চিলি তো আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা কিছু নয়। সেখানেও আমাদের মত মানুষ থাকেন, আর তার বেশিরভাগই নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত। তাদের কথা আর কে ভাবে? ফলে একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ যতই মসৃণ মনে হোক না কেন, অশান্তি এবং অসাম্য সেখানে প্রচুর। আর সেসব বাদেও ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে গোলমাল এখন বিশ্বজুড়ে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন মহাবিশ্বের এনট্রপি ক্রমাগত বাড়ছে। 'এনট্রপি' শব্দটির সঠিক বাংলা করা মুশকিল হলেও, মোটের ওপর এটি বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। সেই নিরিখে বিষয়টাকে পদার্থবিজ্ঞানের হাতে ছেড়ে দিয়ে সিরিয়া থেকে হংকং পর্যন্ত সব জায়গার অশান্তিকেই একই আপেক্ষিকতার বন্ধনীতে ফেলা যেত। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে ভাবলে সেই ব্যাখ্যায় অসম্পূর্ণতা থাকবে। সিরিয়ার অশান্তির কারণ ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়াবাড়ি, আর হংকংয়ে লড়াই চিনের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। অবশ্যই বিশেষ পক্ষপাতে সিরিয়ার মৌলবি এবং চিনের চেয়ারম্যানকে সমর্থন করাই যায়। কিন্তু উদারবাদী ভাবনা হয়তো তাতে সায় দেবে না। তার কাছে একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটাটাই যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু গণতন্ত্রে পৌঁছলেই যে সব সমস্যার সমাধান তা নয়। আর তার একেবারে পাঠ্যবই থেকে তুলে আনা উদাহরণ চিলি। পিনোচেতের সামরিক শাসনের পর সে দেশ সত্যি চেষ্টা করেছে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে। কিন্তু তার সঙ্গে অর্থনীতি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, বামপন্থার দিকে এক পা এগোতে গেলে দু পা পেছোতে হচ্ছে ডানদিকে। সে কারণেই তো ২০১৯ এর বিপুল বিক্ষোভ। আর বেশি এগোনোর আগে সেই সারমর্মটুকু আগে লিখে ফেলা যাক।
১৯৮৯ সালে পিনোচেতের একনায়কতন্ত্রে দাঁড়ি টানার পর চিলি দেখেছে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মেলবন্ধন। কারণ একেবারে সহজ। পিনোচেত রাজত্বে বড়লোক গরিবের যে পাঁচিল, তা তো আর একদিনে ভাঙার কথা না। তাই গণতন্ত্র যেমন বৃষ্টিধারার মত সবার মাথায় পড়ল, তেমনভাবে কিন্তু দেশের সম্পদ চটজলদি জনগণের মধ্যে ভাগ হল না। অর্থাৎ পিনোচেত সাহেবের অর্থনীতি লাগু থেকে গেল। একনায়কতন্ত্রে গরিবের হাঁকডাকের সুযোগ কম। গণতন্ত্রের আগমনী উচ্ছ্বাসে সেই চিৎকার শোনা যায় নি। কিন্তু দিন কাটতেই মধুচন্দ্রিমা শেষ। প্রান্তিক মানুষ বুঝতে পারলো যে আদতে কাজের কাজ বিশেষ হচ্ছে না। মধ্যপন্থার বাঁদিক ডানদিকে পেন্ডুলামের নড়াচড়া চলল কিছুটা। তবে একটাই সুবিধে হল যে না-পাওয়া মানুষের প্রতিবাদ শোনা গেল পরিষ্কার। চিলিতে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং সামাজিক বৈষম্যের ছবি তাই এখন একেবারে স্বচ্ছ। তার মধ্যে বিশেষ জায়গা করে নেবে ২০১৯ সালের আন্দোলন। দক্ষিণপন্থী সরকার আপাতত খুব বেঁচেছে কোভিদের দয়ায়। নাহলে এই আন্দোলনে তাদের মুশকিল অনেক বেশি বাড়ত।
এত অবধি প্রেক্ষিতহীন গৌরচন্দ্রিকা। গবেষণাপত্রের অ্যাবসট্র্যাক্টের মত। এবার একটু চটজলদি পূর্বপাঠের পুনরালোচনা সেরে নেওয়া যাক। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে মানচিত্রের পরিধি বরাবর একটু মোটা পেনসিল দিয়ে দাগ কাটেলেই চিলি চিনে যাবেন। ক্ষেত্রফলে ভারতের চার ভাগের এক ভাগ এই দেশ। তবে লোক সংখ্যা সত্যিই খুব কম, মাত্র দুকোটি। অর্থাৎ জনঘনত্বের দিক থেকে ভারতের চেয়ে অনেক সুবিধেজনক জায়গায় আছে এই দেশ, প্রায় আঠারো ভাগ কম। কিন্তু সেই অনুযায়ী তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভারতের তুলনায় খুব বেশি ভালো নয়, মাথাপিছু আয় বড়জোর তিনগুণ। এখান থেকে চটজলদি দেশটার অর্থনৈতিক বৈষম্য বুঝতে অসুবিধে হয় না। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি ইনকা শাসন পার করে স্পেনের দখলদারি, সেখান থেকে আঠারোশো আঠারোতে স্বাধীনতা। বেশি ইতিহাস বিশ্লেষণে কাজ নেই, তবে সকলেই জানেন এই বাংলার মানুষ বাম রোমান্টিসিজম খুঁজে পেতে ভীষণভাবে উৎসাহী। তাই সেই ছয়-সাতের দশকে বঙ্গভাবনায় সালভাদোর আলেন্দের কথা উঠে এসেছিল বারবার। পেশায় চিকিৎসক এই মানুষটি ১৯৭০ সালের তেসরা নভেম্বর চিলির রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। লাতিন আমেরিকার দেশটিকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এই মার্কসবাদী নেতা। তবে তাঁর রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের কাছে নতি স্বীকার না করে সম্ভবত একে-৪৭ চালিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। বিস্তর অনুসন্ধান এবং গবেষণা বলে (যা চলেছিল ২০১১ পর্যন্ত) রাইফেলের বাট মাটিতে ঠেকিয়ে নলটা নিজের চিবুকের তলায় শানিয়ে গুলি চালান তিনি। আর এই অভ্যুত্থানের গোটা বিষয়টিকে বামপন্থী এক সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন অনেকে। ক্ষমতা দখল করেন চিলির সেনানায়ক অগাস্তো পিনোচেত। ১৯৯০ পর্যন্ত পদ ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে ১৯৮৮ সালে হয় গণভোট এবং সেখানেই তাঁর বিদায় নিশ্চিত হয়। শেষমেশ ১৯৯০ তে পিনোচেত ক্ষমতা ছাড়েন।
পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসন তখনও পুরো হেদিয়ে যায় নি। ইট-বালি-সুরকি আর বহুতল নির্মাণে বাংলার বামেরা পুরোটা নির্বিকল্প সমাধিতে প্রবেশ করেন নি সেই সময়ে। তাই বাড়ির পাশের নালা বন্ধ হয়ে গেলে পাড়ার পার্টি অফিসে যেতে হত। সেখানে লোকাল কমিটির সহ সভাপতির সঙ্গে গভীর আলোচনায় নর্দমা পরিষ্কারের সঙ্গে তুলনায় আসতো সুয়েজ খাল খনন। ফলে আজকের পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের মনে পড়তেই পারে যে পিনোচেতের পতনে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন সেই সময়ের বাম নেতৃত্ব। হয়তো "চিলি থেকে বালিখাল, চারিদিক লালে লাল" গোছের স্লোগানও উঠেছিল। তবে এরপর ফ্রন্টে বামপন্থার অনুশীলন ক্রমক্ষীয়মান হতে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মেই কমতে থাকে পড়াশোনা এবং বিদেশের রাজনীতির প্রতি উৎসাহ। তাই তখন থেকে চিলি সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ রয়ে গিয়েছিল ফুটবল আর চিকেনেই। সেখানকার রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে এমনটা আর মনে হয়নি। তিন দশক পর এই লেখার সূত্র ধরেই আবার চিলির খবর খুঁজতে অন্তর্জালে আনাগোনা। তবে এর মধ্যে গত বছর চিলিতে যে বিপুল রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছিল সে খবর কানে এসেছিল কিছুটা। কিন্তু লোকসভা নির্বাচন, এবং রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল বিজেপি তরজার মুড়ি তেলেভাজা অতিক্রম করে সে সংবাদ কাগজ কিংবা টেলিভিশনের কোণাটুকু পর্যন্ত ছুঁতে পারে নি। কোনও বাংলা সংবাদমাধ্যমে চল-চিত্রের নিচে ভাসমান অক্ষররাশিতেও স্থান পায় নি সেই টুকরো খবর।
তৃণমূলের দশ বছর সামলাতে এখনও পশ্চিমবঙ্গে বামেদের চৌত্রিশ স্মরণ চলছে। কিন্তু ২০১৯-এ চিলিতে বিক্ষোভের দায় তিন দশক পেছনে ফিরে পিনোচেতকে দেওয়া যাবে না। বরং এটা বলা ভালো যে পিনোচেতের পতনের পরে কিন্তু চিলির অর্থনীতি মোটামুটি চাঙ্গা ছিল। রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্র চালালেও মার্কিন সহযোগিতায় দেশের বাজার খুলে দিয়েছিলেন পিনোচেত। ধনতন্ত্র এবং বাজার অর্থনীতিতে এক ধরণের উন্নয়ন অস্বীকার করা যায় না। তার কিছুটা চুঁইয়ে নিচের দিকেও নামে। সামরিক শাসনের লৌহকপাট ভেঙে যাওয়ায় নব্বইয়ের দশকে শুরু হয় গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নব্বই থেকে চুরানব্বই, এই চার বছর রাজত্ব করেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট নেতা প্যাট্রিসিও আলউইন। প্যাট্রিসিও সাহেব ছিলেন সালভাদোর আলেন্দের বিরোধী। ফলে পিনোচেতের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ বিরোধিতা ছিল বলে মনে হয় না। পরবর্তীকালে অবশ্য দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালের গণভোটে অনেকেই মনে করেছিলেন যে পিনোচেত জিতে যাবেন আবার এবং আরও আট বছর ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু এইসময়ে সারা দেশে অসাধারণ দক্ষতায় পিনোচেত বিরোধী হাওয়া তোলেন রিকার্ডো লাগোস এবং প্যাট্রিসিও আলউইন। দেশের মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন না করলেও, প্যাট্রিসিওর রাজত্বকালে কয়েকটি বিষয়ে অর্থনীতির ধারা ছিল জনমুখী। সমাজের প্রান্তিক মানুষের হাতে সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কিছুটা হলেও ছিল ইতিবাচক। শ্রমিক-কৃষকের ন্যুনতম মজুরি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছিলেন তিনি।
চিলিতে কয়েক বছর অন্তর এই ধরণের গণভোট হয় সংবিধান সংশোধন নিয়ে। ১৯৯৪ এর গণভোটে নির্ধারিত হয় পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন ছয় বছরের জন্যে। এবার ক্ষমতা পান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের নতুন নেতা এদুয়ার্ডো ফ্রেই রুইজ-ট্যাগেল। তাঁর বাবা এদুয়ার্ডো ফ্রেই মন্তালভা রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৬৪-৭০, সালভাদোর আলেন্দের আগেই। শুধুই ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গকে ব্যঙ্গ করলেই তো হবে না, পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ সুদূর চিলি থেকেও তুলে আনা সম্ভব। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছেলে এদুয়ার্ডো শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে বেশ ভালো কাজ করেছিলেন। তবে সমগ্র লাতিন আমেরিকার মতই, তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে চিলির অর্থনীতি খারাপ হতে শুরু করে। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তর হয় ২০০০ সাল। জেতেন পার্টি অফ ডেমোক্র্যাসির নেতা রিকার্ডো লাগোস। ১৯৯০-তেই হয়তো তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারতেন, যদিও সেইসময়ে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে সমর্থন করেন প্যাট্রিসিও আলউইনকে। রিকার্ডোর রাজত্বের ধারাও ছিল মোটের ওপর বাম ঘেঁষা। তবে শুরুর দিকে তাঁকে সামলাতে হয় বিপুল বেকারত্বের সমস্যা। বছর তিনের মধ্যেই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামাল দেন তিনি। তাঁর আমলেই ২০০৫ এর গণভোটে মানুষ মতদান করেন রাষ্ট্রপতির শাসন কমিয়ে চার বছর করার পক্ষে। দেশের রাজা একটানা কম সময় ক্ষমতা ভোগ করছেন, সেটা অবশ্যই গণতন্ত্রের পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এরপর ২০০৬ এর নির্বাচনে জয়ী হন সমাজবাদী নেত্রী মিশেল ব্যাসেলেট। ইনি চিলির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। পিনোচেতের সামরিক শাসনে বেশ কিছুটা সময় দেশের বাইরে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। অত্যন্ত নামকরা এই নেত্রী একাধারে চিকিৎসক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে দক্ষ। রাজনীতিতে অগ্রজ লাগোসের রাজত্বে তিনি কাজ করেছিলেন স্বাস্থ্য এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু এঁর রাজত্বের শেষের দিকে আবার হাওয়া ঘুরতে শুরু করল। আসলে রাষ্ট্রপতি তো দিনের শেষে সেই শাসক। বাম-ডানে বিশেষ যায় আসে না। জনগণের ক্ষোভ বাড়াটা তাই স্বাভাবিক। তবে ২০০৯ সালে বিশ্বজোড়া মন্দা যে চিলিতেও প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ২০১০ সালে তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে চিলিতে হয় এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। তার পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সমালোচিত হয়েছিলেন এই নেত্রী।
২০১০ এর নির্বাচনে জয়ী হলেন রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী প্রার্থী সেবাস্তিয়ান পিনেরা। আগেরবার তিনি হেরেছিলেন মিশেলের কাছে। পিনোচেতের সামরিক শাসনের পর পিনেরা-ই (কেরালার সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে গুলিয়ে না যায়) হলেন চিলির প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি। বিপুল ধনী হওয়ার কারণে নির্বাচনে জেতার জন্যে প্রচুর খরচা করেন তিনি। তাঁর আমলের সবথেকে বড় খবর ২০১২ সালে তেত্রিশজন শ্রমিকের সত্তরদিন খনিগর্ভে আটকে থাকা। তবে তাদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। যদিও তাঁর রাজত্বে বেশ কয়েকবার দেশবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। রাজত্বের একেবারের শুরুর দিকেই ২০১১ সালে তেলের দাম বাড়ানোয় বিপুল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সে দেশে। সে বছরই শুরু হয় বিপুল ছাত্রবিক্ষোভ। যা চলে প্রায় ২০১৩ পর্যন্ত। ২০১৪ তে মধ্যপন্থীদের সাহায্যে আবার ক্ষমতা ফিরে পেলেন সমাজবাদী মিশেল ব্যাসেলেট, দ্বিতীয়বারের জন্যে। এবারে তাঁর প্রচারের মূল অস্ত্র ছিল বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিশ্রুতি। সে কাজে যদিও পুরোটা সফল হতে পারেন নি। তার ওপর সমাজবাদী ভাবনায় দেশের বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রে করের মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দেন তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব পড়ে এই সিদ্ধান্তে, এবং দেশের বাজার অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দা আসে। এর মধ্যে দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু অভিযোগও ওঠে নেত্রীর পুত্র এবং পুত্রবধূর বিরুদ্ধে। জনপ্রিয়তা কমতে থাকে তাঁর। আবার তাই পাশা উল্টোলো ২০১৮ তে। দ্বিতীয়বারের জন্যে ক্ষমতায় ফিরলেন সেবাস্তিয়ান পিনেরা, তবে এবার নির্দল প্রার্থী হিসেবে। সমর্থন জানালো মধ্য-দক্ষিণপন্থী সংগঠন চিলে ভামোস।
ক্ষমতার দম্ভ দেশনেতাকে বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। মাথা তখন ঠান্ডা রাখা মুশকিল। দ্বিতীয়বার দখল পেয়ে তাই জনগণের কথা ভুলে গেলেন পিনেরা। চটজলদি দক্ষিণপন্থী সংস্কারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলেন তিনি। এর মধ্যে সবথেকে মারাত্মক হল রাজধানী সান্তিয়াগোতে মেট্রো রেলের ভাড়া বাড়ানো। এমনিতেই নিম্নবিত্ত মানুষের দিন এনে খাওয়ার খরচ বাড়ছিল বেসরকারিকরণের চক্করে। বাড়ছিল অসাম্য। তারমধ্যে মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি একেবারে কেরোসিনে দেশলাই। ছাত্ররা দখল নিল রেলস্টেশনের, মারপিট শুরু হল পুলিশের সঙ্গে। গতবছর আঠারোই অক্টোবর শুরু হয় ব্যাপক ভাঙচুর, বাস পোড়ানো। তার পরের দিন জারি হয় কার্ফু। জরুরি অবস্থা জারি করতে হয় পিনেরাকে, নামাতে হয় মিলিটারি। সান্তিয়াগোর সীমানা ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে চিলির অন্যান্য শহরেও। লক্ষ মানুষের মিছিলে উদ্বেলিত সারা দেশ। ২০১৯ এর শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে নিহত হন অন্তত তিরিশ জন, আহত এবং গ্রেফতার হন যথাক্রমে আড়াই এবং তিন হাজার মানুষ। এ বছরের শুরুতেও জারি থাকে বিক্ষোভ। চলে পরীক্ষা বয়কট এবং প্রশ্নপত্র পোড়ানোর মাধ্যমে প্রতিবাদ। এবছরের মার্চ থেকেই বিশ্ব জুড়ে কোভিদ অতিমারীর কথা সকলের জানে। সেইকারণে চিলিতেও বিক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু এ বছরের অক্টোবরে বিক্ষোভের বর্ষপূর্তিতে আবার মাঠে নামেন সাধারণ মানুষ। পিনেরার রাজত্বে চিলির যে দক্ষিণপন্থার পথে হাঁটা, তাকে একেবারেই মানতে পারছেন না সেদেশের জনগণ। মাসখানেক আগেই, নভেম্বরের আঠারো তারিখেও বিরাট মিছিল হয় সান্তিয়াগোতে। প্রতিবাদ ছিল পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে, দাবি উঠেছিল পিনেরার পদত্যাগের। আসলে এ বছর যে সংবিধান সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে পিনোচেতের সময়ের কিছু একনায়কতন্ত্রী ভাবনা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন পিনেরা। তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন চিলির প্রায় আশি শতাংশ ভোটার। লাতিন আমেরিকার এই দেশটি থেকে তাই গণতন্ত্রের দাবি পৌঁছে যাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। গত কয়েক বছর দক্ষিণপন্থার রমরমা চলেছে সারা বিশ্বে। কিন্তু গতবছর থেকেই চিলির আন্দোলন, এ বছর মার্কিন দেশে ট্রাম্পের হার, সব মিলিয়ে হাওয়া সম্ভবত অন্য দিকে ঘুরছে। এই লেখা যখন শেষ করছি, তখন দিল্লির বিভিন্ন রাস্তা আটকে চলছে কৃষক আন্দোলন। দক্ষিণ এবং বামপন্থার এই সরল দোলগতি বিশ্বরাজনীতিতে চলতেই থাকবে। চিলি কিংবা ভারতবর্ষ কোন দিকে হাঁটবে তা নির্ধারিত হবে সামনের দিনগুলোতেই। আর পুরনো নিয়মেই এই ২০২০-র শেষ মাসেও শাসক শাসাবেন আর পথে নামবেন জনগণ। "ভারত-চিলি ভাই ভাই" গোছের স্লোগানের ট্র্যাডিশন এগোবে ক্রমাগত শীর্ণ হতে থাকা অনন্তের পথে।