এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কোলকাতা জিপিও এবং অন্ধকূপ হত্যার কলঙ্ক (তৃতীয় পর্ব)

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ মে ২০২৩ | ৪০৮ বার পঠিত
  • এছাড়াও বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর 'সিরাজউদ্দৌলা' গ্রন্থের চতুর্দশ, পঞ্চদশ এবং ষোড়শ পরিচ্ছদে বর্ণনা করেছেন এই অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে এবং বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে হলওয়েল সাহেবের এটা নির্ভেজাল মিথ্যে কথা। ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে অর্থাৎ ১৯১৬ সালের 'ভারতী' পত্রিকায় শ্রী মৈত্রেয় এই বিষয়ে আবার কলম ধরেছিলেন। যেখানে তিনি যা লিখেছিলেন তা নিম্নরূপ:

    সে অনেক দিন আগের কথা, প্রায় কুড়ি বৎসরের কথা। তখন ‘সাধনা’ বন্ধ হইয়া গেলে, সিরাজদ্দৌলা-শীর্ষক প্রবন্ধগুলি মাসে মাসে ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হইত। যে মাসে অন্ধকূপহত্যা-কাহিনির সমালোচনা প্রকাশিত হইবার কথা, সেই মাসের লেখাটি ডাকঘরের গোলযোগে হারাইয়া যায়। নকল ছিল না; 'ভারতী’ প্রকাশিত হইবারও বড় বিলম্ব ছিল না। অগত্যা সে লেখাটিকে আবার তাড়াতাড়ি লিখিয়া পাঠাইতে হইয়াছিল। 

    তখন অন্ধকূপহত্যা-কাহিনি সম্বন্ধে তিনটি কথা বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছিলাম। (১) হলওয়েলের কাহিনিই অন্ধকূপহত্যার প্রধান কাহিনি,- সে কাহিনি বিশ্বাস করা কঠিন। (২) মিথ্যা হইলে কথাই নাই,- হইলেও, তাহার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে অপরাধী করা যায় না। (৩) উত্তরকালে অন্ধকূপহত্যার প্রতিহিংসাসাধনের জন্য পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল বলিয়া ইতিহাসে যে কাহিনি স্থানলাভ করিয়াছে, সমসাময়িক কাগজপত্রে তাহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না।

    যখন 'ভারতী’তে এই লেখা বাহির হয়, তখন অন্ধকূপহত্যার স্মৃতিস্তম্ভটি বর্তমান ছিল না;- ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে তাহা অপসারিত হইয়াছিল। সুতরাং তাহার কথাও লিখিতে হইয়াছিল।

    তাহার পর অনেক বৎসর চলিয়া গিয়াছে,- অনেক তথ্যানুসন্ধানের সূত্রপাত হইয়াছে,- গভর্নমেন্টের উদ্যোগে ও ব্যয়বাহুল্যে তিনখণ্ড বৃহৎ পুস্তকে সমসাময়িক কাগজপত্র মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছে, এবং লর্ড কর্জনের বদান্যতায় অন্ধকূপহত্যার একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হইয়াছে। 

    এতকালের পর আবার অন্ধকূপহত্যা কাহিনির সত্যমিথ্যার আলোচনায় সূত্রপাত হইয়াছে। এবার শ্রীযুক্ত জে. এইচ. লিট্ল সাহেব ইংরাজিতে একটি প্রবন্ধ লিখিয়া জানাইয়া দিয়াছেন,- 'অন্ধকূপহত্যা-কাহিনি একটা প্রকাণ্ড ধাপ্পাবাজি!’

    ইহাতে আবার হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছে। সংবাদপত্রে অনেক সমালোচনা ও প্রতিবাদ প্রকাশিত হইতেছে এবং কলিকাতা ঐতিহাসিক সমিতি একটি বিচারসভায় ইহার আলোচনার ব্যবস্থা করিয়া লিট্ল সাহেবকে ও তৎসঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ করিয়াছেন। এই বিচারসভার ব্যবস্থা নূতন যুগের নূতন ব্যবস্থা,- ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের সরল পথ অবলম্বন করিবার লালসা বিজ্ঞাপক প্রশংসনীয় ব্যবস্থা।

    সিরাজদ্দৌলা শীর্ষক প্রবন্ধে ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে দুইটি কথা সর্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হইয়া গিয়াছে। সিরাজদ্দৌলার অপরাধ ছিল না,- প্রতিহিংসা-সাধনের জন্যও পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয় নাই,- এই দুইটি কথা যে সর্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হইয়াছে, তাহার প্রধান প্রমাণ নূতন স্মৃতিস্তম্ভ। পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যে কলঙ্কলিপি সংযুক্ত ছিল, তাহাতে এই দুটি কথা উল্লিখিত ছিল। নূতন স্মৃতিস্তম্ভে যে ফলক-লিপি সংযুক্ত হইয়াছে, তাহাতে এই দুটি কথা স্থান লাভ করিতে পারে নাই।

    ইহা ইতিহাসের পক্ষে অল্প লাভ নয়। আরও একটি লাভের কথা এই যে, হলওয়েল পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যাহাদিগের অন্ধকূপে নিহত হইবার কথা ক্ষোদিত করাইয়া গিয়াছিলেন, নূতন স্মৃতিস্তম্ভ রচনার সময়ে তথ্যানুসন্ধানে জানা গিয়াছে,- তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ দুর্গজয়ের পূর্বে বা সমসময়ে দুর্গরক্ষার্থ প্রাণত্যাগ করেন- তাহাদের পক্ষে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইবার সময় ছিল না! সুতরাং হলওয়েলের মৃতের তালিকা যে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য নহে, সে কথাও প্রকারান্তরে স্বীকৃত হইয়াছে। হলওয়েল ঢাকার হত্যা-কাহিনি রচনা করিয়াছিলেন,- তাহা যে সর্বৈব মিথ্যা, সমসাময়িক ইংরাজ-দরবার তদন্ত করিয়া, সরকারি রিপোর্টে সে কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।

    সুতরাং এখন যাহারা অন্ধকূপহত্যা কাহিনিকে সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেছেন, তাহারাও একবাক্যে বলিতেছেন,- ‘হলওয়েলের সকল কথা সত্য নহে।’

    ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধান এইরূপে ক্রমে ক্রমে অন্ধকূপ হত্যা-কাহিনির বিরোধী নানা কথা স্বীকার করিবার পর, শ্রীযুক্ত লিটল সাহেব তাহাকে শেষ ধাক্কা দিয়া প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন। তাহার প্রবন্ধ বঙ্গ-ভাষায় অনূদিত হইবার যোগ্য হইলেও কেহ এ পর্যন্ত তাহার আলোচনামাত্রও করেন নাই।

    শ্রীযুক্ত লিটল একটি নূতন কথা শুনাইয়াছেন। তিনি আদ্যন্ত সমস্ত ঘটনার আলোচনা করিয়া বলিয়াছেন,- যে সকল ইংরাজ বীরপুরুষ দুর্গরক্ষায় প্রাণ বিসর্জন করিয়া, ইংরাজের পরাজয়কেও বিজয়গৌরবে গৌরবান্বিত করিয়া গিয়াছেন, ইংরাজ লেখকগণ অন্ধকূপ হত্যা-কাহিনি বিশ্বাস করিতে গিয়া, তাহাদিগের পুণ্য স্মৃতিকে অপমানিত করিতেছেন! ইহা অনুমান মাত্র হইলেও, ইহার অনুকূলে যে সকল কথা বলা যাইতে পারে, শ্রীযুক্ত লিটল তাহার উল্লেখ করিয়া বিষয়টির পুনরালোচনার পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। এতদিনের পর ইতিহাস ইংরাজ বীরপুরুষগণের আত্ম-বিসর্জনের মহিমা কীর্তনের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে।

    পরের সংখ্যায় সমাপ্ত...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন