে আমরা সবাই পড়েছি অন্ধের নড়ি বা অন্ধের যষ্টির কথা। মানে কী? সংসদ বাংলা অভিধান বলছে- "অক্ষম অসহায়ের একমাত্র অবলম্বন; অসহায়ের সহায়।" উদাহরণ বা প্রয়োগ দেখা যাক— "বিধবার তিনকুলে কেউ নেই, ও-ই একমাত্র ছেলে, ওকে তুমি দেখো ঠাকুর, ও যে ওর মায়ের অন্ধের যষ্টি।" — উক্তিটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের কথা নাহয় অন্যত্র বলা যাবে, আপাতত অন্ধ শব্দটিকে ধরা যাক। বোঝা যাচ্ছে অন্ধ-শব্দটি এখানে রূপক, বা ইংরেজিতে যাকে বলে মেটাফর। মানে আক্ষরিক অর্থে একটি অন্ধ মানুষের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। অন্ধ-কে এখানে 'অসহায়তা', 'অক্ষমতা'-র সঙ্গে সমার্থক করে দেওয়া হচ্ছে। তাই শুধু মেটাফর না বলে বলা ভালো, অন্ধ এখানে একটি নেগেটিভ মেটাফর। ভাবটা এই, যে অন্ধ মানুষ মাত্রই যেন অসহায়, অক্ষম। আরো একটি প্রবাদ নেওয়া যাক: 'কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন' —হাস্যকর অসামঞ্জস্য বোঝানোর জন্য এই উক্তি। সেই ঘুরেফিরে নেগেটিভ। কানাকড়ি (অচল পয়সা), কানাগলি(একমুখো, একদিক বন্ধ), কানা বেগুন (পোকা ধরা বেগুন) ইত্যাদি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। লক্ষ্য করবেন, প্রতি ক্ষেত্রেই কিন্তু 'কানা' শব্দগুলি নেগেটিভ মেটাফর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্ধভাবে অনুকরণ কোরো না- একথা তো আমরা অনেকসময়ই বলি।
অর্থাৎ নির্বিচারে অনুকরণ করতে বারণ করা হচ্ছে। কিন্তু অন্ধ মানুষ মাত্রই বিচারশক্তিরহিত —অন্ধ শব্দের এমন তাৎপর্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে সমাজমানসে কি বিরূপ মনোভাব তৈরী করে না? স্নেহে অন্ধ, প্রেমে অন্ধ -ইত্যাদির ব্যবহার সাহিত্যে সুপ্রচুর। এই ধরুন না রবীন্দ্রনাথের "গান্ধারীর আবেদন" -এর কথা। ধৃতরাষ্ট্র বলছেন, "অন্ধ আমি। — অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে/ চিরদিন" —অর্থাৎ "শারীরিকভাবে আমি অন্ধ, কিন্তু আবার অন্তরেও (স্নেহে) আমি অন্ধ, বিচারশক্তিহীন।" কাব্যিকভাবে মিলিয়ে দেওয়া হল শারীরিক অন্ধত্ব এবং স্নেহে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যতাকে। ওই সেই ঘুরেফিরে নেগেটিভ মেটাফরেরই কথা।
অন্ধ বা কানা শব্দটির বেশ কিছু মেটাফরিক্যাল প্রয়োগ নাহয় দেখা গেল। এবার (প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত) কিছু অন্য শব্দের দিকেও তাকানো যাক। পঙ্গু— "ওমুক সম্পাদকের মৃত্যুর ফলে তমুক পত্রিকাটি পঙ্গু হয়ে গেল" — এখানে পঙ্গু শব্দের অর্থ অচল। বোবা — "অন্যায় দেখেও তুমি বোবা হয়ে রইলে" —এখানে বোবা প্রতিবাদ না করবার সঙ্গে সমার্থক। আরেকটি দেখি, 'বোবার শত্রু নেই।' - কী মনে হচ্ছে? বোবা শব্দটিকে এখানে বেশ সদর্থেই ব্যবহার করা হল, তাই তো? আসলে যেটা বলতে চাওয়া হল: চুপ করে থাকা, প্রতিবাদ না করা, যথাসম্ভব অন্যের পক্ষে অপ্রিয় মনের ভাব প্রকাশ না করার মধ্যেই ধরা রয়েছে শত্রুহীন, নিষ্কণ্টক, নিশ্চিন্ত যাপনের নিরাপত্তা। দেখুন ঘুরেফিরে সেই নেগেটিভই হল কিন্তু। বোবামাত্রই প্রতিবাদহীন, নির্বিরোধী এবং মনের ভাব প্রকাশে অক্ষম। অতএব, প্রচলিত ভাষার যেদিকেই তাকাই, দেখি প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত শব্দের বিপুল ব্যবহার এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই সেগুলি নেগেটিভ। এছাড়া পাগল, মাথা খারাপ - এসব দৈনন্দিন ভাষায় এত বেশি উঠে আসে, যে তা বোধহয় আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না। প্রতিবন্ধকতা ধারণাটিকেই যেন অসহায়তা, অসম্পূর্ণতা, অচলতা ও 'নেই' -এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু উল্টোটাও আবার সত্যি, মানে এই ধরুন, বিশেষভাবে সক্ষম, ভিন্নভাবে সক্ষম বা "দিব্যাঙ্গ" —এর মধ্যে তো প্রকাশ পায় প্রতিবন্ধী মানুষদের এক উঁচু পেডেস্টালে তুলে দেওয়ার মনোভাব। প্রতিবন্ধীমাত্রই তার কিছু বিশেষ ক্ষমতা, ভিন্ন ক্ষমতা, দৈব ক্ষমতা ইত্যাদি থাকতে হবে। কারো যদি তেমন ক্ষমতা থাকে থাকুক, আপত্তি নেই, আমার তো নেই। হলফ করে বলতে পারি, অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষদেরই তেমন কোনো দৈব ক্ষমতা নেই। তবে কেন এই চাপিয়ে দেওয়া বিশেষণ? মনে হয়, আপাত পোলাইটনেস, আপাত পোলিটিক্যাল কারেক্টনেসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে টোকেনিজমের মূল কথা। ভিন্নভাবে সক্ষম বললেই যেন সব দায়দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়। সমাজকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করবার আর যেন কোনো প্রয়োজন নেই —"তুমি তো ভিন্নভাবে সক্ষম, বিশেষভাবে সক্ষম, অতএব সেইসব ক্ষমতা ব্যবহার করেই তুমি সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যাবে।" ব্যস্, হাত ঝেড়ে ফেলবার মত এমন অজুহাত আর হয় না।
এইবার আপনারা কেউ কেউ হয়ত প্রশ্ন তুলতে পারেন, "কানাকে কানা বললেও দোষ, আবার ভিন্নভাবে সক্ষম বললেও দোষ, - এ তো ভারি মুশকিল!" — আমার উত্তর - মুশকিল বা সমস্যা আপনার/আপনাদের আচরণে, ব্যবহারে, মনোভাবে। ভাষা ও মনোভাব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একদিকে ভাষা মনোভাবকে প্রভাবিত করে, অন্যদিকে আবার তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতএব সত্যিই যদি এক ইনক্লুসিভ সমাজ গড়ে তুলতে হয়, এমন এক সমাজ, যা প্রতিবন্ধীবান্ধব, তবে ভাষা ও মনোভাব —উভয়ক্ষেত্রেই বদল আনতে হবে। ভয়ের কথা এই যে, উপরিউক্ত অধিকাংশ বাগধারা, প্রবাদ ও শব্দবন্ধ আমরা অধিকাংশক্ষেত্রে খুব অচেতনভাবেই ব্যবহার করে যাই। কারণ — এই সব মনোভাব আমাদের মজ্জাগত, ফলত ভাষারও রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিহিত। পাঠক, খেয়াল রাখবেন, এই 'আমাদের' শব্দটির মধ্যে আমি বা আমাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়াটা নিছক বিনয় বা বাকচাতুরী নয়, আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি যে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই এবলিস্ট মনোভাবের শিকার আমি নিজেও, হয়তো আমার মতো আরো অনেকেই। কথাকে কেবলমাত্র কথার কথা না ভেবে, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাজনীতি, সন্ত্রাস সম্পর্কে বোধহয় একটু তলিয়ে ভাবা দরকার আমাদের। মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে লিখছি বলে বর্তমান প্রবন্ধে কেবলমাত্র আমার মাতৃভাষা বাংলা নিয়েই কথা বললাম, কিন্তু এই এবলিজমের সমস্যা ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষাতেও আছে। সেই নিয়ে আলোচনা অন্য কোনোদিন করা যাবে, হয়তো অন্য কেউ করবেন।
বাংলা শব্দের প্রয়োগ নিয়ে লিখবার আগে একটু হরিচরণের শব্দকোষ দেখে নিলে অনেক পণ্ডশ্রম এড়ানো যায়। কানাগলি,কানাকড়ি ইত্যাদি শব্দে কানা অচল অর্থে ব্যবহার হয় না। মেটাফরিক অর্থ নয় বরং কানা শব্দের নিজস্ব অর্থে ব্যবহৃত হয়- সেইটে হল একছিদ্র যুক্ত।
একচক্ষু অকার্যকর যাঁর, তাঁকেও সেই একই কারণে কানা বলা হয়। হয়তো বা কানা কে কানা বলতে নেই প্রবাদ ঠিক এই মানসিকতায়, যে বিশেষ সক্ষমদের বর্গীকরণে সহৃদয়তা দেখানো দরকার।
আমাদের অসংবেদনশীল সত্ত্বাকে জাগিয়ে দেয়া লেখা। অন্তত কিছু মানুষ তো নিশ্চয় সচেতন হবেন।
"কানায় কানায় ওলামেলা, বোবাতে খায় রসগোল্লা গো!" -- লালন সাঁই।
ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহারের ব্যাপ্তি বোঝার বদলে এই লেখায় যে যান্ত্রিক দৃষ্টিভংগীর ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা শুধু আপত্তিকরই নয়, হাস্যকরও। "কানাকে কানা বলিও না, বোবাকে বোবা বলিও না" এই বাল্যশিক্ষার আপ্তবাক্যের বাইরেও ভাষার মহিমা অশেষ, ওপরে সাঁইজীর দেহতত্বের কালাম তারই ইংগিত বহন করে। কিন্তু বোধকরি, "চোখ বুজে চড়ুই ধরার" মতো পন্থায় লেখক তা বুঝতে অক্ষম।
কৃষ্ণচন্দ্র দের গানে রয়েছে "তাঁরে দেখবি যদি নয়ন ভরে এ দুটো চোখ কর রে কানা"!
না: যান্ত্রিকভাবে পলিটিক্যালি কারেক্ট বিহেভিয়ার করতে অপারগ।
এ নিয়ে আলোচনা শুরু করায় লেখককে অনেক ধন্যবাদ। আমার কিছু কিছু পাঠকদের মন্তব্য দেখে বিরক্ত লাগছে। লেখক একবারও বলেননি যে "কানা, পঙ্গু" অভাব বা "নাই"-এর প্রতিক হিসেবেই একমাত্র ব্যাবহার হয়। যেই যেই নিত্যকার ঘটনায় এই ধরণের ব্যাবহার হয় সেইগুলির কথাই বলেছেন।
@ranjan roy, @biplab rahman লেখকের এই প্রয়াসটাকে আমল দেন নি। ওনারা " কানা"-র অন্যান্য প্রয়োগ দেখিয়ে নাকোচ করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদের কথা মন দিয়ে শোনা বা পড়া খুবই কঠিন, নিজের জ্ঞানের কথা শোনানো আরো সহজ।
মজার ব্যাপার হলো, "কানার হাট বাজার" এ "কানা"-র অভাব-বাচক অর্থটাই ব্যাবহৃত হয়েছে। সুতরাং পণ্ডিতিটাও ঠিক ভাবে করতে পারলেন না।
মনোরঞ্জন ব্যাপারী কয়েক বছর আগে এক সভায় বলছিলেন যে বাংলা ভাষায় "চামার" কথাটার ব্যাবহার দেখে ওনার খুব আঘাত লাগে। একটা গোটা পেশাবর্গকে হীন বানানো হয় এতে। এইটা উনি এই মঞ্চে বললে হয়তো পণ্ডিতেরা "চামার"-এর অন্য ব্যাবহারিক অর্থের কিছু নমুনা দেকগিয়ে ওনাকেও নাকোচ করার চেষ্টা করতেন।
কোথাও একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে মনে হয়। লেখকের মূল বক্তব্য-- ভাষার বা শব্দের ব্যবহারে কারও শারীরিক অক্ষমতাকে কটাক্ষ করা বা তাচ্ছিল্য করা অনুচিত এবং বক্তার সংবেদনশীলতার অভাব দর্শায়। এটা যথাসম্ভব পরিহারযোগ্য। এ নিয়ে কারও আপত্তি বা দ্বিমত থাকতে পারেনা।
আমাদের আপত্তি কন্টেক্সট বাদ দিয়ে যান্ত্রিক আলোচনায়।
আমরা বলতে চাইছি কোন শব্দ per se নেগেটিভ বা পজিটিভ হয়না। সেটা হয় কন্টেক্সটের যোগে। এটাই ভাষার বহুমাত্রিকতা।
যেমন 'বোবা' মানে যিনি বাকশক্তিরহিত, জন্মগত বা দুর্ঘটনাজনিত -যে কারণেই হোক। যার কথা বলার শক্তি আছে সে যখন ভয়ে বা অন্য কারণে মুখ না খোলে তাকে বোবা বলে নিন্দা করলে বোবাকে অসম্মান করা হয় না। বরং বাকশক্তি থাকতেও বাকশক্তিহীনের মত ব্যবহারকে নিন্দা করা হচ্ছে। যেমন নির্ধন হওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু ধন থাকতেও যে অন্যের দরকারের সময় কিপটেমি করে নির্ধনের মত ব্যবহার করলে তার নিন্দা হয়। আর কেউ বোবা বললে তাকে মনের ভাব প্রকাশে অক্ষম কেন ধরা হবে? সবাই জানে যে সে হয় লিখে বা সাইন ল্যাংগুয়েজে মত বিনিময় করতে পারে।
শ্যামাসঙ্গীতের একটি লাইন-- "মায়া মোহ ভোগ তৃষ্ণা দেবে তোরে যতই তাড়া,
বোবার মত থাকবি বসে সে কথায় না দিয়ে সাড়া।"
এখানে বোবা শব্দটি পজিটিভ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ স্থুল প্রলোভন এড়িয়ে যাওয়া।
২ এখানে চামার শব্দের উদাহরণ লাগসই হয়নি।
কর্মকার> কামার, চর্মকার> চামার, কুম্ভকার> কুমার। তিনটিই পেশাবাচক।
অথচ, , কামার কুমোর শব্দে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু চামার শব্দে রয়েছে।এটা গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয় এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। কারণ মৃত পশুর চামড়া নিয়ে কাজ ঘৃণ্য পেশা মনে করা হত। দরকার সমাজে ওই পেশাটিকে অন্য জীবিকার সমান মনে করা, তাহলেই মুখ বেঁকিয়ে গালি হিসেবে চামার বলা বন্ধ হবে।
একই ভাবে আজ ঝি-চাকর বলা বন্ধ হয়ে কাজের মাসি ইত্যাদি বলা হয়। দেহোপজীবিদের আজ যৌন কর্মী বলে বোঝানো হয় যে এটিও অন্য অনেক মনোরঞ্জনকারী জীবিকার মত ( নট, ভাঁড় , গায়ক, ক্রীড়াবিদ) আর একটি অর্থকরী জীবিকা মাত্র। এই বোধ ব্যাপক্ স্তরে স্বীকৃতি পেলে মেয়েদের গালি দিতে 'বেশ্যা' শব্দের ব্যবহার উঠে যাবে।
আর আলোচনায় বক্তব্য নিয়ে যুক্তি নিয়ে বিরোধিতা হোক, কিন্তু ব্যক্তি আক্রমণ খুব জরুরি কি?
রঞ্জনবাবু, লেখাটি সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। শুধু আপনাকে ধরতাই দেওয়ার জন্য বলি, মনোরঞ্জন ব্যাপারি আপত্তি জানিয়েছিলেন 'চুরিচামারি' শব্দটি নিয়ে। যেখানে চোর ও চামারকে একাসনে বসানো হচ্ছে। অত্যন্ত সঙ্গত আপত্তি এবং কে না জানে এই ধরণের লব্জ ব্যবহারে ভদ্রলোক শ্রেণি ওস্তাদ।
"চামার" খুবই লাগসই উদাহরন দিয়েছেন। তাচ্ছিল্যবাচক শব্দ ব্যবহারের অভ্যেস আমাদের প্রচুর। আনস্মার্ট বোঝাতে গাঁইয়া, অক্ষম বোঝাতে নপুংসক, হিজড়ে এমন ব্যবহারের উদাহরন প্রচুর। "মেয়েছেলের মত" "হাতে চুড়ি পরে থাকা" ইত্যাদি শব্দবন্ধ এখনও ব্যবহার হয়। এমন কি হালের শব্দ "প্রেস্টিটিউট" আদতে যৌনকর্মীদের অপমানসূচক শব্দ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা বযবহারে আমাদের সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বলেছে। যেমন, সরাসরি সংবাদ ইত্যাদিতে এখন যেমন চট করে অক্ষম বোঝাতে কেউ নপুংসক ব্যবহার করে না। এটা সম্ভব হয়েছে দশকের পর দশক ধরে সচেতনতা বাড়ানো এমন আলোচনার ফলে। শুরু শুরুতে এমনই পলিটিক্যাল কারেক্টনেস ও সাহিত্যের দোহাই দিয়ে ভাষার অসংবেদনশীলতা ঢাকা হত। তাই আশা রাখি এমন দিনও আসবে যখন কেউ "পত্রিকাটি পঙ্গু হয়ে গেছে" ব্যবহার করার আগে দুবার ভাববেন। রবীন্দ্রনাথের দোহাই দেবেন না।
এরকম আরেকটা শব্দ "রিক্সা"। কলকাতায় গেলেই শুনি কেউ কেউ চেঁচিয়ে ডাকছে, রিক্সা অ্যাই রিক্সা! তারপর কাছে এলে, অমুক জায়গায় যাবি? অসম্ভব বিচ্ছিরি লাগে।
অম,
একদম ঠিক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁর সময়ের গড়পড়তা সামাজিক মূল্যবোধের ছাপ থাকবেই। কিন্ত সেটা কোন পত্থর কী লকীর নয়। আর চুড়ি পরে থাকা, গাঁইয়া, হিজড়ে তো এখনও তাচ্ছিল্য করে বলা হয়। রিকশা চালকদের তুই এবং ট্যাক্সিকে তুমি করে বলা কবে বন্ধ হবে?
এলেবেলে,
মনোরঞ্জন বাবুর বক্তব্যের কনটেক্সট আপনার সৌজন্যে জানলাম। শুদ্ধসত্ত্ববাবুর উল্লেখে 'চুরি' গরহাজির।
শুদ্ধস্তত্ব বাবুর "পণ্ডিতি" সহ তৎসংলগ্ন ব্যক্তিগত আক্রমণও যান্ত্রিক বস্তুবাদদুষ্ট। আসলে দ্বিমতের "দর্শন" টিনের চশমায় সম্ভব নয়।
রঞ্জন দাকে ধন্যবাদ, বিতর্কটিকে সঠিক ট্র্যাকে পরিচালনার জন্য। অনেক শিখছি।
*শুদ্ধসত্ত্ব হবে, টাইপো।
ভাষার শাব্দিক অর্থের বাইরে বহুমাত্রিক ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ মাইজভান্ডারির দেহতত্বের গানে :
"খাজার নামে পাগল হইয়া
ঘুরি আমি আজমীর গিয়া রে...
এত করে ডাকলাম তারে
তবু দেখা পাইলাম না...
তুই পাগল, তোর মনও পাগল
পাগল, পাগল, করিস না
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না..."