জলের দেশ আমাদের। একশটা নদী। কয়েক লক্ষ পুকুর ছিল। ঝিল-বিল-সরোবর। কোনোটারই কমতি ছিল না। আকাশ যেমন নীল প্রায় তেমনই নীল নীল ছায়া ধরা থাকত মাঠঘাটে গাঁয়ে। এমনকি শহরেও চারপাশে। অথচ আজ জল নিয়ে এমন দুরবস্থা – যেমন বন্যার বিপদ, তেমনই জল না থাকার কষ্ট। গাছপালা নেই, ঘাসজমিও প্রায় শেষ – বর্ষায় ভেসে আসা মাটি নদীর খাত ভরে দিচ্ছে। একটু বৃষ্টিতেই জল উপচে বন্যা। আর নদী খাল বিলে জল না থাকলে, হেমন্তকাল থেকেই জলের কষ্ট শুরু হয়ে যায়। এদিকে মাটির তলার জল খুব বেশি তুলে ফেলার ফলে কুয়ো নলকূপেও জল নেই। ঘরসংসারে জলের কষ্ট, চাষের ক্ষেতেও তাই। ওদিকে গ্রামশহরে যে লক্ষ লক্ষ পুকুর ছিল, যারা ঘরে বাইরে জলের যোগান দিয়ে এসেছে হাজার বছর ধরে – তাদের মানুষ ভুলেছিল বলে তারাও কাজে লাগার মত নেই আর। মানুষ আধুনিক হয়েছে, অনেক নতুন কিছু শিখেছে, নতুন অনেক কিছু পেয়েছে সত্যি কিন্তু জল তেষ্টা তো এখনও পায়। ক্ষিধের ফসল ফলাতেও জল লাগে। সারাদিনে সব কাজেও জলের দরকার রয়ে গেছে পদেপদে। বরং সে দরকার অনেক বেড়েছে। অথচ বেশিরভাগ মানুষ দরকার মত জল পায় না। জলের যোগান নেই। অনেক অনেক টাকা দিয়ে জল পেতে হয়। যে দেশে এত বৃষ্টি, ভালোজলের ধারা এমন অফুরান, সেখানে জলের এত কষ্ট।
এই অবস্থাটা একদিনে হয়নি। ‘আধুনিক’ হওয়া ‘শহুরে’ হওয়ার মানে আমরা ধরে নিয়েছি নিজেদের সব কিছুকে ভুলে নতুনকে ধরতে যাওয়া। কিন্তু দুনিয়ার নিয়ম তেমন নয়। যা আছে তার অসুবিধাটুকু দূর করে তার সাথে মিলিয়ে নতুনকে নিতে হয়। বাপ-মা, দাদু-ঠাকুমা বুড়ো হয় বটে, কিন্তু তারাই তো আবার ছোট কচি ছেলেমেয়েকে বড় করে। দুশো বছর পরের গোলামি আমাদের শিক্ষিত মানুষদের সাহেব হতে শিখিয়েছিল বলে আমরা লেখাপড়া শিখে মা-ঠাকুমাকে ভেবেছি সেকেলে, গ্রামকে ভেবেছি গাঁইয়া। লক্ষ লক্ষ পুকুরের যত্ন নিত যে সমাজ, জল-ফল-ফসল ব্যবহারের, চাষের নিয়ম বেঁধে দিত যে সমাজ, তা নষ্ট হয়ে গেছে। জাতপাত, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে গিয়ে পুরোনো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা হারিয়ে গেছে অথচ সেই খারাপগুলো রয়েই গেল।
পু্রোনো অভিজ্ঞতা থেকে যে সব নিয়ম লোকে জানে, আমাদের দেশে তা খুব কমই লিখে রাখা হত। সেগুলো চলে আসত লোকের মুখে মুখে। হাতে করে করা কাজের মধ্যে দিয়ে। কেমন করে পুকুর কাটা হয়, কী তার মাপ, কেমন করে জমি বাছা হয়, কোনদিক থেকে কাটা শুরু হয়, কোনও পুজোটুজো হত কিনা – খোঁজ করতে গিয়ে কোথাও পাই না। কতোকাল গ্রামের সমাজে পুকুর কাটা হয় না। পু্রোনো বই-কাগজ-সেটেলমেন্টের দলিল – তাতে আনেক পুকুরের কথা আছে বটে কিন্তু পুকুর কারা কাটত, কেমন করে সেসব কিছু নেই। গাঁয়ের মাথা বুড়ো মানুষরাও সে কথা তেমন গুছিয়ে বলতে পারেন না। খুঁজতে খুঁজতে সেই না পাওয়ার মানে বোঝা গেল। কতো রান্নার বই থাকে, তাতে কালিয়া-পোলাও-চপ-কাটলেট রান্নার নিয়ম লেখা। ভাত কেমন করে রাঁধতে হয় সে কথা তো কোথাও লেখা নেই। ভাত সবাই রাঁধতে জানে। পুকুর কাটার চল এত বেশি ছিল বাংলায় যে সেসব লিখে রাখতে হবে, ধরে ধরে শিখতে হবে বা শেখাতে হবে – এমন কেউ ভাবেনি। পুকুরদের নাম থাকত, তাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হত, কোন কোন গাঁয়ে নাকি বিয়েও হত পুকুরের। পুকুরের বিয়ে হোক কি না হোক বাঙালি বিয়েয় এখনও শেষ রাতে পুকুরঘাটে ‘জল সইতে’ যায়। পরিবারের কেউ মারা গেলে অশৌচ শেষ করে চুল দাড়ি নখ কাটতে হয় ‘ঘাটে’ গিয়ে। কতোরকম করে পুকুর আমাদের ব্রতে, গল্পকথায়, নিয়মকানুনে জড়ানো – তার আর শেষ নেই।
মন দিয়ে, যত্ন দিয়ে খুঁজলে আজও নিশ্চয়ই তার কিছু কিছু পাওয়া যাবে। পুরোনো মানুষ যারা আছেন তাদের কাছে বসলে, একটু একটু করে এখনও এখানকার জলের কথা, সেচের কথা, বিল-জলা-পুকুরের কথা - জানা যাবে। দীঘি-পুকুরের গল্পেসল্পে দেখি সে সব রাজা-জমিদারই কাটান বা গৃহস্থ, জল কিন্তু ব্যবহার করত সবাই। ‘পাঁচজনা’র ব্যবহারের জন্যই পুকুর কাটানোকে পুণ্যকাজ বলে মানা হত। ভিনদেশের পথিক যেতে যেতে মাঠের মধ্যে কি বটের তলায় মন্দিরের পাশের পুকুরধারে বসে পুঁটুলি খুলে গুড়চিঁড়ে বার করে জলে ধুয়ে নিল, হাত মুখ ধুয়ে, খেয়ে, জলপান করে আবার রওনা হল – এটা খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। আজকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশ অবধি যে যশোর রোড, শোনা যায় একসময়ে যশোরের মহারাজার মা সে পথ দিয়ে কালিঘাটের মন্দিরে এসেছিলেন। তখন অন্য কোনো গাড়ি ছিল না, কেবল ঘোড়া। রানি এসেছিলেন পালকি চড়ে। পথে কোথাও এতটুকু ছায়া ছিল না, জল ছিল না। রানিমার আর তাঁর সঙ্গের লোকেদের বড় কষ্ট হয়েছিল। ফিরে গিয়ে রাজাছেলেকে সে কথা বলেছিলেন। মায়ের কথায় ছেলে পথের দুধারে অনেক পুকুর কাটান আর লাগিয়ে দেন অনেক গাছ – যে সব গাছ বেড়ে উঠে আজও যশোর রোডকে ছায়া করে রাখে। শোনা যাচ্ছে, রাস্তা চওড়া করার জন্য সে গাছগুলি এবারে কেটে ফেলা হবে।
গ্রামবাংলায় জাতপাতের বিচার তো ছিল নিশ্চয়ই কিন্তু নিচুজাতের লোকেদেরও কুয়োপুকুর থাকত। সেগুলো সংখ্যায় খুব কম ছিল বলে তারা স্নান কি কাপড়কাচার পুকুরের জলই পান করতে বাধ্য হতেন। রোগবালাই বেশি হত। উঁচুজাতের লোকেরা কিছু পুকুর নিজেদের জন্য আলাদাভাবে দখল করে রাখতেন। তবুও গরমের দিনে বা তেষ্টার সময়ে যারা বাড়ির পকুরের জলও অন্যকে ব্যবহার করতে দিত না, সমাজ তাদের নিন্দে করত। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি এমনকি গাছপালাও জলের ভাগ পেত। গরমের দিনে গৃহস্থ একটু উঁচু জায়গায় পাখির জন্য জল রাখতেন। সে সময়ে পুকুরের ঘাটের কাছে জমা অল্প জলে কাক কি শালিক পাখির স্নান প্রায় সবাই দেখেছি। পুকুরের পাড়ে কিংবা আশেপাশে লাগানো গাছপালা তো ভালো থাকেই, আগেকার মায়েরা, মেয়েরা, কোনো কোনো পুরুষমানুষও বৈশাখ জ্যৈষ্ঠমাসে পুকুরে চান করে উঠে ভিজে কাপড় গামছা মাথায় চাপিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিতেন। পথে যে কটি বট-অশত্থ-হরিতকী-আমলকী গাছ পড়ত, সকলের গোড়ায় অল্প অল্প করে জল দিতে দিতে বাড়ি ফিরতেন। সকাল থেকে দুপুর বেলা পর্যন্ত এভাবে অন্তত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বার একটু একটু করে জল পড়লে গাছের গোড়া ভিজে ভিজে থাকত। দুপুর রোদে রাখাল কি পথিক গাছতলায় বসবার জন্য দুটি ঘাস পেত।
পুকুরকে যে কতখানি গুরুত্ব দিত সমাজ তার একটা নমুনা হল দেশের নানান জায়গায় পবিত্র পকুর। ঠিক যেমন ‘দেবতাদের বন’ – মহারাষ্ট্র-গুজরাটের ‘দেবযানী’ – রাজস্থানের ‘ওরন’ – সাঁওতালদের। সেরকমই সারা দেশে আছে এইসব পুকুর। সাধারণভাবে এসব পুকুরের জল ব্যবহার করায় সামাজিক নিষেধ থাকে। সব জায়গার নিয়ম এক নয়। কোথাও বা সেইসব পুকুর থেকে খাবার জল ভরা যায়, কোথাও বা কেবল মন্দিরের পূজারি স্নান করতে পারেন। কেবলমাত্র কয়েক বছর বৃষ্টি না হলে, খুব বিপদের সময়, পাঁচজনের মত নিয়ে এসব পুকুরের জল পান করবার জন্য নেওয়া হয়। নিয়ম সব পবিত্র পুকুরেই মেনে চলা হয় – সেই জলে বাসকারী কোন প্রাণীর গায়ে কেউ হাত দেবে না। হিমাচল প্রদেশের মুমসিয়ারিতে এরকম কয়েকটি তাল (তালাও=পুকুর) আছে। সেখানকার লোকেরা এই নিয়মটি এত মেনে চলেন যে কারো গরু-বাছুরও যদি মিশির তালের জলে পড়ে যায় সেটা কেউ তুলবে না। এরকম পবিত্র পুকুর পশ্চিমবাংলাতেও আছে। বীরভূমের মল্লেশ্বর শিবমন্দিরের পাশে বিরাট পুকুরে মাছ-সাপ-কমল-ঝাঁজি – কোন কিছুতে কেউ হাত দেয় না। কিন্তু পানীয় জল নেওয়া হয়। এই নিয়ম হিন্দু-মুসলমান – দুই ধর্মের মানুষই মেনে চলেন।
জল সাবধানে রাখা, যত্নে রাখার এইসব নিয়ম কেউ কোন আইনের বইয়ে লিখে রাখেনি। পাঁচজনের ভালোর জন্য সমাজ নিজেই তৈরি করেছিল, নিজেই তা মেনে চলে। এরকম ধরনের নিয়মনীতিগুলি মেনে চলা ভালো নাকি উড়িয়ে দেওয়াই ভালো – সে কথা ভাববার সময় এসেছে। কোন কোন পুরোন নিয়ম ছাড়লে ভালো, কোন নতুন নিয়মপত্র না নিলেই মঙ্গল – ভাবতে হবে সে কথাও।
দুচার বছর পরপর কুয়ো বা পুকুর ‘ঝালাই করা’ হত। তার মানে বর্ষার আগে যখন জল সবচেয়ে কম তখন তলার জমা পাঁক কাটিয়ে কুয়ো-পুকুর গভীর করে নেওয়া। পুকুরের পাঁক দিয়ে পাড়ের ভাঙা কি ফেটে যাওয়া জায়গাগুলো মেরামত হত। আবার ওই পাঁক রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে মাঠে দিলে ভালো সার হয়। ধনী গৃহস্থ হয়ত লোক লাগিয়ে ঝালাইয়ের কাজ করাতেন কিন্তু বাকি পুকুরগুলোয় সে কাজ কারা করত? তারা বছরের বাকি সময় কী করত? অনুপম মিশ্রের বইয়ে একজনের নাম পাচ্ছি – গঙ্গোজী কল্লা। যোধপুরের কাছাকাছি ফলৌদি শহরে তাঁর বাড়ি ছিল। সারা বছর যেমন তেমন পোশাক ছেঁড়া চটি পরে এই মানুষ সকাল বিকেল শহরের আটটা পুকুরের দেখাশোনা করতেন। স্নান করতে এসে, জল ভরতে এসে কেউ ঘাট নোংরা করছে কিনা, কোথায় কি ভেঙেছে, কি মেরামত করতে হবে – সব নজর রাখতেন। এ কাজ তাঁকে কেউ দেয়নি। তিনি নিজেই করতেন। ভালোবেসে। বছর শেষ হবার মুখে একদিন তিনি শহরের কিশোর বালকদের নিয়ে বেরোতেন। পুকুর পাড়ে নয়, সেদিন তিনি যেতেন শহরের বাড়ি বাড়ি। প্রত্যেক সংসার জানত গঙ্গোজী কল্লা বছরে এই একবার আসেন। এক টাকা করে চান। চাইবার আগেই বাড়ি বাড়ি লোকে ভারি খুশি মনে তাঁকে সেই টাকাটি দিত। সব বাড়ি ঘোরা হয়ে গেলে ঝুড়ি কোদাল বেলচা কাঁধে ছেলের দল পুকুরের মেরামতির কাজে লাগত। পাড় বাঁধানো, অপ্রা সাফ করা, পাঁক তোলা – কাজ হত যেমন খেলতে খেলতে। ঝুড়ি প্রতি দুআনা করে দিতেন গঙ্গোজী। সেই ৫০-৫২ সালে দুআনার দাম কম ছিল না। কতো বছর ধরে কে জানে, ৫৬ সাল পর্যন্ত এই কাজ করে গিয়েছেন গঙ্গোজী কল্লা। তারপর তাঁর জীবন শেষ হয়। তাঁর দেহ নিয়ে শোকযাত্রা করেছিলেন শহরের সব লোক। সে শহরে এতবড় মিছিল তার আগে হয়নি, তার পরেও না। জলকে ভালোবেসে এত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন সে মানুষ।
রাজস্থানে, গুজরাটে, মধ্যপ্রদেশে ভীলদের মধ্যে পুকুর সারানো আর পুকুর ঝালাই করা হয় এক উৎসবের মত করে। তাকে বলে ‘ল্হাস খেলা’। তাদের বছরের শেষদিন ছিল ফাগুন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী। অমাবস্যার আগের দিন। সেদিন রাজা-প্রজা সবাই মিলে পুকুরে নেমে মাটি কাটবে, পাঁক মাখবে, একে অন্যকে মাখাবে।
দক্ষিণ ভারতে পুকুর পরিষ্কারের খরচ চালানোর জন্য কিছু জমি থাকত। তারা বলত কোডগে। সেখানে যা ফসল হত কিংবা সেখান থেকে যা টাকা পাওয়া যেত তাই দিয়ে বছর শেষে পুকুর ঝালাই ও মেরামতির কাজ হত। এছাড়া গ্রামে গ্রামে পয়সা জমা করে খরচ চালানোর ভাণ্ডার ছিল, তাকে বলা হত ‘মান্যম্’। কারো ঘরের পশু যাতে পুকুরে না নামে বা পাড়ের ওপর না উঠে পড়ে তার জন্য ‘বন্দেলা মান্যম্’। কোন বছর পুকুরে কতো জল আছে, কার ক্ষেতে কতো জল দেওয়া যাবে তা ঠিক করে সেচের জল খুলবে ‘নীরুকুট্টি’ বা ‘নীরুঘন্টি’। এই নীরুকুট্টির কাজ কেবল দলিত জাতির লোকেরাই পেত।
জানতে ইচ্ছে হয় এই বাংলাদেশে কেমন করে চলত এইসব কাজ। অনেক জায়গায় অনপুছি একারস্ মানে যেই একাদশীতে কাউকে আলাদা করে না শুধিয়েই কোন ভালোকাজে হাত দেওয়া যায় – বাংলায় যাকে উত্থান একাদশী বলে, সেইদিন পুকুর খোঁড়ার কাজে হাত দেওয়া যেত। বাংলায় যে এমন দিনের বিচার ছিল তাও বোঝা যায় পুরোনো পাঁজি দেখলে। তাতে তিথি নক্ষত্র দেখে পুকুর খুঁড়বার শুভদিন বলা থাকত। তার ঠিকভুল কতোটা তা আর আমরা আজকে জানি না। কিন্তু একথা ঠিক যে কাটানো পুকুর হোক বা আপনা থেকে তৈরি হওয়া জলাশয়, তার সাথে জীবন কাটানোর রীতি নিয়ম জানত সেকালের লোক। জলাশয়ের যত্ন করতেও জানত। তাই জন্য পুকুরের জলের ভরসায় মানুষ থাকত, আবার পুকুর দীঘিও থাকত মানুষের যত্নের ভরসায়। পুকুর যেমন, নদীও সেরকমই যত্নের জিনিষ। তবু নদী তো সব জায়গায় সমান থাকে না। যে দেশে, যে গাঁয়ে নদী নেই কিংবা থাকলেও অনেক দূরে আছে, বিশেষত সে সব গাঁয়ের ক্ষেতে সেচ হত পুকুর থেকে।
বাংলার খুব সামান্য হলেও কিছু কিছু অঞ্চলে পুকুরের জলে সেচের কাজ এখনও হয়। এমনকি পুকুরের জল তুলে ক্ষেতে সেচ দেবার কিছু কিছু পুরোনো জিনিষও ব্যবহার হয় আজও। যেমন হাওড়া জেলার বাগনানে ছ আনি গুজরাট বলে একটি গ্রামে ডোঙা দিয়ে, সিউনী বা দুনি দিয়ে সেচ নালায় জল দিতে দেখেছিলাম। একটা তাল বা নারকেল গাছের গুঁড়ির মাঝখানটা লম্বা করে কুরিয়ে ফেলে পাঁচ-ছয়-সাত হাত লম্বা একটা সরু নৌকার মত তৈরি হয়। তাকে বলে ডোঙা। তার একটা দিক পুকুরের জলে থাকে, অন্যদিকটা থাকে সেচনালার মুখে। সেই মুখে একটা বড় মাটির তাল বেঁধে ভার দেওয়া হয়। পুকুরের জলে দাঁড়িয়ে একজন ডোঙাটি পা দিয়ে চেপে জল ভরে ছেড়ে দিলে ভারের দিকটা আপনা থেকেই নিচু হয়। ডোঙাভরা জল গড়িয়ে যায় সেচনালা দিয়ে। ছোটনাগপুর কি এখনকার ঝাড়খণ্ডের অনেক জায়গায় একটা লম্বা বাঁশের গোড়ায় ভার বেঁধে বাঁশের ডগায় বাঁধা চামড়ার মশকটি কুয়োর জলে ডুবিয়ে প্রায় একইরকম করে সেচ দেওয়া হয় ক্ষেতে। তাকে বলে লাটাখাম্বা। ওইসব জায়গায় সবজি বাগানে জল দেবার জন্য পুকুরের বদলে কম গভীর না-বাঁধানো কাঁচা কুয়ো থাকত। সিউনী একটা বড় কুলোর মত জিনিষ। চামড়া দিয়ে তৈরি। তার দুপাশে দুজন লোক দাঁড়িয়ে দড়ি দিয়ে টেনে পুকুর থেকে সিউনী ভর্তি জল পাশে সেচ নালায় দেয়। সেচনালায় যেইখানে এই জল ঢালা হয় তাকে বলে ঝাল। এই সিউনী বা দুনি দিয়ে পুকুর থেকে তিন-চার হাত উঁচু জমিতেও জল দেওয়া যায়।
পুকুর বা বৃষ্টির জল থেকে সেচ দেবার এই নানারকম উপায় দেখে একটা কথা স্পষ্টই বোঝা যায় – সব জায়গায় একইভাবে কাজ চালাতে হবে এমন কথা কেউ ভাবতো না। কোন জায়গায় মাটি কেমন – নরম না শক্ত, চিটা না কাঁকরবালি, বৃষ্টি কম কি বেশি, জমি সমান না কি উঁচুনিচু – এইরকম অনেক কিছু দেখেই এক এক জায়গার চাষিরা নিজেদের জায়গায় সেচের উপায় ঠিক করতেন। সব জায়গায় চাষও এক রকম হত না। বেশিরভাগ জায়গায় যেমন ধান হত তেমনি আবার কোথাও সবজি, কোথাও ফুল এমনকি কোন কোন জায়গায় কেবল পানের চাষও হত। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে চাষিরা নিজেরাই ঠিক জানতেন কোথায় কোন চাষ ভালো হবে। কোন চাষে কীভাবে সার বা সেচ দিতে হবে। চাষ ছাড়াও যেখানে যেরকম গাছপালা সেরকম কাজও হত লোকের। এরকম করেই মালদহ-মুর্শিদাবাদের আম-লিচু-রেশম, দক্ষিণবাংলার হোগলা, দিনাজপুরের হুগলির পাটের কাজ, পুরুলিয়ার নানারকম ছাতু (মাশরুম)-লাক্ষা-সুরগুজা ঘাস-কাসিঘাস, বীরভূমের বেনা, উত্তরবাংলার বাঁশ কি বেত – এইসবের ওপর নির্ভর করে, এসব থেকে নানারকম জিনিষ তৈরি করে হাজার হাজার সংসার চলছে। অতি সুন্দর সব শিল্প গড়ে উঠেছে।
এছাড়া পুকুরের নানারকমের মাছ বাঙালীদের ‘মাছ ভাত’ খাওয়ার উপায় করে রাখত। রোজকার খাবারে যেমনই হোক কিছু কিছু মাছ জুটে যেত – পুকুর থেকে, বর্ষাকালের ধানক্ষেত থেকে।
গত কয়েক বছর ধরে মাটির তলার জল কমে যাওয়া, টিউবওয়েলে আর্সেনিক বা ফ্লোরাইড ওঠা, সারাবছর গ্রামে শহরে জলের অভাব – এইরকম নানা কারণে সারা পৃথিবীতে আবার নতুন করে মেঘের জল ধরে সেই জল কাজে লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে। নানামত কাজ হচ্ছে। আমাদের দেশে বহুকাল ধরেই সেই কাজের কতোরকম ব্যবস্থা ছিল। নতুন করে সরকারি-বেসরকারি তরফে আবার পুকুর তৈরির কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু পুকুর তৈরি বা পকুরের যত্ন করা এমন একটা কাজ যা কোন সরকার ওপরে বসে করতে পারে না। সরকার আইন করে দিতে পারে, সহায়তা দিতে পারে। পুকুরের যত্ন করা তাদের কাজ যাঁরা সেই পুকুরের আশেপাশে থাকেন। তাদের প্রতিদিনের যত্ন আর পরিশ্রম ছাড়া পুকুরগুলিকে বাঁচিয়ে তোলার অন্য কোন উপায় নেই। সেই আশেপাশের মানুষদের পরামর্শ ছাড়া যে সব জায়গায় নতুন পুকুর কাটা হয়েছে তার বেশিরভাগই শেষ অবধি তেমন কাজ দেয়নি। তবে অনেক জায়গায় সরকারি-বেসরকারি সামান্য সাহায্য পেয়ে গ্রামের মানুষরা নিজেরাই নিজেদের গ্রামের পুরোনো পুকুর সারিয়ে তুলে সুন্দরভাবে ব্যবহার করছেন।
মেদিনীপুরের বারশংকর গ্রামে একটি বড় দীঘি ছিল। সেটির চব্বিশ জন ভাগীদার, তারা শহরে থাকেন। গ্রামের লোকেরা একটি বেসরকারি সংস্থার উৎসাহে সেই পুকুরটি সারিয়ে তুলে কাজে লাগানোর কথা ভাবেন। সংস্থাটি তাদের কোন টাকাপয়সা সাহায্য করতে পারেনি, কেবল উৎসাহ পরামর্শ দিয়েছিল। গ্রামবাসী ১২৫টি পরিবার সমিতি গড়ে প্রথমে মালিকদের কাছে পুকুরটি চেয়ে নেন। বদলে বছরে একটা ভাড়া দেবার কথা ঠিক হয়। প্রতি পরিবার থেকে একজন করে প্রতিদিন পুকুরের কাজে শ্রমদান করেন। এই গরীব মানুষরা সারাদিন নিজেদের রুটিরুজির কাজ করতেন আর পুকুরের কাজ শুরু হত সন্ধ্যাবেলায়। চাঁদের দিনে অনেক রাত অবধি কাজ চলত। কাদা তোলা হল, নোংরা পরিষ্কার হল, ঝোপঝাড় কাটা-পাড় বাঁধানো হল। মানুষের মিলিত পরিশ্রমের চেয়ে ভালো মসলা আর কিছু নেই যা দিয়ে গাঁথনি করা যায়। দেখতে দেখতে পুকুরের চেহারা পালটে গেল। চেহারা বদলে গিয়েছে সেই গ্রামেরও। তিন বছর ধরে পুকুরের ভাড়া দিয়েও অনেক উপকার পাচ্ছেন গাঁয়ের মানুষরা। চব্বিশ বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে, পুকুরে অনেক মাছ ছাড়া হয়েছে। সমিতি নিজেরা পুকুর ব্যবহারের নানান নিয়ম তৈরি করেছেন, নিজেরাই সে সব মেনে চলেন। সবচেয়ে বড় কথা – এই পুকুরের কাজ দেখে আশপাশের গ্রামের লোকেরা নিজেদের পুকুরগুলিতে হাত দেবার কথা ভাবছেন।
বীরভূম জেলার মল্লারপুরে ছোট গ্রাম গড়িয়া। এই গরীব সাঁওতাল গ্রামে জীবন ছিল খুব কষ্টের। লাল কাঁকুরে মাটি, হঠাৎ কোথাও কোথাও একটু চিটামাটি পাওয়া যায়। গোটা দুই ছড়ানো পুকুর যাদের জল বর্ষার এক মাসের মধ্যে টেনে যায় আর কয়েকটি মহুল গাছ – এই গ্রামের লোকেদের সম্বল। ফলে ছেলে-মেয়ে-বুড়োকে খাটতে যেতে হত কাছাকাছি পাথর খাদানে। তার ফলও দেখা যায় – গ্রামের ঘরে ঘরে প্রচণ্ড কাশি, ক্রাশার মেশিনে কাজ করতে পাথরকুচি ছিটকে কারো চোখ নষ্ট, কারও হাত আধখানা কাটা, কারও পায়ে উরু থাকে গোড়ালির পুরো মাংসটা চেঁছে গিয়েছিল – এখন বীভৎস দেখতে। কাজ করার ক্ষমতাও নেই। ফাঁকা টাড়জমি পড়েছিল গ্রামে আর পাথর খাদান এগিয়ে আসছিল আস্তে আস্তে। গত এক বছরে কিন্তু ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে।
গ্রামের কিছু পরিবার মিলে সমিতি গড়েছেন। নিজেদের জমিতেই তৈরি করেছেন সমিতির ঘর। সেখানে ছোটদের স্কুল হয়। নানারকম হাতের কাজ, এক জায়গায় বসা। এই এক জায়গায় বসে নানারকম শলাপরামর্শ করতে করতে বেঁচে থাকার নানারকম বুদ্ধি নিয়ে কথা হয়। সবাই জানে, একমাথার চেয়ে পাঁচমাথার বুদ্ধি বেশি। বাইরের নানারকম জলের, চাষের কথাও শোনেন তাঁরা। গত এক বছরে গড়িয়ার মানুষরা নিজেদের জমিতে খুব কম জলে ফলবে এমন সব সবজি লাগিয়েছেন, যেমন, ভিণ্ডি, অড়হর ডাল, সীম, বরবটি। সমিতির বড় ঘরটির খড়ের চাল থেকে যেটুকু বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে তা তারা ধরেছেন, জমা করা হয়েছে মাটিতে চৌবাচ্চা কেটে। খুব বড় নয় সে কুণ্ড, অনেক জলও তাতে ধরবে না, থাকবেও না অনেকদিন। কিন্তু এতে তাঁদের মনে ভরসা জেগেছে খুব। সামনের বর্ষার আগেই নিজের নিজের জমির মাঝে এরকম কুণ্ড কেটে বৃষ্টির জল ধরবার কথা ভাবছেন তাঁরা। ভাবছেন গ্রামে আরো গাছ লাগাবার কথা। পুকুর দুটির মালিকরা রাজি হলে হয়ত এদুটিকেও সারিয়ে ভালো করা যাবে। আগামী কয়েক বছরে দেখা দেবে পাথর খাদান থেকে দূরে হাতের কাজে সাজানো, ভাতের ওপর ডাল-তরকারি-মুরগী খেতে পারা হাসিখুশি এক সবুজ গড়িয়া।
নতুন পুকুর কাটার চেয়ে অনেক জরুরি বরং পুরোনো যে সব পুকুর এখনও বেঁচে গেছে সেগুলিকে যত্ন করে সারিয়ে তোলা। পুকুর ভরাট বন্ধ করবার জন্য সরকার আইন করেছেন। সেই আইন যেন ঠিকমত কাজে লাগানো যায় তার জন্য পুকুরের আশপাশের লোকজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। হাওড়ার উলুবেড়িয়া থানার কামিন্যা গ্রামে কয়েকটি পুরোনো পুকুর সারিয়ে নতুন করে কাজে লাগানো হচ্ছে। চারকাঠা মাপের একটি পুকুরকে যত্ন করে তা থেকে দুবিঘা জমি সেচ দিয়েছেন গৃহস্বামী। বোরো করেননি কিন্তু দুটো ধানের ফসল, সবজি চাষ, পানের বরজ, মাছ, পুকুরের ওপর তারের জাল দেওয়া ঘর করে হাঁস মুরগী, কিনারে ফুলগাছ, লাউকুমড়োর লতা – এরকম এগারোরকম ভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে সেই ছোট পুকুরকে। যা সাশ্রয় ও আয় হচ্ছে তা ভালোমত থাকার জন্য ঢের। পশ্চিমবাংলার আরো নানা জায়গায় এখন নতুন করে বৃষ্টির জল আটকানোর নানারকম উপায় নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে এই কাজের মধ্যেও সব জায়গার আলাদা আলাদা ধরন খেয়াল রাখতে হবে। সেই জায়গার মানুষদের পরামর্শে মন দিতে হবে। নিজের জীবনের শেষ দশবারো বছর বিখ্যাত বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত বীরভূমের গ্রামে কেবল এই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। পুকুর কিভাবে গ্রামের মানুষের গরীবি মুছে দিতে পারে সে কথা বলার সঙ্গে তিনি আরো একটা খুব কাজের কথা বলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন পুকুর কাটা কিংবা সরানোর মাটি গ্রামের মধ্যে এক জায়গায় জড়ো করে বড় ঢিবি করলে বন্যার সময় থাকবার জায়গা হতে পারে। আগে থেকে সেখানে চালাঘর, গোয়াল, ভাঁড়ার, পায়খানা ও নলকূপ রাখলে বন্যার সময়ে গ্রামের মানুষ অনেক কম খরচে নিরাপদে সেখানে থাকতে পারবেন। বোলপুর ১নং ব্লকে কয়েকটি গ্রামে এই কাজ শুরুও হয়। পুকুরের ভরসায় বা যে জল পাওয়া যাচ্ছে তাকে যত্নে ব্যবহার করে একটি গ্রামের জীবন পালটে যেতে পারে – একথার মধ্যে এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। কিন্তু সেই যত্ন করার, রক্ষা করার উপায়গুলি কি? পুকুরের ঢাল কিভাবে কাটতে হয় বলছিলেন কামিন্যা গ্রামের শ্রী দুলাল দেঁড়ে। আপনি কি করে জানলেন যে এরকম হবে? সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি খুব সহজ ভাবে বলেন ‘বরাবর তাই হয়ে এসেছে’।
এই বরাবর হয়ে আসার নিয়ম জানা মানুষরা নানা জায়গায় গ্রামে গ্রামে এখনও আছেন। আমরা যদি ছাত্রের মত, ছেলেমেয়ের মত বিনয় নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে চেষ্টা করি, সেই মানুষদের খুঁজে বার করতে পারব। তাঁদের কাছ থেকে শিখতে পারব। হয়ত হারিয়ে যাওয়া সেই জ্ঞানের অনেকখানি ফিরে পাওয়া যাবে। কাজে লাগানো যাবে। সুন্দর হয়ে উঠবে গ্রামগুলি, ভরভরন্ত হবে মানুষের জীবন।
এ দেশকে বর্ণনা করতে গিয়ে একদিন ‘সুফলার’ চেয়েও আগে ‘সুজলা’ বলেছিলেন কবি। আজকের জলসংকট কাটিয়ে, বর্ষার আশীর্বাদে আবার খনার কথামত ‘ধন্য রাজা পুণ্য দেশ’ হবে।
খুব সুন্দর লেখা। খুব ভাল লাগল।