উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী অঞ্চলের সি ব্লকে ১৬ই এপ্রিল, হনুমান জয়ন্তীর দিন, তিন তিনটে শোভাযাত্রা হয়েছিল। প্রথমটি হয় দুপুর একটা নাগাদ, দ্বিতীয়টি সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে এবং তৃতীয়টি হয় গোধুলির সময়, সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত। শোভাযাত্রা না বলে এগুলিকে শয়তানযাত্রা বলাই শ্রেয়, কারণ প্রতিটি মিছিল ছিল অস্বাভাবিক ভাবে আগ্রাসী ও সশস্ত্র। প্রায় সবার হাতে তলোয়ার আর ত্রিশূল, এমনকি দু'-চারজনের হাতে পিস্তলও দেখা গেছে। এর সাথে সঙ্গত দিয়েছে ডিজের কানফাটানো মিউজিক - যা আদতে মুসলিম-বিরোধী হিংস্র গরল প্রবাহ, অশ্রাব্য গালিগালাজ এবং কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে নাচ। এসব কিছুই সংবাদ মাধ্যমে দেখানো হয়েছে এবং ভিডিওতে সংরক্ষিত আছে। প্রতিটি যাত্রাই বজরং দল দ্বারা সংঘটিত এবং অংশগ্রহণকারীরা প্রায় প্রত্যেকেই বহিরাগত। প্রথম দু'টি ক্ষেত্রে স্থানীয় মুসলিমরা অনুনয় বিনয় করে সংঘটকদের মসজিদ-সংলগ্ন রাস্তা পরিহার করাতে সমর্থ হয়। অনেকের মতে সন্ধ্যা ছটায় তৃতীয় ‘শোভাযাত্রা’র কোনও পুলিশের অনুমতি ছিল না। আরও যেটা গুরুত্বপূর্ণ - সেটা নির্দিষ্ট যাত্রাপথ অমান্য করে মসজিদের সামনে দিয়ে যায়।
নমাজ পাঠের সময় মসজিদের সামনে হল্লা করা, তারস্বরে বাজনা, গলাবাজি, খিস্তিখেউড় করা হচ্ছে মুসলিমদের উত্ত্যক্ত করার শতাব্দী প্রাচীন প্রথা। মোদী জমানায় তা আরও উগ্র ও প্ররোচনামূলক রূপ ধারণ করেছে। ১৬ই এপ্রিল গোধুলিবেলায় অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীরা যখন রোজা ভঙ্গ করে নমাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন মারমুখী শোভাযাত্রাটি মসজিদের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়। বেশ কিছুক্ষণ গেরুয়াবাহিনীর তাণ্ডব চলে। কয়েকজন মসজিদের গেট ভেঙে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করে। তাদের তর্জন-গর্জন মানুষকে শঙ্কিত করে। কিছু দিন পূর্বেই তাঁরা দেখেছেন কীভাবে উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরে সঙ্ঘীরা মসজিদের মিনারে চড়ে গেরুয়া পতাকা লটকে দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ মসজিদের পাশে জড়ো হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় ইটবৃষ্টি। কে, কখন, প্রথম তা শুরু করে তা কোনোদিনই জানা যায় না, এক্ষেত্রেও জানা যায়নি। আটজন পুলিশ সহ বেশ কিছু মানুষ আহত হন। প্রবল হম্বিতম্বি দিয়ে শুরু করলেও সমবেত জনতার রুদ্র রূপ দেখে বজরং বাহিনী পিছু হঠে। তাদের অভিযোগ দিল্লি ‘দাঙ্গা’, ২০২০র মত জাহাঙ্গিরপুরীর ঘটনাও এক গভীর ষড়যন্ত্র। তাদের মতে ইট, পাথর, কাঁচের টুকরো, বিয়ারের বোতল ইত্যাদি জড়ো করে ‘শোভাযাত্রা’র ওপর হামলা করার জন্য মুসলিমরা প্রস্তুত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে ষড়যন্ত্র যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তবে এলাকাবাসীরা প্রথম দুটো জুলুসের ওপর আক্রমণ করল না কেন? তাঁরা যখন দেখেছেন তাঁদের ধর্মস্থান আক্রান্ত হতে পারে - তখনই তাঁরা প্রত্যাঘাত করেছেন। এর ফলে হিন্দুদের কয়েকটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গাড়ি, স্কুটার ভাঙচুর হয়েছে। সমস্ত ঘটনায় পুলিশ ছিল মূক দর্শক। মুসলিমরা পাল্টা আক্রমণ করার সাথে সাথে তারা ত্রাতার ভূমিকা নেয়। ১৭ তারিখ ভোররাতে চোদ্দজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, প্রত্যেকেই মুসলিম (স্ক্রল-১৮/০৪/২০২২)। এর বিরুদ্ধে অঞ্চলের মানুষ সরব হওয়াতে আরও কিছু গ্রেপ্তার হয়, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন হিন্দু আছেন। পাঁচজনকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত করা হয়; বলাই বাহুল্য, পাঁচজনই মুসলিম।
পুলিশের ভূমিকা
ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৭ই এপ্রিল সিপিএম, সিপিআইএমএল সহ বিভিন্ন বাম দলের একটি টিম এলাকায় পরিদর্শনে যান। তাঁরা একটি তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন। এটা থেকে জানা যাচ্ছে যে প্রতিটি ‘শোভাযাত্রা’য় ১৫০-২০০ লোক ছিল এবং সামনে পিছনে দু'টি পুলিশ জিপ ছিল, কিন্তু তাতে মাত্র দু'জন করে পুলিশ ছিলেন। প্রথম প্রশ্ন দেশজুড়ে রামনবমী-হনুমান জয়ন্তীর উদযাপনকে কেন্দ্র করে এতো অশান্তি ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও পুলিশি ব্যবস্থা এতো অপ্রতুল কেন ছিল? দ্বিতীয়, পুলিশ কীভাবে একটি স্পর্শকাতর এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করার অনুমতি দিল? তৃতীয়, মসজিদের সামনে দিয়ে ‘শোভাযাত্রা’টিকে কেন যেতে দেওয়া হল, কেন সেটিকে ঠিক রোজা ভঙ্গের সময় সেখানে অবস্থান করতে দেওয়া হল? চতুর্থ, বজরং বাহিনীর প্রবল প্ররোচনামূলক আচরণ সত্ত্বেও পুলিশ কেন তাদের নিরস্ত করার কোনও চেষ্টা করলো না?
জনৈক পুলিশ অফিসার একটি এফআইআর দায়ের করেন যেটি পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট। এতে বলা হচ্ছে: (১) ‘শোভাযাত্রা’ পুরো শান্তিপূর্ণ ছিল। (২) অংশগ্রহণকারীরা যে সশস্ত্র ছিল সেটার কোনও উল্লেখই নেই। তারা যে উস্কানিমূলক গান চালিয়েছে, গালিগালাজ করেছে সেটারও কোনও উল্লেখ নেই। (৩) মুসলিমরাই নাকি প্রথম হামলা শুরু করে; মহম্মদ আনসার, যিনি আপ এবং বিজেপি উভয় দলের সাথে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন, তিনি এবং চার পাঁচ জন নাকি বজরংগীদের সাথে তর্ক জুড়ে দেন যার ফলে উত্তেজনা ছড়ায়। (৪) সঙ্ঘীরা যে নির্দিষ্ট যাত্রাপথ অনুসরণ করেনি সেটার কোনও উল্লেখ নেই। (৫) মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করার যে চেষ্টা করা হয়েছে সেটাও অনুল্লেখিত।
প্রথমে দিল্লি পুলিশ এই ‘দাঙ্গা’য় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলকে অভিযুক্ত করেছিল, কিন্তু পরে কোনও অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে তাঁরা এদের নাম আর ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করেনি। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ঘটনার পরের দিনই বিজেপির একটি দল জাহাঙ্গিরপুরী থানায় যায়। তাঁরা আহত পুলিশ কর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। দিল্লি বিজেপি সভাপতি আদেশ গুপ্ত তো পুলিশকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। বলেন পুলিশ দাঙ্গাকারীদের সম্মুখে একটা দেয়াল খাড়া করে দিয়েছিল। আরেক নেতা বলেন পুলিশ মানবশৃংখল তৈরি করে হামলাকারীদের প্রতিহত করেছে। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, নিউ দিল্লি, ১৮ই এপ্রিল)। এই একই পুলিশ ভোররাতে যখন মুসলিমদের বাড়ি হানা দেয় তখন যে মহিলারা প্রতিবাদ করে তাঁদের বেলাগাম চড়, ঘুঁষি, লাথি মারে।
কেন্দ্রের শাসক দলের সাথে দিল্লি পুলিশের গভীর যোগসাজশ কোনও স্টেট সিক্রেট নয়। কিন্তু শাসক দলের ক্ষমতার দাপট যে কতো প্রকট এবং তারা যে আইনকানুনের কোনও পরোয়া করে না সেটা বাম পার্টিগুলির তদন্তকারী দল স্থানীয় থানায় গিয়ে দেখে হতবাক হয়ে যান। তাঁরা দেখেন থানার ভিতরে, পুলিশ অফিসারদের উপস্থিতিতে আদেশ গুপ্ত ও বিজেপি সাংসদ হংসরাজ প্রেস কনফারেন্স করছেন। তাঁদের ঘিরে আছে একটি গেরুয়া বাহিনী যারা ক্রমাগত ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান দিচ্ছে। পুলিশ যে পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট এটা প্রমাণ করার জন্য আর কি প্রয়োজন আছে! বলার অপেক্ষা রাখে না, যে পুরো জাহাঙ্গিরপুরী অঞ্চলে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরো তলানিতে এসে ঠেকেছে।
প্রশাসনের ভূমিকা
১৯ তারিখের মধ্য রাতে আদেশ গুপ্ত উত্তর-পশ্চিম দিল্লির পুর কমিশনারকে নির্দেশ দেয় জাহাঙ্গিরপুরীর তথাকথিত অবৈধ নির্মাণ উচ্ছেদ করতে। পরের দিন সকাল ন'টায় পৌরসভার একটি দল নয়টি বুলডোজার ও ১৫০০ পুলিশের এক বাহিনী নিয়ে হৈ হৈ করে উচ্ছেদ অভিযানে নেমে পড়ে ও ঘরবাড়ি দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করে। পৌরসভা যুক্তি দেয় - ঐ অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশ আছে। এটা সর্বৈব মিথ্যা! হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল হকার সংক্রান্ত; যে সমস্ত হকার রাস্তা আটকিয়ে ব্যবসা করছে তাদের হটিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল আদালত (টাইমস অফ ইন্ডিয়া - নিউ দিল্লি, ২২শে এপ্রিল)। দ্বিতীয় কথা, আদেশ গুপ্ত তো শাসক দলের নেতা মাত্র, কোন অধিকারে তিনি পৌরসভাকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার আদেশ দেন? আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে, যিনি ‘জমিয়াত উলেমা-ই-হিন্দ’-এর হয়ে এই উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে পিটিশন করছেন, তিনি বলেন, পুলিশ ও পৌরসভা সংবিধান মেনে চলবে, কোন বিজেপি নেতা কি নিদান দিল সেটা মেনে নয়। এই উচ্ছেদ সম্পর্কে তাঁর মতামত খুব পরিষ্কার: এই অভিযান একটি সম্প্রদায়কে নিঃস্ব করার লক্ষ্য নিয়ে করা হয়েছে। দিল্লিতে ৭৩১টি অবৈধ কলোনি আছে, কিন্তু আপনারা একটা কলোনিকেই টার্গেট করেছেন, কারণ সেখানে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। সৈনিক ফার্ম বা গলফ লিঙ্কের অবৈধ নির্মাণকে তো স্পর্শ করা হচ্ছে না, যত দোষ শুধু জাহাঙ্গিরপুরীর গরীব মানুষদের! তিনি বলেন। আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনও উচ্ছেদ শুরু করার আগে নোটিশ জারি করা হয়, বাসিন্দাদের সময় দেওয়া হয় - এসব কিছুই করা হয়নি। চটজলদি ঘরবাড়ি ধ্বংস করাই ছিল অভিযানের উদ্দেশ্য। বাসিন্দাদের জিনিসপত্র, এমনকি ধর্মগ্রন্থ বার করে আনারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। বৃন্দা কারাট ও সিপিয়াইএমেলের রবি রাই যতক্ষণে স্টে অর্ডার নিয়ে এসে পৌঁছান, ততোক্ষণে প্রায় কুড়িটি বাড়ি ও মসজিদের একটি দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গিরপুরী ও বাঙালি মুসলিমের অস্তিত্ব
জাহাঙ্গিরপুরী সি-ব্লক, যেখানে মূলত ঝামেলা হয়েছে, সেখানে প্রধানত বাঙালি মুসলিমদের বাস। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই চার দশক আগে রুটিরুজির টানে বাংলা ছেড়ে এখানে এসে বসবাস করছেন। এঁরা মূলত ছাঁট এবং অন্যান্য ছোট ব্যবসায় যুক্ত। যেমন আনোয়ার - যাঁকে প্রধান অভিযুক্ত বলা হচ্ছে - তাঁর আদিবাড়ি হলদিয়ায়। আরেক অভিযুক্ত শেখ সোহরাবের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাগর অঞ্চলে। দু'টি জায়গায় দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক এসে ঘুরে গেছেন। এঁদের সবার বৈধ ডকুমেন্ট আছে। সোহরাব দিল্লি পুরসভার কর্মী, তাঁর বাবাও দিল্লি উন্নয়ন পর্ষদে কাজ করেছেন। তবুও তাঁদের ভারতীয়ত্ব সন্দেহের মুখে; তাঁরা নাকি বাংলাদেশি; তাঁদের নথিপত্র সবই নাকি জাল, ভোটে ফায়দা নেওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের তৈরি করে দেওয়া। আজকের ভারতে মুসলিমরা নিত্যনতুন সংকটে জর্জরিত হচ্ছেন; আর যে মুসলিমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছেন তাঁদের সংকট তো আরও গভীর, তাঁদের তৎক্ষণাৎ বহিরাগত, বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে যাঁরা এই দেশে বাস করছেন, তাঁদেরও বিদেশি তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে! শুধু দিল্লি নয়, সারা ভারতে আজকে এটাই ট্রেন্ড! এক ধর্মগুরু তো নিদান দিয়েই দিয়েছেন যে, বাঙালি হলেই সন্দেহের! পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও মুসলিমকে পরিচয়পত্র থাকলেও রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে, তাঁর হুঙ্কার। এ তো ভয়ঙ্কর! এবং ২৫ তারিখের সংবাদপত্রে এই খবর বেরোনোর পর বাংলার কোনও রাজনৈতিক দল এটার বিরুদ্ধে সরব হয়নি। প্রায় সব দলই ব্রাহ্মণবাদী, তাই তাঁরা হয়তো ভাবছেন ভয়টা তো খালি মুসলমানদের, হিন্দুদের তো নয়। আসামের হিন্দুরাও এরকমটাই ভেবেছিল, ভেবেছিল যত ঝড় ঝাপটা - তা মুসলমানদের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে! হায়! যখন এনআরসি প্রকাশিত হল, দেখা গেল ১৯ লাখ মানুষ - যাঁদের বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ১২ লাখ বাঙালি হিন্দু। নির্বাচনে লাগাতার ভাবে আরএসএস-বিজেপির বিরোধিতা করার ফলে পুরো বাঙালি জাতির অস্তিত্বকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আজ সংকটে ফেলা হচ্ছে; তাই যাঁরা ভাবছেন সংকটটা শুধুমাত্র বাঙালি মুসলমানদের, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
এবছরের রামনবমী-হনুমান জয়ন্তীর তাৎপর্য
দোসরা এপ্রিল থেকে এগারো এপ্রিল ছিল চৈত্র নবরাত্রি। দোসরা এপ্রিল থেকে রমজানও শুরু হয়েছে; ১০ই এপ্রিল ছিল রামনবমী, ও ১৬ তারিখে ছিল হনুমান জয়ন্তী। এবছর উভয় সম্প্রদায়ের পরবগুলি এমন ভাবে পরপর এসেছে যেন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের জমি প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু এর অন্যথা হলেও পরিস্থিতির কোনও বিশেষ পরিবর্তন হত না। মুসলিমরা ইদানীং বেজায় কোণঠাসা। সাম্প্রতিক কালে মুসলিমদের যে ভাবে ধনেপ্রাণে মারার চেষ্টা করা হয়েছে, তা অভুতপূর্ব, এই দেশে কখনো এরকম লাগামছাড়া ঘৃণা, বিদ্বেষের বাতাবরণ দেখা যায়নি। লাভ জিহাদ, হিজাব, হালাল মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মুসলিমদের ব্যবসা না করতে দেওয়ার হুমকি, প্রকাশ্যে তাঁদের গণহত্যা ও তাঁদের নারীদের গণধর্ষণ করার হুমকি, স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে ফয়েজের কবিতা ও ইসলামের উত্থান সংক্রান্ত অধ্যায় ছেঁটে দেওয়া, নানাভাবে তাঁদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন করে তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, গোলওয়ালকারের নিদান - হয় তুমি হিন্দু ধর্মের কাছে বশ্যতা স্বীকার করো, নয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে কীটের মত দিনযাপন কর - এর অনুশীলন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে।
এই এপ্রিল মাসে এর সাথে এক ভয়ঙ্কর তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা যুক্ত হয়েছে। রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষ্যে মুসলিম মহল্লায় ‘শোভাযাত্রা’ নিয়ে গিয়ে হল্লা কর, তাঁদের ধর্মস্থান আক্রমণ কর। জোর করে, পায়ে পা লাগিয়ে তাদের সাথে ঝগড়া জুড়ে দাও, যাতে তারা প্রত্যাঘাত করে। পরের দিন দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য, বুলডোজার নিয়ে গিয়ে তাদের ঘরবাড়ি, অফিস, ব্যবসার সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দাও। যোগী আদিত্যনাথ এটা উত্তরপ্রদেশে শুরু করেছিলেন, মধ্যপ্রদেশের খরগোন ও দিল্লিতে একই মডেল অনুসরণ করা হল। যদি ধরেও নেওয়া যায়, যে, ভিনধর্মী সম্প্রদায়ের কিছু লোক দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে তাহলেও কি কোনও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই শাসকের খেয়ালখুশি মত তাঁদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়! এ তো জঙ্গলের রাজত্ব! দুষ্মন্ত দাভে বলছেন, উচ্ছেদ হচ্ছে দখলদারীদের সরানোর শেষ অস্ত্র, সেটার আগে বিভিন্ন স্তরের আইনি প্রক্রিয়া আছে। বার্তাটা পরিষ্কার। তুমি যদি ভিন্ন সম্প্রদায়ের হও এবং যদি তুমি প্রতিবাদী হও তাহলে তোমার রুটিরুজির উপায় ধ্বংস করে দেওয়া হবে। তুমি যদি প্রতিবাদ নাও করে থাকো, স্রেফ মুসলিম হওয়ার জন্য বলা হবে তুমি প্রতিবাদ করেছ, প্রত্যাঘাত করেছ, এবং সপরিবারে তোমাকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হবে।
বিরোধী দলগুলির ভূমিকা হতাশজনক। রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন, কয়েক মাইল দূরে ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি। আপ বিজেপির সাথে গলা মিলিয়ে বলেছে জাহাঙ্গিরপুরীর বাঙ্গালিরা হয় রোহিঙ্গা, নয় বাংলাদেশি এবং বিজেপি ভোটে ফয়দা তোলার জন্য সারা দেশে এঁদের আশ্রয় দিয়েছে। ‘দাঙ্গা’ স্থলের ধারেকাছে আপের কোনও মন্ত্রীসান্ত্রী যায়নি। তেরোটি দলের নেতানেত্রীরা দেশজুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে তাঁকে হস্তক্ষেপ করার জন্য অনুরোধ করেছেন। লক্ষ্যণীয়, এই তেরোটি দলের মধ্যে আপ নেই। প্রায় এক সপ্তাহ বাদে প্রধানমন্ত্রী এই চিঠির জবাব দিয়েছেন - তাঁর নিজের মত করে দিয়েছেন। গুরু তেজবাহাদুরের ৪০০তম জন্মোৎসবে তিনি বলেছেন শিখ গুরুদের মুণ্ডচ্ছেদ করেও আওরেঙ্গজেব তাঁদের বিশ্বাস টলাতে পারেনি। আওরঙ্গজেবের ‘দানবীয়’ কীর্তিকলাপ ইতিহাস থেকে টেনে এনে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন, যে মুসলিম রাজারা নাকি এক সময় হিন্দুদের ওপর প্রবল অত্যাচার করেছেন। এছাড়াও তিনি ঘোষণা করেছেন, যে, সারা দেশে চারটি হনুমানজীর মূর্তি স্থাপিত করা হবে, যার মধ্যে একটি বাংলায়।