৪- রামবাবু ওরফে রোহিত শাউ
নাবালক রামবাবু কাছারি রোডে মারা যায়। ওর গুলি লেগেছিল। বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। ওর কাকিমা মুনিতা শাউ-এর বিবরণ অনুযায়ী, রামবাবুর বাবা মারা গেছে, আর মা মানসিক প্রতিবন্ধী। উনি মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি অভিযোগ জানান যে আহত হওয়ার পর ৪০ মিনিট অবধি ওর কোনো চিকিৎসা হয়নি।
আমরা: ওই দিনের কথা কিছু বলতে পারবেন?
মুনিতা শাউ: আমরা একসাথে থাকি। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করলেন। ময়নাতদন্তের পর বিকেলে পুলিশ আমাদের মৃতদেহ দেয়।
আমরা: ও ওখানে কী করছিল?
মুনিতা শাউ: ভাটপাড়ায় সকাল ১০ টা নাগাদ বোম পড়া শুরু হয়। আমি মেয়েকে স্কুলে দিতে গেছিলাম। ও বলল যে জলখাবারের জন্য কচুরি আনতে যাচ্ছে। ফুচকা বিক্রি করত। তার জন্য কিছু জিনিস কেনারও দরকার ছিল। আমি স্কুলে গেলাম। রামবাবু কিনতে গেল ওইসব। মোড়ের মাথায় পৌঁছে শুনলাম স্কুল বন্ধ বোম পড়ার জন্য। আমি ফিরে এলাম। রাস্তা পার করছিলাম, ও অন্য পাশ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। হঠাৎ গুলি লাগল—একটা নয়, পাঁচ-পাঁচটা।
আমরা: পুলিশের গুলি?
মুনিতা শাউ: হ্যাঁ। একদিকে বোমা পড়ছে আর অন্যদিকে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। আমি দৌড়ে গেলাম ওকে আনতে, পুলিশ বাধা দিল। আমায় বলল আমি গেলে আমারও গুলি লাগতে পারে। একটা পাঞ্জাবি লোক ওখানে শিঙাড়া বিক্রি করে, ও আমায় থামাল। একটু পর পুলিশ এল। আমি হাতে পায়ে ধরে বললাম ওকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে। নিয়ে গেল।
আমরা: আপনাকে কী বলে থামাল পুলিশ?
মুনিতা শাউ: বলল না যেতে, নাহলে ওরা গুলি চালাবে। আমি ২০-৩০ মিনিট পর যেতে পারলাম। অকারণে গুলি চালাচ্ছিল। একজন ফলের রস বিক্রি করত, ওরও গুলি লেগেছিল। আমি যখন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনও ওরা গুলি চালাচ্ছিল। আমার সামনেই ওরা ৪-৫ রাউন্ড গুলি চালাল।
আমরা: মানে ওরা নিরীহ লোক মারছিল?
মুনিতা শাউ: না, ওরা (দাঙ্গাবাজরা) বোমা ছোড়াছুড়ি করছিল। কিন্তু রাস্তায় লোকজনকে আটকাতে পুলিশও গুলি চালানো শুরু করল। কিন্তু ওরা নিরীহ লোকের উপর গুলি চালাচ্ছিল। যেসব লোক জলের রস খাচ্ছিল বা কচুরি খাচ্ছিল তাদের উপর গুলি চালাল।
আমরা: প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ এসেছে এই মৃত্যুর পর?
মুনিতা শাউ: অনেকে এসছিলেন। দিল্লিতে থেকে আলুয়ালিয়া এসছিলেন, অর্জুন সিংহ এসছিলেন আরও অনেকে। আমি সবাইকে চিনি না।
আমরা: SDO বা BDO আসেননি?
মুনিতা শাউ: হ্যাঁ এসছিলেন।
আমরা: ওনারা কিছু সাহায্য করেছেন?
মুনিতা শাউ: ওরা বললেন যে দেখুন যে মারা গেছে তাকে তো আর বাঁচানো যাবে না। আমরা ১০ লাখ টাকা আর সরকারি চাকরি দিতে পারি যাতে আপনাদের পরিবার স্বচ্ছল ভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
আমরা: এখনও অবধি কিছু পেয়েছেন?
মুনিতা শাউ: ২.৫ লাখ টাকা আর পৌরসভায় একটি অস্থায়ী কাজ দিয়েছেন। রামবাবুর দাদা ওই কাজে যোগ দিয়েছে।
আমরা: ওর ক-জন ভাইবোন?
মুনিতা শাউ: তিন বোন দুই ভাই ।
আমরা: আপনারা পশ্চিমবাংলায় কতদিন আছেন?
মুনিতা শাউ: আমার জন্ম আর বিয়ে দুইই এখানে।
আমরা: ফুচকা বেচার সাথে সাথে কোন্ একটা দোকানে কাজ করত না?
মুনিতা শাউ: প্রথমে ফুচকাই বেচত। কিন্তু ১০ দিন ধরে দাঙ্গা চলছিল বলে আমরা ওকে বেরোতে বারণ করেছিলাম। তাই ফুচকা বিক্রি বন্ধ করে একটা দোকানে কাজ করছিল।
আমরা: আপনারা এরকম দাঙ্গা আগে কোনোদিন দেখেছেন?
মুনিতা শাউ: না, জীবনেও না।
আমরা: বিয়ের আগে কোথায় থাকতেন?
মুনিতা শাউ: হাজিনগর।
আমরা: হাজিনগরেও তো ২০১৭ তে দাঙ্গা হয়েছিল?
মুনিতা শাউ: হ্যাঁ তা হয়েছিল। তবে কাঁকিনাড়াতে এই প্রথমবার দাঙ্গা দেখলাম।
আমরা: আপনার কাপড় সেলাইয়ের দোকান আছে। মানে আপনি তো ব্যবসায়ী?
মুনিতা শাউ: বাচ্চাদের খাওয়াতে যা করতে হয়, তাই করি। আগে ইলেকট্রিকের দোকান ছিল। চালাতে পারিনি। রামবাবু রোজগার করত। সেও আর রইল না।
আমরা: এখানে কি আবার দাঙ্গা হবার সম্ভবনা আছে?
মুনিতা শাউ: কী করে বলি? আমরা মনে করছি যে এখানে হিন্দু মুসলিম ঐক্য আছে। কিন্তু রাজনীতির খেলা তো জানেন।
আমরা: ক্ষতিপূরণ কে দিচ্ছে? রাজ্য সরকার না কেন্দ্র সরকার।
মুনিতা শাউ: রাজ্য সরকার, মানে অর্জুন সিংহ আর কি।
আমরা: তাহলে তো কেন্দ্রের টাকা হতে পারে?
মুনিতা শাউ: টাকা অর্জুন সিংহের থেকে এসেছে।
আমরা: এখানে থাকতে কি ভয় করে?
মুনিতা শাউ: সাধারণ কোনো আওয়াজ হলেই ভাবি বোম পড়ল। বাচ্চারা ঠিক করে খেতে পারে না। সামান্য আওয়াজ হলেই কেঁদে উঠে বলে “মা আবার বোম পড়ছে”। আপনারা এখানে থাকলে আপনাদেরও ভয় লাগত।
আমরা: স্থানীয় মুসলিমদের সাথে এখনও সম্পর্ক আছে?
মুনিতা শাউ: হ্যাঁ, থাকবে না কেন? সামনে ইদ আসছে, ওদের জামাকাপড় সেলাই করে দিই আমি। এসব হিন্দু-মুসলিম করতে থাকলে ব্যাবসা কী করে চালাব?
দোকানের একজন: নির্বাচনের সময় থেকে সমস্যা শুরু হয়। মূলত দুই নেতার মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। পরে হিন্দু-মুসলিমের ব্যাপারটা এসে যায়। আমরা সবাই এমনিতে খুব ব্যস্ত থাকি, সক্রিয় রাজনীতি করার সময় কার আছে?
কথা শেষ হবার পর আমরা মুনিতা শাউ-এর মেয়েদের সাথে দেখা করি। ওরা একইসঙ্গে লেখাপড়া করে আবার মাকে দোকানে সাহায্য করে। ওনার বড়ো মেয়ে কলেজে পড়াশোনা করে।
আমরা আর-একজন নিহত, ধরমবীর শাউ-এর বাড়ির দিকে এগোতে থাকলাম। যাওয়ার পথে আমরা শাউ সমাজ ট্রাস্টের পাশ দিয়ে গেলাম—স্থানীয় মহিলারা ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বহু মানুষ কাঁকিনাড়া হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
৫ - ধরমবীর শাউ
ধরমবীরের দাদা কৃষ্ণ শাউ-এর সঙ্গে আমরা কথা বললাম। ওনাদের পরিবারের ফুচকার ব্যাবসা। আমরা ফুচকা তৈরির জায়গায় কথা বললাম। প্রথমে উনি মিডিয়ার লোকেদের সঙ্গে কথা বলায় বিরক্তি প্রকাশ করলেও পরে আমাদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করায় ভদ্র ভাবে কথা বললেন। ধরমবীরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করানোর ব্যাপারে ওনার আপত্তি ছিল।
আমরা: এখানে সবাই মোটামুটি ফুচকা বিক্রি করেন?
কৃষ্ণ শাউ: ৫-৬ টি পরিবার করে। আবার অনেকে সরকারি চাকরিও করেন, অনেকে জুটমিলে আছেন। আমাদের পরিবার ফুচকা বেচে, আমরা ওবিসি।
আমরা: কত বয়স হয়েছিল ওনার?
কৃষ্ণ শাউ: ৪১ বছর ।
আমরা: ওইদিন কী হয়েছিল?
কৃষ্ণ শাউ: কতবার এক গল্প বলব? কী লাভ বলে? ওদের চাকরি দরকার, না হলে বাঁচবে কীভাবে? (একটু বিরক্ত হলেন)
আমরা: পরিবারে কতজন আছেন?
কৃষ্ণ শাউ এক ছেলে, এক মেয়ে আর ধরমবীরের স্ত্রী।
আমরা: সাহায্য পেয়েছেন কোনো?
কৃষ্ণ শাউ: হ্যাঁ, অর্জুন সিংহ সাহায্য করেছেন। ভাটপাড়া পৌরসভায় ক্যাসুয়াল ওয়ার্কার বিভাগে একটা কাজ দিয়েছেন। বাচ্চাদের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ব্যাবস্থাও করে দিয়েছেন। আর কেউ কিছু করেনি। আমাকে বলা হয়েছিল আমাদের পরিবার ১০ লাখ টাকা পাবে, ২.৫ লাখ পাওয়া গেছে এখনও অবধি। শুধু মিডিয়া আসে আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। লোকে যায় আর আসে, কিন্তু কেউ কিছু করে না ।
আমরা: ওনার কি ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছিল?
কৃষ্ণ শাউ: ছেলের জন্য শরবৎ আনতে গিয়েছিল। (ছেলেটি তখন পাশে দাঁড়িয়ে)
আমরা: নাম কী তোমার?
ছেলেটি: সুজন, আর আমার বোন নাতাশা।
আমরা: কোন্ স্কুল?
ছেলেটি: কাঁকিনাড়া হাই স্কুল ।
আমরা: তারপর কী হল বলুন? (কৃষ্ণ শাউ-এর দিকে তাকিয়ে)
কৃষ্ণ শাউ: খবর পেলাম যে ও আহত। তখন ফুচকা ভাজছিলাম। তাড়াতাড়ি ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হসপিটালে নিয়ে গেলাম। তারপর কলকাতার অ্যাপোলো হসপিটালেও নিয়ে গেলাম কিন্তু বাঁচানো গেল না। পেটে গুলি বিঁধে গিয়েছিল।
আমরা: বাঁচার কোনো সম্ভবনা ছিল?
রজক: প্রথমে তো দেহ নিতে দিচ্ছিল না।
কৃষ্ণ শাউ: দেখুন, সত্যি বলতে কি আমি জানি না। আমি গিয়ে দেখলাম ৪-৫ জন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।
আমরা: পুলিশ এই ব্যাপারে কী বলল? গুলি চালানোর ব্যাপারে?
রজক: পুলিশের দাবি ওরা বোমা ফেলছিল, পুলিশ ওদের থামতে বলেছিল। ওরা থামেনি বলে গুলি চালিয়েছে।
কৃষ্ণ শাউ: এটা কখনও হয়? পুলিশ কী একটা বলল ওরা শুনল না আর গুলি চালিয়ে দিল? আমার ছেলে কথা না শুনলে আমি গুলি চালিয়ে দেব?
আমরা: এটা কবে হয়েছে?
কৃষ্ণ শাউ: নতুন পুলিশ স্টেশন যেদিন উদ্বোধন হল সেদিনকেই। তারিখটা ছিল ২০ জুন। আর কী বলব ভাই, ভালোলাগছে না। আমাদের সবরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আমরা: হ্যাঁ খুব স্বাভাবিক, আমরা বুঝতে পারছি।
কৃষ্ণ শাউ: নির্বাচনের আগে এসে সব বড়ো বড়ো কথা দিয়ে যায়, আর বিপদের সময় কেউ আসে না।
আমরা: পুলিশ এসছিল?
কৃষ্ণ শাউ: এসছিল, কিন্তু কী করবে এসে?
আমরা: পুলিশের উপর লোকে রেগে নেই?
কৃষ্ণ শাউ: হ্যাঁ রেগে আছে পুলিশের উপর ।
আমরা: পুলিশ টহল দেয়?
কৃষ্ণ শাউ: প্রথমদিকে আসছিল কয়েকদিন, এখন ওসব বন্ধ।
আমরা: কী মনে হয়, পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হতে পারে?
কৃষ্ণ শাউ: কী করে বলি বলুন তো! আমরা তো সবাই শান্তিতে থাকতে চাই। বিক্রিও বাজে ভাবে কমে গেছে।
আমরা: এই পর্যায়ের ঝামেলা আগে দেখেছেন?
কৃষ্ণ শাউ: আগে রাজনৈতিক দলের মধ্যে দাঙ্গা হত। এখন হিন্দু-মুসলিমে হচ্ছে—এটা আগে ছিল না।
আমরা: মুসলিম এলাকায় যান? নাকি যেতে ভয় করে?
কৃষ্ণ শাউ: হ্যাঁ যাই তো! ওরাও আসে। এভাবে কী থাকা যায় নাকি? তবে কী জানেন, এখন লোকের মনোভাব পালটে গেছে। মনে মনে ভয় ধরে গেছে। আমি হিন্দু, ওরা মুসলিম—কিন্তু আমরা কেউ কারও ক্ষতি চাই না।
আমরা: আমরা শুনেছি বাইরের লোকের সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের লোকও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কোনো ধারণা আছে কে বা কারা?
কৃষ্ণ শাউ: না, আমরা শুনেছি ওরা পুলিশের উর্দি পরে এসে সাধারণ মানুষকে মারধর করেছে। পুলিশের উর্দি থাকলেও জুতো ছিল না, চটি ছিল। এভাবেই বুঝতে পারলাম ওরা পুলিশ নয়—এটা রাজনৈতিক ঘটনা। জানেন, আমাদের হিন্দুদের বাড়িতে একটা ছুরি পর্যন্ত থাকে না। অতিথি আসলে আমরা প্রতিবেশীদের থেকে ছুরি নিয়ে আসি।
রজক: দেখুন, কুরবানির জন্য মুসলিমদের ঘরে চাপাটি থাকে। মানে হিন্দুদের ঘরে ওসব থাকে না, উনি এটাই বলতে চাইছেন।
আমরা: মানে বলছেন যে হিন্দুরা দুর্বল?
কৃষ্ণ শাউ: না, আমার সেটা মনে হয়নি। এখন আমরা তৈরি। মুসলিমরা কাছাকাছিই থাকে। এর আগে এমন তো হয়নি।
আমরা: আগেকার পরিস্থিতি পালটে যাবার মতন এমন কী হল?
কৃষ্ণ শাউ: আমাদের ভিতরের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা বাইরের লোকেরা এসে পাকায়।
আমরা: এখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব আছে তো?
কৃষ্ণ শাউ: দেখুন একবার একটা জিনিস ভেঙে গেলে সেটা আর কোনোদিন পুরোপুরি ভাবে জোড়া লাগানো যায় না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কাল ওদের কুরবানি ইদ আছে, কয়েকদিন পর আমাদের রাখি। কেউ এই মরশুমে ঝামেলা চায় না। ঝামেলাতে শুধু রাজনৈতিক দলেরই সুবিধা হয়। একদল লোক আছে যারা শুধু লুট করতে চায়। ওরা সবসময় ঝামেলা খোঁজে। দেখুন আমি ভাইকে হারিয়েছি, এই ছেলেটি বাবাকে হারিয়েছে। যার যায় সেই বোঝে। আমার ভাইয়ের স্বপ্নগুলি অপূর্ণ রয়ে গেল।
আমরা: আপনারা কি পার্টি ক্যাডারদের দেখতে পেয়েছিলেন নাকি পুলিশের উর্দিতে গুণ্ডা?
কৃষ্ণ শাউ: আমি ওখানে ছিলাম না, আমি শুধু শুনেছি।
আমরা: আপনি তৈরি হয়ে থাকার কথা বলছেন, যে হিন্দুরা তৈরি। কীরকম ভাবে নিজেদেরকে তৈরি করলেন?
কৃষ্ণ শাউ: ওরা আমাদের আর ক্ষতি করতে পারবে না, এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
৬- প্রভু শাউ
প্রভু শাউ দিল্লি থেকে এসছিলেন ছুটি কাটানোর জন্য। ওনার তিন মেয়ে। উনি পুলিশের গুলিতে মারা যান। ওনার স্ত্রী শ্যামলী শাউ-এর সঙ্গে আমরা কথা বললাম। ওনার চার মেয়ে সঞ্জনা, রঞ্জনা, বৈষ্ণবী, এবং বর্ষা-ও উপস্থিত ছিল, যখন আমাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তাগুলি হয়।
আমরা: ঘটনা যেদিন ঘটে সেই দিনের ব্যাপারে আমাদের কে একটু বলুন
শ্যামলী শাউ: দাঙ্গা হচ্ছিল, উনি ঘরের ভিতর ছিলেন। হঠাৎ উনি দৌড়ে গেলেন আর একটা গুলিতে আহত হলেন। পুলিশ দেখে উনি পালাতে চেষ্টা করেছিলেন।
আমরা: উনি তো ঘরেই ছিলেন, পালাতে গেলেন কেন?
শ্যামলী শাউ: উনি ঠিক ঘরের ভিতর ছিলেন না, কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। গলির পিছন দিকটায় পৌঁছে ছিলেন। হঠাৎ তারপর একটা ছাদের উপর দিয়ে দৌড়াতে থাকলেন, এমন সময় ওনার পায়ে গুলি লাগে। উনি আর-একটা ছাদে লাফালেন। এসবেস্টসের তৈরি ছিল, ভেঙএ পড়ল। বাড়িতে পড়ে গেলেন। পুলিশ ওনার মাথায় আর বুকে গুলি করে।
আমরা: আপনারা পুলিশে অভিযোগ নথিভুক্ত করেছেন?
শ্যামলী শাউ: হ্যাঁ, করেছি, কিন্তু আজ অবধি কিছুই হয়নি। উনি ১২ জুলাই মারা গেলেন। ১৩ তারিখ পুলিশ আমাদের মৃতদেহ দেয়। পরিষ্কার দিনের আলোয় হয়েছিল ঘটনাটি।
আমরা: উনি কী কাজ করতেন?
শ্যামলী শাউ: আমরা দিল্লিতে থাকি, উনি ওখানে কাজ করতেন। এখানে আমরা ছুটিতে এসেছিলাম। উনি বোরিং-এ কাজ করতেন।
আমরা: এরকম হবে ভাবতে পেরেছিলেন?
শ্যামলী শাউ: না, কোনোদিন ভাবিনি আমাদের সাথে এরকম হবে।
আমরা: ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছেন?
শ্যামলী শাউ: না, পৌরসভায় কাগজপত্র জমা দিয়েছি পাবার জন্য।
আমরা: উনি পালাতে কেন গেলেন?
শ্যামলী শাউ: আসলে উনি দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই পালাচ্ছে দেখে উনিও পালাতে চেষ্টা করলেন।
আমরা: আপনার কি মনে হয় ওনাকে নিশানা করেই মারা হয়েছে?
শ্যামলী শাউ: আমি কী করে জানব? আপনারা চেষ্টা করলে হয়তো জানতে পারবেন।
আমরা: উনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
শ্যামলী শাউ: না।
আমরা: প্রশাসনের থেকে কেউ দেখা করতে আসেনি আপনাদের সঙ্গে?
শ্যামলী শাউ: না।
আমরা: অর্জুন সিংহ আসেননি?
শ্যামলী শাউ: না, তবে সাহায্য পাঠিয়েছেন।
আমরা: আপনারা ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন?
শ্যামলী শাউ: না, এখনও অবধি আমরা কিচ্ছু পাইনি।
রজক: আমরা শুনলাম ওনারা সাহায্য পাবেন কিন্তু এখনও অবধি কিছু পাননি।
আমরা: ওনারা কি এখানে থাকেন না বলে?
রজক: হতে পারে।
যাঁরা মারা গেছেন বিজয় রজকের চোখে তাঁদের অধিকাংশই দাঙ্গাকারী নন। বিশেষত, যদি খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে নিহতদের কেউই অতীতে কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এখন সবকিছুতেই সাম্প্রদায়িক রং লাগানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন জায়গায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে যেখানে হিন্দু বসতি শেষ হচ্ছে আর মুসলিম বসতি শুরু হচ্ছে—বর্ডার জাতীয় এলাকায়। মদন মিত্র বাস্তবিকেই গুণ্ডা পাঠিয়েছিলেন, আর তাতেই পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
৭ - লালা চৌধুরী
নৈহাটি স্টেশনে লালার ফুচকার দোকান আছে; দাঙ্গা-আক্রান্তদের মধ্যে তিনিও একজন। লালারা তিন ভাই, দুইজন মারা গেছেন তিন মাসও হয়নি, লালা অবিবাহিত, বাড়িতে আছেন বাবা বিরজু চৌধুরী আর মা কাজল চৌধুরী। ছোটোভাই তার সুরাসক্তির শিকার হয়ে লিভার খারাপ হয়ে মারা গেছেন। বসবাসের জায়গা বলতে একটা ছোটো ঘর, সামান্য বর্ষাতেই ভিতরে জল জমে যায়।
আমরা: ঘটনাটা ঘটল কখন?
বিরজু: ২ জুলাই, ও তো নৈহাটি চলে গেল দোকান খুলতে, মাঝেসাঝে ও তো ওখানেই থেকে যায়। সেইদিনও আসেনি, যদিও খুব কমই হয় এরকম। আমরা ভাবলাম হয়তো কোনো কারণে দোকানেই থেকে গেছে, আমি তো চটকলে কাজ করি, অপেক্ষা করতে করতে শেষ অবধি রাত্রি ১ টা নাগাদ শুতে যাই। পরের দিন ভোরবেলাই, ওর মা স্টেশনে যায়, ওর পাশের দোকানের মালিক বলে—কাকিমা ও তো কাল তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেছিল।
আমরা: ফোন করেনি?
বিরজু: ফোন নেই। ও যে শর্টকাটটা দিয়ে ফেরে ওটা দিয়ে আসতে কতবার বারণ করেছি। যবে থেকে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, তবে থেকেই বারণ করে যাচ্ছি, ওই যে বারিয়া পট্টির শনি মন্দিরটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা রেল লাইন ঘেঁষে যাচ্ছে ওটা। কী আর বলি? ভাগ্যটাই খারাপ ছিল ওর। আমি ঠিক জানি, ওই রাস্তা দিয়ে ফেরার সময়ই ওরা পাকড়াও করেছিল।
আমরা: ওই এলাকাটা…
কাজল: ওটা মুসলিম এলাকা, শরীরটা পেলাম ওখানেই, মাথাটা হাসনাবাদে ওখান থেকে বারাসাতে। (কাঁদতে শুরু করেন, একটা ভারী আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়)
আমরা: মানে, মাথাটা শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছিল?
রজক: আসলে খুনি মাথাটাকে একটা খবরের কাগজ মুড়ে ঝুড়িতে রেখেছিল, তারপর সেটাকে ট্রেন এর বগিতে তুলে দেয়।
বিরজু: গাড়ি ওখান থেকে কারশেডে ঢোকে, সেখান থেকে হাসনাবাদ হয়ে বারাসাত। আমি যখন বডি শনাক্ত করতে গেলাম, ওখানে দুজন পুলিশ আমায় ধরে বলতে থাকে কাকু আপনাকে শক্ত হতে হবে, আমি বললাম, ছেলেটাকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না, কীই বা দেখার আর বাকি আছে? সাড়ে ছ-ঘণ্টা ধরে ঘুরেছি আমি, আমি নিশ্চিত মাথাটা মেশিনে কেটে আলাদা করা হয়েছে।
রজক: এক ফোঁটা রক্তও পড়েনি, পুরো পরিষ্কার।
আমরা: পুলিশ কী বলল? রেল দুর্ঘটনা নিশ্চয়ই নয়?
বিরজু: না, না, বলার কোনো উপায় ছিল না।
[কাজল চৌধুরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছিলেন, আর আমাদের পক্ষে সেই মুহূর্তে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন ছিল। বিজয় রজক কথোপকথন চালিয়ে গেলেন।]
রজক: মাথাটা কোথা থেকে কেটেছিল?
বিরজু: ঘাড়ের তলা থেকে, পুলিশরা বলছিল মারার আগে অত্যাচারও চালিয়েছে। মুসলিমদের ছাড়া একাজ অন্য কারও নয়… আমার ছেলেটা ধর্মের বলি হয়ে গেল। সবাই বলাবলিও করছিল ও কাজ মুসলিমদের।
আমরা: আপনি কী করে জানলেন?
বিরজু: অমন নিখুঁত করে মাথাটা কেটে ফেলা ভালো কসাই ছাড়া অন্য কেউ পারবে না, কাছেই একটা কসাইখানা আছে।
রজক: শুনেছিলাম লিঙ্গটিও কেটে নিয়েছিল, সত্যি নাকি?
বিরজু: হ্যাঁ, কিছুই অবশিষ্ট ছিল না ওখানে। তা ছাড়া শরীরের অন্য কোথায় কোনো ক্ষত নেই।
রজক: শরীরটা কোথায় পেয়েছিলেন?
বিরজু: রেল লাইনের পাশে ফাঁকা মাঠটায়।
আমরা: ওখানে কি ট্রেন থামে? না হলে মাথাটা তুলল কী করে?
বিরজু: স্টেশনে তো থামে, কাছেই একটা স্কুলও আছে। ছেলেপুলে নেশা করে ওখানে বসে।
আমরা: FIR করেছিলেন?
বিরজু: করেছিলাম তো, কোনো সুরাহাই হয়নি ।
আমরা: কারও সঙ্গে ওনার শত্রুতা ছিল?
বিরজু: না না, যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন লালা কেমন ছিল। ও মারা যাওয়ায় একদিনের জন্য নৈহাটি মার্কেট বন্ধ ছিল। আমি কত মারধোর করেছি একটাও কথা বলেনি উলটে। কাছেই একটা পুকুর আছে, সবাই স্নান করে চলে গেলে ও যেত। খালি ফুচকার তেঁতুল আনার জন্য বাইরে বেরোত।
আমরা: সরকারের থেকে কেউ এসেছিল?
বিরজু: পবন সিং এসেছিলেন।
আমরা: কী বললেন?
বিরজু: দেখুন, ও তো কোনো পার্টি করত না, নিজের ব্যাবসা নিয়েই থাকত। ও ফুচকা কিনত আর আমরা আলু-মটর সেদ্ধ করতাম। ছেলেটা শুধু এই জাতিদাঙ্গার বলি হয়ে মুসলিমদের হাতে অকালে মারা পড়ল।
আমরা: হিন্দুরাও তো মুসলিমদের মেরেছে।
বিরজু: হ্যাঁ, বোম ফেলেছিল তো। পুলিশ মুসলিমগুলোকে অ্যারেস্ট করছে আর মমতা ব্যানার্জি ফোন করে ছেড়ে দিতে বলছেন। খোদ পুলিশি একথা বলছে। অজয় ঠাকুর বলেছিলেন, পুলিশ চাইলে দু-ঘণ্টার মধ্যেই সব থামিয়ে দিতে পারত, বিশ্ব হিন্দু পরিষদও পারত, করতে দিল না তাই।
রজক: না সেটা বেআইনি হত।
বিরজু: মনোজ বর্মা এসেছিলেন, খুব ভালো অফিসার। কিন্তু উনি বদলি হয়ে গেলেন।
আমরা: সরকারের তরফে কিছু পেয়েছিলেন?
বিরজু: এখনও না, পুলিশ ছাড়া রাজ্য সরকারের তরফে কেউ আসেননি। পবন সিং এসেছিলেন। ব্যাস, ওই অবধিই। আমার সবথেকে ছোটো ছেলেটা এখন জুটমিলে খাটে।
আমরা: উনি কি বিবাহিত ছিলেন?
বিরজু: না, বিয়ে করেনি। ও বলত আগে বোনেদের বিয়ে দিয়ে তারপর কিছু ভাববে। ওদের বর্ধমানে ভালো বাড়িতে বিয়ে হয়ে গেছে। পুলিশ ওদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল, আমি রেগে গিয়েছিলাম, ওদের অযথা বিরক্ত করতে বারণ করে দিই।
আমরা: এসব শুরু হল কোথা থেকে?
বিরজু: রাম নবমীতে। মদন মিত্র এসে ব্যাপার আরও ঘোরতর হয়ে যায়। এই রাস্তা দিয়েই গেলেন (বাড়ির সামনের সদর রাস্তাটা দেখিয়ে দেন)। স্কুলের মহিলারা ওনার গায়ে হাত তোলে, ওখান থেকেই শুরু, আমাদের এলাকাটা ওনার বিষনজরে পড়ে যায়।
আমরা: মহিলারা মেরেছিলেনই বা কেন?
বিরজু: ১৯ তারিখের ঘটনা, উনি গালাগাল দিয়েছিলেন।
আমরা: আপনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কথা বলছিলেন, ওরা পারবে এদের সাফ করে ফেলতে? সেটা কীভাবে সম্ভব?
বিরজু: নিশ্চয়ই, একবার সুযোগ দিয়েই দেখুন না।
(ক্রমশঃ)
"কৃষ্ণ শাউ: দেখুন একবার একটা জিনিস ভেঙে গেলে সেটা আর কোনোদিন পুরোপুরি ভাবে জোড়া লাগানো যায় না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কাল ওদের কুরবানি ইদ আছে, কয়েকদিন পর আমাদের রাখি। কেউ এই মরশুমে ঝামেলা চায় না। ঝামেলাতে শুধু রাজনৈতিক দলেরই সুবিধা হয়। একদল লোক আছে যারা শুধু লুট করতে চায়। ওরা সবসময় ঝামেলা খোঁজে।"
এটাই মোদ্দা কথা। প্রান্ত জনের আবার জাত কী?
ওপারে রাজনৈতিক কারণে দাংগা হয়। স্বীকার করি, এপারে দাংগা নয়, হয় নিষ্ঠুর জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন। তবে এ-ও রাজনৈতিক চাল। আর কখনো খোদ রাষ্ট্র এইসব নিপীড়নকে উস্কে দেয়।