অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? থাকে না। আর থাকে না বলেই, সেই প্রলয়ের অভিঘাত এসে পৌঁছে যায় আমার বা আমাদের ঘরে।
“আমি” কে এখানে? প্রত্যেকের মত আমার “আমি”ও অনেকগুলো পরিচয়ের সমাহার। যেমন, আমি পেশায় অধ্যাপক, যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াই, যেমন আমি বাঙালি মধ্যবিত্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এ সব কিছুর সঙ্গে আমার আরেকটা পরিচয় আছে। কোভিড ১৯ এবং লকডাউন কি ভাবে আমার সেই পরিচয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে, সে কথা বলতেই এই লেখা।
শুরু করি জনতা কারফিউর দিন থেকে।
২২শে মার্চ দু-হাজার কুড়ি, রোববার, প্রস্তুত হয়েই ছিল সারা দেশ। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই শাঁখ, কাঁসর-ঘন্টা, হাততালি -ইত্যাদি শুরু হয়ে গেল। ঘরবন্দী আমিও দমবন্ধ করা একঘেয়েমি কাটাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিব্যি খালি গলায় গান গাইলাম, কবিতা বললাম। তেরই মার্চ(শুক্রবার) লাস্ট ইউনিভার্সিটি গেছি, তারপরেই তো সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। অফিশিয়ালি লকডাউন শুরু হয়নি বটে, কিন্তু ঘরেই আছি, বেরোচ্ছিনা, বন্ধুরা অনেকেই দেশের বাড়িতে ফিরে গেছে, সারাদিন টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুকে শুধু করোনার খবর, আর শুধু সংখ্যা। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সারা পৃথিবীজুড়ে। আমার ঘুম, মানসিক স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন রুটিন-সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। এসবের মধ্যে পাঁচমিনিটের জন্য শাঁখ-ঘন্টা-গান-কবিতার অন্যরকম কোলাজ মন্দ লাগে নি। ইন ফ্যাক্ট ভালোই লেগেছিল বলব। কিন্তু বারান্দা থেকে ফিরে এসে যখন আবার সেই খবর খুলে বসলাম- যা দেখলাম তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো কই মিলল না। শুধু শাঁখ-কাঁসর-ঘন্টাই নয়, জল গড়িয়েছে ঢাক-ঢোল-চকলেট বোম-কালীপটকা, এমনকি মিছিল পর্যন্ত। বন্ধু-অ্যাক্টিভিস্টদের মেসেজ আসতে থাকল, তাতে লেখা, এই হঠাৎ ক্যাকোফোনির ফলে অল্প সময়ের জন্য হলেও, নানাধরণের প্রতিবন্ধী মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য কিভাবে আফেক্টেড হয়েছে তার বিবরণ। কিন্তু বলবার কথা এই যে, "বিকেল পাঁচটায় পাঁচমিনিট"- এর বিরুদ্ধে উঠে আসা মূলস্রোতের সমালোচনায় এই প্রতিবন্ধী মানুষদের অসুবিধার দিকটা বিশেষ আলোচিত হতে দেখলাম না।
শুধু এক্ষেত্রেই নয়, কোভিড নাইন্টিন ও লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে যে খবর উঠে আসছে তার কতটুকুই বা প্রতিবন্ধী মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার ওপর আলো ফেলছে? এবং তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এই খবর ও তথ্যের কতটুকুই বা তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছচ্ছে? এই লকডাউন ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে কি সাংঘাতিকভাবে আহত করেছে এবং করে চলেছে, সে সম্পর্কে খবর প্রায়ই পাচ্ছি। কিন্তু যে দেশে প্রতিবন্ধকতা দারিদ্র্যের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে, যে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের একটা বড় অংশ অ-সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, সে দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা সেভাবে উঠে আসছে কই? ভাতা ও রেশনের চালের কিছু ব্যবস্থা করা হলেও ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে জানতে পারছি যে আমাদের চারপাশের বহু প্রতিবন্ধী মানুষই হয় তার আওতায় পড়েন না, অথবা সেসব ন্যায্য পাওনা এখনও তাঁদের হাত অব্দি এসে পৌঁছয় নি। তবে এইসব বড় কথা থাক। আমার মত সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কথা বলা বা ভারতবর্ষের প্রতিবন্ধী মানুষদের গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা চূড়ান্ত ধৃষ্টতা বই কি! দারিদ্র্য সম্পর্কে আমার কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। এবং তাই জেনারেলাইজড স্টেটমেন্টের বদলে একটু স্পেসিফিক কথা বলি, আমার কথা বলি।
আমি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ, এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঁ দিকের কানে শোনবার অসুবিধা আছে। আমার পৃথিবীটা বহুলাংশেই নির্ভর করে আমার ডানকানের ওপর। আগেই বলেছি আমি পেশায় অধ্যাপক। তার সঙ্গে আমি বর্তমানে পি-এইচ ডি-ও করছি। অ্যাকাডেমিক কাজকর্মের জন্য আমি রিডার সার্ভিসের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। যে বা যারা আমাকে পড়ে দেয়, লকডাউনের কারণে তারা হয় যে যার দেশের বাড়ি ফিরে গেছে, নাহয় তারা ঘরবন্দী। ফলে এই মুহূর্তে আমার কোনো মানুষ রিডার নেই। হ্যাঁ অ্যান্ড্রয়েড ফোন, স্ক্রীণ রিডিং সফটওয়্যার আছে বটে, ইন্টারনেট-ইউটিউব ইত্যাদিও আছে, কিন্তু আমার অ্যাকাডেমিক অ্যাক্টিভিটি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো নেহাতই অপর্যাপ্ত।
একটু বিশদে বলি, আমার গবেষণার বিষয় রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের নাটক। আমার অধিকাংশ প্রয়োজনীয় বই-ই কেবলমাত্র হার্ড কপিতে পাওয়া যায়। ডিজিটাল মাধ্যমে বা পিডিএফ-এ পাওয়া যায় না, যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুও ফোটো স্ক্যান করে করা, ফলে আমি টকিং সফটওয়ারের মাধ্যমে সেগুলো অ্যাক্সেস করতে পারি না। আমার গবেষণার কাজ অতএব এখন বন্ধ। এবারে আসি পড়ানোর কথায়, অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে শুনছি চারিদিকে, আমিও যে দু-একটা অনলাইন ক্লাস নিইনি তাও নয়। কিন্তু লেকচার প্রিপেয়ার করবার জন্যও আমার আবার সেই রিডার সার্ভিসই দরকার। ইন্টারনেট-ইউটিউব এসব দিয়ে কাজ চালানো যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা ওই কাজ চালানো পর্যন্তই। অতএব অ্যাকাডেমিক কাজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকে যে এই লকডাউন পার করে দেব, সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এ তো গেল টেকনিক্যাল অসুবিধার কথা। কিন্তু এছাড়াও প্রতিনিয়ত আরো বড় একটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমি। আমার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এই মহামারী ও বাধ্যতামূলক গৃহবন্দীত্বের যে কি সাংঘাতিক প্রভাব পড়ছে তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জগৎ অনেকটাই স্পর্শের উপর নির্ভরশীল। এবং আমার ক্ষেত্রে তো এই নির্ভরশীলতা আরো অনেকগুন বেশি। কারণটা আগেই বলেছি- দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি আমার আংশিক শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাও আছে। আক্ষরিকভাবেই আমার কমিউনিটির মানুষদের, আমার বন্ধুদের ছুঁয়ে থাকবার সুযোগ আজ আমার নেই। উপরন্তু, দীর্ঘ সময় ধরে ফোনে কথা বলা আমার কানের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক, এবং সে বিষয়ে আমার ডাক্তারবাবুর কড়া নিষেধ আছে। ফলতঃ, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, আড্ডা দেওয়া বা এমনকি ঝগড়া অথবা তর্ক করা -যা আমার দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ছিল- সেসব এখন বন্ধ। মনখারাপ হচ্ছে, হতাশ লাগছে, অবসন্ন বোধ করছি -কিন্তু আমার বন্ধুদের সঙ্গে সেসব ভাগ করে নিতে পারছি না।
অবশ্যই মা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, এবং এখন তো আরো বেশিই। মনখারাপ হলে মাকে বলছি, কিন্তু তার নিজেরও তো মানসিক অসুবিধা আছে। বিষাদ-হতাশা আছে। এর ওপরে আবার আমার ডিপ্রেশনের ভার চাপিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? ভেবে দেখুন অবস্থাটা- দুজন অবসন্ন মানুষ, চারদেওয়ালের মধ্যে বন্দী, তা প্রায় মাসখানেকেরও বেশি হয়ে গেল। একজন প্রতিবন্ধী, আর একজন সেই প্রতিবন্ধী মানুষের একমাত্র নির্ভর। দুজনেই একে অপরের দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা শুনতে বেশ নাটকীয় লাগলেও এটা বাস্তব। এটা ঘটছে। বিভিন্ন এনজিও এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠার এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য অনলাইন বা টেলিফোনিক কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করেছে শুনেছি কিন্তু ওই যে আগেই বললাম, ফোনে একটানা দীর্ঘ সময় কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
অডিও বুক, গান, কবিতা -এসব নিয়ে থাকবার চেষ্টা করছি। কিন্তু এগুলো তো প্রাথমিকভাবে আমার অবসর কাটানোর উপায়। এখন অবসরই যদি মানুষের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় তবে তা-ই বা আর কতক্ষণ ভালো লাগে! হতাশা ও অবসাদের প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। আমার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের কারণে প্রায় অনেকেই আমাকে অনুপ্রেরণার একটা অনর্গল উৎস হিসেবে প্রজেক্ট করতে বা দেখতে চান। যখনই সুযোগ পেয়েছি, আমাকে এই 'ইন্সপিরেশন পর্ণ্ ' হিসেবে গড়ে তোলবার প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করেছি। তবে এ-কথাও স্বীকার করে নেব যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদের সুযোগ পাইনি, বা পেলেও সবসময় প্রতিবাদ জানাই নি। আজ এই দুঃসময়ে, ক্রাইসিসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ভালনারেবিলিটির কথা, হতাশার কথা, সমাজের সামনে অ্যাসার্টিভলি তুলে ধরতে চাই। এবং সেই সুযোগে সক্ষমতার মোড়ক দিয়ে ঢেকে প্রতিবন্ধকতাকে মোটিভেশনাল বা ইন্সপিরেশনাল হিসেবে পরিবেশন করবার এবেলিস্ট প্রবণতার ওপর আরো একবার আঘাত করতে চাই। নিজেকে ও পাঠকদেরকে সোচ্চারে একথা মনে করাতে চাই, হ্যাঁ, আজ আমি অবসন্ন, ডিপ্রেসড, কিন্তু সে কথা জানাতে আমার কোনো লজ্জা নেই, কোনো সংকোচ নেই। নিজেকে প্রতিনিয়ত রেজিলিয়েন্সের প্রতিমূর্তি হিসেবে তুলে ধরবার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় আমার নেই।
আরেকটা কথা বলে লেখাটা এবার শেষ করব। মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে বা আলোচনায় কোভিড ১৯ ও লকডাউনের প্রসঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষদের অভিজ্ঞতার কথা (বিশেষতঃ তাদের নিজেদের ভাষায়) প্রায় উঠে আসছে না বললেই চলে। যেটুকু আসছে বলাই বাহুল্য যে সেটা একেবারেই selective এবং inadequate। নিজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধাজনক অবস্থানকে মাথায় রেখে এবং সেটিকে ব্যবহার করেই আজ আমি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা গুরুচন্ডালির মত একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরলাম। হয়ত এটি বর্তমান সময়ের একটি দলিল হিসেবে থেকে যাবে যা সাধারণ পাঠকদের পাশাপাশি ভবিষ্যতের গবেষকদেরও একটু অন্যভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।
লেখক পরিচিতিঃ ঈশান চক্রবর্তী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি রবীন্দ্রসাহিত্য, ডিসএবিলিটি স্টাডিজ, ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি, আমেরিকান লিটারেচার নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ২০১৯ সালে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের ক্ষমতায়নের জন্য রোল মডেল বিভাগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে রাজ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হন।