গাঙুরের জলে ভাসে বেহুলার ভেলা
দেখি তাই, শূন্য বুকে সারারাত জেগে থাকি-
আমার স্বদেশ করে কাগজের নৌকা নিয়ে খেলা।
—বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯২০–১৯৮৫)। কবির প্রতিকৃতি—শিল্পী হিরণ মিত্র
যে মানুষের জন্মদিনের একশো বছর পার হল, তিনি এত প্রাসঙ্গিক থাকেন সমকালীন ইতিহাসকথনের প্রত্যক্ষতায়—এমনটা পাওয়া খুব সুলভ নয়। ‘যেদিন জগতে চলে আসি/ কোন মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশী...’
তাঁর জন্মসময়ই কি নির্ণায়ক ছিল এই ঐতিহাসিকতার? বিশ্বের সাথে সাথে এই বাংলার এক আমূল পটপরিবর্তনের মধ্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা। ১৯২০ সালে ক্যালেন্ডারের হিসেবমতো সদ্য শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪ – ১৯১৮) কিন্তু লুণ্ঠিত উপনিবেশগুলোতে তখনও চলছে অবশিষ্ট নিয়ে কাক-কুকুরের ছেঁড়াছিঁড়ি। কুড়ি বছর বয়স কোনো স্বপ্ন দেখবার আগেই তাঁদের চোখ জ্বলে গেছে নরকদর্শনে। ক্ষত শুকোবার আগেই যৌবনের ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে আর-একটি বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯ – ১৯৪৫) হিংস্রতায়। খাদ্যহীনতা, বস্ত্রহীনতা, ধনীর মূল্যবোধহীনতা। কালোবাজারি, সহনাগরিককে খুবলে খাওয়া, তারই ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক নেতাদের ‘মনে এক মুখে আর’ নীতি—এই ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে উঠে দাঁড়াচ্ছে বাংলা বিশেষত কলকাতার যুব সম্প্রদায়।
‘মাঝের কুড়ি বছর যেন নর্দমায় স্রোতের ইতিহাস
পিপাসা স্নান জীবনধারণ সকলই অমানুষিক
সোনাগাছির বুড়ো বাড়িউলির চেয়ে ভীষণ
মন্ত্রী নেতা অধ্যাপক লেখক ছাত্র ভাদ্রমাসের কুকুর
এখন একসূত্রে বাঁধা স্বাধীন দেশে’
(মৃত্যুর পর, কুড়ি বছর)
কুড়ি বছরের মধ্যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার মধ্যে থেকে পৃথিবীজোড়া নতুন সমাজভাবনার অভ্যুত্থানের আপ্রাণ স্বপ্নকে বুকে নিয়ে লড়াইয়ে শামিল হল ভারতবর্ষও। তারপর সারাদেশে নানাচেহারায় ঝড় তোলা সেই আন্দোলনের প্রবল ঝঞ্ঝাকে বাধা দিতে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার জারি করল চূড়ান্ত গণতন্ত্র-বিরোধী এমার্জন্সি (১৯৭৫ – ১৯৭৭)। বাংলার পথঘাটে রক্তের স্রোত বয়ে গেল ভদ্রসমাজের প্রায় অপ্রতিবাদে।
তারা সবাই হেঁটে যায়, একজনের পিছনে আরেকজন।
সেইসব দ্রুতগামী কিশোরেরা। মৃত। একজনের
পিছনে আরেকজন...
(রাস্তায় যে হেঁটে যায়)
ভুবন ভরে গিয়েছে আজ
চোখের জলের সমারোহে
যেদিকে চাই ক্ষুধার সভা
নরক যেন যায় বিবাহে।
বিবসনা বসুন্ধরা
সপ্তঋষির অন্ন জুড়ায়
গন্ধে বাতাস শিউরে ওঠে
আলোর দেশে ঝড় বয়ে যায়
অনেক দূরে অরূন্ধতীর ওষ্ঠ জ্বলে চোরের চুমায়
আর, সমস্ত আকাশ জুড়ে যুধিষ্ঠিরের কুকুর ঘুমায়।
(রাত্রি কালরাত্রি)
বেদনা আর অসহায় আত্মধিক্কারের এই লেখাই বুঝি তাঁর মুদ্রা।
কলকাতা শহরের জগবন্ধু ইন্সটিউশন-এ যখন ছাত্র, তখনই ‘প্রাণ দিতে পারিস?’-এর টানে ‘দেশকে স্বাধীন করার’ জন্য কিশোরের সাধ্যমতো রাজনীতির কাছে আসা। কাজে জুড়ে আবার ছিটকে যাওয়া বড়োদের মন আর মুখের অমিল দেখে, সবচেয়ে বেশি—মমত্বহীনতা দেখে। এদিকে তখন দেশ জুড়ে আকাল। খাদ্য নেই এমন নয়, আয়ত্তের মধ্যে নেই। আজ বিশ্ব জানে কীভাবে যুদ্ধের বীভৎস স্বার্থে ধানচালের দেশ বাংলাকে নিঃস্ব ন্যাংটো করে নিয়েছিল সেইসব উপনিবেশের প্রভু। সেদিন কেবল সেই ভাতের স্বপ্ন দেখে প্রেতচ্ছায়ার মতো দলে দলে মানুষ শহরে এসে ভাত চায়নি। ফ্যান চেয়েছিল। ফ্যান যদি চায় কেউ, তাহলে তো ভাত রান্না হয়, হচ্ছিল। বিনা ভাতে কী ফ্যান হয়? তবু গৃহগুলি বিস্ফোরিত হয়নি। ভদ্রজীবন চলছিল। উনিশশো বত্রিশ-তেত্রিশ সাল—বাংলা সাহিত্য সাবালক হচ্ছে কল্লোলে। সে কলকাতার মধ্যে ছিল আর-একটা কলকাতা। খিদে, যখন রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি, যখন ছেলের সামনে কাপড় জোটাতে না-পেরে গলায় দড়ি দিচ্ছে মা, এক পুঁটলি চালে ভাত রেঁধে স্বামী-সংসারের মুখে একবেলা তুলে দেবার জন্য অন্যের বিছানায় যাচ্ছে বধূ, সে কলকাতাও, ঠিক তখনই।
দীঘির জল আগুন
কুয়োর জল ছাই
জননী বলেছিলেন
পিপাসা পেতে নাই
রোদ না উঠতে, ফ্যান দাও
রোদ চলে গেল, ফ্যান দাও
ঘুমের মধ্যে ভয়ে
পা দুটি সরিয়ে রাখি
(কয়েকজন ভিক্ষুক) (১৯৬৭)
প্রচ্ছন্নে হিসেব ঠিকই রাখাও হচ্ছিল কোথাও। তৈরি হচ্ছিল সেই ক্ষুধা-নিধনের বর্ণমালা, ছবিতে লেখায় দিনপঞ্জিকায়। ক্রোধ আর চূড়ান্ত হতাশার দিনলিপি। তারপর দেশভাগ। কোনো শব্দ যথেষ্ট নয় যে অবস্থাকে বর্ণনা করার জন্য।
সে চিৎকারে স্বর্গমর্ত্য টলে
পাথরও চৌচির হত ভারতবর্ষের বন্ধ্যা পাথর না হলে
জঠরের অসহ্য ক্ষুধায়
ধূমাবতী জন্মভূমি সন্তানের দুর্ভিক্ষের ভাত কেড়ে খায়
(নচিকেতা)
যুদ্ধ বিদ্বেষ দেশভাগের ভয়ংকর ক্ষত ভুলবার আগেই, বাজারে বিকোনো দেশে রক্তাক্ত স্বাধীনতার দু-দশক পর থেকে স্বাধীন দেশ জুড়ে আবার স্বভূমির মাটি ভিজতে থাকে ঘরের ছেলেমেয়ের রক্তে। বয়ে যায় নির্যাতন পীড়ন ও হত্যার স্রোত। আর মানুষের মুখে মুখে জেলের গরাদে, থানায়, টর্চার চেম্বারের নরকে যেন বাতাসের ঠোঁটে পৌঁছায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। বিনাবিচারে বন্দির সঙ্গে নির্জন কারাকক্ষে জেগে থাকে রাতের পর রাত। সেই পঙ্ক্তিগুলির পথ ধরে ধরে দৈবাৎ ছাড়া পাওয়া বা তখনো ধরা না-পড়া ছেলেমেয়েরা আসতে থাকে কবির কাছে। কী যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একজনের উচ্চারিত শব্দমালা বুকে হেঁটে হেঁটে অনেকের হয়ে ওঠে। তখন কারও কারও মনে হয়েছিল—রাজনৈতিক আদর্শের কথা অর্থাৎ শোষণের, অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে গিয়ে যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অথচ এত দিন পরে সেসব কবিতা ফিরে পড়তে গিয়ে আমরা দেখি নিরন্তর ভালোবাসার, স্নেহের, এক নির্ঝর যেন সেই জ্বালাপ্রান্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই দেশ থেকে, যে দেশ কখনও বিশ্লিষ্ট নয় দেশের মানুষ আর মানুষের সময় থেকে, তার সঙ্গে এমন হাড়েমজ্জায় শিরায় বিজড়িত রয়ে গেলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে এলিয়েনেশন জানলেন না কখনও। হয়ে উঠলেন না যথেষ্ট আধুনিক।
এমন আপ্রাণ স্নেহ বধ্যভূমি দেখেনি কখনও।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যেন সমস্ত প্রতিবেশ—আবালবৃদ্ধবনিতা, প্রত্যেকে। প্রত্যহই। তারই মাঝখানে কবিতার প্রতিমায় ভালোবাসা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বীভৎসাকে অগ্রাহ্য করে সেই বেঁচে থাকার কথা।
একটি স্বাধীন দেশের বুক থেকে
যখন উলঙ্গের আর্তনাদ আর নিরন্নের চিৎকারই শুধু
উচ্চারিত হতে থাকে
তখন আমাকে যত মদই গেলানো হোক না কেন
কেউ বলতে পারবে না
আমি কোনো স্বর্গকে নরক বানাচ্ছি
(মাতলামো) (১৯৬৮)
ভেঙেচুরে আমি আজ বানাবো ঈশ্বর এক অভিনব,
সে আমাকে শেখাবে অপ্রেম
সে আমাকে শেখাবে কবিতা, স্পর্ধিত কুঠার আর বারুদের
গন্ধমাখা আগ্নেয় উল্লাস
আমি প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যায় একশত কিশোরের কিশোরীর
ছিন্নমুণ্ড নিয়ে
দেবো তাকে প্রণামী, আমার আত্মার ক্ষত থেকে যে দূষিত রক্ত বিস্ফারিত
আমার হিংসা ও ঘৃণা
(দেয়ালের লেখা)
নরকের মতো তাঁর চারপাশ, যেখানে দখল যার সে সূচ্যগ্র জমি দেবে না কোনো শিশুর আবাস গড়তে, কোনো অভুক্তের ফসলমুষ্টি তুলতে, কোনো স্বপ্ন কোথাও রাখবার জন্য। অথচ সেখানে, সেখানেই এক কবি গাইছেন কেবলই স্নেহের গান, আমর্ম ভালোবাসার গান। মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে জল্লাদের বধ্যভূমিকেই জড়িয়ে ধরেন তিনি ‘দেশ’ বলে। উনিশশো তিয়াত্তরের নরকে রাজপথে দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাশীপুর বরানগরের পারে লুটোতে দেখেন যৌবরাজ্যের মুকুট। প্রকাশ্য দিবালোকে গঙ্গার অনিচ্ছুক স্রোতে ভেসে যায় সংখ্যাতীত মৃতদেহ। বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক ভদ্রজন থাকেন আশ্চর্য উদাসীন। যেন কিছুই জানতে, দেখতে, শুনতে পান না তাঁরা। সেই অনবধানের, সেই অপ্রতিরোধের আড়ালে সংঘটিত হতে থাকে যুবমেধ। দেশ কাঁদে নিঃশব্দ হাহাকারে।
তাঁর সেই দেশ স্পষ্ট দাগে ভিন্ন হয়ে যায় শাসকের ‘দেশপ্রেম’ থেকে—
মৃত্যু এসে চোখ অন্ধ করে সামনে দাঁড়াবে
আর সব আবছা—নাম মুখ চুমুগুলি
হলুদ পাতার মত ঝরে গেছে।
এখন আগুন চারিদিকে, মৃত্যুর মুখের উজ্জ্বলতা
গম্ভীর নির্দেশ
‘নিঃশ্বাস নিও না, আর নিঃশ্বাস নিও না, আর নিঃশ্বাস নিও না’
(মহাদেবের দুয়ার)
আলো জ্বললে স্বদেশ
অন্ধকারও স্বদেশ
মন্ত্রী যখন ন্যাংটোছেলের কান মলে দেন
বুঝতে পারি
চতুর্দিকে সভা করছে স্বদেশ।
(চতুর্দিকে স্বদেশ)
পুলিশ বাইরে পাহারা দেয়, ঘরের মধ্যে তুমি
ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখছ, আলো নিয়েছে চোরে
বাইরে গাছের পাতা ঝরছে তাতেও তোমার নালিশ
ঐ বুঝি কেউ আলো নেভায়, শুনছো পায়ের শব্দ
ঘুমের মধ্যে দারুন ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছ—পুলিশ!
যেন পুলিশ করবে অন্ধকারকে জব্দ
(পুলিশ দিয়ে)
শুয়ে আছে দেবশিশু
তার ঠান্ডা বুকের মাঝখানে
শীর্ণ রক্তধারা
যেন প্রার্থনার মৃদু ঘণ্টা বাজে
(২৮ মহাদেবের দুয়ার)
‘এখন নিজের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ’, ‘মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়’ ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’-র মতো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বহু তীব্র লাইন সত্তর দশক থেকে ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফিরেছে।
উত্তেজনা ছড়াই না। কেন না এ মৃতবৎসা দেশে
আগুনের ফুলকিগুলি শ্মশানের বাহবা বাড়ায়
দূর থেকে শোনা যায় শৃগালের হাসি আর হায়েনার গর্জন
যত রাত দীর্ঘ হয় ততই বাঘের চোখ ভৌতিক আলোর মত
পাড়ায় পাড়ায় ছড়ায় আতঙ্ক।
(মাতলামো) (ডিসেম্বর। ১৯৭২)
১৯৭৫ সালে লিখছেন—
পাহাড়গুলি কাঁপছে প্রসবযন্ত্রণায়
এবার তবে জন্ম নেবে
কয়েকলক্ষ ধাড়ি ইঁদুর, মানুষখেকো বাঘের চেয়ে ভীষণ
(ভূতপত্রীর দেশ) (২১।৯।১৯৭৫)
গানের পাখিদের খাঁচায় পুরে
তাদের হুকুম করা হচ্ছে
‘বলো হে যুগ যুগ জিও’
(সূর্য কেন বাদ যায়)
এমনকি ৭৭ সালে ‘স্বৈরতন্ত্রের ওপর বিজয়লাভে’র দিনে ইমার্জেন্সিকে পরাস্ত করে, ইন্দিরা গান্ধিকে হারিয়ে দিল্লিতে নবীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরও নীচের মানুষদের অবস্থা অপরিবর্তিত—
আমাদের স্বপ্নগুলি বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মত
সমস্ত দিন, সমস্ত রাত যাকে সামনে পায়
তারই পা জড়িয়ে ভিক্ষা চায়
সে দৃশ্য আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছি
(স্থিরচিত্র) (২৮/৬/১৯৭৭)
জানি আমাদের অক্ষমতা যখন কবিতার নীচে ওই তারিখলাঞ্ছন কোনো কথাই বলে না আজকের নবীন, প্রত্যাশী পাঠককে। তবু কিন্তু এই ক্রোধ, এই প্রত্যাখান, সুমিতা চক্রবর্তীকে দেওয়া তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই বলছেন, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের মতাদর্শ থেকে নয়, উৎসারিত হচ্ছে মানবতার ওপর নেমে আসা অত্যাচার আর কণ্ঠরোধের বিরোধিতা থেকে। নিপীড়িত মানুষ তাঁর কাছে শুধুই মানুষ। একটু মন দিয়ে পড়লে স্পষ্ট হয় যে নামেই তাঁকে চিহ্নিত করা হোক না কেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার প্রধান স্বর ভালোবাসা। ‘ছেঁড়া কামিজের তলে ঢেকে রাখা প্রাণান্ত ভালোবাসা’। করুণ স্নেহ। যে ভালোবাসা না থাকলে কেউ এমন মরিয়া ভাবে নিজেকে ঠেলে দিতে পারে না সন্ত্রাসের বিপদে, চূড়ান্ত দারিদ্র্যের অনিশ্চয়তায়। ক্যান্সারের যন্ত্রণা ঢেকে মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে বলতে বসে না একমাত্র নিজের কবিতার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার বিবরণ কেন না কেবল কবিতাই তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ সময় নিয়ে ভাবনা প্রকাশের বাহন। সেই ভালোবাসার স্বচ্ছ প্রকাশ ঝলক দিয়ে ওঠে তাঁর কবিতাভুবন জুড়ে। আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। লেখার ওপর কোনো খবরদারি, এমনকি গোষ্ঠীগত আদর্শেরও, তিনি মেনে নিতে পারেন না। সে জন্যই কখনও কোনো রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় তাঁর বাস করা হয়ে ওঠেনি। নিষ্ঠুর অভাবে বাস করেছেন জীবনভর কিন্তু ভালোবাসা বন্ধক রেখে নিরাপত্তার আশ্রয় নিতে পারেননি।
আমার ডানহাতে সবসুদ্ধ পাঁচটা আঙুল
একটি কবিতা লিখতে
এতগুলো আঙুলের দরকার হয় না
কিন্তু, কলমটা আস্ত থাকা চাই
(আর এক আরম্ভের জন্য)
কারণ তাঁকে তো কথা বলতে হবে, কথা। যেমন দৃশ্য দেখার জন্য তৈরি হয়নি মানুষের চোখ, যে যাপন সয়ে নেবার জন্য তৈরি হয়নি মানুষের জীবন, সেই জীবন লেখার জন্য, তাকেই আদর করার জন্য, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতকে শেষ স্নেহ করার জন্য কোল পেতে দিচ্ছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা।
সমস্ত মানুষ—মার খাওয়া, খিদেয় কাতর, বস্ত্র আর গৃহহীন, তাঁর সোনার স্বদেশ জুড়ে ফুটপাতে, রাস্তায় আর বধ্যভূমিতে ছিটিয়ে থাকা যতো মানুষ, কবিতার পর কবিতায় সেই মানুষদের জন্য তাঁর ভালোবাসা কোনো উঁচু মঞ্চ থেকে বিতরিত করুণাকর্তব্যের ভালোবাসা নয়, নিজের সমস্ত জীবন ধরে যে স্বদেশকে তিনি ছুঁতে চেয়েছেন, যাকে জেনেছেন, ‘সূর্য সাক্ষী চন্দ্র সাক্ষী এবং সাক্ষী তুমি/ নদী কোনদিন হয় না মলিন এবং জন্মভূমি’ এই আকুলতায়, সেই বেদনা জড়ানো আশ্রয় সন্ধানই তাঁর ভালোবাসার স্বরূপ।
পৃথিবীতে কোথাও আর নদী পাহাড়
কোথাও আর ঘুমিয়ে থাকার ছ’ফুট জমি নেই
একটি পাখির বাসা গড়ে তোলার মত সামান্য আশ্রয়
একটি ঘাসের দাঁড়িয়ে থাকার মাটি
আজ আমাদের অতীত ইতিহাসের স্বপ্ন, ঠাকুরমার মুখের রূপকথা।
মিছেই মানুষ নিজের দেশের নিজের দলের গর্ব করে।
আসলে তার পায়ের নিচে কোথাও আর মাটির কোনো চিহ্ন নেই
ছ’ফুট জমি মেপে নিয়ে যেখানে উপনিবেশ গড়া যায়।
(যুদ্ধের বিরুদ্ধে)
এই অসহায় ভালোবাসায় সবচেয়ে নীচে পড়ে থাকা, সবচেয়ে প্রান্তবাসী মানুষরাও তাঁর স্নেহের বৃত্তে আসে অন্য একভাবে। গরিবের মুখের কথা শোনা, তাদের জন্য কিছু কথা বলার যে পরিচিত করুণাময় দরদ দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তার বাইরে।
তোদের মুখের ভালোবাসায়
আমার মন ভরে না রে
আমি তোদের বুকের মধ্যে ঘুমোতে চাই
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে নয়।
আমি তোদের বুকের মধ্যে জেগে উঠতে চাই
তোদের মুখের কথা শুনতে নয়।
ফুটপাতে খিদের জ্বরে কাতর শিশুর পরে পড়ে থাকা জ্যোৎস্না, আর মায়ের লুকিয়ে মোছা চোখের জল।
মাগো, এত ডাকি খিদের দেবতাটাকে
বেশি নয় যেন দু’বেলা দু’মুঠো নুনমাখা ভাত রাখে
তুই আর আমি দুঃখ ভুলব, ভুলব পেটের জ্বালা
খিদের দেবতা, সে কি একেবারে কালা!
(কালো বস্তির পাঁচালি)
সব আশ্রয়সন্ধানের চূড়ান্ত যে মা, বারে বারে তার কাছে ফেরে এ কবির যন্ত্রণা যাত্রা, কিন্তু সেই মা-ও তো নন গড়ে তোলা কোনো অভ্যস্ত পূর্ণতামূর্তি। কোথাও মা এক আশ্রয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক আবার কখনও তিনি নিজেই যেন মা।
অসহ্য এক চেতনার উন্মাদ আদেশ করল ‘ওঁকে প্রণাম কর’
আমি বললাম ও যে আমার মা, আমার এখন সমস্ত গায় জ্বর।
কোলের ওপর লুটিয়ে দিলাম মাথা
মাগো কোথায় শান্তি কোথায় সুখ?
দেখিস নে তুই অনাহারের জ্বালা,
চোখ চাইতে কাঁপে না তোর বুক?
(তেরো নদীর জল)
আমরা আজও এই লবণজলে অন্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে সেই ছেলের দিকে তাকাতে ভয় পাই যে ‘খিদেয় পোড়া গা’ নিয়েও আকাশে হাত বাড়ায়, যার মা লুকিয়ে মোছেন চোখের জল। সেই মাও পারেন না সন্তানকে রক্ষা করতে বা এমনকি নিজেকেও! কোথা থেকে রক্ষা করবে?
অসীম করুণা তার, ঐ বধ্যমঞ্চ যাকে বলি মাতৃভূমি
জল্লাদেরা প্রেম বিলায় কোলের শিশুকে, তাঁর লীলা...
যন্ত্রণায় বসুমতী ধনুকের মত বেঁকে যায়
বাজারে মহান নেতা ফেরি করে কার্ল মার্ক্স লেনিন স্টালিন গান্ধী
এক এক পয়সায়
এই নরকের মধ্যে কবি হাতড়ে খোঁজেন শেষ আশ্রয়গুলি, আর আমাদের চোখের সামনে খুলে যায় স্নেহ শব্দের নতুন নতুন দরজা। বেশ্যা মেয়েটিকে দেখি সেই স্নেহ-পৃথিবীর আশ্চর্য উৎসের রূপ নিয়ে। যে নিজেই আশ্রিত, করুণ আর সেইই নিরুপায় আশ্রয়। কখনও কোনো কবি কি দেখেছেন এই মেয়েটিকে এইমত?
উপোসে আমার জন্ম, জীবন কেটেছে আস্তাকুঁড়ের চারপাশে
বুকে স্তনের কুঁড়ি না-ফুটতে দেখেছি স্বর্গ আর নরকের বিয়ে
আমি সারাজীবন
হাজার বলির পশুকে বুকে মুখ রাখতে দিয়েছি, তবু ঘুম পাড়াতে পারিনি
কী করে জ্বরে ক্ষুধায় ভয়ে কাঁপতে থাকা শিশুকে আমি ঘুম পাড়াবো?
প্রভু, আমি যে উপবাসের নিয়ম মানি
(নতজানু বেশ্যার প্রার্থনা)
কালো মানুষ, আশ্রয়হারা, ভরসাহারা অপমানিত ভীত, মানুষকে ক্ষণিক হলেও আনন্দ আর বিস্মৃতি ফিরিয়ে দেয় যে কালো নগ্নিকা নর্তকী, তাকে এই কবিতার মানুষ দেখেন অপরূপ স্বীকৃতির স্নেহে—
নাচো হার্লেমের কন্যা, নরকের ঊর্বশী আমার
মাতলামোর সভা আনো চারদিকের নিরানন্দ হতাশায়, হীন অপমানে
নাচো ঘৃণ্য নিগ্রো নাম মুছে দিতে। মাতালের জাত নেই
পৃথিবীর সব বেশ্যা সমান রূপসী
নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক করতে স্বর্গ ও হার্লেম।
(নাচো রে রঙ্গিলা)
অথচ ভোলা কি যায়, এই প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তাঁর উচ্চারণ—‘কারো সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে’। মানুষে এই তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস। যে মানুষ বারে বারে এক হয়ে যায় তাঁর ‘স্বদেশ জন্মভূমি’র সঙ্গে।
আমার জন্মভূমি,
আমি অনেকদিন তাঁকে দেখি না
তাঁর কোন খবর রাখি না।
তিনি কি এখনও কুয়াশায় কাঁথামুড়ি দিয়ে
আগের মতই নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন?
(জননী জন্মভূমিশ্চ)
শতবর্ষের আলোয় আবার যখন দেখছি এই কবিতাদের মুখ, নতুন নতুন দেখা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে আজকের ব্যথা আর বিভ্রান্তির প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বলতে পারছি না তাদের। এখনও পারছি না। শব্দগুলি ব্যবহৃত হতে হতে নিজেদের ভেতরের সমস্ত অর্থের আলো মুছে ফেলেছে। যাই বলা হোক, তারা জেদি বাচ্চার মতো ঘাড় শক্ত করে থাকে, কোনোকিছুই প্রকাশ করে না। মনে হয় শান্ত একটি জলাশয় খুঁজতে হবে। তার পাশে প্রাচীন ছায়া ফেলা শান্ত একটি বনস্পতি। সেইখানে নেমে সমস্ত ধ্যান নিয়ে শব্দগুলিকে ধুতে হবে খুব যত্নে। তবে যদি বোধকে প্রকাশ করা যায় আবার কখনও।
তার আগে অবধি কবিতাই কবিতার জানলা।
সেইখান দিয়েই তাকে দেখি।
অনন্য লিখন