এবার অন্য এক স্বাধীনতা দিবস। তৃণমূলের আগের রাত থেকে মঞ্চ বেঁধে মাইক বাজানো বন্ধ, বিজেপির নেই জগদ্ধাত্রীর আদল বদলে বাঘের পিঠে বসা ভারতমাতার পুজো। কোভিড গুলিয়ে দিয়েছে সবকিছুই। মানুষ যে এইসময়ে জীবাণুর কাছে পরাধীন তা তর্কাতীত। পরের স্বাধীনতা দিবসেও যদি এই দশা দেখতে হয়, সেক্ষেত্রে শুধু ভারত নয়, আরও অনেক দেশও নিজের নিজের বিশেষ দিনটিতে কোভিডের কুশপুত্তলিকা দাহ করবে। বিশ্ব জুড়ে এমন স্বাধীনতাহীনতা কোন কবি দেখেন নি। তবে ভাইরাসের কাছে সাধারণ মানুষ কুঁকড়ে থাকলেও, রাজনীতির কারবার থেমে নেই। সঙ্গে ধর্মের তো পোয়াবারো। গোলমেলে পরিস্থিতিতে যদি কোভিড সংক্রমিত মানুষদের তেঁতুলপাতা চূর্ণ গেলানো হয়, আমাদের দেশে তার মধ্যে প্রায় সাতানব্বই আটানব্বই শতাংশ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠবেন। কারণ সেটাই এ দেশের পরিসংখ্যান। ওষুধ খান কি না খান, মৃত্যুর হার সংক্রমিতদের সংখ্যার হিসেবে দুই থেকে তিন শতাংশ। সুতরাং ধর্মগুরুরা বলতেই পারেন যে তেঁতুল কিংবা কলা অথবা বটপাতা কোভিড অব্যর্থ ওষুধ। গোচোনা হয়তো বহু ব্যবহারে কোভিডের অতিপরিচিত, তাই উপকার কম। অবিজ্ঞানের কাছে বিজ্ঞানের পরাধীনতা ঠিক এইখানে। কারণ তাকে যারা ব্যবহার করে তাদেরকে বিজ্ঞানী হতে হয় না।
তবে বিজ্ঞানে ঢোকার আগে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়টা মিটিয়ে ফেলা যাক। সেখানে তো আর অঙ্ক নেই, ফলে ইতিহাসের ক্যালেন্ডারে পাঁচ কিংবা পনেরোতে কী-ই বা যায় আসে? দেশের প্রধানমন্ত্রী রাম মন্দিরের শিলান্যাস (থুড়ি ওটা শিলার বদলে রূপো হবে, কারণ মূল আকর্ষণ চল্লিশ কেজির ইটটা রূপোর) করে তাকেই যদি সত্য স্বাধীনতা বলেন তাতে দোষের কী? যুক্তি তো বিজেপি দিয়েই দিয়েছে। বাবরের কোন এক পেটোয়া সৈন্য নাকি পাঁচশো বছর আগে গোটা একটা ধর্মকে পরাধীন করেছিল। তার থেকে মুক্তি পাঁচই অগাস্ট বিশবিশ। সাতচল্লিশের পনেরোই অগাস্ট তো মাত্র দুশো বছরের ঠুনকো পরাধীনতার সমাপ্তি। ফলে পাঁচশো বনাম দুশোর অঙ্কে আড়াইগুণ ছাতি বৃদ্ধির পর বিজেপির শীর্ষনেতা যদি রামমন্দির খাড়া করাকে স্বধর্মে উত্তরণ বলে মনে করেন, তাতে নিন্দুকদের হুক্কাহুয়া ডাক উপেক্ষা করাই শ্রেয়। কেন্দ্রের শাসক দল সেটাই করছে। সঙ্গে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার যেমন একটা দেশজ ভাবনা থাকে, তেমনই থাকতে পারে ব্যক্তিগত উপলব্ধি। সেই কারণেই তো এই কোভিড পরিস্থিতিতেও সিঁড়ির সামনে রাষ্ট্রনেতা সাষ্টাঙ্গ, গায়ে যতই ভাইরাস ঠেকুক না কেন। রামনাম সত্য হলে কে আর ভাইরাসকে ডরায়? আর দেশের বেশ কিছু মানুষ যে আজকের প্রধানমন্ত্রীর ভাবা স্বাধীনতার সঙ্গে একমত, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিজেপির ক্ষমতায় আসা। জনগণেশের আশীর্বাদ ছাড়া তো আর আজকের থান ইট ঢালাই হত না, সরযূ তীরে গোলাপি রঙের বন্যাও দুকূল ভাসাত না। সন্ধ্যায় যাঁরা প্রদীপ জ্বেলেছেন সরযূ তীরে, তাঁরা অনেকেই মুখোশ খুলে আর কোভিড ভুলে ছিলেন। সেটাই তো আজকের দিনে সচেতন স্বাধীনতা।
মুশকিল শুধু দেওয়ালের অন্য পারে গিয়ে দাঁড়ালে। কাশ্মীরে স্বাধীনতা চেয়ে যুদ্ধ করলে সে ব্যাটা অবশ্যই আমাদের কাছে উগ্রপন্থী এবং সন্ত্রাসবাদী। অথচ পাকিস্থান কিংবা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের কাছে সেই লোকটাই স্বাধীনতা সংগ্রামী। কোন দিক থেকে দখলদারি দেখছেন এবং কতটা গায়ের জোরে তাকে সংজ্ঞায়িত করছেন, সে দিয়েই নির্ধারিত হয় সমাজবিজ্ঞানের স্বাধীনতা। তার মধ্যে পাঁচফোড়নের মত দর্শন ছিটিয়ে দিলে তো কথাই নেই। জাতীয়তাবাদী দর্শনে দেশের জন্যে জীবন বলিদান। আরও ঊর্ধ্বে উঠলে সবই মায়া। সব মিলে রাষ্ট্রের নির্ধারণ করে দেওয়া রাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাধীনতা। কোনটা রামমন্দিরের, কোনটা তুর্কির হাগিয়া সোফিয়ার। যার গায়ের জোর বেশি, যে যুদ্ধে জেতে, সেইসময় সে-ই স্বাধীন। ধর্মযুদ্ধে জয়ী যে, তার ধর্মই মানবধর্ম। সেই নামেই ঠিক হবে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সিনাগগ। হারলেই গল্প শেষ। তখন পুরোটাই পরস্মৈপদী অধীনতার লম্বা উপন্যাস। একটার দেওয়ালে চুনকাম করে অন্যটা, ইট উপড়ে সিমেন্ট, এক মূর্তি সরিয়ে নিরাকার, কোথাও বা আকারহীনতা ভুলে পৌত্তলিকতা। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সিনাগগ এই চারটে নিয়েই চব্বিশ রকমের পারমুটেশন হয়, বাকি ধর্ম আর বেশি না বাড়ালেও চলবে।
সমাজবিজ্ঞানে কথায় কথা বাড়ে, তবে বিজ্ঞানে নয়। সেখানে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক অনুমানকে যাচাই করা হয়, তাই মোটামুটি ঠিক ভুলের হিসেব আছে। আর বিষয়টা না বুঝলে স্পষ্ট বলে দিতে হয় যে জানি না। বিশেষ জ্ঞানের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িয়ে থাকে জ্ঞানের স্বাধীনতা আর বিজ্ঞানভিত্তিক যাচাই করা যায় এমন সত্যতা। অসম্পূর্ণতা থাকতে পারে বিজ্ঞানের পরতে পরতে, কিন্তু হাঁক পেড়ে মিথ্যে গছানোর সুযোগ কম। সেই বিজ্ঞান আজ অসহায়। একদিকে হানাদার কোভিড, যার ধরণ ধারণ বুঝতে বিজ্ঞানীদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। অন্যদিকে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, কিংবা রাজনীতির হানাদারি। কাঁচা হলুদে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে একথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। কিন্তু কোভিড আক্রান্ত রোগীর শ্বাস উঠলে তাঁকে যদি অক্সিজেন না দিয়ে মধু-তুলসীপাতা চাটানো হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গে ধূপ-ধুনো আর খইটাও প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। আইনের নাকের ডগায় কোভিড থেকে মুক্তির আয়ুর্বেদিক ওষুধ বাজার কাঁপাচ্ছে। সনাতন রাম মুখ লুকোচ্ছে রামদেবের বিজ্ঞাপনী প্রচারসর্বস্বতায়। রাষ্ট্র কি ধর্মের কাছে হার মানবে? মোটেই না। দেশনেতা নিদান দেবেন কতদিনের মধ্যে কোভিডের টিকা চাই। আমাদের দেশে টিকা প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল এই স্বাধীনতা দিবসে। ভাগ্যিস রামমন্দিরের হইচই সে ভাবনা ভুলিয়ে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তো পারলে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভরে মানুষের শরীরে ফুটিয়ে দেবেন। পুতিন সাহেবের তর সইছে না। রাশিয়া নাকি আর দু-এক দিনের মধ্যেই প্রতিষেধক বার করে ফেলল বলে। চিনের খবর তো আবার জানতেই পারা যায় না, সেখানে সবটাই আমৃত্যু শি জিনফিং। সব মিলিয়ে বিজ্ঞান বলে যে একটা বিষয় ছিল, আর তা যে ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছামত বদলানো যায় না, সেটাই মনে থাকছে না ক্ষমতাশালীদের। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ব্রুনোর বিচার, কাছাকাছি সময়ে গ্যালিলিও-র ভোগান্তি, পাঁচশো বছর পরেও সে সব বাঁধন থেকে মুক্তির পথ ঘোলাটে। রাম বাঁচলেও বিজ্ঞানের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার বিরাম নেই। বিজ্ঞানীদের পুড়িয়ে মারা, মুণ্ডচ্ছেদ, কিংবা শূলে চড়ানো হয়ত আজকের দিনে ততটা জনপ্রিয় নয়, তবে বিজ্ঞানের অবস্থা কোভিড পরিস্থিতিতে বেশ বিপজ্জনক। আড়ালে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলির চটজলদি বিপুল মুনাফার দুষ্টু অঙ্ক।
তবে শেষমেশ বাঁচাবে বিজ্ঞানই। আর সঙ্গে যখন স্বাধীন এবং সাহসী বিজ্ঞানীরা থাকবেন, সরকার যখন তাদের কাজে নাক গলাবে না, গবেষণা যখন অসফলতার আগল ছেড়ে রোগমুক্তির আভাস দেবে, তখনই তো আসবে বিশ্বমানবের স্বাধীনতা দিবস। সরযূর তীর কিংবা লালকেল্লার ভাষণে করোনা নিধনের ওষুধ নেই। বরং পলিথিনের আগলে ঘামতে থাকা চিকিৎসাকর্মীদের লড়াই আজকের দিনেও অধিকাংশ মানুষকে বাঁচাচ্ছে। সেইরকমই বিজ্ঞান গবেষকরাও অবশ্যই কোভিড-মুক্তির ভোর আনবেন। সে স্বাধীনতা বিজ্ঞানের অর্জিত। সেখানে সংজ্ঞা বদলের দায় নেই।