এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো  গুরুচন্ডা৯ তেরো

  • বাঙালবাড়ির কিস্‌সা (২য় পর্ব)

    রঞ্জন রায়
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ০১ মার্চ ২০০৯ | ৯৬৫ বার পঠিত
  • স্মৃতি সততই সুখের নয়

    (১)

    ১৯৯৬ য়ের জুন মাস। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরের দূর্গাবাড়ি রোডের রাস্তায় একটি টয়োটা গাড়ি। ভর-দুপুরে গাড়িটি ঢিমে লয়ে চলছে, এদিক-ওদিক, দোকানের সামনে থেমে জানতে চাইছে - সূর্যসিঁড়ি নামের বাড়িটি কি করে যাব? বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামে তারা দু'জন। কমবয়েসি ছেলেটি রজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগের ছাত্র। এক বন্ধুর দাদার দেওয়া যোগাযোগে কদিন ধরে কাজকম্ম ছেড়ে ঘুরছে কোলকাতা থেকে আসা একটি বাংলা দৈনিকের সাংবাদিকের সঙ্গে। ঘুরছে চরকিবাজির মত। সক্কালে কিছু নাস্তা করে বেরিয়ে পড়া। দুপুরের খাওয়া যে কোথায় হবে, বা আদৌ হবে কি না, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। তবে সন্ধের মুখে সাংবাদিক ভদ্রলোক চলে যাবেন স্থানীয় প্রেস্‌ ক্লাবে, নয় হোটেলে যাতে দিনের ডেস্‌প্যাচ্‌ ঠিকমত কোলকাতায় পাঠানো যায়। এভাবে ঘোরা হয়ে গেছে প্রায় আদ্ধেক বাংলাদেশ; বগুড়া, খুলনা,রংপুর, যশোর,পাবনা, কুমিল্লা - কোথায় নয়! মাঝেমাঝেই বাংলাদেশের পুলিশ ও প্যারামিলিটারি আটকাচ্ছে তাদের গাড়ি, তল্লাশি করছে কাগজপত্তর। কোলকাতার সাংবাদিক জেনে ওদের বাঁকা ভুরুজোড়া আর সোজা হচ্ছে না। তবে কোথাও ওদের রাস্তা আটকানো হয়নি। বলা হয়নি - স্পর্শকাতর এলাকা, বিদেশি সাংবাদিকের জন্যে নিষিদ্ধ।

    কারণটা আলাদা। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের সময় পুরনো ক্ষমতাসীন দলটি কেয়ারটেকার গভর্ণমেন্টের কাজ করে না। বরং প্রধান বিচারপতি বা অমনি কেউ নির্বাচিত নতুন সরকার শপথ নেয়া অবধি কেয়ারটেকার সরকার চালান। ফলে সরকারি মেশিনারি খুল্লমখুল্লা পক্ষপাত করতে পারেনা। আবার আছে 'নেশন ওয়াচ্‌'এর মত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসম্পন্ন সংস্থার খবরদারি। তবু আছে এনজিওরা, দৌড়ে এসে পথ আটকাচ্ছে -
    'আসেন, ১৭ নং বুথে, দ্যাখেন কান্ডটা! জেনুইন ভোটাররে অমুক দলের লোকেরা ধমকাইত্যাছে। পুলিশ হালায় খাড়ইয়া তামাশা দ্যাখতে আছে।' কুমিল্লা জেলায় তো একটি বুথে স্পষ্ট ছাপ্পা মারতে দেখা গেল।

    এবার ভোটরঙ্গ শেষ, কাল গণনার কাজ শুরু হবে। কাল এরা রাজধানী ঢাকা কভার করে আজ ময়মনসিং শহরে এসেছে। কিন্তু কোলকাতার সাংবাদিক জানিয়েছেন যে তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ শহরে ড: নীলমণি রায়ের বাড়ি যেতে চান। কেমন যেন কুটুম লাগে। ঐ যে বুড়ো ভদ্রলোক, প্র্যাক্টিস করেন না, ওষুধের দোকান আছে।

    হ্যাঁ, রজ্জাক দূর্গাবাড়ি রোড চেনে বইকি! ঐ শহরে ওর খালা ডাক্তার। যাতায়াত খুব। সঙ্গে যেতে রাজি। এবার নামে চল্লিশোর্ধ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি। রজত রায় । এই ইলেকশান কভার করতে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কোলকাতা থেকে এসেছে। কিন্তু এই ক'দিন ধরে তুফানি ট্যুর করতে করতে ওর মধ্যে জেগে উঠেছে এক সুপ্ত ব্যক্তিগত এজেন্ডা। কিন্তু কোলকাতা থেকে রওনা হবার সময় ও নিজেও জানতো না ওর মনের কোণের এই সুপ্ত ইচ্ছার কথা।

    ও চায় নিজের চোখে একবার মিলিয়ে দেখতে। কি দেখতে? ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে - 'তোরা তো আর দেখলি না! সে যে কি দিন আছিল।' বাজার থেকে কয়েক পিস ল্যাংড়া আম এসেছে। সেগুলো জলে ডুবিয়ে রেখে কেটে বাড়ির বাচ্চাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কেউ আড়াআড়ি টুকরো তো কারো ভাগে আঁটি। আবার আঁটির ভোগস্বত্ব নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল। ক'জনের পিঠে পড়ল দু'ঘা। ব্যস্‌, শুরু হয়ে গেল বম্মা বা বৃদ্ধা প্রপিতামহীর লেকচার বা বিলাপ। 'আইজ এই দিন দ্যাখনের লেইগ্যা বাঁইচ্যা আছি? আমার নাতির ঘরের পুতিরা আমের টুকরার ভাগা লইয়া কাইজ্যা করে! আরে, বৈশাখ-জষ্টি মাসে ত' শোয়ার ঘরের কাঠের চৌকির তলে বাগানের মেলা আম ফজলি-ল্যাংড়া-হিমসাগর শ'য়ে শ'য়ে রাখা থাকতো। কাঁসার জামবাটিতে ঘন দুধ আর আম লইয়া ল্যাডা মাইর‌্যা বইয়া নাতিরা খাইতে থাকতো, যত ইচ্ছা। তরা তো দেখলি না! '
    সামনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ। টিকিট পাওয়া কঠিন। তাই বাড়িতে এসেছেন রাঙাকাকার শালা - দিলীপমামা। ইস্টবেঙ্গলের লাইফ মেম্বার। এসেই জিজ্ঞেস করলেন - 'মৃণালবাবু, আইজ কি মাছ আনলেন?' যেই মাছের গল্প শুরু হল মামা ওনার পুরনো ধরতাইয়ে ফিরলেন। 'তুমরা তো দ্যাখলা না?' রজতের পিত্তি জ্বলে যায়, - ধুস্‌ শালা! বেশ করেছি, দেখিনি। তার জন্যে কি আমরা দায়ী? কিন্তু সামনে সোনামুখ করে বলে -
    'মামা, কি দেখি নাই, খুইল্যা কয়েন।'
    'বুঝলা, এপাড়ে ফুলঝুরি ঘাট, ঐপাড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট। স্টীমারে পার হইবা, তবে যাইবা মইমনসিং। আর স্টীমারঘাটায়, বুঝলা নি, মাইজ রাতেও আলো জ্বলতে আছে। সারিসারি মাছ-ভাতের দোকান খুইল্যা সমানে যাত্রীদের ডাকতে আছে--আসেন, আসেন। লোকে আইত্যাছে, যাইত্যাছে, খাইত্যাছে।'
    দিলীপমামা খানিক্‌ক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে যোগবলে পৌঁছে গেছেন চল্লিশের দশকের বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানে। ধ্যান ভাঙ্গলে চোখ খুলে শ্বাস ছেড়ে বল্লেন, 'রজত, তুমরা কিছুই দ্যাখলা না।'

    কোলকাতার পার্কসার্কাস পাড়ায় বাজারের সামনের ভাড়াবাড়িতে বাইশজন মানুষের একটিমাত্র বাথরুম। রোজ এক ক্যাচাল। রজতের দাদা শুধোয় বাবা সলিলকুমারকে-
    'আচ্ছা, তোমাদের বাজিতপুর বা আঠারবাড়িয়ার গাঁয়ের বাড়িতে পায়খানার কেমন ব্যবস্থা ছিল?'
    সলিলকুমার উৎসাহিত হন -
    'বাঙ্গালরা অনেক সভ্য, বুঝলি। প্রথম র‌্যাংলার উমেশচন্দ্র বসু যে মইমনসিংহের, হেইডা খাম্‌কা না। ঘটিদের দেখ। ওদের গাঁয়ে থাকে একটি হেগোপুকুর, যেখানে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নিত্যকর্ম করতে যায়। বিশ্বাস হয় না তো শ্রীম রচিত '' শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত'' দ্যাখ,কামারপুকুরের হেগোপুকুরের উল্লেখ আছে।'
    মিশনের মন্ত্রদীক্ষিত স্মৃতিকণা বিরক্ত হন। মানুষটার কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই?
    'তুমার কি মাথাখারাপ হইছে? পুলাপানের লগে এইটা কি কথা কও?'
    সলিল হেসে স্ত্রীকে থামতে বলেন। ওনাকে তখন কথায় পেয়েছে।
    'আমাদের দ্যাশে প্রত্যেক বাড়ির পিছনে খাটাপায়খানা, কলাগাছ দিয়া ঘেরা। সেইখানে শুধু বাড়ির মেয়েরা যায়।'
    'আর বাড়ির ছেলেরা?'
    সলিল বিরক্ত হন -
    'আরে, আগে শুইন্যা ল'। প্রথমে বাড়িগুলির কাঠামটা বুঝতে হইবো। প্রত্যেকটা বাড়ি একেকটি স্বতন্ত্র দ্বীপের মত। অনেক উঁচু কইর‌্যা তৈরি। মানে ভিত এত উঁচু যে সিঁড়ি বাইয়া উঠতে হয়। '
    'কেন?'
    'কেন? বৈশাখে হিমালয়ে বরফ গলতে থাকে। হেই জল ব্রহ্মপুত্র বাইয়া আসে আমাদের নদীগুলিতে। যমুনা-ধনু-মেঘনা।'
    'কিন্তু, যমুনা তো দিল্লির কাছে?'
    বড়ছেলে বাবার ভূগোল গোল হবার সম্ভাবনায় রোমাঞ্চিত হয়। সলিল হাতের ইশারায় এসব আপত্তি খারিজ করে জানান যে ভারতে শুধু একটিই যমুনা নয়, ময়মনসিংহ জেলাতেও একটি যমুনা আছে। এটি মেঘনার শাখা নদী। আর ব্রহ্মপুত্র ওখানে এসে মেঘনা নাম নিয়েছে। ছেলের মাথায় টিউবলাইট জ্বলে। ভূপেন হাজারিকার গান-'' গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা। আমার দুইচোখেরই জলের ধারায় মেঘনা-যমুনা'' অন্যমাত্রা পায়। ওদিকে সলিলের গল্প তর্‌তরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
    'ফলে বর্ষা আসার অনেক আগেই নদীর জল বাড়তে থাকে। আষাঢ় মাসে তো দুইবাঁশ সমান উঁচা। তাই সব বাড়ি দ্বীপের মত। তখন এক বাড়ি থেইক্যা আরেক বাড়ি যাইতে হইলে নৌকা লাগে। বাজার কর নৌকায়। বেড়াইতে যাও নৌকা বাইয়া। এমনকি তরিতরকারি- তেলনুন-রসগোল্লা সবই নৌকায় কইর‌্যা বেচতে আসে। তো মহিলারা যায় বাড়ির পিছনে লাগা খাটা-পায়খানায়, আব্রুর লাইগ্যা কলাগাছ দিয়া ঘিরা। আর ছেলেরা যায় নৌকা বাইয়া জলের মাঝে। আমাদের নৌকা ঘটিদেশের মত না। গলুই বড় উঁচা। তার উপর চইড়া অপকর্মটি সারে আর কইমাছ ও অন্য জিওলমাছে আইয়া টপ কইরা খায়। '
    এবার স্মৃতিকণা উঠে চলে যান। রজত হিসেব মেলাতে পারে না। ( ও কি ছোটবেলা থেকেই ইন্‌ভেস্টিগেটিভ্‌ জার্নালিজম করতো না কি?)
    ' বাবা , এই কাজের জইন্য অতদূর? নদীর মধ্যে?'
    ' দুর অ, ব্যাডা ব্যাক্কল! কেডা কইসে নদীর মইধ্যে? কইলাম না, বর্ষাকালে নদীর জল, ক্ষেতের জল, মাঠের জল সব মিল্যা-মিশ্যা একাকার। এ সিংগল শীট অফ ওয়াটার! হেইদৃশ্য তো তরা কোনদিন দেখবি না! '

    রজত ভোলেনি। আগের প্রজন্মের কথায়, প্রস্তাবে, খেদোক্তিতে, দীর্ঘশ্বাসে, স্মৃতিচারণে সে এক রূপকথার দেশ। কোলকাতার ইঁট-কাঠ-কংক্রীটের দুনিয়া থেকে একেবারে আলাদা। সেখানে গাঁয়ের চৌকিদার বা দফাদারদের নাম অনায়াসে হয় - মিছার বাপ, যদিও তার ছেলের নাম মিছা নয়। মহিলাদের নাম -- ঠান্ডার মা, বাচার মা, মেঘার মা, যদিও তাদের সন্তানদের কেউই ঠান্ডা, বাচা বা মেঘা নয়। কোন মানুষকেই তার আসল নাম ধরে ডাকাটা রেয়াজ নয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষ মাত্রেই কারও বাপ বা কারো মা! ( তবে কি ' না-বিইয়েই-কানাইয়ের-মা' প্রবাদের জন্মভূমি পশ্চিম নয়, পূর্ববঙ্গ?) ভাইদের নাম ধরে দাদা বলা যাবে না। তারা অবধারিতভাবে মেজদা-সেজদার পর ক্রমশ: কনাদা, রাঙাদা, ন'দা, ফুলদা, ধনদা, ছোড়দা ইত্যাদি। তেমনি দিদিরা। রজত একবার আপন দাদাকে বড়দা না বলে নাম ধরে দা' প্রত্যয় জুড়ে ডেকে দেখুক তো! গুরুজনেরা রে-রে করে তেড়ে আসবেন।
    'কি কইলি? নাম ধইর‌্যা ডাকলি? কেন তর পাড়ার দাদা নাকি? কাইল কি তর বাপ-মায়েরে নাম ধইর‌্যা সলিলবাবা - স্মৃতিমা কইর‌্যা ডাকবি?'
    রজত মেলাতে চান। বৃষ্টি না হলে নাকি মুসলমান মেয়েরা মাটির সরায় করে নাকে নথ পরানো ব্যাঙকে নিয়ে পূজো করে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে? গান গায় না, গীত গায় - 'ম্যাঘরাজা রে! তুই নি আমার সোঁদর ভাই? এক ফোঁটা পানি দিলে জলির ভাত খাই।'
    'জলির ভাত কি জিনিস?'
    'তাও জানস না? হুঁ! ঐ যে কইল্যাম আকাশের জল নামার আগেই নদীতে, তারপর ক্ষেতে জল বাড়ে। তার লগে তাল রাইখ্যা বাড়ে এক বিশেষ ধানগাছ। জলের লেভেল বাড়ে, ধানগাছ আরও উঁচা হয়। খালি পাতাটি জলের উপর জাইগ্যা থাকে। এইভাবে জলের স্তর যখন প্রায় দুই তলা, তখন ধানগাছও বাঁশগাছের সমান উঁচা। হেই ধান হইল জলির ধান। তরা জানবি কেমনে? তরা তো আর দ্যাখস নাই। '

    রজত এবার দেখেই ছাড়বে। ছোট রজত মাছ খেতে চায় না। ডাল-আলুভাজা হলেই হল। বাঙালবাড়ির বাচ্চা মাছ খাবে না? মাথায় এক চাঁটি!
    'ডাল দিয়া ভাত মাইখ্যা খাইয়া উঠবি? তুই দেখি আমাদের বাড়ির কামলাদের মত। কামলারা বাগানে-ক্ষ্যাতে কাম কইর‌্যা যখন খাইতে বসে তখন খালি ডাইল-তরকারি চায়। কয়, বাবুর বাড়ি আইয়া মাছ খাইতাম না। মাছ তো আমরা নদী-নালায় ধইর‌্যা খাই, মাগনা। ডাইল তো কিন্যা খাইতে হয়। কাজেই ডাইল দ্যান গো মা-ঠাকুরাইণরা! হেই দিন গ্যাছে, এখন আর কামলা কই ? আমাদের বাড়িতে কাজের পরে চল্লিশজনের পাত পড়তো। গরম ভাত, ডাইল আর লাবড়া। তরা তো আর দেখবি না। '

    রজত এবার ভাল করে দেখবে, সুযোগ পেয়েছে। আকাশবাণীতে পল্লীগীতি গাইছেন দীনেন্দ্র চৌধুরি। সলিলকুমার সব্বাইকে ডেকে বাইরের ঘরে লোক্যাল সেট রেডিওর সামনে জড়ো করেছেন।
    'আরে, মন দিয়া শুন। আমরার দ্যাশের মানুষ গায়, দীনেন্দ্র চৌধুরি। আরে না, না, নির্মলেন্দু না। দীনেন্দ্র। '

    ''যাত্রা করিয়া মোরে বিদায় দে,
    ও মা যশোদা, মাগো যশোদারাণী।
    কালীদহে যাব আমি।''

    এবার কোরাস ধরে নেয়,- 'কালীদহে যাব আমি, কালীদহে যাব'।
    সলিল বিরক্ত হন -
    'ধুরু জা! এই গানে প্রাণ নাই। আরে এইডা খোলা আকাশের নীচে নাও-বাইচের গান। এইসব কি শহরের স্টুডিওতে বইয়া হয়। পুলাপানেরা গাইতাছে, কিন্তু নদী দ্যাখে নাই। গানে প্রাণ আইব কেমনে? দশটা নৌকা বাইচের সময় পতাকা লাগাইয়া সাইজ্যা আইতো। গলুইয়ের উপর চইড়া একজন হাতে করতাল লইয়া নাচতো আর সুর ধরতো। অন্যরা দোহার দিত। 'কালীদহে--যাব' শব্দের লগে নৌকার দশজন দাঁড়ির বিশটা বইঠা একলগে উঠতো আর পড়তো। আমাদের নৌকায় গলুইয়ের উপর উইঠ্যা নাচতো, নাচতো আর গাইতো লাউয়া মিঞা, ভালা নাম মোম আলি। বড় রসিক আছিলো। একবার তর মেজকাকা কইলকাতার কলেজের থেইক্যা ছুটিতে দ্যাশের বাড়িতে আইলো। লাউয়া এক চিঠি আইন্যা পড়তে দিলো। তর কাকায় কয় - 'চাচা, লম্প নিয়া আসো। নইলে দেখতে পাই না।' লাউয়া কয়,'এইডা কি কইলা? লম্প ছাড়া চিঠি পড়তে পারো না? লেখাপড়া পয়সা দিয়া শিখছো? নাকি ধান দিয়া?' অমন মানুষ! অমন স্নেহ! অমন কইল্‌জার জোর! তরা তো আর দেখলি না'!

    এবার রজত শেষ দেখে তবে ছাড়বে। এটাই এবার ওর নিজস্ব এজেন্ডা। কিন্তু চাইলেই কি আর দেখা যায়? দেখার জন্যে চাই পাখীর নজর। বিশেষ দেখার জন্যে আলাদা চোখ আর মন। তা' কি আর রজতের আছে? সাড়ে চারশ' বছর আগে সেক্ষপীর কিন্তু ব্যাপারটা জানতেন যে প্রেমিকের চোখ ইজিপ্সীয় চেহারায় হেলেনের মুখের লাবণ্য খুঁজে পায়। রজত কি পাবে? দেখছে, চেষ্টা করছে - কিন্তু হিসেব মিলছে না। ছোটবেলা থেকে স্মৃতির মণিকোঠার অ্যালবামে সযত্নে তুলে রাখা ছবিগুলো বাস্তবের সঙ্গে মেলে কই? এবার রজত পেরিয়ে এসেছে ফুলঝুরি ঘাট থেকে স্টীমারে বাহাদুরাবাদ ঘাট। হ্যাঁ, স্টীমারঘাটায় এখনও আছে মাছভাতের দোকান। আজও তারা খদ্দের ডাকে - ''আসেন, আসেন! গরম-গরম মাছের ঝোলভাত খাইয়া যান''। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল রেখে কিছু দোকানের ডেকর পাল্টেছে। লম্প-টেমি-হ্যারিকেনের জায়গায় টিউবলাইট, হ্যালোজেন এসেছে। নিদেনপক্ষে হলদেটে আলো ছড়ানো একশ' পাওয়ারের বাল্ব। সেই এথনিক লুকওলা চাটাইয়ের বেড়া ও কাঠের বেঞ্চি আজ আর নেই বল্লেই চলে। রজত মাছভাত খেতে বসে পাঙাস মাছ আর খেতে পারে নি। মুখের ভেতরে একটা বোদা স্বাদ। স্বপ্নভঙ্গের স্বাদ। আস্তে আস্তে রজত সমস্যাটা বুঝতে পারে। ভুল তারই। সময় বলে যে ফোর্থ ডাইমেনসন আছে তাকে যে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় নি।

    সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। বাপ-ঠাকুদ্দার ভিটেমাটি আর পঞ্চাশ বছর আগের অবস্থায় নেই। আর রজতের নেই আগের প্রজন্মের আশৈশব-লালিত আবেগ-অনুভূতি। অনেক আগে একবার কলেজ জীবনে ভিলাইনগরের টকীজে রাজকাপুর-নার্গিসের ''বরসাত'' সিনেমা দেখতে গিয়েছিলো । দুপুর বারোটার শো'। দর্শকের আসনে বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের ক্লাস পালানো ছেলেছোকরার দল। রজতেরই মত। এই সিনেমা নাকি চল্লিশের শেষে কোলকাতার এক হলে একশ' সপ্তাহ না অমনি কি যেন রান করার রেকর্ড করেছিল! 'শোলে' র আগে অমন ভাবে গণদেবতার দিল-মে-রাজ-করনেওয়ালে কোন মুম্বাইয়া ফিলিম নাকি হয় নি! তাই অনেক আগ্রহ নিয়ে টিকিট কাটা। কিন্তু হল অন্ধকার হওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই দর্শকদের হাসির আওয়াজ ও ক্যাট্‌কল শোনা যেতে লাগলো। সেটগুলো বালখিল্য গোছের, ক্যামেরায় খালি লং শট ও মিড শট্‌। গল্প আর এগোয় না। শেষকালে দর্শকদের মাঝখান থেকে আওয়াজ উঠলো - 'উস্‌ জমানেকে সারে ফিলিম্‌বানানেওয়ালে 'চুতিয়া' থে ক্যা?' হলজুড়ে সমর্থনের হাততালি আর হাসি। রজত হল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো। আজকে সেই ঘটনাটা বারবার মনে পড়ছে। কাজেই 'জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'। শান্তিনিকেতনের দর্শনের ছাত্র রজতের বৌদ্ধদর্শন বড় প্রিয়। 'মিলিন্দ্‌ পঞহো' গ্রন্থে রাজা মিনান্দারকে ভিক্ষু নাগসেনের সেই উপদেশ - 'একই নদীতে দ্বিতীয়বার অবগাহন করা যায় না' - রজতকে আলোড়িত করেছে। মনে হয়েছে চতুর্থ ডাইমেনশন সময় বা কালখন্ডকে আর কেউ এমন চমৎকার করে বোঝাতে পারেনি। তাহলে কি আশায় আজ ছোটবেলার শোনা কিস্‌সা-পরস্তাবের ম্লান হয়ে আসা স্মৃতির ওপর ভরসা করে এতদূর আসা? কি দেখতে চায়? পূর্বপুরুষের ভিটে? সেখানে আটচালা? নাটমন্ডপ? দাদুঠাকুরমার প্রাণ হাতে করে দেশছাড়ার সময় ফেলে আসা শালগ্রাম শিলা খুঁজবেন? সেখানে তো চল্লিশ বছর আগে থেকেই বাবর আলি মুন্সীর মোরগেরা নাটমন্দিরের চূড়োয় চড়ে প্রহরে প্রহরে বাঙ্‌ দিচ্ছে, এমনটাই তো শুনেছিলেন। কোলকাতার ফুটপাথে ক্রিকেট খেলে বড় হওয়া রজত কি করে জানবেন বিশাল খোলা মাঠে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা বা জাম্বুরা (বাতাবি লেবু) নিয়ে খেলার মজা? ঝড়ের সময় নদীতে নৌকোবাওয়া বা জোয়ারের সময় চিৎ হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলার রোমাঞ্চ? বাড়ির কামিয়া বা নানকার প্রজাদের সঙ্গে মিলে জলে ডুব দিয়ে পাটগাছ তোলার ও সেগুলো বেচে দিয়ে চুপিচুপি রসগোল্লা কিনে খাওয়ার নিষিদ্ধ আনন্দ? বা, বর্ষাশেষে ''ঘাটু'' বা নদীর ঘাটে কৃষ্ণলীলা ( যাতে অল্পবয়সী ছেলেদের রাধার ভূমিকা করার জন্যে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হত) দেখে কৈশোরক যৌনানুভূতির স্বাদ?

    এসবই তো শোনা বাবা সলিলকুমারের মুখে। সলিলকুমারকে কাকারা আড়ালে বলতেন 'তারাস বুলবা'। রজত কৈশোরে বইটি বাংলা অনুবাদে জোগাড় করে পড়েন কেবল বাবাকে বুঝবার অদম্য কৌতুহলে। হ্যাঁ, তারাসই বটে। মিলিটারি জীবনের জন্যে অদম্য শ্রদ্ধা, পারিবারিক সম্মানের প্রশ্নে একেবারে পাহাড়ি আদিবাসীদের মত স্পর্শকাতর এই ভদ্রলোকের সঙ্গে গোগোলের রাশিয়ান তারাসের বেশ মিল। পাকিস্তান থেকে এসে কোলকাতার পার্কসার্কাসে আশ্রয় নেয়ার একবছরের মাথায় ছাদে কাটা ঘুড়ি ধরা নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় স্থানীয় পার্ক ইউনিয়ন ক্লাবের জনাবিশেক ছেলে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গালিগালাজ করে যায়। সামনের হোটেল ও ধাঙড় বাজারের লোকজন বিনিপয়সায় মজা দেখে। সন্ধেয় ফোর্ট উইলিয়ম থেকে ফিরে সলিল নাকি রাগে ফেটে পড়েছিলেন।
    'তোরা পাঁচ-পাঁচটা ভাই! চুড়ি পইর‌্যা ঘরে বইয়া রইলি? আমি কেন ঘরে আইয়া দেখলাম না যে আমার ভাইয়েরা সব হাসপাতালে? তাইলে আমার অনেক বেশি আনন্দ হইতো। অনেক গর্ব হইতো।'
    একজন বোধহয় মিন্‌মিন্‌ করে 'ঘরে একটা লাঠিও তো নেই' গোছের কিছু বলার চেষ্টা করলে সলিল গর্জে উঠলেন। পকেট থেকে টাকা বের করে বল্লেন 'যা,কলেজ স্ট্রীটের ''স্টিক হাউস'' থেকে গোটা ছয়েক সীসেবাঁধানো লাঠি কিনে আন।'

    আরও বেশি মিল যখন একসময়ে ছুটি ক্যান্‌সেল্‌ করে কাশ্মীর-ফ্রন্টে- স্বেচ্ছায়-লড়তে-যাওয়া সলিল, অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন খান্‌খান্‌ হয়ে যাওয়ায়, কাঁধের ব্যাজ্‌, কোমরের বেল্ট খুলে ফেলে প্যারেডে আসতে অস্বীকার করলেন। কম্যান্ডারকে বল্লেন - 'আমি আর মিলিটারি সার্ভিস করবো না। হয় আমাকে রিলিজ অর্ডার দিন, নয় কোর্ট মার্শাল করুন।'
    দাদু বলতেন, 'তোর বাবার পায়ে ফোঁড়া পাকলে ললিত ডাক্তার অপারেশন করলো। তখন গ্রামদেশে কোথায় লোক্যাল অ্যানাস্‌থেসিয়া? তের বছরের ছ্যাড়া, মুখ থেইক্যা একটা আওয়াজ বাইরয় নাই। আর তোর দাদারে দ্যাখ, গায়ে আরশোলা উইড়া আইলে লাফালাফি লাগাইয়া দ্যায়। এইডা হইসে সিংহের ঘরে শিয়াল।'

    কিন্তু, বয়:সন্ধির রজতের মনে হল তারাস নয়, সলিলকুমারের বেশি মিল '' হাঁসুলীবাঁকের উপকথা''র বনোয়ারী চরিত্রের সঙ্গে। সেই গোষ্ঠীপতি- গোষ্ঠীপতি রকমসকম, সেই পরিবারের জন্যে জান-কুরবান ভাব। তবে রজতের না-পসন্দ ওনার বড্ড বেশি রেজিমেন্টেশন। সলিলের অভিধানে ব্যক্তি মানুষের ''প্রাইভেট স্পেস্‌'' একেবারেই নেই। সবাই পরিবার-বা-গোষ্ঠীর স্বার্থের অধীন। রজতের মনে হয় কোন কম্যান্ড ইকনমিতে সলিল হয়তো আদর্শ নাগরিক হবার সম্মান পেতেন। ছেলেদের চুলের ছাঁট, প্যান্টের কাটিং সবই ওনার হিসেবে হওয়া চাই। সেলুনে গিয়ে নাপিতকে বুঝিয়ে আসবেন-- উত্তম ছাঁট নয়, দশ আনা-ছ'আনা নয়। ছোট করে কাটতে হবে। ছেলেরা হবে পুরুষালি, যাত্রাদলের সখী নয়। কাজেই দর্জিকে বানাতে হবে বৃটিশ জমানার ডাবল্‌প্লেটেড ট্রাউজার্স, ড্রেন্‌পাইপ বা বেলবটম নয়। তখনই মনে পড়ে বনোয়ারীর রেজিমেন্টেশন - 'সাবোধান, সাবোধান! খ্যানত্‌ হয়ে যাবে। পুরনো নিয়ম ভাঙা চলবে না।' মনে পড়ে যখন বেহারার দল বর-বৌয়ের পাল্কিতে কম্পিটিশন করে আনন্দের সঙ্গে পথ চলছিলো, পাগল কাহার বেহারাদের ধরতাই দিচ্ছিল - 'বরের পাল্কি, পড়িল পিছেতে। আগে চলে লক্ষ্মী, পিছে এস নারায়ণ।' এমন সময় ওকে থামিয়ে 'গোষ্ঠীপতি' বনোয়ারী শুরু করলো - 'ভাইসব সাবোধান, আলপথে নামিলাম'।

    আর তখনই রজতের ইচ্ছে হত 'করালী' হতে, সব রেজিমেন্টেশন তছ্‌নছ্‌ করে পুরনো নিয়মকানুনের মা-মাসী করতে। তাই শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়ার সময় বনোয়ারী-বাপের থেকে ও একপয়সা খরচা নেয় নি। বাবাকে প্রতিপদে পড়াশুনোর হিসেব দেয়ার কথা ও ভাবতে পারে না। তবে একটা জায়গায় রজত বাবাকে ঈর্ষা করত। মেদহীন ছিপ্‌ছিপে সলিলের চেহারায় , তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্বে একধরণের আকর্ষণ ছিল। যে কোন দরবারে মহিলারা রায়দার প্রতি বিশেষ পক্ষপাত দেখাতেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ ফৌজের সাথে বার্মা- ইন্দোনেশিয়া, পরে তেলের কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বাহরিন দ্বীপে থাকা সলিল আয়ত্ত করেছিলেন মহিলাদের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান শিভালরাস্‌ ব্যবহার। উনি যেভাবে সুন্দরী মহিলাদের ঝুঁকে বাও করে অনায়াসে বলতেন - 'ভাল আছেন? ভাল থাকুন', তাতে রজত ও তার দাদা নিজেদের মধ্যে কনুই দিয়ে ঠেলাঠেলি করত। তবু রজত জানতো, যে যাই হোক, কিছুতেই সে তার বাবার মত হবে না। সে বনোয়ারী হতে চায় না, সে হবে করালী।

    পনের বছর আগে একটা ঘটনার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সলিলকুমার মারা গেলেন, মারা গেলেন ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের ভিতরে গাঁ থেকে আসা একটি ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে। এমসিসি রুমের ভিতর সীমেন্স কোম্পানির কয়েক টনের কন্‌ট্রোল প্যানেল যখন পিছলে মজদুরদের ওপর পড়তে যাচ্ছিল তখন তিরিশ হাত দূরে দাঁড়ানো সলিল দৌড়ে এসে দু'হাত দিয়ে মেশিনটিকে আটকানোর চেষ্টা করে মজদুরদের পালাতে বলেন। ওরা বেঁচে যায়, সলিলের ওপর ঐ প্যানেল ক্রমশ: ভারি হয়ে চেপে বসে। মাটিতে ফেলে পিষে ফেলে। টেলিফোনে খবর পেয়ে কোলকাতা থেকে পৌঁছে সাজানো চিতার সামনে দাঁড়িয়ে রজত বুঝতে পারে বাবা একসঙ্গে তারাস ও বনোয়ারী, দুটোই।

    তখন থেকে ওর মাথায় একটা যন্ত্রণা। একবার যাবে সেই রূপকথার দেশে, যেখানে ব্রহ্মপুত্র থেকে ঢল নামে, বর্ষায় নদী-নালা-পুকুর সব একাকার হয়ে নির্মাণ করে - 'এ সিংগল শীট অব ওয়াটার'। যেখানে ব্যাঙ্‌রাজার বিয়ে দিলে ম্যাঘরাজা সদয় হয়। যেদেশে হুমর‌্যা বাইদ্যার ( ওমর বেদে?) চুরি করে আনা শিশুকন্যা মহুয়া যৌবনের আঙিনায় পা রেখে নইদ্যার ঠাকুরকে দিওয়ানা বানায়। মহুয়া যখন বলে -

    ''লজ্জা নাইরে, নদ্যার ঠাকুর, লজ্জা নাইরে তর্‌?
    গলাতে কলসী বাইন্ধা জলে ডুইব্যা মর।''

    নইদ্যার ঠাকুর ( নদীয়ার ঠাকুর?) অনায়াসে জবাব দেয় -

    ''কোথায় পাইয়াম কলসী কইন্যা, কোথায় পাইয়াম দড়ি?
    তুমি হইয়ো গহীন গাঙ্‌,আমি ডুইব্যা মরি রে কইন্যা, আমি ডুইব্যা মরি।''

    আসলে ও দেখতে চায় ওদেশের মাটি, জল, সূর্যাস্তের রঙ্‌; যা জন্ম দিয়েছে ওর দেখা তারাস বা বনোয়ারীকে, যাকে ও ঈর্ষা করে।

    গতকাল রজত গিয়েছিলো আওয়ামী লীগের গোপন আড্ডায়। গিয়ে দেখে বেশ উৎসব-উৎসব ভাব। সবাই জানে এবার ওরা জিতছে। বেগম হাসিনা আবার ঢাকার মসনদে বসবেন। চমৎকার খাওয়াদাওয়া। বিদেশি তরল পানীয়। জামদানি পরা বিদেশী সুগন্ধীর সুবাস ছড়িয়ে ফোরেন ওষ্ঠরঞ্জনীতে রাঙানো ঠোঁটে চটুল হেসে সুন্দরী মহিলারা ভারতীয় সাংবাদিককে ঘিরে ধরেন। দেশ কোথায় জেনে আহ্লাদিত হন। তারপর জিজ্ঞেস করেন -
    'দ্যাশে ফিরতে ইচ্ছা করে না?'
    তারপর প্রত্যাশিত উত্তরটি না পেয়ে আহত হন। খানিকক্ষণ আশকথা-পাঁশকথা হওয়ার পর শুরু হয় সেইসব অবধারিত প্রশ্ন -
    'ছেলেমেয়ে কয়ডি? মেয়ের নাম কি রাখছুইন?'
    মেয়ের নাম তিতাস জেনে তাঁরা কোরাসে হইহই করে ওঠেন। -
    'আরে মাইয়ার নাম তিতাস? তবে যে কইলেন দ্যাশে ফিরতে ইচ্ছা করে না! কেন করে না?'
    রজত নিরুত্তর। অপ্রিয় সত্য বলা যায় না। শেষে সুন্দরীদের পেড়াপিড়িতে বলেন -
    'আমি ঠিক জানিনে।'
    একজন প্রগলভা বলেন -
    'ভাবেন, ভাল কইর‌্যা ভাবেন। চব্বিশ ঘন্টা টাইম দিলাম। কাইল আবার আইসেন এইহানে। আমাদের জানাইয়া যাইবেন। '

    তাই রজত আজ এসেছেন খুঁজেপেতে দূর্গাবাড়ি রোডের সূর্যসিঁড়ি নামের বাড়িটিতে। সলিলের ছোটমামা পঁচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া ডাক্তার নীলমণি রায়ের কাছে। উনিশশো পঞ্চাশের জুন নাগাদ দাদু-ঠাকুমা-মা-বাবা সবাই পাকিস্তান থেকে শেষ রেলগাড়ি ধরার আগে এইবাড়িতে প্রায় দু'সপ্তাহ কাটিয়ে ছিলেন যে!

    অনেকখানি জায়গা জুড়ে পুরনো বাড়িটিতে অযত্নের ছাপ। সামনের দিকে টিনের চাল। খানিকটা বাগান। সবটা মিলিয়ে যেন বেলাশেষের গান। বারান্দায় আরামকেদারায় ফতুয়া-লুঙি পড়ে থাকা সাদাচুলো বয়স্ক ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে ক' সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলেন - 'রজত না!'
    রজত হাসে, -
    'তাইলে চিনতে পারলেন? সেই কবে দশ-বার বছর আগে কইলকাতায় দেখসিলেন। '
    - 'আমি যারে দেখি সহজে ভুলি না।'
    একজন সারাক্ষণের কাজের লোক আছে, সে চা নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে একটি রিকশা থামে । এক চশমা-পরা পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া মহিলা নেমে হাসিমুখে এগিয়ে আসেন। রজত লাফিয়ে ওঠে -
    'আরে, দীপাপিসি! তুমি! কোত্থেকে? '
    - 'আমি থাকি পেছনের পাড়াতেই। তুই যখন বাড়ি খুঁজছিলি তখন ঘরে ফেরার পথে তোকে দেখলাম। তাই ঘরে গিয়ে তোর খাবার ব্যবস্থা করে এলাম। তুই আর তোর সঙ্গের ছেলেটি আমার ওখানেই চান করবি, খাবি। কোন ওজর আপত্তি শুনছি না।'
    দীপাপিসির বড়বোন লিপিপিসি, ভাই সুবীর (যে কিশোরকুমারের গলায় ঢাকায় একটি ব্যান্ডে গান গাইতো), বাচ্চু, সবাই সেই একাত্তরে বাংলাদেশ হওয়ার সময় থেকেই কোলকাতার বাসিন্দে। শুধু দীপাপিসি (যে 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় কবিতা লিখে প্রাইজ পেয়েছিল, ঢাকা রেডিওতে গান গাইত) ময়মন্‌সিং ছেড়ে নড়ে নি। বিয়ে করেছিল কমিউনিস্ট পার্টির এক সর্বক্ষণের কর্মীকে, যার সঙ্গে বিবাহিত জীবনের আদ্ধেকটাই কেটেছে জেলের ভেতরে ঢুকতে আর বেরুতে। নীলমণি রায় এই জামাইয়ের কথা উঠলে বলেন -
    'সে তো জেলের ভিতরে দিন কাটায়, আমি জেলের বারান্দায় জেলারের লগে ডেক চেয়ারে বইয়া আড্ডা দেই। সে আর নাই কয় বছর হইল। শরীর ভাইঙ্গা গেসিল, আর সারে নাই।'
    এই স্টোয়িক জীবনদর্শন রজতের মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে -
    - 'বাংলাদেশ হওয়ার সময় তো খানসেনা আর রাজাকারদের হাত থেইক্যা রক্ষা পাইতে কইলকাতা ভাইগ্যা গেলেন। তারপর মুজিবসরকারের আমলে ফির‌্যা আইয়া বাড়িঘর-জিনিসপত্তর সব ফিরৎ পাইসিলেন?'
    নীলমণি রায় হাসলেন -
    'হ্যাঁ, তা' বাড়ি ফির‌্যা পাইসি, ওষুধের দুকান লুট হইয়া গেসলো, তবে আমার খাট পালং দেখি পড়শিদের বাড়িতে। দেইখ্যা সব বুইঝ্যা চুপ কইর‌্যা ছিলাম। তারাও কিছু কয় না। পরে ভাইব্যা দেখলাম - ঠিকই হইসে। অরা ভাবে নাই আমরা আর ফিরা আসতে পারবো। তাই নিছে। এখন লজ্জা পাইয়া চুপ কইরা আছে। ছাড়ান দেও পুরান কথা। এস আমার সঙ্গে।'
    বাড়ির সামনের রাস্তায় উঠে বৃদ্ধের যেন বয়েস কমে গেল -
    'রজত, ঐ দেখ, গোলাপিবাড়িটার পাশে যে খালি প্লটটা দেখছ, আমি এই বছর কিনেছি। আর আগে ঐ স্কুলবাড়ির পেছনে আরেকটা খালি চারকাঠার প্লট। সেটাও কয়বছর আগের কেনা। এবারে ধান বিক্রি করেছি ভালরকম।'
    রজত দাদুকে খোঁচায় -
    'এখনও আপনার জমির পিপাসা মিটল না? কি হইব এইসব কইর‌্যা? সবতো কইলকাতায় গেছে গিয়া। আপনেও চলেন। ময়মনসিংহের আরেক ডাক্তার তসলিমা নাসরীনও এখন কইলকাতায়। আপনেও চলেন।'
    নীলমণি রায় স্মিত হাসেন, বলেন -
    'হ্যাঁ, যাব। এই একটু গুছিয়ে নেই।'
    দীপাপিসি হাসে। রজত বোঝে এঁরা কেউ কোলকাতায় যাবেন না। এখানেই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবেন।

    কারণটা রজতের জানা, এবার ঘোরাঘুরি করে আরও নি:সন্দেহ হল। গ্রামের দিকে যাই হোক, ময়মনসিং শহরে সেই ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির দিনগুলিতেও কোন বড় দাঙ্গা হয় নি। তাই রজতের বাপ-ঠাকুর্দারা সপরিবারে দেশ ছাড়লেও বাবার ছোটমামা ডাক্তার নীলমণি রায়েদের মত অনেক পরিবার ময়মনসিংহের মাটি আঁকড়ে থাকাতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। ১৯৭১ এর ব্যাপারটা আলাদা। তখন ইয়াহিয়া খানের খানসেনা আর রাজাকার বাহিনীর আতঙ্কে গারোপাহাড়ের দিক ধরে ভারতে পালিয়ে আসা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। হ্যাঁ, শহরেও দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গার আগুনে ঝলসে গেছে দুই বাংলার সীমান্তবর্তী জেলাগুলি। দাঙ্গার নির্মম রূপ দেখা গেছে পাবনা-বগুড়া- কুষ্টিয়া- যশোর-খুলনা- কুমিল্লা-নোয়াখালি-চাটগাঁ এইসব দিকে। কারণ এপারবাংলার তাড়া খেয়ে পালানো জনগোষ্ঠীর বড় মোটিভ ছিল ওপারে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকজনের বাস্তুভিটে-সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে দখল করে গেঁড়ে বসতে। সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকজনের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সম্পত্তি হাতানোর বাস্তবিক সম্ভাবনা ছিল নগণ্য।
    সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পুরনো প্রজন্মের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে এক চাপা হাহাকার শোনা যায় - 'মুড়া তো সব চইল্যা গ্যাছে, খালি আমরা ল্যাজারা পইড়া আছি। ' তবে নতুন প্রজন্মের এসব নিয়ে কোন হেলদোল নেই।

    সন্ধে বেলা হোটেলে ফেরার পথে রজত রজ্জাককে জানায় যে সে কালকেই কোলকাতার প্লেন ধরবে। সুন্দরীদের সেই আড্ডায় আর যাবেনা। রাত্রে খাওয়ার টেবিলে মল্ট হুইস্কির পাত্রে চুমুক দিতে দিতে রজ্জাককে বোঝায় -
    'আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি। দ্যাখ, আজ ময়মনসিং একটি ছোট পিছিয়ে থাকা শহর। আমাদের মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুর শহর থেকে খুব বড় নয়। আমি এখানে বড় হলে আজ নিজেদের ক্ষেতের সরুচালের ভাত এবং 'মৎস্য মারিব, খাইব সুখে' করে, খুব বেশি হলে কীর্তন গেয়ে দিন কাটাতাম। সত্যি কথা, দেশ ভাগ হয়ে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান হওয়া এক বড় মাপের মানব ট্র্যাজেডি। কত পরিবার রিফ্যুজি ক্যাম্পে গিয়ে চালান হয়েছে। কত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের জন্যে এটা অভিশাপ না হয়ে ব্লেসিং-ইন-ডিস্‌গাইজ হয়েছে। কেন? কোলকাতার মাধ্যমে আমরা যে লিব্যারাল ডেমোক্র্যাসি এবং ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি তা' বাংলাদেশে বসে কোথায় হত? কাজেই ফিরে আসার প্রশ্নই ওঠে না।'

    রজ্জাক বিদায় নেবার আগে রজতের থেকে একটি সিগ্রেট নিয়ে ধরায়। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে একটু কিন্তু-কিন্তু করে বলে -
    'রজতদা, সবটা মানতে পারছি না। আপনি কি মনে করেন ময়মনসিং বা বাংলাদেশের কোন শহর সেই চল্লিশ বছর আগের অবস্থায় ফ্রিজ হয়ে আছে? ভুল ধারণা। ইদানীং ময়মনসিংহের থেকে প্রতি বছর কতজন আমেরিকা-ইংল্যান্ড যায়, আপনি জানেন? চাটগাঁ থেকে? সবাই খালি এথনিক রেস্তোরাঁ খুলতে না, স্কলারশিপ নিয়েও যাচ্ছে। ভাবুন তো, প্রোফেসর মহম্মদ ইউনুসও তো বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা গেছলেন। আর আপনারা যখন পুরো খানদান কোলকাতায় পৌঁছলেন তখন কি ভাবে কতটুকু জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছিলেন, ভাবুন তো, ওটা কোন কোয়ালিটি লাইফ ছিল কি?'

    রজতের মুখে বাক্যি হরে গেল। মনের পর্দায় ও একটা বহুপুরনো স্মৃতিবিবর্ণ সিনেমা দেখতে লাগল।

    (২)

    বাইশ জন মানুষ। তিন কামরার ঘরে গাদাগাদি করে ওরা থাকে বাইশজন মানুষ। না, হিসেবে ভুল হল। তিন কামরা ছাড়াও আছে রান্নাঘর, ছাতের চিলেকোঠা। সর্বত্র গাদাগাদি করে, ঘেঁষাঘেষি করে ওরা শোয়। রান্নাঘরে সবার খাওয়া দাওয়া হলে এঁটোকাঁটা সাফ করে মেজে পরিষ্কার করে ঘুঁটে দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। তারপর সেই মেজেতে শোয় বহুবছর আগে চা'বাগানের আড়কাঠি থেকে ছাড়া পেয়ে এই পরিবারে আশ্রয় নেয়া ভেলিপিসি ও তার ছেলে যদু। পরিবারের কর্তা সতীশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী সরযূবালা কোমর-পড়ে-যাওয়া অশীতিপর মাকে নিয়ে মাঝের ঘরে, তিন নম্বর ঘরের দুটি তক্তপোষকে আশ্রয় করে অসুস্থ বড় জামাই সুরেশচন্দ্র পাল মশায়কে নিয়ে বড় মেয়ে শিশিরকণা ও তার ছেলেমেয়ে। বড়বৌ স্মৃতিকণা ও অবিবাহিত ছোট ননদ মনীষা বাইরের ঘরে ভীড়ের মধ্যে মেঝেয় ঢালা বিছানায়। পা দুটো খাট বা টেবিলের তলায়। গরমের দিনে রেলিং দেয়া একচিলতে বারান্দায়। অবিবাহিত দেওরেরা খোলা ছাদে বা চিলেকোঠায়। বড়ছেলে সলিল ফৌজি আদমী। উনি শুলেন ছাদে ওঠার আগে সিঁড়ি মোচড় খেয়ে ওপরমুখো হওয়ার আগে যে একটা চৌকোমত উপত্যকা বানিয়েছে ( বাঙালভাষায় 'হাঁটুভাঙ্গা') তাতে। বাড়ির চাকর সারাদিন ভুতের বেগার খাটার পর ঐখানে বাবুর পাশেই লম্বা হয়। কিন্তু ইয়ে শো'না ভি কৈ শো'না হ্যায় রে লল্লু? বেচারা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে ঘুমের ঘোরে বাবুর গায়ে পা না লেগে যায়! শোয়ার জায়গা না হয় হল, কিন্তু বাথরুম যে একটাই, তায় পায়খানা আবার তার ভিতরে। ফলে একসময় বাইশজনের কোন একজনই পাবেন প্রবেশের অধিকার। তারপর কারো যদি আবার পেট ছাড়ে। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় ওর দরজা বন্ধ থাকে। কিছুদিন পরে বাড়ির ছেলে-ছোকরারা এর সমাধান খুঁজে বের করল। বিশাল ছাদের এককোণায় বড় বড় দুই জলের জন্যে তৈরি লোহার ট্যাংক পিলারের ওপর বসানো। তার পাশে উপচে পড়া জল যাওয়ার নালী। ব্যস, ছোটবাইরের জন্যে ছেলেরা আর বাথরুম যেতো না। সোজা ছাদে গিয়ে ঐ নালাকে নদীর গৌরব দিয়ে তার পাশে উপনদী, শাখানদী তৈরি করে সৃষ্টিকর্তার শ্লাঘা অনুভব করতো ।

    সলিল কুমার একদিন মিটিং ডাকলেন, ফৌজি কায়দায়। দেখা গেল চাকরি করছেন মাত্র তিনজন। হা-ঁমুখ অনেক। ছোটভাইয়েরা সবাই ছাত্র। কেউ স্কুলে যাবে, কেউ কলেজে। সিদ্ধান্ত হল - এ'বছর ফর্মাল পড়াশুনো মুল্‌তুবি রাখতে হবে। আর আয় বাড়াতে হবে। দুটো এক্সপেরিমেন্ট হল। এক, পাইস হোটেল খোলা। দুই, শেয়াল্‌দার ফুটপাথে আমের ঝুড়ি নিয়ে বসা। প্রথমটা তিনমাস চললো। দ্বিতীয়টা তিনদিন। দুটো এক্সপেরিমেন্টেরই আঁতুড়ঘরে মৃত্যু অবধারিত ছিলো। রক্তে রয়েছে ময়মনসিংহের খাস মৌজার তালুকদারি। এঁয়ারা করবেন ব্যবসা? তাও ফুটপাথে আম বিক্কিরি?

    প্রায় দুই দশক পরে সদ্য গোঁফের রেখা বেরুনো দুই ছেলে যখন বিপ্লব-বিপ্লব খেলবে ঠিক করলো - স্মৃতিকণার ভাষায় 'উদোম হইয়া লাগলো', তখন সলিলকুমার বোঝানোর চেষ্টা করলেন -
    'ডি-ক্লাস হওয়া এত সোজা? এক জেনারেশনে হওয়া যায় না, তো তোরা ভাবছিস এক বছরে হইবি? শোন, এইসব ইয়ার্কি ছাড়। পড়াশুনা কর। কায়স্থপরিবারের ছ্যাড়া,এই একটা কাজই পারবি। হুঁ:, ডি-ক্লাস! আরে আমরাও চেষ্টা করছিলাম। পারলাম কই? গাঁয়ে রাস্তা দিয়া হাঁইট্যা গেলে বাপের বয়সী প্রজারা সেলাম করতো। হটাৎ কইর‌্যা ফুটপাতে আম লইয়া বসা? ভাল কইর‌্যা শুন, মাইনসে ডি-ক্লাস হয় শখ কইর‌্যা না, বাধ্য হইয়া। ইতিহাসের নিয়মে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।'

    ১৯৫০ এর দশকে কোলকাতার পার্কসার্কাস পাড়ায় গ্রীষ্মের ভোর হত প্রায় চারটে নাগাদ। অনেক দূর থেকে, সম্ভবত: ময়দান, তিলজলা, বন্ডেল গেট বা অমনি কোন দিক থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসত বিহার-উত্তরপ্রদেশের নিবাসী কিছু মানুষের রাতজাগা-কোরাস-ভজন, তার রামা-হো আর ঢোলক-করতালের চাক্কাইকে-চাক-ধুম, খচমচ-খচমচ। তারপর আকাশের রং যেন একটু ফিকে হল। একটা-দুটো পাখি নড়াচড়া করতে লাগলো। ওদের টি-ঁটি-ঁচিক্‌চিক শুরু হতে না হতেই ধাঙড় বাজারের সামনে ফুটপাথে মুখ ঢেকে শোয়া শরীরগুলো আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভাঙ্‌তে লাগলো।
    - 'বিরজু, এ বিরজু, আবে বিরজুয়া ! উঠ বে! আভি লোটা লেকে টাট্টি যা।'
    - 'আবিদা,উঠ বেটি! ফজর হো গয়া। '
    - 'আবে এ রামাবতার! জগাহ্‌ খালি কর বে। রাস্তাধোনেওয়ালা আ গিয়া। অব উঠবেই করি।'
    সত্যি সত্যি এসে গেছে কর্পোরেশনের লোক। ফুটপাথের হাইড্র্যান্ট খুলে পাইপ লাগিয়ে ধুয়ে দেবে ফুটপাথ-রাস্তা, সব। জানিনা আজকের কোলকাতায় সাতসক্কালে রাস্তা ধোয়া হয় কি না! আজকের জয় গোস্বামীদের কলম থেকে কি বেরুতে পারে - 'হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল'! আরো লোক আসে। হুক-লাগানো লাঠি দিয়ে নেভাতে থাকে ফুটপাথের ওপর সারারাত জ্বলা সবুজ কাঁচে ঢাকা গ্যাসবাতিগুলো। (রাত্তিরবেলা ঝাউতলা রোড বা বালুহক্কাক লেন দিয়ে যেতে যেতে ঐ সবুজরঙা আলো বেশ একটা গা-সিরসিরানি ভাব আনতো। মনে হত এক্ষুণি কোণায় দাঁড় করানো ফিটন গাড়ি থেকে নেমে আসবে টুপিনামানো বাঁকামুখে পাইপ চিবুনো শার্লক হোমস্‌। অথবা পাশের গলি থেকে কোন ডক্টর হাইড এসে একলা পথিককে কষাবে এক ঘা!) ইতিমধ্যে কোন কোন দোকানে কয়লার উনুনে আঁচ পড়েছে। ছোট ছোট মাটির ভাঁড়ে চা' আর বেগুনি-ফুলুরি। সক্কাল সক্কাল ডিউটিওলা লোকজন বা আশপাশের রিকশওলা- মুটেমজুরের দল ধীরে ধীরে ভিড় জমাচ্ছে। পার্কসার্কাসে সকাল হয় ধাঙড়বাজারকে কেন্দ্র করে। এই সময় এসে দাঁড়ায় গোটা তিন লম্বাটে হাত ঠেলা। তাতে লাইন দিয়ে শোয়ানো বেশ কটি গরুর শরীর; ছালছাড়ানো, ধোয়া, স্লটার হাউস থেকে পবিত্রতার নীলচে ছাপ লাগানো। ল্যাঙ্‌ট পরা বেশ ক'জন পালোয়ানমার্কা লোক সেগুলোকে কাঁধে করে নামিয়ে সোজা মাংসের স্টল আর হোটেলে চালান করে। তারপর সামনের সার্কাস হোটেলের বারান্দায় বড় উনুনে ঝকঝকে লোহার শিকে তৈরি হবে শিককাবাব। মাংসপোড়া গন্ধে বাতাস ভারি হয়। সকালে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে মাছ কিনতে আসা ভদ্রজনেরা নাকটিপে ফুটপাথ পেরিয়ে যান। একটু পরে আসে হরিণঘাটার মাদার ডেয়ারির গাড়ি। কাছের স্টলে লাইন পড়ে। জনাদুই অল্পবয়েসি দিদিমণিরা হাতে হাতে ধরিয়ে দেন বোতলের দুধ, গরুর হলে বোতলের সীল সোনালি, মোষের হলে রুপোলি। এবার পত্রিকার হকারদের পালা। সাইকেল থামিয়ে ওরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা রোল করে শণের দড়ির টুকরো দিয়ে বেঁধে নিপুণ হাতে ছুঁড়ে দেয় দোতলা- তিনতলার বারান্দায়। রাস্তায় লোকচলাচল বাড়ছে। ফুটপাথ পেরুচ্ছে স্কুলগামী ছোট বাচ্চারা, ঠিকে ঝিয়েরদল। শব্দ বাড়ছে। লোহার চাকার ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ময়লা সাফ করতে আসা জঞ্জালের গাড়ি। সওয়ারি নিয়ে দৌড়তে থাকা হাত-রিকশার ঘন্টির ঠুন্‌ঠুন। কাছের ট্রামলাইন ধরে ধাবমান ট্রামের ঘন্টি। এবার সত্যিই সকাল হয়েছে।

    এই বাজারের ওপর কড়েয়া রোড ও সার্কাস মার্কেট প্লেসের সংযোগস্থলে দোতলার তিনকামরা ও ছাতের চিলেকোঠায় ছড়িয়েমড়িয়ে থাকা রায়েদের বাড়িতে সকাল হত কেমন করে? বাড়ির সবচেয়ে সিনিয়র সিটিজেন বড়মা বা পরিবারের কর্তার মা সুখময়ীর ঘুম ভেঙে যায় রাতের তৃতীয় প্রহরে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। খানিকক্ষণ উনি শান্ত থাকেন। এমন সময় নীচের তলার তৈয়ুব মিঞার বাড়ির পোষা মোরগ ডেকে ওঠে। তার কোঁকর-কোঁ চারপাশের ফ্ল্যাটবাড়ির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে শেষরাতের নিস্তব্ধতাকে খান্‌খান্‌ করে দেয়। বারকয়েক এমনি হওয়ার পর উনি শুনতে পান বাড়ির কর্ত্রী ছেলেবৌ সরযূবালার গলা - 'এই মুন্না! তোদের মোরগটাকে জবাই কর। নিজেদের দেশে এসেও ঘুমুতে পারবো না নাকি?' মুন্না তৈয়ুববাবুর বছর এগারোর ছেলে। নীচের তলা থেকে কোন উত্তর আসে না। এতক্ষণে সুখময়ীর পেট কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু নিত্যকর্মটি একা সেরেফেলা ওনার অসাধ্য। সেই যে বছর কয়েক আগে বাজিতপুরের ললিতডাক্তার কোমরের ফোঁড়া কাটতে গিয়ে কোন্‌ শিরা না কি যেন কেটে ফেলেছিলো, তখন থেকেই কোমর গেছে পড়ে। বসে বসে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে উনি তিন মিনিটে পায়খানায় গিয়ে পাদানিতে বসে পড়বেন, কিন্তু তারপর? চারফুট উঁচু চৌবাচ্চার থেকে মগ দিয়ে জল তুলে শৌচপাত্রে ঢেলে দেয়া? আরেকজন চাই যে! কাকে ডাকবেন? আর কাকে? নিজের ছেলেকে। এদিকে সতীশচন্দ্রেরও বিরক্তি ধরে গেছে। রোজ রোজ বছর-বছর ঐ একই কাজ! তায় তালপাতার হাতপাখা নাড়তে নাড়তে ভোরের দিকে ঘুমটা খালি এসেছে, এমন সময় মায়ের ডাক। সতীশচন্দ্রের সন্দেহ হয়, হয়তো মা ইচ্ছে করলে আরো খানিকক্ষণ সামলে-সুমলে থাকতে পারেন। কিন্তু উনি সবার ঘুম ভাঙিয়ে আনন্দ পান, নিজের ঘুম ভেঙে গেছে তো! ক্রমশ: এই সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়। ফলে শুরু হয় মা-ছেলের চাপান-উতোর। শেষমেশ হয় হারমানা ছেলে বা অন্যঘরের থেকে ঘুম ভেঙে উঠে আসা কেউ জল ঢেলে দেয়। এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়। সুখময়ী বসে বসে ছোটবাচ্চাদের ফুগড়ি খেলার স্টাইলে ঘর থেকে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে পায়খানাগামী হন। কিন্তু ঐ ভঙ্গীতে চলা? পেটের ওপর চাপ বাড়ে। তলপেটের পেশিগুলো এক এক করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে থাকে। ফলে সুখময়ীর যাত্রা শেষ হলেও চরণরেখাসম এক পীতরেখার আল্পনায় সকালের গল্পটির নান্দনিক সমাপন হয়।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০১ মার্চ ২০০৯ | ৯৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন