কলকাতায় গঙ্গার ঘাট কটা? সব কটাতেই আপনি কখনো না কখনো গিয়েছেন। নিতান্ত না গিয়ে থাকলেও ভেবেছেন যাবার কথা। কিন্তু এই ঘাটটায় হয়ত যান নি। নদীর দিকে মুখ করে সিমেন্টের বেদীর ওপর দাঁড়ানো এক নারী আর এক পুরুষ মূর্তি। সামান্য পোষাক, মাথার পোঁটলায় যথাসর্বস্ব। দাঁড়িয়ে আছে জাহাজ আসবে বলে। সেই জাহাজ তাদের নিয়ে যাবে সুরিনাম বলে কোন এক মহাসুখের দেশে। সেখানে চাষের খাটনি নেই, কাল কী খাবো, তার চিন্তা নেই। সেখানে থাকবার জন্য চমৎকার বাড়ি, খাবার অঢেল ব্যবস্থা। ও দেশে থাকবার লোক নেই বলে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে। ১৮৭৪ থেকে ১৯১৬-র মধ্যে ৩৫,০০০ ভারতীয় শ্রমিক হিসাবে চালান হয়েছিলেন সুরিনামে। আখ, কফি আর কলার খেতে কাজ করার জন্য। সপ্তদশ শতক থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ডাচ উপনিবেশ ছিল দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত ছোট্ট দেশ সুরিনাম। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে পঞ্চাশ বছর ধরে শ্রমিক পাঠাবার গোপন চুক্তি করে ডাচ সরকার।
‘এখনকার উত্তর প্রদেশ আর বিহার থেকে আড়কাঠিরা মেয়ে মরদ ফুসলে আনত নতুন দ্বীপের স্বপ্ন দেখিয়ে। প্রতিটা মেয়ে-মরদের জন্য কমিশন পেত তারা। তারপর ইলাহাবাদ, বেনারস, বস্তার, মুজফফরপুরের সাব-ডিপো। জানেন প্রথমবার কতজন শ্রমিক চুক্তিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ? ৩৯৯ জন । তার মধ্যে ২৭৯ জন ছিল পুরুষ, ৭০ জন মেয়ে, দশ বছরের কম ছেলে ৩২ জন আর ১৮ জন পুঁচকি মেয়ে । পাঁচ বছরের চুক্তি, সপ্তাহে ছয় দিন। সাত থেকে ১০ ঘন্টা করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। একবছরের মধ্যে ২০ শতাংশ শ্রমিক মারা গিয়েছিল স্যার। মালিকদের অত্যাচারে ৩০ শতাংশ মেয়ে গর্ভবতী হয়েছিলো।’
মর্মন্তুদ ইতিহাস। তবু পাঠক, আপনার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে — এর মধ্যে কলকাতার গঙ্গার ঘাটটা কোথায়? আছে। ওই সব সাবডিপো থেকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধরে আনা দুঃখী মানুষগুলোকে জড়ো করা হত ২০নং গার্ডেনরীচের মেইন ডিপোতে। সেখান থেকে জাহাজ ছাড়ত। সেই মানুষগুলোর আর ফেরা হয়নি। তাদেরই স্মরণে ঐ সুরিনাম ঘাট। ওই মাই-বাপ মূর্তি।
কলকাতার সুরিনাম ঘাটে মাই-বাপ মূর্তি
কলকাতা শহরের এই না-জানা চোখের জল আর রক্তের ইতিহাসটি বড়ো মরমী ভাষায় লিখেছেন একজন কলমবাজ যাঁর নাম পাঠকের কাছে এখনও তেমন পরিচিত নয়। নয় তাঁদের কাছে যাঁরা সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়েন নি। একবার পড়বার পর, নিঃসন্দেহে বলা যায়, দ্বিতীয়বার তাঁরা নিজেদের আগ্রহে এঁর লেখা খুঁজে বার করবেন। কলকাতাকে নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা তার প্রেমিকের সংখ্যা কম নয়, তবু এমন যত্নে কলকাতার অলিগলি ইতিহাস-ভূগোল খুঁজে বার করা লেখক সমসময়ে বেশি নন, বিশেষত তথ্য আর রসের একত্র সমাহার খুঁজতে চাই যদি।
বইয়ের নাম ‘দই-দম্বল’ বটে কিন্তু আমার মতে এ বই একেবারে ‘জমে ক্ষীর’। আর, সেই ক্ষীরসমুদ্র থেকে কতো যে হীরেমানিক উঠেছে! জেলেপাড়ার সঙ—
‘হাসি হাসব না তো কী
হাসির বায়না নিয়েছি
হাসি ষোল টাকা মণ
হাসি মাঝারি রকম...’
এ থেকে আরম্ভ করে প্যারিস থেকে পরমবন্ধু বিদ্যাসাগরকে লেখা মধুসূদনের চিঠি, ‘প্যারিসের একটি দোকানে আমি তোমার একটি-দুটি বই দেখতে পেলাম...। পকেটে যথেষ্ট ফ্রাঁ থাকলে এখনি সেগুলি দোকানের ছাপ সহ দেশে তুলে নিয়ে যেতাম। তোমার হাতে তুলে দিয়ে ধন্য হতাম তো বটেই...তবে কিনা ফরাসী শ্যাম্পেন না খেয়ে ছাড়তাম না...’। প্রথম কলকাতা বইমেলা থেকে ‘পঞ্চাননতলা বাজারের পেছনে যাদের বাড়ি’ সেই শিমূলের মা, হলুদ খয়েরি লম্বা বাড়িগুলোর তিন তলা–সাততলা-দশতলায় কাজ করা সামীমা— নানান কলকাতাকে ভাঁজে ভাঁজে খুলে দেখতে থাকেন লেখক। আর এক আশ্চর্য বালিগ্রন্থের মত কলকাতাও খুলতে থাকে।
‘শহর আমার মায়ের শাড়ির গন্ধ / এখনও সেই হলুদ লাগা, আটপৌরে / চোখ করলেই বন্ধ’ এমন লাইন ভাসিয়ে দেওয়ার চাবি যার হাতে তার কাছে না-খুলে বা করে কী! বইখানার সবচেয়ে দীর্ঘ লেখাটি এক বিশেষ বিন্দু থেকে ছড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র ইতিহাস-কথন, কেন্দ্রে ‘মিত্র ইনস্টিট্যুট স্কুল’। তার একপ্রান্তে দারোয়ান মণি শুকুল, সদ্যকিশোর বয়সে উত্তরপ্রদেশের কোন অজ পাড়া গাঁ থেকে বাবা-কাকার সঙ্গে কলকাতায় এসে বলরাম বসু ঘাট রোডে স্কুলের কর্মীদের ঘরে থাকতে শুরু করে বার্ধক্যে পৌছনো মানুষটি, অন্যপ্রান্তে স্কুলের শিরোভূষণ ‘সংখ্যার দেবতা’ কেশব চন্দ্র নাগ। বিষয়ের বৈচিত্রে কলকাতার মতই অসংখ্য, অগণন।
ছোট বড় ব্যক্তিগত গদ্যে বিন্যস্ত বইটি কথাও বলে কলকাতার নিজস্ব ঢঙে, আড্ডার মেজাজে। সেই আড্ডায় নেই কী! ছবি বিশ্বাস আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাড়ে চুয়াত্তরের ‘মাসিমা, মালপো খামু’ থেকে শুরু হয়ে কথা চলে যায় পঞ্চাশের দশকে নিজের পয়সায় ফ্রান্সে গিয়ে তাদের জাঁদরেল ফিলিম ইন্সটিট্যুটে ছবি করতে শিখে আসা পরিচালক বারীন সাহা, বাজারী প্রমোদের কাছে হারা স্থানীয় গ্রামীণ এক সার্কাস দলের আখ্যান ‘তেরো নদীর পারে’ যাঁর একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘের ছবি, সেই অদ্ভুত পরিচালক বারীন সাহা, কমলকুমার মজুমদার, সত্যজিত রায়; পাড়ার নাপিত হরিদার ‘কাটিং রুম’ থেকে এক নিশ্বাসে ১৯২৪ সালে আইয়ার চ্যাটারটন সাহেবের লেখা A History of the Church of England in India: Since the Early Days of East India Company-তে (বইটি অন-লাইনে নিখরচায় পড়ার লিঙ্ক দেখুন নীচে) লেখা শাহী নরসুন্দর ‘নাঈ’দের বৃত্তান্ত হয়ে একেবারে বাদশা হুমায়ুনের ‘নাঈ-কি-মকবরা’ অবধি দৌড় লাগিয়েও ক্লান্ত, একঘেয়ে, পন্ডিতি নয় একেবারেই। বরং রসে ছলছল। সে রসে লেডিকিনির জন্মদিনের চটচটে মধুর রসের পাশাপাশি আছে টিপিক্যাল বাঙালি মুজতবা আলি সাহেবের মত ইট্টু চোখ ছলছলের নুনও। ‘চারাবেলা’য় ডাক্তারি শিক্ষার অগ্রগমন মানসে প্রথমবার বিলেত গিয়ে সেখানকার বিরলকেশ, ‘হিচককের মত গম্ভীর’ ডীন সাহেবের বাড়িতে থাকার সাংঘাতিক সৌভাগ্য ঘটে, তার মূলেও এই শহর। মেমসাহেব পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান কালে ইন্ডোলজি নিয়ে অ্যাডভান্সড স্টাডি করার জন্য একবছর কাটিয়েছিলেন কলকাতা শহরে। ইলিয়ট রোডে বাড়িভাড়া নিয়ে। একা। ছেলের বয়সী কলকাতাবাসী তরুণকে পেয়ে কলকাতা-কথা উপচে উঠতে থাকে, যার শেষে ছিল ‘বড়নগর’ নামের জায়গায় একটা ছোট দোতলা বাড়ি, বাইরে দরজার পাশে ‘জুঁইফুল’-এর লতা। এক কবিতালেখা, মায়াবী তরুণের বাড়ি। সে আখ্যানের শেষ দেখা দেয় লালচে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠার একটি বইরূপে, বিভুতিভূষণের ‘পুঁইমাচা ও অন্যান্য গল্প’। উপহারের পাতায় লেখা ‘সকালবেলায় বাজলো ঢাক / মেম খায় পুঁইশাক’। নারী পুরুষ নানা বয়সের, নানা অবস্থার, তাদের চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা এ শহরের পথঘাট, সৌধ বা ভাঙাবাড়ি। বর্তমান এবং ইতিহাস। এক শহর-ইয়ারের আসর খোলা পাতায় পাতায়। তার সঙ্গে বিরল, ইতিহাসময় সব ফটোগ্রাফ।
কলকাতার বৈঠকী গল্প শেষ হতেই পারে না যদি তার গানের ইতিহাস নিয়ে কথা না হয়। আছে, তাও আছে। বিশেষত সেইসব কিন্নরকন্ঠীদের কথা যাঁরা নিজেদের জীবনকে জ্বালিয়ে কলকাতার বাতাসে সুরের নেশা ছড়িয়ে রেখেছিলেন আতর-গোলাপের মত। বিনোদিনী, শামশাদ বেগম, আঙুরবালা ইন্দুবালা, সলিল চৌধুরীর জীবনসঙ্গিনী জ্যোতি, স্টুডিও ফ্লোরে শুটিংয়ের সময় সহ অভিনেতার চড় খেয়ে নাচ-গানে হিন্দি ফিল্মের দুনিয়া মাতানো পিয়ারী মুন্নির হয়ে যাওয়া এক চোখ হারানো ললিতা পাওয়ার...গল্পের পর গল্পের সুতো খুলে খুলে বোনা হতে থাকে বর্ণময় চাঁদোয়া।
‘আর থাকে যোগিয়া ত্রিতাল
জ্যোৎস্নার ফলন্ত আকাশে
বেগম আখতার হয়ে সকরুণ ভাসে।’
কোনো তুলনায় না গিয়েও বলা যায়, যে কোন সিরিয়াস জিনিস নিয়ে রঙ্গ করা আর ভারী কথাকে হাসিঠাট্টার ভিয়েনে সরস করায় এই লেখকের মুন্সিয়ানা দেখে আমার এক একবার মনে হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলির ঘরানা রক্ষার একটা হদিশ বুঝি হল এতদিনে।
একজন ব্যস্ত চিকিৎসক কী করে খুঁটে খুঁটে জোগাড় করেন একটি জনপদের ভূগোলে জড়ানো ইতিহাসের এত পুঁতি, কেমন করে তাকে গাঁথেন এমন সহৃদয় ভাষা দিয়ে, ভারি আশ্চর্য হয়ে রইলাম।
আশ্চর্য হয়ে রইলাম আরো দুটো কথা নিয়ে। এক, দু দুটো খণ্ডে জাম্বো সাইজের দুটি আলাদা বই লিখে কেন দুটোর একই নাম দিলেন লেখক? এতো দুই ছেলেমেয়ের একই নাম দেবার মত! দুই, এমন সরস সুখপাঠ্য বই দুটির কোন প্রচার নেই কেন? ভার আছে অথচ গোমড়া নয়— এমন বইয়ের পাঠকরা এই বই পেলে খুশিই হবেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু তার জন্য তো বইদুটির অস্তিত্বের কথা প্রকাশককে সুপ্রকাশ করতে হবে!
জয়া মিত্র বইটি পড়ার মজলিসি মেজাজ ছড়িয়েছেন মনে। ভালোবাসার কলকাতার নিয়ে এমন একটি বই। সাগ্রহে অপেক্ষা করে রই !
লেখকের কথা শুনে আশা, চিকিৎসায় মনোযোগী তবুও সাহিত্য ভালোবাসা।।
ধন্যবাদ জয়া মিত্র দি।
ধন্যবাদ গুরুচন্ডা৯