নয় বছর আগে কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের পিএইচ ডি ফেলো হিসেবে কাজ করার সময়ে এক বিষণ্ণ একাকী দিনে লেখাএই ব্যক্তিগত চারণটির দিকে যখন তাকিয়ে দেখি, তখন নিজেকে দেখতে পাই একটি জলার মধ্যে। কিচ্ছুটি বদলায়নি।
এই এলাকায় হিন্দুত্ব মাথা চাড়া দিয়েছে, ভারত রাষ্ট্রের যথার্থ সাম্রাজ্যবাদী চেহারা ও গোবলয়ের অ্যাজেন্ডা গুরুত্বপূর্ণ ও বর্বর হয়ে উঠেছে। তবে অভ্যুত্থান পরবর্তী ডিপ্রেশন এবং অরাজনীতির রাজনীতির যে বর্তমান চোরাবালি, তার বিপ্রতীপে বিশাল সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ আসামে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর গুয়াহাটি শহর ছাত্রছাত্রীরা দখল করে নেয় এবং সেসময়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ, এই বিমূর্ত সত্তা তথাকথিত বিদেশিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনতাড়িত বটে কিন্তু এ লড়াই বিদেশিদের বিরুদ্ধে নয়, এ লড়াই ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কারণ তারা ভারত রাষ্ট্রের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত।”
১৯৯০ নিয়ে আমাদের যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, একটা বিষয় স্পষ্ট, আসামের রাজনীতি এ সময়ে ১৯৮০ থেকে পাল্টে গিয়ে গুরুতর ও বুনিয়াদি বিষয়ে লক্ষ্য স্থির করেছিল। আজ হিন্দুত্ব এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কিছু ভারতীয় লিবারেল সে আন্দোলন মুছে দিতে চাইছে, উভয় পক্ষেরই তাতে নিজস্ব সুবিধা রয়েছে। আমি এখনও ন্যায়ের সপক্ষে গণতান্ত্রিক, ঐক্যবদ্ধ জন আন্দোলনে আস্থা রাখছি। এই স্মৃতির লেখাটুকু মনে করিয়ে দেবে সরল, আন্তরিক, বিকল্পনার কথা এবং বিশ্বাসঘাতকতার এক মুহূর্ত, যে কোনও সময়ে যার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।
(অঙ্কুর তামুলি ফুকন)
আমরা যারা আসামের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে পড়াশোনা করছি, তাদের অনেকেই ২০০৯ সালে আলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের বাংলাদেশে গ্রেফতারির ঘটনায় বিস্মিত হই। কোনও না কোনও দিন এ ঘটনা ঘটতই, কিন্তু আমরা তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ওঁদের সাহসিকতা ও রূপকথার যে ভাবমূর্তি আমাদের সামনে তৈরি করা হয়েছিল, আমরা তাতেই অভ্যস্ত ছিলাম। ওঁদের যে পরাজয়ও ঘটতে পারে তা বিশ্বাস করতে আমাদের সময় লাগছিল।
৯ এর দশকের শুরুতে আমাদের বেড়ে ওঠা ওঁদের সঙ্গেই, ওঁদের অলংকার সংবলিত বিবৃতি থেকেই আমাদের রাজনৈতিক মতের নির্মাণ। আমরা বড় হয়ে উঠেছি রোজ খবরের কাগজে আলফার জন সচিবের বিবৃতি, স্থানীয় ভাষার সংবাদ পত্রে প্রয়াত পরাগ দাস ও অজিত কুমার ভুঁইয়ার জ্বালাময়ী এবং উৎসাহব্যঞ্জক সম্পাদকীয় পড়ে, আলফা নেতাদের লেখা দারুণ সব কবিতা পড়ে, ভারতীয় সেনার হাতে আলফা ক্যাডারদের অত্যাচারের পর হত্যার কাহিনি, কেবলমাত্র আলফা ক্যাডারদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাবা-মায়ের সামনে নিরপরাধ তরুণী ও কিশোরীদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাসমূহ ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের অনন্ত ঘৃণা তৈরিতে সাহায্য করে।
আমরা জনসমাবেশে যোগ দিই, নৈরাশ্য থেকে কবিতা লিখতে থাকি, লিখতে থাকি ভাষ্য। পর্বান্তরটিকে খেয়াল না করেই আমরা নয়া রাজনৈতিক সত্যে উপনীত হতে থাকি, কিন্তু জ্বালাময়ী বিবৃতির মাধ্যমে ভারতীয় সেনাকে বা আমরা যাদের ভারতীয় বলে চিহ্নিত করেছিলাম তাদের যে পিছু হঠানো যাচ্ছে না, উপলব্ধি করি সেই সত্যও। এ যেন অলংকার সর্বস্ব জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদের তাত্ত্বিক অসংবৃতিতে যাত্রা।
আমাদের অধীর, খাঁটি ও সৃজনী আত্মা এবার মার্ক্সবাদের জটিলতায় ভর করল। দ্রুত আমরা নয়া শত্রু চিহ্নিত করলাম। সিপিআই-সিপিএম হয়ে উঠল আমাদের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালি অধ্যুষিত দল। সে সময়ের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের প্রভাব প্রায় শূন্য হলেও আমাদের তাত্ত্বিক নেতারা, যাঁরা ছিলেন পার্শ্ববর্তী স্কুল বা কলেজের শিক্ষক - আমাদের শোনাতেন ১৯৭৯-১৯৮৫-র আসাম আন্দোলনের কাহিনি। আসামের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শ্রমিক শ্রেণি বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন হিসেবে সিপিএম যেভাবে চিহ্নিত করেছিল তা থেকেই প্রমাণিত হয় তাদের গোঁড়ামি, যার জেরে আসামে শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক ভিত্তিক কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়, এমনটাই বুঝিয়েছিলেন আমাদের তৎকালীন তাত্ত্বিক নেতারা।
ওঁরা ছিলেন আমাদের চেয়েও অধীর। এঁরা সকলেই ছিলেন ৭০-এর নকশালপন্থী আন্দোলনের ফসল। ওঁরা মনে করতেন, যৌবনে ওঁরা বিপ্লবের সুযোগ হারিয়েছেন, এবার আর তা করা যাবে না। আমরা ওঁদের বিশ্বাস করতাম, ওঁদের মত করে ভাবার, কথা বলার চেষ্টা করতাম। মতাদর্শগত সঠিকতার টানে আমরা কলেজে আমাদের এসএফআই-এর বন্ধুদের সঙ্গে বিতর্ক করতাম, তাদের গাল দিতাম ভুল পার্টি লাইনের জন্য।
আসাম আন্দোলন থেকে সকলেই নিজস্ব প্রাপ্য পেয়েছিল, বন্ধু হোক বা শত্রু। সে আলফা শান্তি প্রক্রিয়ার প্রধান শীর্ষ বুদ্ধিজীবী হীরেন গোঁহাই হোক বা স্থানীয় সিপিএম কর্মী, সকলেই আসাম আন্দোলনের রমরমা টের পেয়েছিলেন। হীরেন গোঁহাই টের পেয়েছিলেন খোদ রাজধানী শহরের ভেতরেই তাঁর উপর শারীরিক আক্রমণ মারফৎ, কিন্তু বহু সিপিএম কর্মীর কাছে ওই ছটি বছর ছিল জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।
আসামের জটিল ও সামাজিক গ্রামজীবনে নিজেদের আপন মানুষের ফ্যাসিস্ট ভাবধারার বিরুদ্ধে ওঁরা সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ওঁদের যত গোঁড়ামিই থাকুক, এটা ঘটনা যে সিপিএম কর্মী ও বহু মার্ক্সবাদ বিশ্বাসী কঠিনতম পরিস্থিতিতে নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী মতাদর্শের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ওঁরা সফল হয়েছেন কিনা তা আমি জানি না, তবে আসাম আন্দোলনের পর অসমিয়া সমাজ তাঁদের সকলকেই আপন করে নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিএম আর কখনও আসামে নিজেদের ভিত্তি বাড়াতে পারেনি। ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে তারা আসামের সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যায়, জায়গা নেয় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ যারা অন্তত উপর উপর মার্ক্সবাদকে জড়িয়ে থাকে।
জাতীয়তাবাদী মুখ সমন্বিত মার্ক্সবাদ আসামের বাম আন্দোলনে চোরা স্রোত হিসেবে চিরকালই থেকে গিয়েছে, এবং উল্টোটাও। আসাম আন্দোলনের সময়ে বা তার পর মাওবাদী, লেনিনবাদীদের মধ্যে থেকে এক নতুন গোষ্ঠী বেরিয়ে আসতে থাকে, যারা গোঁড়া মার্ক্সবাদী লাইনের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি জুড়তে শুরু করে। ফলে লেনিন-স্তালিন হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী-মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার পড়া লেনিনের প্রথম বই কী করিতে হইবে নয়, জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর লেখার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।
অসমিয়া ভাষায় এর অনুবাদটি ছিল চমৎকার। আমার এক তাত্ত্বিক নেতা আমাকে বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। আমার এ বইটি পড়া কেন প্রয়োজন, তা খুব স্পষ্ট ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইতিহাসের কোনও কোনও সময়ে জাতীয় বুর্জোয়ারা কেন বন্ধু হয়ে ওঠে, তার একটি ধারণা মিলবে এখান থেকে। জাতীয় বুর্জোয়ারা কেমন দেখতে হয়, সে নিয়ে অবশ্য আমার কোনও ধারণা ছিল না। সে সময়ে আমার সঙ্গে যারই দেখা হত, সে-ই বলত আমাদের শিল্প প্রয়োজন, শিল্প ছাড়া আমরা বাঁচব না। সংবাদপত্র বিতর্ক হত কীভাবে অসমিয়া জনগণের জন্য জাতীয় পুঁজি গঠন করা সম্ভব হয়।
আসাম চুক্তি যখন হল, তার আগে চুক্তির রাজনৈতিক দিকসমূহ নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাইনি আমরা। তার প্রস্তাবনায় ছিল আসামে শিল্পস্থাপনের সম্ভাবনা। একই মতাদর্শের কিছু মানুষ আমাকে বলেছিলেন, আসামের একটি তৈল সংশোধনাগারের জন্য অসমিয়ারা এক সাহসী লড়াই লড়েছিলেন। চিন্তাভাবনার ব্যাপারে আমি তখন বড়ই ছোট, আসামের জাতীয় বুর্জোয়া বলতে কী বোঝায়, সে প্রতর্কের পক্ষেও আমার বয়স তখন নেহাৎ কম। আমার উপর লেনিনের প্রভাব ছিল ভয়ংকর। ফলে আমি চে গেভারার দিকে চলে যাই এবং তাঁর দুটি বই তৎক্ষণাৎ আমার নজর কাড়ে। একটা বই সদ্য অসমিয়ায় অনুবাদ হয়েছে তখন, এবং বিক্রি হচ্ছে হট কেকের মত। সে বইয়ের খদ্দের যেমন আমার মত হবু বিপ্লবীরা, তেমনই আলফা ক্যাডাররাও। বইটা ছিল গেরিলা যুদ্ধকৌশল নিয়ে।
দ্বিতীয় বইটা ছিল বাংলায়, কিউবার বিপ্লব নিয়ে গেভারার ডায়েরি। বইটা আমি দেখি আমাদের এক তাত্ত্বিক নেতার বইয়ের তাকে। যেই না আমি বইটায় হাত দিয়েছি, অমনি তিনি উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন, দয়া করে বইটা ফেরত দিও, আমি পাঁচবার বইটা কিনেছি, আর কিনতে চাই না। তিনি জানান, তাঁর পরিচিত এক আলফা নেতা বারবার ওঁর কাছ থেকে এই বইটি ধার নিতেন, এবং কখনও ফেরত দিতেন না। এর পর তিনি আমাকে বলেন গেভারার ডায়েরির কতটা প্রভাব আলফা ক্যাডারদের উপর পড়েছে। তিনি বলেন গেভারার ডায়েরি পড়ে অনুপ্রাণিত আলফা ক্যাডাররা নিজেদের ডায়েরি রাখতে শুরু করেন, তাতে তাঁরা লিখে রাখতেন দৈনন্দিন জীবনের কথাস তাঁরে মতাদর্শগত ধারণার কথা, আভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল, সংঘর্ষ, প্রেম, পরিবার ও অনেক সাংগঠনিক খুঁটিনাটির কথা।
পরবর্তী বছর গুলিতে এই ডায়েরিগুলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে ওঠে যার মাধ্যমে এই ক্যাডারদের তাড়া করে হত্যা করা হয়, এর সাহায্যেই তৈরি হয় ডেটাবেস এবং সংগঠনের মধ্যে ফাটল ধরানো হয় এই ডায়েরিগুলির মাধ্যমেই।
এখন স্মৃতি হাতড়ে এসব খুঁটিনাটি মনে করার সময়ে একটা আয়রনির দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, বাঙালি সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আমাদের যে অনুভূতিই থাকুক না কেন বা বাংলা ভাষার চক্রান্ত নিয়ে আমরা যে তত্ত্বই তৈরি করে থাকি না কেন, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে পরবর্তী সময়ের কোনও সংযোগ ছিল না। যারা ইংরেজি বুঝত না, মার্ক্সবাদী পৃথিবীতে তাদের পা রাখার একমাত্র মাধ্যম ছিল বাংলা। চে গেভারা বা ফিদেল কাস্ত্রোর মত অ-তাত্ত্বিক বই তখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র বাংলাতেই মিলত।
যদিও কিছু জরুরি মার্ক্সিয় বই, যেমন বিপ্লব কীভাবে সম্ভব বা খাঁটি বিপ্লবী বলতে কী বোঝায়, এ ধরনের বই সোভিয়েত রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশন থেকে অসমিয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে অনুবাদগুলো ছিল অসম্ভব খারাপ, লোকজন সেগুলো পছন্দও করত না। সে কারণেই বাংলা বই ও তার প্রভাব ছিল চিরন্তন, যদিও আমরা ব্যবহার করতাম ধার করা বই, যেগুলো আমাদের ভাষায় পাওয়াই যেত না।
আমার বাঙালি বন্ধুরা জানলে খুশি হবে যে বাংলা সাহিত্যের এখনও এত সুনাম রয়েছে!
আলফা নেতাদের অধিকাংশের সঙ্গেই মার্ক্সবাদের কোনও যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন মার্ক্সবাদীদের কাছ থেকে নয়া স্বীকৃতিলাভ করে থাকে এবং এই সময়ে, ১৯৯০-এর দশকে তাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি গৃহীত হয়। আমরা খুব নিশ্চিত ছিলাম না যে তারা সমাজতন্ত্রকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল কিনা, এবং আমাদের অনেকেই এখনও আলফার সংবিধান ঘেঁট তাদের সে সময়ের রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করে চলেছি।
তবে এখানে আমি একটা চিত্তাকর্ষক গল্প বলতে পারি। এ গল্পটা বেশ কয়েকবছর আগে অসমিয়া সংবাদমাধ্যমে চাকুরিরত একজন বন্ধু এ গল্প আমায় বলেছে। মধ্য পর্যায়ের কিছু অত্যুৎসাহী নেতা সংগঠনের মধ্যে বিতর্ক তুলেছিলেন যে আলফার উচিত সত্য অর্থে মার্ক্সবাদকে দিশা করে তোলা। তাঁদের কথা শোনার পর পরেশ বরুয়া বলেছিলেন, বাঙালি কমিউনিস্টদের কাছ থেকে মার্ক্সবাদ শিখবেন না। আপনাদের যদি সত্যিই মার্ক্সবাদ শিখতে হয়, আমাকে বলুন, আমি আপনাদের কিউবা পাঠাব, ফিদেল কাস্ত্রোর কাছ থেকে মার্ক্সবাদ শিখবেন। আমি জানি না এ ঘটনা সত্যি কিনা, কিন্তু এর থেকে বোঝা যায়, সিনিসিজম আমাদের আন্দোলনের লাইনকে কতটা সরু ও আবছা করে ফেলেছিল।
আসামে নকশালপন্থীদের একটি ছোট অংশ দীর্ঘ বিতর্কের পর ১৯৮৬ সালে নতুন পার্টি লাইন নেয়। বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক ও ক্রমাগত লাইন বদলের জেরে তাদের নামও বারবার পাল্টাতে থাকে। অবশেষে তারা ইউনাইটেড রেভলিউশনারি মুভমেন্ট কাউন্সিল অফ আসাম বা আর্মকা নাম গ্রহণ করে এবং চিত্তাকর্ষক এক পার্টি লাইন নিয়ে আসে।
তারা সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলি উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ও অসমিয়া এলিটদের দ্বারা শোষিত, ফলে তাদের অধিকার রয়েছে জাতীয়তার নির্মাণে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব করার। আলফার সঙ্গে তাদের সংঘাতের কোনও বিন্দু ছিল না, অন্তত তাত্ত্বিক পর্যায়ে, আলফাও একই রকম যুক্তিতে কথা বলত।
আমার মনে আছে চেয়ারম্যান রাজখোয়া একবার এক ভাষ্যে বলেছিলেন আসামের জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হতে পারে আসামের সমস্ত স্থানিক গোষ্ঠীর সমানাধিকারের মাধ্যমে। কিন্তু কার্যত তা অসম্ভব।
অসমিয়া জাতীয়তার অংশীদার হিসেবে তাদের যারা মনে করত, সেই অহোম ও কোচ রাজবংশীদের মধ্যে আর্মকা কাজ শুরু করতে তাদের সঙ্গে আলফার সম্পর্ক নির্ধারণ শুরু করে সামরিক বাহিনী। আর্মকার সেরা কর্মীদের অনেকেই ১৯৮৮-৮৯-এ নিহত হন।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত বিশ্বাস করেন যে আসামের জাতীয়তা সমস্যার সেরা সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে এসেছিল আর্মকা। কিন্তু তারা কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ক্ষুদ্র জাতি ও পরিচয়ের উপর জোর দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আন্দোলন জন আন্দলনকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে তাকে টুকরো করে দেয়।
আমি খুব একটা নিশ্চিত নই যে এটাই সাধারণ ধারা কিনা, তবে জাতীয়তা সমস্যা সমাধানে স্থানীয় স্তরে আলফার একটা পরিকল্পনা ছিল। আমি যে ছোট শহরে থাকতাম তার কাছে একটা বিশাল জঙ্গল এলাকা ১৯৯২-৯৬ সময়কালে আলফার তত্ত্বাবধানে সাফ করা হয় এবং সেখানে তারা স্থানীয় জনজাতিদের ভূমির অধিকার দেয়। ওই জনজাতিদের সেখানে বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়। সম্প্রতি আমি বিশাল ওই প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত, সাদামাটা জীবন কাটান। তিনি আমাকে বলেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বানভাসি বোড়োরা ওই এলাকায় এসে থাকতে শুরু করার পর।
আলফা ক্যাডাররা তাঁদের আশ্রয় দেয় এবং যাতে সেখানে তাঁরা বসবাস করতে পারেন, সে কারণে কিছু এলাকা সাফ করতে বলা হয় তাঁদের। এ খবর সারা আসামে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যায়, নদীপারের ভূমিক্ষয়ে, বা মহাজনদের গ্রাসে যাঁরা জমি হারিয়েছেন, তাঁরা ওই এলাকায় আসতে শুরু করেন এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন।
আলফা ক্যাডাররা সেখানে আরও কিছু দেশিয় গোষ্ঠীকে আনার চেষ্টা করেন, যাতে সেখানে একটা মাইক্রো আসাম গড়ে তোলা যায়। প্রায় সমস্ত গোষ্ঠীরই সমর্থন পেয়েছিলেন তাঁরা, কারণ প্রতিটি দেশিয় গোষ্ঠী বলপূর্বক ভূমিহারা হচ্ছিলেন। প্রাক্তন আলফা ক্যাডার আমাকে জানান যে নদীতীরস্থ মিশিং গোষ্ঠী এ উদ্যোগে শামিল হননি, যদিও তাঁদের কেউ কেউ স্বল্প সময়ের জন্য এই এলাকায় এসেছিলেন।
প্রতি বাড়ির জন্য আট বিঘা জায়গা দেওয়া হয়। এর ভিত্তি ছিল পুরনো অহোম পাইক বন্দোবস্ত, এবং অহোম রাজনৈতিক রাষ্ট্র, যেখান থেকে জাতীয়তাবাদীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পুনরুচ্চারিতই হোক বা পুনরাবিষ্কৃত, ঐতিহাসিক অহোম রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সাফল্য ছিল একক অসমিয়া জাতীয়তার গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ।
এ ন্যারেটিভ নির্মিত হতে পেরেছিল ঐতিহাসিক সময়ের সাত পূর্বস্থ রাজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে। ( সাত রাজা মারি এক রাজ)। লেনিন সত্ত্বেও, কমিউনিস্ট তত্ত্ব সত্ত্বেও, আত্তীকরণের তত্ত্ব কেন্দ্রস্থ হতে পেরেছিল।
অনেক মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাবিদ মার্ক্সীয় লাইনের সঙ্গে এই তত্ত্ব খাড়া করতে সাহায্য করেছিলেন। আমি মনে করতে পারছি ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া এক মেমোরান্ডামে ১৯৯১ সালে সংযুক্ত যুব মোর্চা নামের এক নকশালপন্থী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ভারত রাষ্ট্রের যথার্থ ফেডারেল কাঠামোর দাবি তুলে আত্তীকরণ তত্ত্ব বুদ্ধিদীপ্তভাবে বর্ণনা করতে পেরেছিলেন।
এই আত্তীকরণ নীতির ফল ছিল অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বা আরও যথাযথভাবে বললে অহোম রাজ্য। ওই মেমোরান্ডামে অতীতে আত্তীকরণের ইতিহাসের কথা বলা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল তা ভবিষ্যৎকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। ছিল পুরসভাও, এবং আপনি জানতেও পারবেন না, কোনটা আপনার, কোনটা নয়।
আত্তীকরণ তত্ত্ব আকাশ থেকে পড়েনি। বিশ শতকের গোড়ায় আমরা ক্ষমতাশালীদের ভয়ে তাড়িত থাকতাম। তারা স্মার্ট, দক্ষ। তারা আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছিল, বিশাল ব্যবসায়িক প্রকল্প স্থাপন করেছিল - এই ক্রুর পৃথিবীতে বাঁচতে যা লাগে সবই দখল করেছিল। মরিয়া আমাদের হাতে কেবল ছিল আত্তীকরণ তত্ত্ব - এই লোকগুলোকে আমাদের আওতায় এনে আত্তীকরণ করা প্রয়োজন ছিল আমাদের।
কিন্তু তেমনটা কদাপি ঘটেনি। ধীরে ধীরে আমরা তিনসুকিয়ার বিহারি ব্যবসায়ী ও মফসসলে কর্মরত বিহারি শ্রমিকদের তফাৎ ভুলে গেলাম। সকলেই আমাদের কাছে সমান হয়ে উঠল। খারণ আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেখেছি, কীভাবে বিহারি শ্রমিক রাতারাতি অবিশ্বাস্য বড়লোক হয়ে গেল। অত দ্রুত লাখপতি হওয়ার জাদু আমাদের জানা ছিল না।
আমরা দেখেছি এদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হলে ভারত সরকার কত দ্রুত পদক্ষেপ করে। আমি এখনও জানি না বিহারি বা মারওয়ারি মহাজন খুন বা অপহরণ হলে ভারত সরকার কেন দ্রুত জবাব দেয়।
আমি এখনও জানি না কেন ভারত সরকার ওই একই সংগঠনের দ্বারা কোনও জনজাতির মানুষ খুন বা অপহৃত হলে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ভারত সরকার যখন ঘোষণা করে তারা মধ্য ভারতের মাওবাদী এলাকায় নিজেদের মানুষদের বিরুদ্ধে সেনা নামাতে চায় না, তখন আমার অশ্রদ্ধা হয়, রাগ হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে তারা কোনও না কোনও ভাবে বলতে চায় আমরা আইনি নাগরিক নই এবং সে কারণেই আমাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সেনা নামিয়ে রাখা যায়। আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর শক্তি নেই।
৩৫ বছরের মত সময় ধরে যুদ্ধ করার পর আমাদের সেনারা ঘরে ফিরেছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যদি তুমি অন্যের ঘর জ্বালাও তাহলে তোমার হাত পুড়বেই। ফলে আমরা তাদের নিজ ভূমে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি কেন এই বিপ্লবীদের প্রতিবার জনসমক্ষে হাজিরা দেওয়ার জন্য আম্বানির মত থ্রি পিস স্যুট লাগে। আমরা তাদের উপর ভরসা রাখি এখনও, আশা করি নয়া আসাম চুক্তি প্রক্রিয়ায় তাঁরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
অনেকের মত আমিও এক আধা অ্যাক্টিভিস্ট, আশ্রয় নিয়েছি নদীতীরবর্তী ভূমিক্ষয়, বড় বাঁধ, এবং এরকম কিছু বিষয়ে যে ব্যাপারে গত ১০ বছরে নজর দেওয়া উচিত ছিল, বিশেষ করে আমাদের মত ছোট রাজ্যে বাজার অর্থনীতির মাথা চাড়া দেওয়ার সময়ে। সম্প্রতি আমি ডিব্রুগড় গিয়েছিলাম। সেখানে একদল স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্ট রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে দারুণ লড়াই করছেন, ইস্যু নদীজনিত ভূমিক্ষয়। কয়েক বছর সময়কালে একটি ঘনবসতিপূর্ণ, সুন্দর এলাকা তার সমস্ত গৌরব হারিয়েছে।
ব্রহ্মপুত্রের রাক্ষুসে স্রোত এর দুটি চমৎকার নদী , হাজারো ছোট বন এলাকা, এবং শয়ে শয়ে গৃহ ও তৎসংলগ্ন জমি খেয়ে ফেলছে। ওঁরা আমাকে একটা নিকটবর্তী গ্রামে নিয়ে গেলেন, যেখানে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল এক নম্র ধর্মভীরু বৃদ্ধের। তিনি আমাকে সেই সব পুরনো দিনের গৌরবগাথাই বলতে শুরু করলেন, কিন্তু হঠাৎই সরাসরি চাঁছাছোলা প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি অস্ত্র ধরবে! আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। বোঝার পর যখন না বললাম তখন তিনি খেপে উঠলেন। বললেন, তাহলে মরতে এখানে এসেছ কেন! অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া পুলিশ ও ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় নাকি! অসম্ভব। অস্ত্র নিয়ে এসো, তারপর তোমাদের আন্দোলনে যোগ দেব।
আমি স্তম্ভিত, এরকম কথা আমি আলফা পর্বের চূড়ান্ত পর্যায়েও শুনিনি। আমাদের অনেকের কাছেই এই ঘটনা নিপীড়ক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক চিহ্নিত করে দেয়। ওই বৃদ্ধ মানুষটি অনুভব করেছিলেন কীভাবে বন্দুকের নল থেকে ক্ষমতা উৎসারিত হয়। আমার নিজের কাছে এ ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছিল যে গত কয়েক বছরে আমরা সৃজনশীল ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছি এবং হারিয়েছি সৃজনশীল উপায়ে আমাদের যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতাও।
আসামের ভবিষ্যতের পক্ষে এই শান্তি আলোচনা জরুরি, যদিও আমাদের অনেকেই এই প্রক্রিয়ায় খুব বেশি আশা রাখেন না। ভারত রাষ্ট্র কীভাবে এই ভূমিকা পালন করবে তা আমরা লক্ষ্য করব এবং তারা কীভাবে আমাদের যথার্থ দাবি পূরণ করে তার উপর নির্ভর করবে আসামের ভবিষ্যৎ। পিছন বাগিচায় আতসবাজি প্রস্তুত রয়েছে, অন্যদের সামান্য সাহায্যেই তা পোড়ানো শুরু হয়ে যাওয়া সম্ভব।
Read my original article here :: https://kafila.online/2011/11/02/my-days-with-nationalism-in-assam-ankur-tamuli-phukan-2/