মহানবী সম্পর্কে অবমাননামূলক মন্তব্যর জন্য বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একই বক্তব্য টুইট করার জন্য দলের দিল্লি শাখার নবীন জিন্দালকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বোঝাই যায় দলে নূপুর যথেষ্ট ওজনদার নেত্রী যে কারণে মূল বক্তব্যটি তাঁর হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে শুধুমাত্র সাসপেন্ড করা হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন কে এই নূপুর শর্মা? আশি নব্বইয়ের দশকে বিজেপির অতি পরিচিত মুখ ছিলেন বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, গোয়ালিয়রের রাজমাতা। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানে রূপ কানোয়ার যখন তাঁর স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। সতীদাহ ফিরিয়ে আনার তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সারা দেশ ধিক্কার জানিয়েছিল। তাঁর যোগ্য দুই উত্তরসূরি ছিলেন উমা ভারতী ও সাধ্বি রিতাম্ভারা। এঁরা ধর্মীয় বাতাবরণে, ধর্মীয় শিক্ষায় ও ধর্মগুরুদের আশ্রয়ে লালিত পালিত হয়েছেন। এঁদের বেশভূষা ছিল সাবেকি সাধ্বীদের মত, আদবকায়দা আটপৌরে, ভাষা কর্কশ, বিষময়, বেলাগাম ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোয় এঁদের জুড়ি মেলা ছিল ভার।
একবিংশ শতাব্দীর বিজেপিতে উপরোক্ত ধরণের নেত্রীরা পিছনে চলে গেছে। এখন তাঁদের পোস্টার গার্ল নূপুর শর্মা, মনিকা অরোরা, সোনালি চিতলকার, প্রেরণা মালহোত্রা। এঁরা উচ্চ শিক্ষিতা। মনিকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সোনালি ও প্রেরণা দিল্লির মিরান্ডা হাউস এবং রামলাল আনন্দ কলেজের অধ্যাপিকা। বিশ বছর আগেও বিজেপিকে মনে করা হতো একটা বানিয়াদের দল, দূরবীন দিয়ে খুঁজেও তাঁরা তাঁদের হয়ে বলার মত কোন বুদ্ধিজীবী পেতেন না। যুগ আমূল পাল্টে গেছে। ২০২০র দিল্লি ‘দাঙ্গা’র একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এই প্রথম শাসক তাঁর পেটোয়া লোকজনদের দিয়ে একটি তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট তৈরি করে ফেলে। মনিকা, সোনালি ও প্রেরণা ছিল সেই রিপোর্টের কারিগর যাতে তাঁরা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, শাহীনবাগ, জামিয়া-জেএনইউতে প্রতিবাদ এবং অবশেষে ‘দাঙ্গা’, পুরোটাকেই একটা আর্বান নকশাল-জিহাদি চক্রান্ত হিসাবে সাব্যস্ত করে। ব্লুমসবেরি থেকে তাঁরা এই রিপোর্টটিকে বই হিসাবে প্রকাশিত করারও চেষ্টা করে। বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অন্যতম গেস্ট অফ অনার ছিলেন এই নূপুর শর্মা।
তিনি নিজে বই লিখেছেন ‘দিল্লি এন্টি-হিন্দু রায়টস, ২০২০, দ্য ম্যাকাবার ড্যান্স’ যেখানে তিনি একই নকশাল-জিহাদি তত্ত্ব আউরেছেন। তিনি নতুন শতাব্দীর এই নতুন নেতা নেত্রীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল তারকা। নূপুর শর্মা উচ্চ শিক্ষিতা তো বটেই, বিদেশী ডিগ্রির তকমাও তাঁর আছে। আগেকার নেত্রীদের মত ইংরাজি বলতে গিয়ে তাঁকে বারবার ঢোক গিলতে হয় না। হিন্দি ইংরাজি দুটোতেই তিনি তুখোড়। তাঁর বেশভূষা ঝকঝকে, স্মার্ট; ঠাটবাট, আদবকায়দা রীতিমতো চমকপ্রদ। রোজ সন্ধ্যায় তিনি টিভি চ্যানেল আলোকিত করেন। গোদি মিডিয়ার সঞ্চালক/সঞ্চালিকাদের সাহায্যে যে কোন বিতর্কে তিনি বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করে দেন, অনায়াসে গালি দিয়ে তাঁদের চুপ করিয়ে দিতে পারেন। ভক্তরা তাঁর ক্ষমতায় অভিভূত, তাঁকে সিংহী, বাঘিনী নামে ভূষিত করেন। দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রত্যেকে তাঁর বাকপটুতা, বাকচাতুর্যে মন্ত্রমুগ্ধ। তাঁরা তাঁর টুইটার নিয়মিত অনুসরণ করেন। এহেন এক নেত্রী যিনি দলের মুখপাত্র বিজেপি তাঁকে নিছকই একজন ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’, নগণ্য ব্যক্তি, বলে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, বলছে তাঁর বক্তব্য সরকার বা দলের মতামত নয়।
নূপুর ২৬শে মে একটি টিভি চ্যানেলে বিতর্কিত মন্তব্যটি করেছিলেন। তারপর এক সপ্তাহ কেটে গেছে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির তরফ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে কানপুরে হিংসা ছড়িয়েছে তবুও নেতারা মৌনব্রত পালন করেছে। আরব ও ইসলামিক দেশ যখন প্রতিবাদে মুখর হয়েছে, ভারতীয় পণ্য বয়কট করা শুরু করেছে, ভারতের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে কড়কানো শুরু করেছে, তখন বিজেপি নড়েচড়ে বসেছে। পত্রপাঠ দু’জনকে বিদায় করে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছে।
প্রশ্ন হল বিজেপি কি আদৌ অনুতপ্ত? অন্য ধর্মের সাথে আমার হাজার বিবাদ থাকলেও তাঁদের পয়গম্বরকে অপমান করা যে অপরাধ এই বোধ কি আদৌ বিজেপি নেতৃত্বের আছে? নাকি মুসলিম সমাজকে হেনস্থা ও কোণঠাসা করার যে সীমারেখা যা তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রসারিত করছে, নূপুর শর্মার মন্তব্য সেরকমই একটি প্রয়াস? বিশেষ করে ২০১৯ এর পর থেকে তাঁরা একটা করে লক্ষণ-রেখা তৈরি করেছে এবং সেটাকে লঙ্ঘন করেছে, আবার নতুন লক্ষণ-রেখা সৃষ্টি করেছে। বারবার পরীক্ষা করেছে মুসলিম সমাজ কতটা কড়া দাওয়াই সহ্য করতে পারে। সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে, হিজাব বিতর্কের সময়, মুসলিম সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কিন্তু প্রবল সরকারি দমন-পীড়ন, বিচিত্র নামধারী হিন্দু সেনাদের সন্ত্রাস এবং উগ্র ধর্মান্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকা বিপুল হিন্দু জনতার নিস্তব্ধতা বা নীরব সমর্থন তাঁদের অবস্থা ক্রমশ আরও অসহায় করে তুলছিল। সুতরাং দাওয়াইটা আরও কড়া কর, খোদ পয়গম্বরকে আক্রমণ কর।
এবারও কিছু বিক্ষোভের পর হয়তো মুসলিমরা ঘরে ফিরে যেতেন, নেহাত আরব দুনিয়া প্রতিবাদে সরব হল বলে বিজেপি দুঃখপ্রকাশ করতে বাধ্য হল। আরেসেস-বিজেপি নেতৃত্ব অনুতপ্ত নন, যদি হতেন তাহলে ঘটনার পরে এতদিন তাঁরা নীরব থাকতেন না। তাঁরা কেউ ঘটনার নিন্দা করেননি। নূপুর শর্মার দুঃখপ্রকাশও লোক-দেখান; তিনি জানিয়ে দিয়েছেন হিন্দু দেবতাকে ক্রমাগত অপদস্থ করার (জ্ঞানব্যাপী মসজিদে খুঁজে পাওয়া কাঠামোটিকে ফোয়ারা বলা তাঁর মতে শিবলিঙ্গকে হেয় করা) কারণেই তিনি পয়গম্বরকে আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার আরব দেশগুলির ক্ষোভ প্রশমিত করবে, সেটা খুব কঠিন হবে না কারণ নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে তারাও চাইবে না যে এই ঘটনা বেশিদূর গড়াক। সেটা হয়ে যাওয়ার পরেই তাঁরা এই ঘটনার ফয়দা তোলার চেষ্টা করবে। তাঁরা জানেন নূপুরের বহিষ্কার ভক্তদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাঁরা বলবেন হিন্দু ধর্ম আক্রান্ত, আমাদের দেবতাকে কটু কথা বললে কোনও প্রতিবাদ হয় না অথচ মুসলিমদের ক্ষেত্রে নিন্দার ঝড় ওঠে! তাঁরা এটাও বলবেন আমরা নিজেদের লোককে কী ভাবে শাস্তি দিয়েছি সেটা তো বিশ্ব দেখেছে, এবার কোনও মসজিদের তলায় কী পাওয়া গেছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করলে, কোনও ‘কটূক্তি’ করলে কিন্তু কেউ পার পাবে না। সেটা পয়গম্বরকে অপমান করার সমতুল্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। অতএব মোহন ভাগবত মিষ্টি কথায় যেটা বলেছেন মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ না পাওয়া গেলেও কিছু যায় আসে না, আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসটাই সার কথা, সেটাই মসজিদ ভেঙে মন্দির করার রাস্তা সুগম করে দেবে। অত খোঁড়াখুঁড়ি, প্রমাণ ইত্যাদির বাপু আর কোনও দরকার নেই।
অতএব মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার কাজ ত্বরান্বিত হবে। ১৯৯১ সালে সংসদে আইন পাস হয়েছিল যে বাবরি মসজিদ ছাড়া দেশের আর কোনও ধর্মস্থানের স্টেটাস পরিবর্তন করা যাবে না। বিজেপি সেই আইনের তোয়াক্কা করে না। তাঁদের গেরুয়াবাহিনীর সামনে মুসলিমরা গুটিয়ে যাবে; দেশজুড়ে শত শত মসজিদ লাইন দিয়ে তাঁদের হাতে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। জ্ঞানব্যাপীর পর মথুরার শাহি ইদ্গাহ, তারপর কুতুব মিনার, তাজমহল... আরও কত; মধ্যপ্রদেশের কমল মৌলা মসজিদ, কর্ণাটকের বাবা বুদান দরগা, সীরঙ্গপাটনার মসজিদ-ই-আলা, খোদ টিপু সুলতানের প্রাসাদ, সেটাও নাকি হিন্দুদের জমির ওপর নির্মিত হয়েছে। এক কর্ণাটকেই নাকি ১০০০০ ধর্মস্থান আছে যা হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে।
এরপর তাঁরা বলবেন নূপুর শর্মাকে যখন শাস্তি দেওয়া হয়েছে তখন কানপুরে যাঁরা ঝামেলা করেছেন তাঁদেরও উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। সেখানকার পুলিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া একদম প্রত্যাশিত। তাঁরা বলেছেন ‘দাঙ্গা’ পূর্ব পরিকল্পিত, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার সাথে দাঙ্গাকারীদের যোগাযোগ আছে, বিদেশী পয়সা এসেছে, হোয়াটস অ্যাপে চক্রান্ত নিয়ে কথোপকথন হয়েছে, একেবারে ডিটো দিল্লি ‘দাঙ্গা’, ২০২০ নিয়ে সঙ্ঘীদের যা বয়ান ছিল তাই। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা প্রায় সবাই মুসলিম। ইসলামিক দুনিয়ায় হৈ চৈ হওয়ার পরে এক বিজেপি আধিকারিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এইসব হট্টগোলের মধ্যে টুক করে নূপুর শর্মার বরখাস্ত রদ করে দেওয়া হবে।
একটা উল্টো সম্ভাবনাও আছে। এক জঙ্গি গোষ্ঠী ফ্রান্সের কার্টুন পত্রিকা চার্লি হেবদোর অফিসে আক্রমণ করে যে ভাবে বারো জনকে হত্যা করেছিল, ঠিক একই ভাবে এখানে যে কোনও উন্মাদ প্রত্যাঘাত করবে না তা কে বলতে পারে? সেটা হলে তা হবে ভয়ঙ্কর! এক মৌলবাদ আরেক মৌলবাদকে পুষ্ট করে। সেটা হলে হিন্দু মৌলবাদীদের দাপট যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আরেসেস-বিজেপির ক্ষমতা এখন সর্বব্যাপী। প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তাঁদের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। বিরোধীরা মূক। এই ঘটনা নিয়ে তাঁদের কোনও জোরাল প্রতিবাদ নেই। তাই নূপুর শর্মার ঘটনা সাময়িক ভাবে গেরুয়াবাহিনীকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিলেও, আদপে এই সংকট তাঁদের পক্ষে আরও অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে।